পাহাড়ে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে সেনাবাহিনীর অভাবনীয় উদ্যোগ
মোঃ সাইফুল ইসলাম
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সুদীর্ঘকাল ধরে পাহাড়ে বসবাসরত জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষে নিয়মিতভাবে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন উন্নয়নমূখী কার্যক্রম গ্রহণ করে আসছে। পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের চিকিৎসা সেবা প্রদানে সেনাবাহিনী অনন্য ভূমিকা পালন করছে। এছাড়াও সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিভিন্ন প্রকার শিক্ষা উপকরণ, ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল ড্রেস ও খেলাধুলার সামগ্রী বিতরণ করে থাকে। পার্বত্য অঞ্চলের অবহেলিত মানুষদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে সেনাবাহিনী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই মেশিন বিতরণসহ উক্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণও প্রদান করে। দূর্গম পার্বত্য এলাকার জনগণের সুষ্ঠু বিনোদনের জন্য সেনাবাহিনী কর্তৃক বিগত বছরে প্রায় ২শতাধিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের পাশাপাশি উন্মুক্ত চলচ্চিত্রও প্রদর্শন করা হয়।
সেনাবাহিনী পার্বত্যাঞ্চলে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির পরিচালনা করে, এ সকল চক্ষু শিবিরে দূর্গম পার্বত্য এলাকার সুবিধাবঞ্চিত বয়োবৃদ্ধ পাহাড়ি ও বাঙ্গালীর চোখের ছানি অপারেশনসহ বিভিন্ন ধরনের চক্ষু সেবা প্রদান করা হয়। এ ছাড়াও সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে গুইমারা, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান রিজিয়নে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী উপজাতি ও বাঙ্গালীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকে। এই চিকিৎসা সেবার আওতায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিগত বছরে কয়েক লক্ষ লোকজনকে বিনামূল্যে নানাবিধ চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়।
এবার অতীতের সব কর্মকান্ডকে ছাপিয়ে পাহাড়ের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে এক অভাবনীয় উদ্যোগ হাতে নিয়েছে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিবিশনের আওতাধীন ২৪ আর্টিলারি ব্রিগেড (গুইমারা রিজিয়ন)। যা সফল ভাবে পরিচালনা করা গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেকার সমস্যার সমাধান হবে খুব দ্রুত সময়েই, আলোর মুখ দেখবে পাহাড়ের বেকার যুবকরা।
শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে স্থানীয় জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিন্দুকছড়ি জোন নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ধারাবাহিকতায় গুইমারা রিজিয়ন এবং বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সিন্দুকছড়ি জোনের উদ্যোগে সিন্দুকছড়ির জালিয়া পাড়া এলাকায় একটি জুতা কারখানা স্থাপন করা হয়েছে।
সূত্র মতে, পাহাড়ের বিভিন্ন দূর্গম এলাকায় বেকার সমস্যা অনুধাবন করতে পেরে তা সমাধানের লক্ষ্যে একটি সু-দক্ষ প্রকল্প হাতে নেয় গুইমারা রিজিয়ন। রিজিয়ন আওতাধীন জেলার গুইমারা উপজেলার জালিয়াপাড়ায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর সোমবার গুইমারা রিজিয়নের অধীনে জালিয়াপাড়া বেকার কল্যাণ সংগঠনের নিজস্ব কার্যালয়ে সম্ভাবনাময়ী একটি জুতা কারখানার উদ্বোধন করেন গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিন্দুকছড়ি জোন কমান্ডার লে. কর্নেল দেওয়ান মনজুরুল হক চৌধুরী, রিজিয়নের জিটুআই তাজুল ইসলামসহ সামরিক পদস্থ কর্মকর্তাগণ।
গুইমারা রিজিয়নের সিন্দুকছড়ি জোনের পরিচালনায় এদিন যাত্রা শুরু করে সিন্দুকছড়ি সুজ নামে (জুতা) কারখানাটি। জুতা কারখানাটি সিন্দুকছড়ি জোনের দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় অনগ্রসর জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সাম্যতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
