ছয়জন টিকিয়ে রেখেছেন যে ভাষা
![]()
কালের বিবর্তন কিংবা নানা কারণে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে অনেক কিছুই। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি। বিলুপ্তির পথে যে ভাষাগুলো রয়েছে তাদের মধ্যে ‘রেংমিৎ চা’ বা ‘রেং মিটচ্য’ ভাষা। কোনো এক সময় রেংমিৎ চা (রেং মিটচ্য) ভাষীদের ছিল আলাদা সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্য।
তারা কথা বলতেন নিজের মাতৃভাষা রেংমিৎ চা ভাষায়। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে কয়েক শত পরিবার নিয়ে বসবাস ছিল তাদের। বর্তমানে তাদের ছেলে-মেয়েরাই জানে না সেই মাতৃভাষা। বান্দরবানে বসবাসরত আরেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ম্রোদের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় প্রায় শূন্য এখন এ ভাষা ও সংস্কৃতি। জেলায় রেংমিৎ চা ভাষা বলতে পারা মানুষ আছেন মাত্র ছয়জন। এ ভাষার চর্চাও করেন না এখন তারা।
জেলার আলীকদম উপজেলার ক্রাসিং পাড়ায় বাস করেন মাংপুন ম্রো (৭৪) কুন রাও ম্রো (৬৯) কুন রাও ম্রো (৬১), মেনচিং পাড়ায় বাস করেন থোয়াই লক ম্রো (৬৫), সাংপ্ল পাড়ায় রেং পুন ম্রো (৬৫)। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার চাইন প্রা মৌজার ওয়াই বট পাড়ায় মাং ওয়াই ম্রো (৬০)। রেংমিৎ চা ভাষা জানা এ ছয়জনের সবাই এখন বার্ধক্যের কোটায়।
এদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিতে পারে রেংমিৎ চা নামের ভাষাটির সঙ্গে জড়িত ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, গল্প, উপন্যাস।
সিংরা ম্রো (৪৪) বলেন, ১২ বছর পর্যন্ত শুধু রেংমিৎ চা ভাষাই জানতেন। কারণ বাড়িতে সবাই এই ভাষাতেই কথা বলতেন। সিংরার দাদু ওয়ালক ম্রো মারা যাওয়ার পর বাড়িতে আর তেমন ভাষা চর্চা হয় না, নিজেও বিয়ে-শাদী করে বাবার বাড়ি থেকে আলাদা হওয়ার কারণে ভাষা চর্চা করা যায়নি। রেংমিৎ চা ভাষায় কথা বললে আশপাশের ম্রোরা হাসাহাসি করতো, তাই লজ্জায় কেউ রেংমিৎ চা ভাষা ব্যবহার না করে সবাই ম্রো ভাষা ব্যবহার করতেন। এখন অনেকটা রেংমিৎ চা ভাষা ভুলেই গেছেন।
২০০৯ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউ কলেজের ভাষা তত্ত্বের অধ্যাপক ডেভিড এ পিটারসন বান্দরবানে এসে জানতে পারেন আলীকদম উপজেলার প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকায় ম্রো জনগোষ্ঠীর একটি গোত্র আছে যাদের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। পরে তিনি রেংমিৎ চা ভাষাভাষীদের খুঁজে বের করেন। তাকে সার্বিক সহযোগিতা করেন ম্রো জনগোষ্ঠীর গবেষক লেখক ইয়াং ঙান ম্রো।
বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলাধীন সদর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের দুর্গম এলাকাগুলোর, মধ্যে ‘ক্রাংসি পাড়া’ একটি। কোনো এক সময় রেংমিৎ চা ভাষীদের কয়েকশ পরিবারের বসবাস ছিল এই পাড়াটিতে। বর্তমানে রয়েছে মাত্র ২৩টি পরিবার। তারাও এখন কথা বলে ম্রো বাষায়।
