রাঙ্গামাটিতে ইচ্ছামতো পাহাড় কাটা চললেও নির্ভার প্রশাসন - Southeast Asia Journal

রাঙ্গামাটিতে ইচ্ছামতো পাহাড় কাটা চললেও নির্ভার প্রশাসন

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

রাঙ্গামাটি জেলা শহরের আসামবস্তি-ভেদভেদী সড়কের লুম্বিনী বিহার এলাকার সাধনাপুর। পিচঢালা সড়কের পাশেই উঁচু সুবিশাল পাহাড়। আগে এসব পাহাড় ছিল বিভিন্ন প্রজাতির গাছে পরিপূর্ণ, ছিল সবুজে ঢাকা। সেখানে এখন চলছে পাহাড় কাটার উৎসব। সবুজ তো নেই-ই, পাহাড় কেটে নেয়া মাটি পরিবহনের কারণে পুরো এলাকা ধুলায় ধূসরিত। প্রায় দুই মাস ধরে নিয়মিত এ এলাকার পাহাড় কেটে মাটি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি পরিবেশ অধিদপ্তর বা স্থানীয় প্রশাসনকে।

সরেজমিনে রাঙ্গামাটি পৌর এলাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাধনাপুরে গিয়ে দেখা যায়, পিচঢালা রাস্তার পাশের বড় একটি উঁচু পাহাড় ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল বা খাড়াভাবে অর্ধেকের বেশি অংশ কাটা হয়েছে। এজন্য ব্যবহার করা হয়েছে এক্সক্যাভেটর। পুরো পাহাড়ের গায়ে রয়েছে এক্সক্যাভেটর দিয়ে কাটার চিহ্ন। রাস্তার পাশের পাহাড়টির পেছনের দিকের আরো বেশ কয়েকটি পাহাড়ও কাটা চলছে। পাহাড় কাটার পর পরিত্যক্ত মাটি সরানো হচ্ছে ভারী ট্রাকের মাধ্যমে। এ ট্রাক চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। এ রাস্তা দিয়েই পাহাড়ের মাটি ট্রাকে করে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।

ট্রাক চলাচলকারী এ পথ ধরে একটু সামনে এগোলেই চোখে পড়ে আরো কয়েকটি বিশাল পাহাড় কেটে সমান করা হয়েছে। যেখানে একটি এক্সক্যাভেটর দেখা গেলেও কথা বলার মতো কাউকে ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ একর জায়গাজুড়ে এ ধ্বংসযজ্ঞ চলছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ সম্পত্তির মালিক মোহন চান দেওয়ান। তিনি স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। অবশ্য এ পাহাড় কাটার সঙ্গে আরো বেশ কয়েকজন জড়িত থাকার কথা জানা গিয়েছে। যদিও তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সমতল করা জায়গায় একসঙ্গে বেশকিছু খুঁটিও দেখা গেছে। পিচঢালা সড়কটির বিপরীত দিকে আরেকটি পাহাড়ও কেটে সমতল করা হচ্ছে। ফলে সংলগ্ন এ সড়কও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এ পাহাড়ের মালিক হিসেবে রনেল দেওয়ানের নাম জানা গেছে।

অন্যদিকে পাহাড় কাটার পর পরিত্যক্ত মাটি ট্রাকে করে সরিয়ে নেয়ার কারণে এলাকার সরু সড়কটিতেও উঁচু-নিচু খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। ধুলায় ধূসর হয়ে পড়েছে সড়কটি। যে কারণে স্থানীয়রাও পড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িতরা প্রভাবশালী হওয়ায় এ ব্যাপারে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেছে স্থানীয়রা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, যারা পাহাড় কাটছে তারা সবাই এলাকার প্রভাবশালী। তারা অবশ্যই সবকিছু ম্যানেজ করে পাহাড় কাটছে। স্থানীয়দের এভাবে পাহাড় কাটার পক্ষে মত না থাকলেও প্রতিবাদ করার মতো অবস্থা কারো নেই।

সাধনাপুর এলাকার আরেক বাসিন্দা জানান, দুই মাস ধরে পাহাড়গুলো এক্সক্যাভেটর দিয়ে খাড়াভাবে কাটা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বড় বড় বেশ কয়েকটি পাহাড় কেটে সমান করা হয়েছে। আরো কয়েকটিও কাটার কাজ চলছে। বড় পাহাড়গুলোর ভূমির মালিক মোহন চান দেওয়ান। তবে পাহাড় কাটার সঙ্গে আরো বেশ কয়েকজন থাকতে পারেন। শুনেছি পাহাড়গুলোতে আবাসন প্লট তৈরি করা হবে।

