অনাস্থা ভোটে হেরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বিদায় নিলেন ইমরান খান
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বহু নাটকীয়তার পর পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন ইমরান খান। গতকাল শনিবার সারাদিন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন তিন চার দফা মুলতুবি হবার পর পাকিস্তানে মধ্যরাতের পর অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
জাতীয় পরিষদের ৩৪২জন সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জন সদস্য তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ভোট দেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম একজন প্রধানমন্ত্রীকে অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হল। সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পর শনিবার সকালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসে। কিন্তু ভোটাভুটি গড়ায় মধ্যরাতের পর। এর মাধ্যমে পাকিস্তানে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের সরকারের শাসনামল শেষ হয়ে গেল।
জাতীয় পরিষদ নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে আগামী সোমবার আবার অধিবেশনে বসবে। অক্টোবর ২০২৩এ পরবর্তী নির্বাচন হবার কথা। তার আগে নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকবেন। মি. ইমরান খান অনাস্থা ভোটের আগে বলেন, তিনি বিরোধী সরকারকে স্বীকৃতি দেবেন না। তিনি বলেন আমেরিকার নেতৃত্বে ষড়যন্ত্র করে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হচ্ছে। যদিও এর পক্ষে কোন তথ্যপ্রমাণ তিনি দিতে পারেননি।
ভোট অনুষ্ঠানের কয়েক মিনিট আগে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার, ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ, আসাদ কায়সার পদত্যাগ করেন। মি. খানের পার্টির সদস্যরা ভবন ত্যাগ করে যান এবং জোর দিয়ে বলতে থাকেন যে ইমরান খান আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। ভোটাভুটি পরিচালনা করেন নাওয়াজ শরীফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ, পিএমএল-এন-এর আইয়ায সাদিক।
বিরোধী নেতা শাহবাজ শরীফ এক টুইট বার্তায় বলেন পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের সংসদ “অবশেষে গভীর সঙ্কট থেকে মুক্তি পেল”। তিনি আরও বলেন: “পাকিস্তানে নতুন প্রভাতের লগ্নকে অভিনন্দন।”
অনাস্থা ভোট হল যে পটভূমিতে
গত রবিবার এই প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইমরান খানের নিজের দল এই প্রস্তাব আটকে দেয়। এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ বিরোধী দলগুলো সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় এবং আবেদন জানায়, যেভাবে অনাস্থা প্রস্তাবটি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আটকে দেয়া হয়েছে, তা ছিল বেআইনি ও অসাংবিধানিক। এরপর প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পরামর্শে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট।
কিন্তু তার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট সুয়ো মোটো রুল জারি করে। সেই রুলের শুনানির পর সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দেয়, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধীদলের আনা অনাস্থা প্রস্তাবটি খারিজ করে জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি বেআইনি কাজ করেছেন, এবং এতে পাকিস্তানের সংবিধানের ৯৫ ধারা লঙ্ঘিত হয়েছে।
গত ৩রা এপ্রিল বিরোধী দলের এমপিরা জাতীয় পরিষদে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো। বিরোধীরা আশা করছিলেন, পার্লামেন্টে যেহেতু তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই কাজটা সফল হবে। কিন্তু সেদিন ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয় যখন জাতীয় পরিষদেরর ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি দ্রুত এই প্রস্তাব আটকে দেন। তিনি বলেন, সরকার ফেলে দেয়ার জন্য ‘একটা বিদেশি রাষ্ট্রের’ সঙ্গে ‘পরিষ্কার আঁতাত’ দেখা যাচ্ছে।
সংকট শুরু যেভাবে
পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইমরান খান ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০১৮ সালের জুলাইয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে। তখনও দেশটির সেনাবাহিনীর ভূমিকা তার বিজয়ের পথ তৈরি করে দিয়েছে- এমন কথাই প্রচলিত ছিলো।
পাকিস্তানকে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয়ে নেতৃত্ব দেয়া মি. খান ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই আর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে। কিন্তু বাস্তবতা হলো অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই ধীরে ধীরে বিপাকে পড়তে শুরু করে তার সরকার। এক পর্যায়ে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান নিয়োগ নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়ান তিনি।
আবার রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা শুরু করে, তখন তার মস্কো সফরও পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ভালো ভাবে নেয়নি। এর মধ্যেই তার ক্ষমতাসীন জোটের বড় অংশ এমকিউএম তাকে ছেড়ে বিরোধী জোটে যোগ দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারায় তার সরকার।
এ-ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেই ইমরান খান বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিলেন, এরা ‘বিদেশি রাষ্ট্রের’ সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তিনি আরও অভিযোগ করেছিলেন, এই ষড়যন্ত্রের পেছনে আছে যুক্তরাষ্ট্র, কারণ তিনি রাশিয়া এবং এবং চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এজন্যেই তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে বলে তিনি দাবি করেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই।
তবে ডেপুটি স্পিকার কাসেম সুরি রুল জারি করেন যে, এই অনাস্থা প্রস্তাব পাকিস্তানের সংবিধানের পঞ্চম অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছে, যেটিতে রাষ্ট্র এবং সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের কথা আছে।
এরপর ইমরান খান পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। এর ফলে ৯০ দিনের মধ্যে পাকিস্তানের পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান বিরোধী নেতারা। তারা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংবিধানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনেন। এরপরই তারা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করতে যান এই বলে যে, অনাস্থা ভোট আটকে দিয়ে সরকার তার সাংবিধানিক ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করেছে।
এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ বিরোধী দলগুলো সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় এবং তাদের আবেদনে বলা হয় যেভাবে অনাস্থা প্রস্তাবটি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আটকে দেয়া হয় তা ছিল বেআইনি ও অসাংবিধানিক।