পাড়ার বাসিন্দা মাংপুন ম্রো জানান, ক্রাংসি পাড়ার বয়স তিনশ বছরের বেশি। বাস করতো ২শ এর বেশি পরিবার। এছাড়া রানি পাড়া, সাংতং পাড়া, কোয়া রাও পাড়া, বোন চু পাড়ার সবাই রেংমিৎ চা ভাষাভাষীদের বসবাস ছিল। ৪০-৫০ বছর আগে সবাই মিয়ানমার, ভারতে চলে যায়। আর যারা এখানে ছিল তারা সবাই ম্রো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায়। এভাবেই দিন দিন রেংমিৎ চা ভাষার লোকজন কমে গিয়ে চর্চার অভাবে ভাষাটিও হারিয়ে গেছে।
বর্তমানে ক্রাংসি পাড়ায় ১০, প্রেংথং পাড়ায় ৫, রেংপুন ম্রো হেডম্যান পাড়ায় ৪, পায়া পাড়ায় ৮, মেন সিং পাড়ায় ২ পরিবার, রেংমিৎ চা পরিবার থাকলেও কেউই এ ভাষা জানেন না।
তিনি বলেন, রেংমিৎ চা ভাষা ও ম্রো ভাষার মধ্যে দশ শতাংশেরও কম মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
যেমন- ফুলকে ম্রো ভাষায় বলা হয় ‘পাও’ আর রেংমিৎ চা ভাষায় বলা হয় ‘খেলেং’, বাঁশিকে ম্রো ভাষায় বলা হয় ‘প্লুং’ আর রেংমিৎ চা ভাষায় বলা হয় ‘ত্লোম’, লাউখোলকে ম্রো ভাষায় বলা হয় ‘তৈয়া’ আর রেংমিৎ চা ভাষায় বলা হয় ‘তৈদুং’। ম্রো ভাষায় কুকুরকে বলা হয় ‘কুই’, অন্যদিকে রেংমিৎ চা ভাষায় বলা হয় ‘উই’।
ঘরকে ম্রো ভাষায় বলা হয় ‘কিম’ আর রেংমিৎ চা ভাষায় বলা হয় ‘ইম’, মাটিকে ম্রো ভাষায় বলা হয় ‘ক্রং’ অন্যদিকে রেংমিৎ চা ভাষায় বলা হয় ‘ত্লং’, পাহাড়কে ম্রো ও রেংমিৎ চা উভয় ভাষায় ‘হোং’ বলা হয়।
রেংমিৎ চা ভাষায় গান কবিতা না থাকলেও রয়েছে জীব প্রেমের রূপকথা। এর মধ্যে মোরগ-মুরগির ও মালিকের রূপকথা একটি।
সিংরা ম্রোর বাংলা অনুবাদে গল্পটি এমন- তরকারি ভালো না থাকায় পরিবারের ছোট ছেলেটি ভাত খেতে চাচ্ছিল না। মা আশ্বাস দিয়ে বলে এবেলা খাও, কাল ঘরে পালিত মোরগ জবাই করে রান্না করে খাওয়াবে। সে কথা মোরগ শুনে ফেলে। আগামীকাল তাকে জবাই করা হবে।
মোরগ-মুরগি না ঘুমিয়ে সারারাত কান্নাকাটি করতে থাকলো। মুরগি মোরগকে বললো তুমি না থাকলে আমিও যে ডিম দিতে পারবো না বাড়ির মালিক কি জানে না? মোরগ বললো জানলে কি আর তোমাকে রেখে আমাকে জবাই করতো? সেদিন রাত্রে দূর গ্রাম থেকে একজন কবিরাজ-বৈদ্য এসে বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন।
ক্রাংসি পাড়াস্থ ডলুঝিড়ি ছড়া
সেই বৈদ্য ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ঘরের মালিককে বললেন, মোরগ-মুরগির কান্নায় সারারাত ঘুমাতে পারি নাই। আপনারা নাকি ঠিক করেছেন ভোর হলে মোরগকে জবাই করবেন? বাড়ির মালিক অবাক হয়ে বৈদ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কিভাবে জানলেন? বৈদ্য বললেন, তিনি দৈব বলে সব প্রাণির কথা বুঝতে পারেন, বাড়ির মালিক মোরগকে আর জবাই করেননি।
এতে জীবপ্রেমের একটি অনন্য উদাহরণ পাওয়া যায় রেংমিৎ চা জনগোষ্ঠী থেকে। ম্রো ভাষার গবেষক, লেখক ইয়াং ঙান ম্রো জানান, ২০১৩ সালেও রেংমিৎ চা ভাষার মানুষ ৩২ জন ছিলেন বর্তমানে ২০২২সালে এসে ৬ জন আছেন। বাকিরা মারা গেছেন।
