পদ্মা সেতু: সক্ষমতার প্রমাণ বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানের
নিউজ ডেস্ক
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সেতু পদ্মার মূল ভৌত কাঠামো, নদী শাসন, সংযোগ সড়কসহ সব কাজই হয়েছে বিশ্বমানের। চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড সেতুটি নির্মাণ করলেও এতে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশের বহু প্রকৌশলী ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ৩০ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে তার ২৫ শতাংশেরই যোগান এসেছে দেশের ভেতর থেকে।
প্রকল্পে ব্যবহৃত রড, সিমেন্ট, ইট ও বালুর পুরোটাই এসেছে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে। রডের ৮৬ ভাগের যোগানদাতা এককভাবে বিএসআরএমের। সিমেন্টের নেতৃত্ব দিয়েছে বসুন্ধরা ও হাইডেলবার্গ সিমেন্ট।
নদীশাসনে ৪ কোটিরও বেশি জিও ব্যাগের পুরোটাই দিয়েছে স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পে ব্যবহৃত ৫০০ কোটি ঘনফুটের বেশি বালি এসেছে সিলেটের মৌলভীবাজার থেকে।
সেতুতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্যের বিশ্বমান ও উৎপাদন সক্ষমতা শ্রেষ্ঠত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়েছে। সরেজমিন একাধিক পরিদর্শন এবং দেশি-বিদেশি ল্যাবে পরীক্ষা করে এসব উপাদানের গুণগত মান যাচাই করা হয়েছে। উৎপাদন সক্ষমতা খতিয়ে দেখা হয়েছে।
নির্মাণ সামগ্রীর পাশাপাশি সাবকন্ট্রাক্টে বহু কাজের অংশীদারও হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। দুই পাড়ের সংযোগ সড়কসহ নদী শাসনের কাজে মালয়শিয়ান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড।
কারিগরি সহায়তার হাজার কোটি টাকার বেশি প্রকল্পের অংশীদারিত্ব রয়েছে বুয়েটসহ দেশের আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের।
সেতু বিভাগের সচিব মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতুতে আমরা স্থানীয় যেসব ম্যাটেরিয়ালস ব্যবহার করেছি তার শতভাগ বিদেশী প্রকৌশলীদের দিয়ে মান নিয়ন্ত্রণ করা।’
তিনি বলেন, দেশীয় প্রতিষ্ঠান বিএসআরএমের স্টিলের মান বৈশ্বিক যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ভালো। সিমেন্টের ক্ষেত্রে বসুন্ধরা ও স্ক্যান সিমেন্টও মানে সর্বোৎকৃষ্ট। দেশে উৎপাদিত কংক্রিট মিক্স এবং অন্যান্য উপাদানও কয়েক দফা মান যাছাই করে ব্যবহারের সার্টিফিকেশন দিয়েছে চীনের প্রকৌশলীরা।
এক লাখ টন রডের পুরোটাই বাংলাদেশের
৩০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের সবচেয়ে বড় কাজ নদীর উপর ৬.১৫ কিলোমিটার সেতু নির্মাণ। এই দূরত্বকে ৪০টি ভাগে ভাগ করে ৪৩টি পিলারের উপর ৪২টি স্প্যান বসিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে পদ্মা সেতুর কাঠামো।
এই কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে স্টিল স্ট্রাকচারের স্প্যান বসানোতে। ৪২টি স্প্যানের সব কটিই চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে তৈরি করে জাহাজের মাধ্যমে এনে বসানো হয়েছে। প্রথম স্প্যানটি বসানো হয় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, আর শেষটি গত ১০ ডিসেম্বর।