জালিয়াপাড়া বেকার কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোঃ সুবেদ আল-মামুন সাংবাদিকদের জানান, করোনা মহামারীর কারণে শত শত যুবক বেকার হয়ে পড়েছে। বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে এই কারখানা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তাঁর বিশ্বাস।
জানা যায়, প্রথম পর্যায়ে ১০জন বেকার ছেলে-মেয়েকে প্রশিক্ষণ দিয়ে চালু করা এই কারখানা। রাজধানী ঢাকা হতে কাঁচামাল সংগ্রহ করে ফিটিংস থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদন করা হবে এখানেই। মানুষের অন্যতম প্রয়োজনীয় এই জুতা বা সেন্ডেল পাইকারি ক্রয়ের পাশাপাশি খুচরা মূল্যের পাওয়া যাবে এখন জালিয়া পাড়ায়। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এ ফ্যাক্টরি চালু করতে সার্বিক সহযোগিতা করছেন। এছাড়াও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন জালিয়া পাড়ায় ফেক্টরিতে তৈরি করা ২০হাজার জোড়া জুতা অগ্রিম অর্ডার করেছে।
এছাড়া, শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে স্থানীয় জনগণের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গুইমারা রিজিয়ন এবং বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এবং লক্ষ্মীছড়ি জোনের উদ্যোগে লক্ষ্মীছড়ি এলাকায় একটি লুঙ্গী কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। উক্ত লুঙ্গী কারখানাটি লক্ষ্মীছড়ি জোনের দায়িত্বপূর্ণ এলাকার অনগ্রসর জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সাম্যতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর সোমবার লুঙ্গী কারখানাটি উদ্বোধন করেন গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন। এ সময় অন্যান্যদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন লক্ষ্মীছড়ি জোন অধিনায়ক লে: কর্ণেল মো: রাশেদুজ্জামান রাশেদসহ গুইমারা রিজিয়নের আওতাধীন সকল জোন কমান্ডার এবং অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তা এবং কর্মচারীবৃন্দ।
পাশাপাশি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলায় একটি মানসম্মত বেকারীও উদ্বোধন করা হয় এদিন।
দুর্গম পার্বত্য এলাকার অসহায় এবং গরীব মানুষের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রজেক্টসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষে গুইমারা রিজিয়ন ভবিষ্যতেও সর্বদা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে বলে রিজিয়ন কমান্ডার এদিন আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এ বিষয়ে গুইমারা কলেজের অধ্যক্ষ নাজিম উদ্দিন জানান, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে এ অঞ্চলের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে গড়ে তোলা জুতা ও লুঙ্গী কারখানাটি পাহাড়ে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এ অঞ্চলে এসব ছোট-বড় কারখানা স্থাপন ও সফল ভাবে পরিচালনা করা গেলে পাহাড়ে বেকার সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি এ অঞ্চলের অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পাবে, মাদকাসক্ত বেকার যুবকদের সংখ্যা কমে আসবে। এতে করে এখানকার বেকার, অসহায় ও হতদরিদ্র জনসাধারনের জীবনমানের উন্নতি ঘটবে। আর পাহাড়ের জনসাধারণের জন্য এমন অভাবনীয় উদ্যোগ গ্রহন করায় তিনি সেনাবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ও মানিকছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ মাঈন উদ্দিন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সুদীর্ঘ সময় ধরেই কাজ করে যাচ্ছে। সম্প্রতি এ অঞ্চলের মানুষের বেকারত্ব দূরীকরণে সেনাবাহিনী গৃহিত পদক্ষেপগুলো সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে, আশাকরি সেনাবাহিনীর হাত ধরেই পাহাড়ে বেকার সমস্যার সমাধান হবে।