তিনি দুঃখ করে বলেন, যে ৬ জন বেঁচে আছেন, তাদের সবার বয়স গড়ে ৬০ বছরের ওপরে, তারা মারা গেলে মানবসভ্যতা থেকে একটি ভাষার পরিসমাপ্তি ঘটবে।
এই গবেষক বলেন, ২০১৩ সালে ২২ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি নিয়ে দুইবার মিটিংও করা হয়েছিল, কিন্তু রেংমিৎ চা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য কার্যকর কিছুই করা যায়নি।
তিনি উল্লেখ করেন, রেংমিৎ চা ভাষা-ভাষীদেরও আগ্রহ কম সেজন্য কাজ করা সম্ভব হয়নি।
বান্দরবান জেলা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক মং নু চিং জানান, রেংমিৎ চা ভাষা সম্পর্কে লোকে-মুখে শুনেছেন, কিন্তু বিস্তারিত কিছু জানেন না। বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ৮টি জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে চলমান কার্যক্রম আছে, কিন্তু রেংমিৎ চা ভাষা নিয়ে কোনো কাজ করার সুযোগ হয়নি এবং কোনো কার্যক্রম নেই।
বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য সিং ইয়ং ম্রো বলেন, ২০১৩ সালে রেংমিৎ চা ভাষা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন ৩২ জন রেংমিৎ চা ভাষা জানা মানুষ ছিলেন। ২০২২ সালে এসে মাত্র ছয়জন আছেন, বাকিরা মারা গেছেন।
তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করেছিলাম যারা ভালোভাবে রেংমিৎ চা ভাষা জানেন, তাদের মাধ্যমে অন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রয়োজনে রোমান হরফ দিয়ে হলেও রেংমিৎ চা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু যারা রেংমিৎ চা ভাষাভাষী আছেন তারাও আগ্রহী না হওয়ার কারণে এ ভাষা নিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
রেংমিৎ চা ভাষা নিয়ে গবেষণার বিষয়ে জানতে যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ডেভিড এ পিটারসনের কাছে ই-মেইল করা হলে তিনি জানান, দশ জন রেংমিৎ চা ভাষা জানা ব্যক্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন ভালোভাবে বলতে পারেন, আর পাঁচজন কম জানেন।
তিনি জানান, ১৯৫০-৬০ সালের দিকে জার্মান নৃবিজ্ঞানী লরেন্স লফলার পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছিলেন ম্রো ও খুমি সম্প্রদায়ের ওপর গবেষণার কাজে। পরে তার কাজের অংশ নিয়ে হার্ভার্ড থেকে প্রকাশিত হয় ‘এথনোগ্রাফিক নোটস অন ম্রো অ্যান্ড খুমি অব দি চিটাগাং অ্যান্ড আরাকান হিল-ট্র্যাকটস’।
লফলার লিখেছিলেন, আলীকদমের তৈন মৌজা এলাকায় রেংমিৎচা নামে একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের ভাষা আলাদা ও স্বতন্ত্র। তবে তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ম্রো মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে যায়। রেংমিৎ চার সঙ্গে ম্রো ভাষার নৈকট্য কম, তবে খুমী, লুসাই, বম, খিয়াং ও পাংখোয়া ভাষার সঙ্গে মিল বেশি। তার মতে, রেংমিৎ চা ভাষাটিও তিব্বতি-কুকি-চিন ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। রেংমিৎ চা ম্রো ভাষা থেকে আলাদা হলেও ম্রোদেরই একটি বলে মনে করেন তিনি।