নদীতে ৪৩টি ও ডাঙায় ৭৬টিসহ মোট ১১৮টি পিলারের পুরো রড, সিমেন্ট, কংক্রিট ও বালু সরবরাহ হয়েছে স্থানীয় সূত্র থেকে। রডের সিংহভাগ সাপ্লাই এসেছে বিএসআরএম স্টিল থেকে।
সংযোগ সড়কসহ পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ১ লাখ টন রড ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্য পিলার ও নদী শাসনে ৮৬ হাজার টন রডের একক যোগানদাতা বিএসআরএম লিমিটেড। বাকি রডও সরবরাহ করেছে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (সেতু) দেওয়ান মোহাম্মদ আব্দুল কাদের বলেন, ‘প্রকল্পে শুধু বিএসআরএম থেকেই ৯০ হাজার টনের বেশি রড ব্যবহার করেছি আমরা। এজন্য বিএসআরএম লিমিটেডের কারখানা কয়েকদফা পরিদর্শন করে মান যাছাই করা হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে বিএসআরএম’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর আমেইর আলিহুসাইন বলেন, প্রকল্পের চাহিদা অনুযায়ী তারা ৪০মিমি ও ৫০মিমি রড তৈরি করেছ। এই ধরণের রডের ব্যবহার বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশে প্রথমবার হয়েছে।
আমেইর বলেন, ইতোমধ্যেই তারা ৮০ হাজার টন রডের যোগান দিয়েছেন এবং প্রকল্পের যতোটুকু কাজ বাকী আছে তাতে আরও ৬ হাজার টন রড লাগবে।
বিএসআরএম এর পর পদ্মা সেতু প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি রডের যোগান দিয়েছে কেএসআরএম।
দেশের বাইরে থেকে কোনো সিমেন্ট আসেনি
প্রকল্পে ব্যবহৃত সিমেন্টের পুরোটার যোগানও এসেছে দেশি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে।
বসুন্ধরা গ্রুপের সিমেন্ট সেক্টরের প্রধান মার্কেটিং অফিসার খন্দকার কিংশুক হোসেন বলেন, দেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বাধুনিক ভিআরএম প্রযুক্তিতে তৈরি বসুন্ধরা সিমেন্টের ফ্যাক্টরি পরিদর্শন, উৎপাদন সক্ষমতা, সরবরাহ ব্যবস্থা ও সর্বোপরি গুণগত মানের নিশ্চয়তা যাচাই করে তা ব্যবহারের জন্য নির্বাচন করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
সেতুর মূল প্রকল্পের কাজ তিনটি- অ্যাপ্রোচ রোড, রিভার ট্রেনিং এবং মূল সেতু। প্রকল্পের অ্যাপ্রোচ রোডের শতভাগ করা হয়েছে বসুন্ধরা সিমেন্ট ব্যবহার করে। রিভার ট্রেনিংয়ের কাজেও বসুন্ধরা মূল সাপ্লাইয়ার। আর মূল সেতুতে স্ক্যান সিমেন্টের সঙ্গে বসুন্ধরার অংশীদারিত্ব ছিল।
খন্দকার কিংশুক জানান, সেতুর রেল সংযোগ লাইন নির্মাণে ৭ লাখ টন সিমেন্ট সরবরাহ নিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এটি সর্বোচ্চ সিমেন্ট সরবরাহের চুক্তি।
স্ক্যান ব্র্যান্ড সিমেন্টের প্রতিষ্ঠান হাইডেলবার্গ সিমেন্টের পরিচালক আশরাফুল আলম বাদল বলেন, ‘মূল ব্রিজের পাইলিংয়ের জন্য ২০১৫ সাল থেকে আমরা সিমেন্ট সরবরাহ করেছি। আমাদের সিমেন্ট নির্বাচনের আগে চীনের প্রকৌশলীরা বেশ কয়েকবার আমাদের কারখানা দেখেছেন। কয়েক দফায় সিমেন্টের মান যাছাই করেছেন। দেশ ও বিদেশের ল্যাবে যাছাইয়ে যর্থার্থতা প্রমাণের পরই আমাদের সঙ্গে চুক্তি হয়।’
নদী শাসনের কাজে চার লাখ টন সিমেন্ট সরবরাহ করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা সিমেন্ট। ক্রাউন সিমেন্টও দিয়েছে ৯ হাজার টন সিমেন্ট। সিমেন্ট এসেছে আবুল খায়ের গ্রুপের শাহ সিমেন্ট এবং সেভেন সার্কেল গ্রুপের সেভেন রিংস সিমেন্ট থেকেও।