এসব বিষয়ে জানতে পাহাড়ের মালিক ও অভিযুক্ত মোহন চান দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সব জায়গাই উঁচু-নিচু পাহাড়। সামান্য বৃষ্টি পড়লেই পাহাড় কাটতে হয়। নিজেদের জায়গা কাটা হচ্ছে, এজন্য অনুমতি নেয়া হয়নি। তাছাড়া প্রশাসন থেকেও আমাদের কোনো বাধা দেয়া হয়নি। পাহাড়টি পতিত অবস্থায় ছিল, তাই এটি কেটে সমান করা হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন ফলের চারা রোপণ ও খামার করার কথা ভেবেছি। তাই পাহাড়ের উপরি অংশ কেটে কিছুটা সমান করা হচ্ছে। পাহাড়ের মাটির কিছু অংশ জায়গা সমান করার কাজে আর কিছু মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। আমরা মাটির দামও বেশি নিচ্ছি না।

মোহন চানের দাবি, এসব জমির মালিক তিনি একা নন। সেখানে আরো কয়েকজনের জায়গা রয়েছে। তারা মোহন চান দেওয়ানের আত্মীয়। তবে তিনি আত্মীয়দের পরিচয় দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এর কিছুক্ষণ পরই মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি নিজেকে মোহন চান দেওয়ানের বন্ধু হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, আমরা এখানে ঘরবাড়ি করব, বাগান করব। সংস্কার ছাড়া তো করা যায় না; তাই কিছু কাটাকাটি হচ্ছে। এ সময় তিনি এ প্রতিনিধিকে চা-নাশতা খেয়ে এরপর বিস্তারিত কথা বলার আহ্বান জানান। তবে আরেকটি পাহাড়ের মালিক রনেল দেওয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। একটি দেশের প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাহাড়, বনজ সম্পদ, জীব প্রজাতি এবং খনিজ ও কৃষিজ পণ্যের উৎস। পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশির ভাগ পাহাড়ের অনেক গভীর পর্যন্ত বালির আধিক্য রয়েছে। ফলে পাহাড় কাটলে ভূমিধসের ঝুঁকি তৈরি হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ৬(খ) অনুযায়ী পরিবেশ সুরক্ষায় পাহাড় কাটায় স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ আইনে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কাটা যাবে না বলে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে পাহাড় বা টিলা কাটার কথা বলা হয়েছে। পরিবেশ আইনের ধারা ১৫ অনুযায়ী, পাহাড় বা টিলা কাটার প্রমাণ পাওয়া গেলে অনধিক এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

রাঙ্গামাটির পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী বণিক বার্তাকে বলেন, পাহাড় কাটার কারণে ভূমিধসের ঝুঁকি থাকে। পাহাড় কাটার বিরূপ প্রভাব কী হতে পারে সেটি রাঙ্গামাটিসহ সারা দেশের মানুষ ২০১৭ সালে দেখেছে। পাহাড় কেটে অপরিকল্পিতভাবে বসতি গড়ে তোলার কারণে ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটিতে শতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তবুও পার্বত্য এলাকায় পাহাড় কাটা থেমে নেই। কখনো সরকারি, কখনো ব্যক্তিমালিকানাধীন কাজে পাহাড় ধ্বংস চলছে। পরিবেশকে বাঁচাতে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরে ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় অধিবাসীদের আরো সচেতনতার প্রয়োজন।

পাহাড় কাটার অনুমতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রাঙ্গামাটিতে পাহাড় কাটার কোনো অনুমতি নেই। আমি সদর ইউএনওকে বলে দিচ্ছি। তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন। পরে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমা বিনতে আমিন বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। পাহাড়টি কীভাবে ও কেন কাটা হচ্ছে আমরা খতিয়ে দেখব।

পাহাড়ি জেলা রাঙ্গামাটিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয় না থাকায় এখানে এ প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম নেই বললেই চলে। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়ের পরিচালক মুফিদুল হকের সঙ্গে সেলফোনে যোগাযোগ করেও বক্তব্য জানা যায়নি।

সংবাদ প্রকাশের পর প্রশাসনের অভিযান
পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতে পাহাড় কাটার ঘটনায় অবশেষে মামলা ও জরিমানা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। গত শনিবার বিকেলে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজমা বিনতে আমীন জেলা শহরের রাঙাপানি সাধনাপুর এলাকার লুম্বিনী পাড়ায় পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করেন।

দণ্ডিতরা হলেন- মোহন চান দেওয়ান ও রনেল দেওয়ান। মোহন চান দেওয়ানকে ৫০ হাজার টাকা ও রনেল দেওয়ানকে ২০ হাজার টাকা জরিমানাসহ দুজনের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়ের করা হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করে রাঙ্গামাটি সদর ইউএনও নাজমা বিনতে আমীন বলেন, লুম্বিনী পাড়ায় পাহাড় কাটার কথা জেনে সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। অভিযানে পাহাড় কাটার দায়ে অভিযুক্ত মোহন চান দেওয়ানকে ৫০ হাজার ও রনেল দেওয়ানকে ২০ হাজার টাকা জরিমানাসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এছাড়া সেখানে সতর্কতামূলক পোস্টার টাঙানো হয়েছে।

ইউএনও বলেন, আমরা অভিযুক্ত আরেকজনের কথা জেনেছি। তাকে এবার পাওয়া যায়নি। সামনে তার বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাহাড় কাটা ও পরিবেশ বিধ্বংসী কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের তৎপরতা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।