পাত্তর চাকমাদের গল্প... - Southeast Asia Journal
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

 

পারভেজ হায়দারঃ

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রিকন চাকমা ওরফে পাত্তর চাকমার বিষয়ে বেশ লেখালেখি হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমের পাত্তর চাকমার জীবনের ঐ অংশটাই আসছে যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে একটু জানার জন্য রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে পাত্তরদের বাড়ির আশে-পাশে একটু খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম, আমার সাথে ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পরিচিত হওয়া চাকমা সম্প্রদায়ের এক বন্ধু। পাত্তর চাকমা সম্পর্কে তার গ্রামের লোকজনদের কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করলে প্রথমে তারা মুখ খুলতেই চাইছিলো না, হয়তো চাকমা বন্ধুটির সাথে বাঙ্গালী হিসেবে আমিও ছিলাম সেজন্য। আমার চাকমা বন্ধুটি বিষয়টি বুঝতে পেরে আমাকে নানিয়ারচর সদরের একটি চায়ের দোকানে বসিয়ে নিজেই চলে যায় পাত্তর এর খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য। আর জেনে আসে রিকন ওরফে পাত্তর চাকমার জীবনের করুণ কাহিনী।

পাত্তর চাকমার বাবা রুপধন সামান্য রাজমিস্ত্রীর কাজ করে কোন রকমে সংসার চালান। দারিদ্রতার জন্য পাত্তরকে একটি বারের জন্যও স্কুলে পাঠানো তার সম্ভব হয়নি। পাত্তরের কৈশোর কেটেছে অন্যান্য দূরন্ত কিশোরদের মতো লেকে মাছ ধরে অথবা বাবাকে কাজে সহায়তা করে। এমন একটি সহজ-সরল দরিদ্র পরিবারের অসহায় ছেলেকেই হয়তো প্রসীত পন্থি ইউপিডিএফ খুঁজছিলো। দীর্ঘদিন যাবৎ ঐ দলের লোকজন তার গতিবিধি অনুসরণ করার পর একসময় তাদের দলে ভেড়ানোর জন্য ইউপিডিএফ’র বিলাশ চাকমার নেতৃত্বাধীন একটি সশস্ত্র দল তাকে জোর পূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। পাত্তরের বয়স তখন ১৬ কি ১৭। তাকে অপহরণ করেই ইউপিডিএফ ক্ষান্ত হয়নি, তার বাবার একমাত্র ফসলি জমিটিও কেড়ে নিয়েছিলো তারা। জীবন বাঁচানোর তাগিদে অসহায়ভাবে বিষয়টি মেনে নেওয়া ছাড়া পাত্তরের বাবার আর কোন কিছুই করার ছিলোনা। আমার চাকমা সম্প্রদায়ের বন্ধু (নিরাপত্তার কারণে নাম বলছি না) ঐ এলাকায় অনেকের সাথেই কথা বলে জানতে পারে ইউপিডিএফ’র সাথে কাজ করার জন্য পাত্তর একেবারেই রাজি ছিলো না। এজন্য ইউপিডিএফের সশস্ত্র গ্রুপের আস্তানা থেকে সে একাধিকবার পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলো। ইউপিডিএফ পাত্তরকে অপহরণ করার পর প্রথম ১০-১৫ দিন তাদের সশস্ত্র গ্রুপের প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত করে। এরপর তাকে ১৫-২০ দিনের জন্য সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছিলো। এরই মধ্যে পাত্তরের সাথে চিক্কো চাকমা নামের একটি মেয়ের প্রণয়ের সম্পর্ক থাকে। সেই সুবাদে সুযোগ বুঝে একদিন মেয়েটিকে নিয়ে সে চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় পালিয়ে যায়।

