অদম্য বাংলাদেশের নারী শান্তিরক্ষীরা
নিউজ ডেস্ক
দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন-আনমিসে কর্মরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নারী শান্তিরক্ষীরা সাপ, বিচ্ছু, বিষাক্ত পোকা-মাকড়, ম্যালেরিয়ার উপদ্রব উপেক্ষা করে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। স্বজন-পরিজন থেকে প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশে তারা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের সুরক্ষায় কাজ করছেন। পাশাপাশি মোতায়েনের পর থেকে তাঁরা কন্টিনজেন্টের সঙ্গে বিভিন্ন আভিযানিক ও সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন।
নারী শান্তিরক্ষীরা তাঁদের পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংঘাতপূর্ণ এলাকায় শান্তিপূর্ণ উদ্ধারে সমানতালে কাজ করছেন। এ জন্য মোতায়েনের তিন বছরের মধ্যে তারা সুদানের সাধারণ মানুষের কাছে আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। সম্প্রতি দক্ষিণ সুদান শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের কন্টিনজেন্টগুলো পরিদর্শনকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নারী সদস্যদের অনেকের সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ প্রতিদিনের।
ক্যাপ্টেন নাফিসা বিনতে নাসিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা এই দক্ষিণ সুদানে নারী জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে তাদের সঙ্গে কাজ করি। এখানকার নারীদের কাছ থেকে তাদের সমস্যা জেনে তা সমাধানের মাধ্যমে তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করি। এর মধ্য দিয়ে তারা আমাদের সঙ্গে ফ্রি ফিল করেন। অনেক সময় তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের আক্রমণ চালানো হয়। তখন আমাদের পুরুষ সদস্যদের তারা তা জানাতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে আমরা ফিমেল শান্তিরক্ষীরা পেট্রোলিংয়ে যাই। তাদের সঙ্গে কথা বলি। তারা স্বাচ্ছন্দ্যে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। অনেক সময় তাদের কাছ থেকে টেররিজম অ্যাকটিভিটির তথ্য পেয়ে থাকি।
ক্যাপ্টেন নাফিসা বলেন, উনারা যেসব বিষয়ে ফ্রি ফিল করেন সেসব বিষয়ে তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। তাদের সঙ্গে মিলেমিশে একটা স্থিতিশীল শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করছি আমরা। তারা অধিকাংশ সময় নিজেদের ভাষায় কথা বলে। তখন আমরা দোভাষী ব্যবহার করি। এ ছাড়া তাদের কেউ যদি ইংরেজি ব্যবহার করে তখন আমাদের ফিমেল সদস্যরাও ইংরেজিতে আলোচনা চালান। তিনি আরও বলেন, এখানকার নারীদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করি আমরা। এর মধ্য দিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়। সংঘাত কিংবা জঙ্গি তৎপরতার সময় নারীদের তল্লাশির প্রয়োজন হলে আমাদের নারী সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন-ব্যানব্যাট-৫ এ নিয়োজিত ল্যান্স করপোরাল কারিমা খাতুন বলেন, এখানে ডিউটি করার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা সাপ বিচ্ছুর প্রকোপ। আমরা চেষ্টা করি বুট পরে থাকার জন্য। বুট পরে না থাকলে সাপে কামড় দেওয়ার ভয় থাকে। এ জন্য আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়।
ল্যান্স করপোরাল জেসমিন আক্তার বলেন, বাংলাদেশে আমার একটা ছেলে বাবু আছে, তিন বছরের। তার জন্য খারাপ লাগে। সব সময় কথা বলার চেষ্টা করি। এখানে দেশের জন্য কাজ করছি ভেবেই ভালো লাগে। নারী শান্তিরক্ষী সুমাইয়া ইয়াসমিন বলেন, আমি এখানে ফিমেল এনগেজমেন্ট টিমের সদস্য হিসেবে কাজ করছি। আমার দেশের বাড়ি যশোরে। আমার পরিবার-পরিজন থেকে এত দূরে এসে এখানে দেশের জন্য কাজ করছি। নিজের দেশের জন্য কাজ করতে পারাও অনেক গৌরবের।
নারী সৈনিক শারমীন আক্তার বলেন, গত বছর অক্টোবরে আমি এখানে এসেছি। চার মাস হয়ে গেছে। দেশে আমার শুধু মা আছেন। বাবা নেই। ভাই, বোন নেই। মাকে ছেড়ে এত দূরে আছি, দেশের জন্য কাজ করছি। এটা ভেবেই আমার ভালো লাগে। দিন শেষে যখন মায়ের কথা মনে পড়ে, তখন ফোনে, ভিডিও কলে কথা বলি। প্রযুক্তির কারণে দূরে থেকেই তাদের কাছে ফিল করি।
উল্লেখ্য, আফ্রিকার দেশ দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ১৯ সদস্যের একটি নারী কোম্পানি মোতায়েন করে। সেখানে নিয়োজিত নারী সেনাদের প্রথম ফিমেল এনগেজমেন্ট টিম হিসেবে মোতায়েন করা হয়। এরপর চলে গেছে তিন বছর। মোতায়েনের পর থেকে তাঁরা কন্টিনজেন্টের সঙ্গে স্বাভাবিক কার্যক্রমের পাশাপাশি স্থানীয় নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা এবং বিভিন্ন বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের নিজেদের সুরক্ষার পরামর্শ দিচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় কৃতিত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য গত বছর দক্ষিণ সুদানে কর্মরত ফোর্স কমান্ডারের প্রশংসাপত্র অর্জন করেছেন তারা। এই কৃতিত্বকে ধরে রেখে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যেতে চান তারা।