পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি কি স্থিতিশীল নাকি অস্থিতিশীল?
![]()
পারভেজ হায়দারঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ও জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্র সমূহে আর্টিকেল ও সংবাদ প্রকাশিত হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃত ও সঠিক সংবাদ সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা ও এলাকার দূর্গমতার কারণে অনেক কলাম লেখক ও নিউজ পোর্টাল পরিচালনাকারী ব্যক্তিবর্গ জেলা সদরে তাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই সংবাদ প্রচার করে থাকেন। অনেকক্ষেত্রে বিশ্লেষনধর্মী কোন আর্টিকেল হলে লেখকগণ সাধারণত সাম্প্রতিক অতীতে সংগঠিত ঘটনাপ্রবাহের উপর বিশ্লেষন করে কলাম লিখে থাকেন। এছাড়া লেখকের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক পছন্দও তার লেখাকে প্রভাবিত করে। সাম্প্রতিক সময়ে একটি দৈনিক ও অনলাইন পোর্টালে পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীলতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। একই সাথে এটাও বলা হচ্ছে যে, আঞ্চলিক উপজাতি দলসমূহ ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমন চালাতে পারে। হ্যাঁ, যেকোন কিছুই ঘটতে পারে। এ ধরণের ঘটনা যে একেবারেই ঘটবেনা তা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে বিশ্লেষনধর্মী কলাম লিখার ক্ষেত্রে যৌক্তিক সমর্থনমূলক তথ্য থাকা বাঞ্চনীয়। বিষয়টি একটু যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষন করা যাক। গত ছয় মাসের উল্লেখযোগ্য সংবাদের শিরোনাম সমূহ এক জায়গায় সন্নিবেশিত করলে নেতিবাচক অনেক মন্তব্য করা যাবে। একই ধরণের ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সমতলের জেলাগুলোতেও অহরহ ঘটছে। তবে এটা ঠিক, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির ধরণ অন্য যেকোন এলাকার চেয়ে আলাদা, কিন্তু যৌক্তিক সমর্থন ব্যতীত সংবাদ প্রচার করলে তা জনমনে ভীতির সঞ্চার করতে পারে এবং একই সাথে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাসমূহ বিভ্রান্ত হতে পারে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতি ও সশস্ত্র দলগুলোর কার্যক্রম সবসময় অধিক গুরুত্ব প্রাপ্তির দাবি রাখে। তবে কোন বিষয়ে শেষ করে নিরাপত্তাজনিত ব্যাপারে কোন মন্তব্য করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র ও ঘটনাপ্রবাহ বিরাজমান কি-না, এ বিষয়টি আমলে নেয়া উচিত। প্রকৃতপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলগুলোর অধিকাংশই নিজ নিজ দলের ব্যর্থতার কারণে অস্থিতিশীলতায় ভূগছে। নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, সন্তু লারমার জেএসএস এর নেতা-কর্মীগণ সাম্প্রতিক সময়গুলোতে নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতায় কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে জঙ্গী চাকমার নেতৃত্বাধীন একটি দল রাঙ্গামাটি সদর ও সংলগ্ন এলাকা থেকে কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপসহ আলাদা হয়ে রাইখালীর দিকে গমণ করলে সন্তু লারমার আস্থাভাজন অন্য একটি দল জঙ্গী চাকমাসহ আরো কয়েকজনকে হত্যার মাধ্যমে উদ্ভূত পরিস্থিত নিয়ন্ত্রনে আনতে সক্ষম হয়। তবে জেএসএস নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজমান রয়েছে বলে সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। এদিকে জঙ্গী চাকমার ছেলে কল্যাণ চাকমা রাঙ্গামাটি সদরে তার বাবার হত্যাকান্ডের ঘটনায় দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিবর্গকে আসামী করে মামলা দায়ের করে বলে জানা যায়। জেএসএস দলের অনেকেই সেই মামলা থেকে গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে শোনা গেছে। কিছুদিন পূর্বে সন্তু লারমার জেএসএস’র প্রধান চাঁদা সংগ্রাহক জ্ঞান শংকর চাকমা র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। এছাড়া সশস্ত্র গ্রুপের কোম্পানী কমান্ডার চার্মিং চাকমা, পূর্নাঙ্গ চাকমাসহ বেশ কয়েকজন কর্মী জেএসএস সংস্কার দলে যোগদান করেছে বলেও সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