সৌভাগ্যক্রমে একটি বৈদেশিক কোম্পানীতে তার চাকরীও হয়। একসময় সে চিক্কো চাকমাকে বিয়েও করে, কিন্তু তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকে নি। চট্টগ্রামের ইপিজেড ও সংলগ্ন এলাকায় হাজার হাজার পাহাড়ী ছেলে-মেয়েরা চাকরীতে নিয়োজিত আছে। ইউপিডিএফ সমর্থিত অনেক কর্মীরই ঐ এলাকায় বিচরণ রয়েছে। প্রায় ৬-৭ মাস চাকরী করার পর কোন একদিন পাত্তর পিসিপির কয়েকজন কর্মীর নজরে পড়ে যায়। ইউপিডিএফের অঙ্গ-সংগঠন পিসিপির ছেলেরা পাত্তর ও তার স্ত্রী চিক্কোকে জোর করে নানিয়ারচর এলাকায় ধরে নিয়ে আসে। শুরু জয় পাত্তরের প্রতি অমানুষিক নির্যাতন। সবচেয়ে অমানবিক, বাস্তবতা বিবর্জিত নৃশংস যে ঘটনাটি ঘটে তা হলো, পাত্তর চাকমার বিয়ে করা ও সাত মাস সংসার করা স্ত্রী চিক্কো চাকমার উপর ইউপিডিএফের কর্মীরা ব্যাপকভাবে পাশবিক নির্যাতন চালায়। অনেকদিন নির্যাতনের পর কোন এক কর্মীর সাথে নামমাত্র বিয়ে দিয়ে চিক্কো চাকমাকে ঐ এলাকা থেকে অজানা কোন এক এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। পাত্তর চাকমা আর কখনোই জানতে পারেনা তার স্ত্রী চিক্কোকে কোথায় রাখা হয়েছে। জীবন বাচাঁনোর তাগিদে পাত্তর প্রায় ১ বছর ইউপিডিএফ সশস্ত্র দলের সাথে কাজ চালিয়ে যায়। কিন্তু এই দলটির প্রতি ঘৃনা তার মনের মধ্যে রয়েই গিয়েছিলো। তাই সে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিলো। কোন একদিন সে সেই মোক্ষম সুযোগ পেয়েও যায়।

সে পালিয়ে গিয়ে নানিয়ারচরের বৌদ্ধ বিহারে নিজের অবয়ব পরিবর্তন করে ভান্তের বেঁশ ধারণ করে। কিন্তু ইউপিডিএফ সশস্ত্র গ্রুপের বিলাশ চাকমা যেন তার পিছুই ছাড়ছিলো না। ক্রমাগত তাকে মোবাইল ফোনের মাধ্যেমে ফোন করে আবারো দলে যোগদান করতে বলে। পাত্তর চাকমা একসময় বাধ্য হয় তার সীম কার্ড ভেঙ্গে ফেলতে। কিন্তু তাতেও ক্ষান্ত হয়নি বিলাশ চাকমা ও কয়েন চাকমার লোকজন ২০১৭ সালের কোন একদিন নানিয়ারচরের বৌদ্ধ বিহার থেকে তাকে আবারো ধরে নিয়ে যায়। এবারো শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর পাত্তর আবারো পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকে। একদিন সে পালিয়ে গিয়ে রাঙ্গামাটির রাজবন বিহারে গিয়ে পুনরায় ভান্তের বেশ ধারণ করে। এরই মধ্যে ফেসবুকের মাধ্যেমে সোনাবি চাকমা নামের একটি মেয়ের সাথে তার পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে সে চট্টগ্রামে পালিয়ে গিয়ে শহরের একটি রেষ্টুরেন্টে ঝাড়ুদারের চাকরি নেয়। পরবর্তীতে স্থানীয় একটি বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে পাত্তর সোনাবি চাকমাকে কে বিয়ে করে। ছোটখাটো চাকরি, ছোট সংসার আর নিউমুরিং এলাকায় কষ্টসাধ্য জীবন এই নিয়ে মোটামুটি ভালোই যাচ্ছিলো পাত্তরের সময়। কিছুদিন আগে অচেনা কিছু লোক আবারো পাত্তরকে ধরে নিয়ে যায়। পাত্তরের জীবনের এই অধ্যায়ে কি ঘটবে তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উপজাতি দলগুলোর তাদের স্বজাতি ছেলে-মেয়েদের প্রতি এই নির্মমতা কবে শেষ হবে? মিতালী চাকমা, জোসনা চাকমা, ফাতেমা, ইতি চাকমার ঘটনাগুলো ইতিমধ্যে সকলের জানা। এর সাথে এখন নতুনভাবে যোগ হলো পাত্তর চাকমার বিয়ে করা স্ত্রী চিক্কো চাকমার নাম। বাংলাদেশের নারীবাদী সংগঠনগুলো কি একটু বিষয়টি বিবেচনায় আনবেন?

You may have missed