পদ্মা সেতুর রিভার ট্রেনিং কাজে ব্যবহৃত হয়েছে ক্রাউন সিমেন্ট। এখানে ৯ হাজার টন সিমেন্ট সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য উৎপাদান ক্যাপাসিটি বাড়িয়েছে কোম্পানিটি।
ক্রাউন সিমেন্টের উপদেষ্টা মাসুদ খান বলেন, ভিআরএম প্রযুক্তিতে উৎপাদনের ফলে স্থানীয় সিমেন্ট ব্যবহার হয়েছে পদ্মা সেতুতে। এখন রেল ও সড়ক সংযোগেও বিপুল পরিমাণ স্থানীয় সিমেন্ট ব্যবহার হবে।
প্রকল্পে দেড় কোটি কংক্রিট ব্লক তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের সিমেন্ট দিয়েই।
প্রকল্পে খরস্রোতা পদ্মার নদী শাসন ছিল চ্যালেঞ্জিং কাজ। ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চীনের সিনো হাইড্রেড করপোরেশনের করা এ কাজেরও অধিকাংশ উপাদান এসেছে দেশের ভেতর থেকে।
নদীর তলদেশ খনন, ব্লক ও জিও ব্যাগ ফেলা ও পাড় বাঁধাইয়ের কাজেও ছিল স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাধান্য। ৪ কোটির বেশি বালুভর্তি জিও ব্যাগের সাপ্লাইয়ার দেশীয় প্রতিষ্ঠান DIRD Felt Ltd। নদী শাসন, মূল পিলার ও সংযোগ সড়কে ব্যবহৃত ৫০০ কোটি ঘনফুটের বেশি বালির পুরোটাই দেশের ভেতর থেকে সাপ্লাই দিয়েছে স্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। সিলেটের মৌলভীবাজার থেকে এসেছে এই বালু।
প্রকল্পে ব্যবহৃত পাথর অবশ্য এসেছে বিদেশ থেকে। নদী শাসনের জন্য ১১ লাখ ঘন মিটার ও মূল ব্রিজের জন্য ১০ লাখ ঘনমিটার পাথর এসেছে দুবাই, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে।
ঠিকাদারিতেও বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান
পদ্মা সেতুর মূল কন্ট্রাক্টর চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। নদী শাসন ও মূল সেতুর কাজে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
সাব কন্ট্রাক্টর হিসাবে আরো প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে বিশ্বের কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার কে এ সি, মালয়শিয়ান এইচসিএম জেভি, চীনের সিনোহাইড্রোর মতো প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করেছে বাংলাদেশের আব্দুল মোনেম লিমিটেড।
প্রতিষ্ঠানটি মাওয়া সংযোগ সড়কে এইচসিএম জেভির সঙ্গে যৌথভাবে ১৯৩ কোটি টাকা, জাজিরা সংযোগ সড়কে একই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় ১১০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। আর সার্ভিস এরিয়া- ২ নির্মাণে ২০৩ কোটি টাকার প্রকল্পের পুরোটাই করেছে আব্দুল মোনেম লিমিটেড।
প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সংযোগ সড়ক উন্নয়নের কাজে নিজেদের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করেছি আমরা। স্থানীয় ইট, বালু আর আমদানি করা বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকৌশলীদের পরামর্শ অনুযায়ী বিদেশী পাথরও ব্যবহার করতে হয়েছে এ কাজে।
সেতু বিভাগের সচিব মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, সেতুতে আব্দুল মোনেম লিমিটেড ছাড়াও বেশ কয়েকটি কোম্পানির সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করেছে।