রাঙ্গামাটি শহরের অনেক ব্যবসায়ী মন্তব্য করেছেন, তারা চাঁদার টাকা দেওয়ার লোক খুঁজে পাচ্ছেন না। সূত্রে জানা যায়, সন্তু লারমার জেএসএস এর সশস্ত্র দলসমূহ সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন দূর্গম স্থানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অপরদিকে সন্তু লারমার আস্থাভাজন বাঘাইছড়ি এলাকার সশস্ত্র দলটি গত ১৮ই মার্চের নির্বাচন সংক্রান্ত হত্যাকান্ডে আসামী হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় এলাকা ত্যাগ করেছে। এছাড়া রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি হত্যা মামলায় জেএসএস’র সেখানকার নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছেন বলেও জানা যায়। সর্বোপরি সন্তু লারমার জেএসএস’র মধ্যে যে, অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে তা সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ সমূহে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, সন্তু লারমার জেএসএস’র আভ্যন্তরীন কোন্দলের অন্যতম প্রধান কারণ হলো, প্রসীত পন্থি ইউপিডিএফের সাথে ঐক্য প্রচেষ্টা। সন্তু লারমার জেএসএসর বড় অংশই ইউপিডিএফের সাথে ঐক্য প্রচেষ্টায় আগ্রহী নয়। তবে সন্তু লারমার ইচ্ছা অনুসারে ইউপিডিএফের সাথে এলাকাভিত্তিক এক প্রকার সমঝোতা করে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাগড়াছড়ি জেলায় নিরাপত্তাবাহিনীর কার্যকরী অভিযান সাফল্যের কারণে প্রসীত পন্থি ইউপিডিএফ ভালো অবস্থানে নেই। তাদের নেতা-কর্মীদের কাউকেই জেলা সদর ও উপজেলা সদর এলাকায় দেখা যায়না। তবে তাদের সশস্ত্র দলসমূহ লক্ষ্মীছড়ি এলাকা, পানছড়ির পুঁজগাং ও সীমান্তবর্তী এলাকা, বাঘাইহাটের লক্ষ্মীছড়ি ও ভূয়াছড়ি, বাঘাইছড়ির করেঙ্গতলী ও মারিশ্যাসহ অন্যান্য কিছু দূর্গম এলাকায় অবস্থান করে থাকে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ইউপিডিএফ সশস্ত্র দলসমূহের বিরুদ্ধে নিরাপত্তাবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গত সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ সাম্প্রতিক সময়গুলোতে জেএসএস সংস্কার ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সরকারী দলের পক্ষে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছে। এমনকি অন্যান্য সময়ের মতো গত ৭ই মে ইউপিডিএফ দলের প্রধান জালোয়া চাকমা তরু সংবাদ সম্মেলন ডেকে সরকারকে সর্বাত্নক সহযোগীতা ও শান্তিচুক্তির পূর্ন বাস্তবায়নের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।
সার্বিক বিষয় বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি সরকারের নিরাপত্তাবাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে মায়ানমার আর্মি ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান যুদ্ধ, রোহিঙ্গা সমস্যা, এএলপি, এমএলপি ও এমপিএইচপিপি ইত্যাদি দলসমূহ সংক্রান্ত জটিলতায় অদূর ভবিষ্যতে বান্দরবান ও সীমান্ত এলাকা সমূহে বেশ কিছু নতুন সমস্যার উদ্ভব হতে পারে বিধায় সরকারের উচিত সার্বিক বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল অনুধাবন করে গবেষণাপ্রসূত কোন কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেওয়া। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীলতার বিষয়ে যৌক্তিক সমর্থনমূলক তথ্যসহ প্রতিবেদন প্রচার করা উচিত কারণ, বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে ইউপিডিএফ-জেএসএস সশস্ত্র দলসমূহ দূর্গম স্থানে অবস্থান করতে বাধ্য হওয়ায় এবং রাজনৈতিকভাবে তাদের দূর্বল অবস্থানের কারণে বিভিন্ন ভাবে তারা অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। একই সাথে প্রসীত পন্থি ইউপিডিএফ, জেএসএস সংস্কার পন্থি দলের একাংশকে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দলকে অসহযোগীতাসহ তাদের সাথে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দিয়েছে বলে সূত্রে জানা যায়। কিন্তু জেএসএস সংস্কারের পক্ষ হতে ইতিবাচক কোন সাড়া দেওয়া হয়নি বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি সব সময় নজরদারিতে রাখা উচিত তবে, বর্তমান পরিস্থিতি অবশ্যই সরকার ও নিরাপত্তাবাহিনীর পূর্ন নিয়ন্ত্রনে রয়েছে।