সীতাকুন্ড: আগুন, উত্তাপ ও ধোঁয়া ছড়িয়েছে আড়াই বর্গকিলোমিটারজুড়ে - Southeast Asia Journal

সীতাকুন্ড: আগুন, উত্তাপ ও ধোঁয়া ছড়িয়েছে আড়াই বর্গকিলোমিটারজুড়ে

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়িতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আগুন, উত্তাপ ও ধোঁয়া প্রত্যক্ষভাবে ছড়িয়েছে আড়াই বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। আর এর দূরবর্তী প্রভাব পড়েছে ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর্থ জুমের স্যাটেলাইট ইমেজ বা ছবি বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানিয়েছেন স্কটল্যান্ডের ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন্দন মুখার্জি।

সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে গতকাল শনিবার রাত ১১টায়। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলের আশপাশের অন্তত চার বর্গকিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। ঘটনাস্থলে এখনো আগুন জ্বলছে। এ দুর্ঘটনায় অন্তত ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, কনটেইনার ডিপোটিতে ‘হাইড্রোজেন পারক্সাইড’ নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ছিল। হাইড্রোজেন পারক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। এটি যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে।

ঘটনাস্থলে থাকা প্রথম আলোর প্রতিবেদক জানিয়েছেন, বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় রাসায়নিকের বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। এতে উদ্ধারকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আশপাশের জনবসতিতে বাসিন্দারা নাখ-মুখ ঢেকে চলাচল করছেন।

নন্দন মুখার্জি জানান, আজ রোববার বেলা তিনটায় সীতাকুণ্ডের ওই ডিপো এলাকার ওপর দিয়ে বাতাস ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার বেগে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে যায়। ফলে আগুন, কালো ধোঁয়া ও উত্তাপের প্রভাব কুমিরা, বাড়বকুণ্ড ও সীতাকুণ্ড শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

বিএম কনটেইনার ডিপো এলাকা থেকে আগুনের প্রভাব যেদিকে বিস্তৃত হচ্ছে, সেই এলাকায় একটি সংরক্ষিত বনভূমি রয়েছে। এটি প্রতিবেশগতভাবে বিপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।

নন্দন মুখার্জি বলেন, বাতাসের গতিবেগ ও গতিমুখ বিবেচনা করে এবং স্যাটেলাইটের ইমেজ ব্যবহার করে আগুন ও প্রভাব নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে।

বিস্ফোরণের পর থেকে কালো ধোঁয়া আর রাসায়নিকের পোড়া গন্ধে অসুবিধায় পড়ার কথা জানিয়েছেন আশপাশের তিন গ্রামের বাসিন্দারা। পোড়া গন্ধে বেশি অসুবিধার কথা জানিয়েছেন শিশু ও বৃদ্ধরা। মুখে মাস্ক পরে থাকতে দেখা গেছে বেশ কয়েকজনকে।

কেশবপুর গ্রামের বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী লাকী আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পর থেকে কালো ধোঁয়া আর গন্ধে টিকতে পারছিলাম না। আতঙ্কে শিশুরা কান্না করছে সারাক্ষণ। বাড়ির বৃদ্ধদেরও খুব কষ্ট হচ্ছে।’

১৭ ঘণ্টায়ও নিয়ন্ত্রণে আসেনি আগুন, নিহত বেড়ে ৪১
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে লাগা আগুন ১৭ ঘণ্টায়ও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১। আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস ২৫টি দল।

রোববার বেলা তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়, আগুন লাগা কনটেইনারগুলোয় ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ওপর থেকে যন্ত্রের সাহায্যে পানি ছিটাচ্ছেন। কিছু কিছু জায়গায় জ্বলছে আগুন। আর কিছু জায়গায় উঠছে ধোঁয়া।

ডিপো পরিদর্শনে বন্দর চেয়ারম্যান
সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপো পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান। আজ রোববার তিনি ডিপো পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে ডিপোতে বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণসহ সর্বশেষ পরিস্থিতি কাছে তুলে ধরেন সংবাদ মাধ্যমের কাছে।