সেনাবাহিনীর এমন উদ্যোগের সফলতা কামনা করে মাটিরাঙ্গা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলছেন, পাহাড়ে এমন আরো ছোট-বড় কিছু কারখানা স্থাপন করা গেলে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বেকারত্ব কমে আসবে, আর্থিক স্বচ্ছলতা আসবে। এছাড়া পাহাড়ে বর্তমানে দেশী-বিদেশী বহু ফলের বাম্পার ফলন হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এ অঞ্চলে হিমাগার না থাকায় স্থানীয় কৃষকরা ফল সংরক্ষনের অভাবে কৃষির ন্যায্যামূল্য পাচ্ছেন না। সেনাবাহিনী বেকার সমস্যা দূর করার যে প্রয়াস চালু করেছেন তার পাশাপাশি এ অঞ্চলের কৃষির উন্নয়নে, কৃষকের উন্নয়নে একটি হিমাগার স্থাপন করবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
প্রয়োজনীয় শিল্প-কারখানা না থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বেকারত্বেও হার কিছুটা প্রকট মন্তব্য করে সেনাবাহিনীর গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, এলাকার বেকার ছেলেদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এই কারখানাগুলোতে স্থানীয় ৬০জন বেকার যুবককে নিয়ে স্বল্প পরিসরে প্রথম পর্যায়ে শুরু করা হলেও আগামীতে এর প্রসার আরো বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, মাটিরাঙ্গায় মানসম্মত বেকারি কারখানা, লক্ষ্মীছড়িতে তাঁত শিল্প এবং জালিয়া পাড়ায় শুরু করা হলো জুতা কারখানা, এসব কিছুই এ অঞ্চলের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণের জন্যই সেনাবাহিনীর এ উদ্যোগ।
ধীরে ধীরে এসব কারখানার পরিধি বাড়বে আশাবাদ ব্যক্ত করে রিজিয়ন কমান্ডার বলেন, অর্থনৈতিক ভাবে ভঙ্গুর ও বেকারত্বেও হার বাড়তে থাকায় এ অঞ্চলের উঠতি বয়সী যুবক-যুবতীরা হতাশাগ্রস্থ হয়ে মাদকাসক্তসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছিলো, সেনাবাহিনীর এমন উদ্যোগের ফলে যেমন, বেকারদেও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি এ এলাকার অপরাধ প্রবণতাও কমে আসবে, হতদরিদ্র জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তিও মিলবে অদূও ভবিষ্যতে।
উল্লেখ্য, মহামারি করোনার প্রকোপে সারা বিশ্ব যখন নড়বড়ে তখনো পাহাড়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ভরসার প্রতীক হয়ে কাজ করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। করোনা পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে সুস্থ রাখতে ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধা হিসেবে সংক্রমণ এড়াতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছে; তবে অতীতের মত নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে নয়, এবার একটি যুদ্ধ জয় করে দেশবাসীকে নিরাপদ রাখতে মাঠে নেমেছিলো সেনাবাহিনী।
প্রথম ধাপে শুরুর দিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাজপথে দেশের সাধারণ জনগণকে ঘরে ফেরাতে কাজ করা শুরু করে। রাস্তায় রাস্তায় হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করে, মাস্ক ও সাবান তুলে দিয়ে করোনা প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করে, প্লেকার্ড হাতে করোনার সংক্রমণ এড়াতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বোঝানোর মতো কাজ করে যায় সেনাবাহিনী। দ্বিতীয় ধাপে এসে সেনাসদস্যরা করোনা মোকাবেলায় কিছুটা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। নিজেদের বেতনের একদিনের সমপরিমান অর্থ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে প্রদান করেই ক্ষান্ত থাকেনি সেনা সদস্যরা, নিজেদের রেশনের চাল, ডাল, আটা, আলু প্রভৃতি বাঁচিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ের আনাছে-কানাছে পাহাড়ী সম্প্রদায়ের মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় সেনাবাহিনী। রোদে পুড়ে-বৃষ্টিতে ভিজে, ঘূর্নিঝড় উপেক্ষা করে পাহাড়ী টিলা-ছড়া পেরিয়ে প্রতিটি ঘরে ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিত করে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশন।
