করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই সীমিত পরিসরে পালিত হয়েছে বিজিবি দিবস
 
নিউজ ডেস্ক
নানা চড়াই-উৎরাই পিরিয়ে ২২৫ বছরে পা দিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ১৭৯৫ সালে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলা হতে যাত্রা শুরু করা রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়নই আজ সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিজিবি। ১৭৯৫ সালের ২৯জুন রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন সৃষ্টি হলেও বাহিনীটি প্রতিবছর ২০ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করে থাকে।
চলমান করোনা মহামারি পরিস্থিতির মধ্যেই এবার সীমিত পরিসরে দিবসটি পালন করেছে বর্ডার গার্ড ব্যাটলিয়ন বাংলাদেশ (বিজিবি)। দিবসের কর্মসূচি অনুযায়ী রাজধানীর পিলখানস্থ বিজিবি সদর দপ্তরে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ সাফিনুল ইসলাম সকাল ৯টায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিজিবি’র রেজিমেন্টাল পতাকা উত্তোলন করেন এবং সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে ঘটিকায় পিলখানাস্থ ‘সীমান্ত গৌরব’ এ মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বিজিবি দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে সকাল ১০টায় মহাপরিচালকের বিশেষ দরবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ জনিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বিজিবি দিবস-২০২০ এর বিশেষ দরবার অনুষ্ঠিত হয়েছে যেখানে বাংলাদেশের সকল প্রান্ত হতে বিজিবি সদস্যগণ যুক্ত ছিলো।

বিজিবি মহাপরিচালক বৈশ্বিক করোনা মহামারীতে বিজিবি সদস্যদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আগামী দিনগুলোতে সরকার কর্তৃক অর্পিত যে কোন দায়িত্ব আরও দৃঢ় মনোবল নিয়ে সততা, নিষ্ঠা ও আত্মপ্রত্যয়ের সাথে পালন করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকার আহবান জানান। তিনি বিজিবি’র মূলনীতিতে দীক্ষিত হয়ে সুসংগঠিত, শক্তিশালী এবং যুগোপযোগী বাহিনী হিসেবে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণে সবাই একযোগে কাজ করবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এলাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় আনা সম্ভব বলে মনে করেন বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম। বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, এখন কূটনৈতিকভাবে এবং আমরা আমাদের দিক থেকে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি যেন সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে পারি। সেজন্য সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের সচেতন করার চেষ্টা করছি যেন অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম না করেন। সীমান্তবর্তী জনগণকে শিক্ষা দীক্ষায় এবং অর্থনৈতিকভাবে যদি স্বাবলম্বী করতে পারি তাহলেই সীমান্ত হত্যা কমে যাবে।

সাফিনুল ইসলাম বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কিছু অরক্ষিত সীমানা রয়েছে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য সীমান্তে বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট (বিওপি) বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সেখানে নতুন বিওপি স্থাপন করে এই দূরত্ব কমাতে হবে।
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনীর সামনে কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে- এমন প্রশ্নে মহাপরিচালক বলেন, পৃথিবী টেকনোলজির দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে সঙ্গে বাংলাদেশও প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি হয়েছে। সেটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিজিবিকে সময়োপযোগী করাটা জরুরি
দরবার শেষে অনারারী সুবেদার মেজর হতে অনারারী সহকারী পরিচালক এবং অনারারী সহকারী পরিচালক হতে অনারারী উপপরিচালক পদে পদোন্নতি প্রাপ্তদের র্যাংক ব্যাজ পরিধান, শ্রেষ্ঠ রিক্রুট প্রশিক্ষক/প্রশিক্ষণে অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জনকারী/জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে দলগত/ব্যক্তিগত পুরস্কার প্রদান, অপারেশনাল কার্যক্রম, চোরাচালান নিরোধ এবং মাদকদ্রব্য আটকের ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য পুরস্কার প্রদান, শ্রেষ্ঠ ব্যাটালিয়ন ও রানারআপ ব্যাটালিয়নকে পুরস্কার প্রদান, শ্রেষ্ঠ কোম্পানী ও বিওপি কমান্ডারদের পুরস্কার প্রদান এবং মহাপরিচালকের অপারেশন ও প্রশাসনিক ইনসিগনিয়াসহ প্রশংসাপত্র প্রদান করা হয়।