আজ সকাল নয়টার দিকে বন্দর চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি দল দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসে। বেলা ১১টা পর্যন্ত তারা ডিপো পরিদর্শন করে। এ সময় ডিপোতে আগুন জ্বলছিল। ডিপোতে এখনো অক্ষত থাকা হাইড্রোজেন পারক্সাইডসহ রাসায়নিক পণ্যভর্তি কয়েকটি কনটেইনার সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দেন বন্দর চেয়ারম্যান। মালিকপক্ষ ও কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। এম শাহজাহানের মতে, অক্ষত কনটেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ডিপোতে হাইড্রোজেন পারক্সাইডবাহী ২৬টি কনটেইনার ছিল। ডিপোর টিনশেডেও প্লাস্টিকের জারে এই রাসায়নিক ছিল। আগুন লাগার পর কনটেইনারে থাকা রাসায়নিকভর্তি জার ফেটে যায়। এতে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বের হয়ে কনটেইনারের সংস্পর্শে আসে। অক্সিজেন নির্গত হয়ে পানি ও আগুনের সংস্পর্শে কনটেইনারের ভেতরে তাপমাত্রা বেড়ে বিস্ফোরণ ঘটে। কনটেইনার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে স্প্রিন্টারের মতো তা ছড়িয়ে পড়ে। হাইড্রোজেন পারক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে।

এম শাহজাহান বলেন, এই ডিপোতে ‘আইএসপিএস কোড’ কমপ্লায়েন্স বা নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে। আইএসপিএস কোড হলো আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা প্রণীত বন্দর ও বন্দর-সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাসংক্রান্ত ব্যবস্থা। বিপজ্জনক পণ্য রাখার জন্য ডিপোতে আলাদা ইয়ার্ডও দেখেছেন তিনি।

বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দ্রুত দুর্ঘটনাকবলিত কনটেইনার ক্রেন দিয়ে সরিয়ে আলাদা জায়গায় রাখি। রাসায়নিক হলে পানির পরিবর্তে ফোম ব্যবহার করি। এখানে হাইড্রোজেন পারক্সাইডের মতো বিপজ্জনক পণ্যে আগুন লাগার পর ক্রেন দিয়ে কনটেইনার সরিয়ে নিলে দুর্ঘটনার ভয়াবহতা কমে যেত।’

বন্দর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কনটেইনার ডিপোগুলোর পরিচালন কার্যক্রম তদারক করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। আর নিরাপত্তাসংক্রান্ত কার্যক্রম তদারক করে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। ডিপোগুলো বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি হওয়া পণ্যবাহী কনটেইনার ব্যবস্থাপনা করে।

নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবার পাবে ২ লাখ টাকা
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে দুই লাখ টাকা সহায়তা দেবে সরকার। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে।

আজ রোববার শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এ ঘোষণা দেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে এই আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় আরও সহায়তার প্রয়োজন হলে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।

দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের উপমহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল সাকিব মুবারাত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে দ্রুত আর্থিক সহায়তা দিতে হতাহত শ্রমিকদের তথ্য সংগ্রহের জন্য ১৩ সদস্যের আরও একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
দুর্ঘটনায় সার্বিক শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে বিভাগীয় শ্রম দপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক এস এম এনামুল হক তিন সদস্যের আরও একটি কমিটি গঠন করেছেন।

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এ ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখপ্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় প্রতিমন্ত্রী নিহত ব্যক্তিদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন।

ফায়ার সার্ভিসের চার কর্মী নিখোঁজ
ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের আট কর্মী নিহত হয়েছেন। নিখোঁজ আছেন চারজন কর্মী। ওই ঘটনায় গুরুতর আহত দুই কর্মীকে চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় আনা হচ্ছে।

আজ দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেল থেকে পাঠানো এক খুদে বার্তায় বলা হয়, সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের নিহত কর্মীর সংখ্যা বেড়ে ৮ হয়েছে। ওই ঘটনায় চট্টগ্রামে সিএমএইচে অসুস্থ অবস্থায় ১৫ জন চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে গুরুতর আহত দুজনকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস ও প্রশিক্ষণ) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রেজাউল করিম আজ দুপুরে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের চারজন কর্মী নিখোঁজ। তবে এখন আগুন আর চারদিকে ছড়িয়ে নেই। আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে নেভানোর চেষ্টা চলছে।

গতকাল শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর রাত পৌনে ১১টার দিকে রাসায়নিকভর্তি একটি কনটেইনারে বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলের আশপাশের অন্তত চার বর্গকিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। আশপাশের বাড়িঘরের জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।