মাঝে রাঙামাটির সাজেক, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, সদরের ভাইবোন ছড়া, মাটিরাঙ্গা ও বান্দরবানের লামা-আলীকদমে দেখা দিয়েছিলো আরেক মহামারী হামের প্রাদুর্ভাব। সারাদেশ যখন করোনা সামলাতে ব্যস্ত ঠিক তখনি সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের নির্দেশে করোনার সাথে সাথে পাহাড়জুড়ে হাম নিয়ন্ত্রনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনাবাহিনীর অকুতোভয় সৈনিকরা। বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিমের চিকিৎসা সহায়তা ক্যাম্প পরিচালনা, খাগড়াছড়ি রিজিয়নের উদ্যোগে ২দিন ধরে পায়ে হেঁটে হাম আক্রান্ত দুর্গম পাহাড়ে পুষ্টিকর খাবার ও বিশুদ্ধ খাবার পানি পৌঁছে দেয়া, এমনকি নিজস্ব হেলিকপ্টারে করে হাম আক্রান্ত মুমূর্ষ ৫ শিশুকে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে গিয়ে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলার মতো উচ্চ মানসিকতা দেখায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
এসময় পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন করে অভিনব এক বাজার চালু করে সেনাবাহিনী। ২৪ পদাতিক ডিভিশনের নির্দেশে অধীনস্থ রিজিয়নগুলো তাদের আওতাধীন এলাকাগুলোতে চালু করে এক মিনিটের বাজার। নামে বাজার হলেও সম্পূর্ন স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে সেখান থেকে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় শাক-সবজি ও তরকারীসহ ত্রান সহায়তা বিতরণ করা হয় অসহায় ও দুঃস্থদের মাঝে। এক মিনিটের বাজার থেকে বিনামূল্যে সবাই প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে গেলেও সেখানে বিতরণকৃত শাক-সবজি, তরকারী, ফলমূল মূলত সেনাসদস্যরা পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে অসহায় কৃষকদের কাছ থেকেই ন্যায্যমূল্যেই সংগ্রহ করে। ইতিপূর্বে পাহাড়ের প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রি, পরিবহণ ও বাজারজাত করা নিয়ে বিপাকে পড়েছিলো কৃষকরা। এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের মতো সেসময় সেনাবাহিনী যেমন অসহায় কৃষকের পন্য মাঠ থেকে সরাসরি ন্যায্যমূল্যে সংগ্রহ করেছে তেমনি এক মিনিটের বাজারের মাধ্যমে তা অসহায় ও কর্মহীনদের মাঝে বিতরণ করেছে। এছাড়া করোনা সংক্রমনের মাঝেই একমাস রমজান শেষে ঈদের আগে এম মিনিটের বাজারের পাশাপাশি পাহাড়ে অসহায়দের মাঝে শাড়ি, লুঙ্গিসহ কাপড়-চোপড়ও বিতরন করে সেনা সদস্যরা।
এছাড়া করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়ারচরে দেশখ্যাত সুমিষ্ট আনারসের বাম্পার ফলন হলেও পরিবহণ সুবিধা, বাজারজাতসহ আনারস বিক্রি নিয়ে বিপাকে পড়া চাষীদের পাশে দাঁড়িয়েছে সেনাবাহিনী। ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও এরিয়া কমান্ডার নানিয়ারচরের প্রান্তিক চাষীদের নিকট থেকে ন্যায্য মূল্যে সবজি কেনার পাশাপাশি মৌসুমী ফল আনারস ক্রয় করে দরিদ্র চাষীদের সহায়তার ব্যবস্থা করে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। আনারস বিক্রয় ও পরিবহণজনিত জটিল সমস্যার কথা জানামাত্র তা সমাধানের জন্য আনারস চাষী ও ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ায় ২৪ পদাতিক ডিভিশনের সেনা সদস্যরা। এতে প্রান্তিক চাষীরা বাগান থেকে ন্যায্যমূল্যে আনারস বিক্রয় করার কারণে পরিবহন ভাড়া বাঁচিয়ে অধিক লাভবান হয়েছে।
অন্যদিকে, করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক রোগীই তাদের চিকিৎসা কিংবা চেকআপের সময়সীমা পরিবর্তন করেছেন। অনেক রোগীই করোনাকালীন সময়ে মোবাইল ফোনে টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করছেন। কিন্তু গর্ভবতী ও সন্তান সম্ভবা নারীদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেকেই। সন্তান প্রসবের নির্দিষ্ট সময়ে এসে অনেকেই স্থানীয় হাসপাতাল থেকে কোন ধরণের চিকিৎসা সেবা পান নি। অনেকেই সšন্তন প্রসবকালীন চিকিৎসা সেবা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। এমতাবস্থায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে সারাদেশের পাশাপাশি পাহাড়জুড়েও নিজেদের মেডিকেল কোরের প্রশিক্ষিত চিকিৎসকদের সমন্বয়ে এক অভিনব মেডিকেল ক্যাম্প চালু করেছিলো সেনাবাহিনী। করোনা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সেনাবাহিনীর এসব মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা দেয়া হয় পাহাড়ের আনাচে-কানাচে, দূর্গম এলাকাগুলোতে বসবাসরত, চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত পাহাড়ী-বাঙ্গালী গর্ভবতী ও সন্তান-সম্ভবা মায়েদের। সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশন ও চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডারের সার্বিক দিক-নির্দেশনায় ইতিমধ্যেই পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে অভিনব এ চিকিৎসা সেবা ক্যাম্প পরিচালনা করেছে সেনাবাহিনী।