এছাড়াও বিজিবি দিবস উদযাপন উপলক্ষে পিলখানাসহ বিজিবি’র সকল রিজিয়ন, সেক্টর, ব্যাটালিয়ন ও প্রতিষ্ঠানসমূহে কেক কাটা ও প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয় এবং মাগরিবের নামাজের পর বিজিবি’র সকল মসজিদে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে মিলাদ ও বিশেষ দোয়া করা হয়।
জানা যায়, ১৭৯৫ সালের ২৯ জুন ৪৪৮ জন সদস্য নিয়ে এই বাহিনীর সৃষ্টি হয়। ৬ রাউন্ড গোলা, ৪টি কামান ও ২টি অনিয়মিত অশ্বারোহী দল নিয়ে রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন নামে বাহিনীটির যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮৬১ সালে পূর্বাঞ্চলের নিয়মিত ও অনিয়মিত পুলিশ বাহিনীর সমন্বয়ে রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়নকে নতুনভাবে ফ্রন্টিয়ার গার্ডস নামে পুনর্গঠন করা হয়। যার সদস্য সংখ্যা ১,৪৫৮ জনে উত্তীর্ণ করে চট্টগ্রামে সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। ১৮৭৯ সালে স্পেশাল রিজার্ভ কোম্পানি নামে এ বাহিনী তৎকালীন সদস্যদের নিয়ে পিলখানায় প্রথম ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। এ পর্যন্ত পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকান্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৮৯১ সালে বাহিনীর নতুন নামকরণ করা হয় বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশ। ঢাকা, খুলনা, ভাগলপুর ও গ্যাংটকে ৪টি ব্যাটালিয়নে ভাগ করে কোম্পানিগুলোকে স্থানান্তর করে একজন ইউরোপীয় সুবেদারের অধীনস্থ করা হয়। ১৯২০ সালে কালের বির্বতনে বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশকে ইন্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইয়েলস নামে পুনঃনামকরণ করে ১৬ প্লাটুনে বিভক্ত করে সীমান্ত ও অভ্যান্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তের পর এ বাহিনীর নামকরণ করা হয় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)। কলকাতা মেট্রোপলিটন আর্মড পুলিশের একটি দল পরবর্তী সময়ে আরো তিন হাজার বাঙালিকে নিয়োগ করে এ বাহিনীকে পুনর্গঠিত করে দক্ষ নেতৃত্ব এবং দিকনির্দেশনার প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী থেকে অফিসার নিয়োগ করা হয়। ১৯৫৮ সালে এ বাহিনীকে প্রদান করা হয় চোরাচালান দমনের দায়িত্বে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য এ বাহিনীর ১৪২ জন সদস্য জাতীয় বীরত্বপূর্ণ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন যার মধ্য মরণোত্তর বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন ৯ জন, বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন ৪০ জন এবং বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন ৯১ জন। দেশ স্বাধীনের পর নতুন আইন সংশোধন এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ ইপিআর এর পোশাক পরিবর্তনসহ নতুন নামকরণ করা হয় বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস)। সর্বশেষ গত ২৩ জানুয়ারি ২০১১ সালে বাহিনীটির নাম ও পোশাক পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পতাকা উত্তোলন করেন।

বাহিনীটি দেশ-মাতৃকার কাজে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ১৭৯৫-১৮৭৩ সাল পর্যন্ত, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া শাষনামলে ১৮৭৩ হতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত, পাকিস্থান শাষন আমলে ১৯৪৭ হতে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এবং বাংলাদেশ ১৯৭১ হতে আজ পর্যন্ত সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বাহিনীটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৬৫ সালের ইন্দো-পাকিস্থান, ২০০১ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এবং ২০১৫সালে বাংলাদেশ আরকান সীমান্ত সংঘর্ষে দেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রাখেন। ২০০৫ সালের ৬ জুন রামগড় ৩৩ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের উদ্যোগে তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রামগড়ের অফিসটিলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দৃষ্টিনন্দন ‘রাইফেলস স্মৃতিস্তম্ভ’ উদ্বোধন করেন। কালের বিবর্তনে এখানে স্থাপন করা হয় বাহিনীটির প্রতিকায়নের ইতিহাস, বাহিনীটির বিবর্তনে পোড়ামাটির তৈরি ৮টি প্রতীকী অবয়ব। পশ্চিম পাশে সীমান্ত পিলারের অনুকরণে ৪টি আর সিসি পিলার স্থাপন করা হয় যাতে রামগড় ১৭৯৫ অলংকিত করা হয়েছে এবং স্মৃতিস্তম্ভর মাঝখানে ধাতব পদার্থ স্থাপন করা হয় যাতে সৈনিকদের রাইফেলসের প্রতীকী ছবি প্রদর্শন করা হয়েছে।
বিজির জন্মস্থান খাগড়াছড়ির রামগড়ে পাশাপাশি চারটি পিলারে চারটি স্তরে উপরে বর্ণমালা আর নিচে সংখ্যায় সাজানো জন্মস্মৃতি স্মারক। বামদিক থেকে প্রথম পিলারের উপরে ”রা” নিচে ”১’, দ্বিতীয় পিলারটিতে উপরে ‘ম’ নিচে ’৭’, তৃতীয় পিলারটির উপরে ‘গ’ নিচে ’৯’ এবং চতুর্থ পিলারটির উপরে ‘ড়’ এবং নিচে’ ৫’। উপরের বর্ণমালা একত্রে মিলিয়ে পড়লে হয় রামগড় এবং নিচের সংখ্যাগুলো সাজালে হয় ১৭৯৫। চার বর্ণের রামগড় এবং চার সংখ্যার ১৭৯৫ ইতিহাস বিখ্যাত হয়ে রয়েছে আজ অবদি।
সূত্র জানায়, সারাদেশের ন্যায় সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) বিজিবি দিবস ২০১৯ পালিত হচ্ছে বিজিবির জন্মস্থান রামগড়ে। এ উপলক্ষে রামগড় জোন প্রতি বছরের মতো সকালে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, রেজিমেন্টাল পতাকা উত্তোলন, প্রীতিভোজ, সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হচ্ছে।