শুধুমাত্র সাধারণ মেডিকেল চেকআপ নয় করোনা সংকটে সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ কর্তৃক সেবা দেয়া এসব ক্যাম্পে মেডিকেল চেক-আপের পাশাপাশি দেয়া হয় নানা ধরণের ঔষধপত্র, পুষ্টিকর খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং মানবিক সহায়তার অংশ হিসেবে দেয়া হয় চাল-ডাল-তেলের সমন্বয়ে অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীও। এতে শুধুমাত্র এখানে সেবা নিতে আসা গর্ভবতী মায়েরা সেবা নেয় তা কিন্তু নয়; গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা সেবা ও ঔষধপত্রের পাশাপাশি তার পরিবারর পায় বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সামগ্রী।
অতীতের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে মহামারী কলেরা, ম্যালেরিয়া, দূর্ভিক্ষসহ নানা দূর্যোগে পাহাড়বাসীর বিপদে-আপদে পাশে থেকে এমনকি নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে পাহাড়বাসীদের জীবন বাঁচিয়ে নেয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এমনিভাবে করোনার এই দূর্যোগকালীন সময়ে প্রকৃতপক্ষেই সাধারন মানুষের পরম বন্ধু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সকল কাজে পেশাদারিত্ব আর পরিকল্পনার ছাপ থাকায় সাধারণ মানুষ খুবই উপকৃত হয়।
এর বাইরে, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মহালছড়িতে দূর্গম পাহাড়ে বসবাসকারী সাধারণ পরিবার সমূহের চিকিৎসা সেবায় এক মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সেনাবাহিনীর মহালছড়ি জোন। অত্র এলাকার মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানবিক সেবার অংশ হিসেবে মহালছড়ি সেনা জোনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় উপজেলার পঙ্খীমুড়া, ধুমনীঘাট এলাকার জনসাধারণের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে সেনা সদস্যরা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় দূর্গমতার কারণে সেভাবে গড়ে উঠেনি চিকিৎসালয়, উপজেলা ও ইউনিয়ন সদরে কিছু কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও চিকিৎসক সংকটসহ নানা কারণে তা পাহাড়বাসীর চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন জোনের ব্যবস্থাপনায় দিনব্যাপী চিকিৎসা সেবা ক্যাম্প পরিচালনা করা হলেও চিকিৎসা সেবায় স্থায়ী কোন সমাধান পাচ্ছিলো না দূর্গম পাহাড়ের বাসিন্দারা। বিষয়টি মাথায় রেখে তাই মহালছড়িসেনা জোনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় উপজেলার পঙ্খীমুড়া, ধুমনীঘাট এলাকার জনসাধারণের জন্য স্থায়ী ভাবে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করে মহালছড়ি জোন।
বৈশ্বিক করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে খাগড়াছড়িসেনা রিজিয়নের উদ্যোগে মহালছড়ি সেনা জোনসহ রিজিয়নের অধীনস্হ সকল জোন সমূহ বিভিন্ন মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চলমান রাখে। তারই ধারাবাহিকতায় মহালছড়ি সেনা জোনের তত্ত্বাবধানে পঙ্খীমুড়া, ধুমনীঘাট এলাকায় গোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অত্র এলাকায় বসবাসরত সাধারণ পরিবার সমূহের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা প্রদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়।
সেনাবাহিনী জানায়, উক্ত কমিউনিটি ক্লিনিক হতে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাসহ মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ করা হবে। খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়নের অধীনস্থ জোন সমূহ করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ সহ বেশ কিছু চিকিৎসা সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে। ভবিষ্যতেও সেনাবাহিনী এই ধরনের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।