পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন সশস্ত্র সংগঠন গড়ে উঠার কারণ কী?
আবুল খায়ের
*পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬ টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় বঞ্চিত
পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পিসিজেএসএস নামে একটি দল থাকলেও বর্তমানে ৬টি দল সক্রিয় রয়েছে। ৬টি দলেরই সশস্ত্র শাখার সদস্যদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে সশস্ত্র সংঘাত ক্রমশ বাড়ছে।
সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি নতুন সশস্ত্র সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং তারা পার্বত্য ৩ জেলার নয়টি উপজেলার স্বায়ত্ত্বশাসন দাবি করছে।
সংগঠনটির ফেইসবুক পেইজের পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ছোট ছোট ৬ টি জাতিগোষ্ঠী যেমন-বম, খুমি, লুসাই, পাংখোয়া, ম্রোও খিয়াং এর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করছে বলে প্রকাশ করে।
উল্লেখ্য, ৬ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিজেদের কুকি-চিন জাতি হিসেবে দাবি করে। তারা বিভিন্ন পোস্টে ব্যক্ত করেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে জেএসএস (মূল) এর অত্যাচার ও নির্যাতনে তারা আজ প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। জেএসএস (মূল) দলে চাকমা সম্প্রদায়ের আধিপত্য থাকায তারা এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। এরূপ পরিস্থিতি হতে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষ্যে তারা জেএসএস এর বিরুদ্ধে কেএনএফ নামে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছে বলে ব্যক্ত করেছে।
অন্যদিকে, মারমা জাতির অধিকার আদায় এবং আঞ্চলিক রাজনীতি ও সরকারি-বেসরকারি সকল সেক্টরে চাকমা সম্প্রদায়ের আধিপত্য ও স্বেচ্ছাচারিতা হতে মুক্তি লাভের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা সম্প্রদায়ের যুবকরা মারমা ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এমএনপি) গঠন করেছে এবং জেএসএস (মূল) এর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে।
দেশে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি ও সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে পার্বত্য ৩ জেলার ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠী আরও পিছিয়ে পড়েছে এবং বড় জাতিগোষ্ঠীর আধিপত্যের কারণে রাজনীতি ও সরকারি চাকরিসহ সকল ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এরূপ পরিস্থিতি হতে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষ্যে সশস্ত্র দল কেএনএফ ও এমএনপি গঠিত হয়েছে বলে স্থানীয় সচেতন মহল মনে করেন।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য রেমলিয়ান পাংখোয়া বলেন, পাংখোয়া এখন দেশের বিলুপ্ত প্রায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। গত ৫০ বছরে পাংখোয়া সম্প্রদায়ের বিসিএস ক্যাডারে কোনো প্রতিনিধি নেই। তাহলে কি আমরা উচ্চ শিক্ষায় পিছিয়ে আছি? উচ্চ শিক্ষায় বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো আমরা ভর্তির কোনো সুযোগ পাচ্ছি না। এজন্য বিদ্যমান কোটাতে পাংখোয়াদের বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে।
পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জেএসএস (সংস্কার), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মারমা ন্যাশনালিস্ট পার্টি( এমএনপি) ও কেএনএফ এই ৬ টি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে নিয়মিত হত্যা, অপহরণ ও সশস্ত্র সংঘাত সংঘটিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ আজ পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দাপটে ও গণহারে চাঁদাবাজির কারণে অসহায় হয়ে পড়েছে।
জনশুমারি-২০২২ অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে সাড়ে আঠারো কোটি মানুষের বসবাস। তারমধ্যে পার্বত্য বাঙালির সংখ্যা ৯ কোটির (৫০ শতাংশ) উপরে। পার্বত্য বাঙালিদের শিক্ষার হার মাত্র ২৩ শতাংশ। যেখানে চাকমা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার হার ৪৫ শতাংশ। পার্বত্য বাঙালি জনগোষ্ঠী শিক্ষা ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে থাকলেও তাদের কোন কোটা সুবিধা নেই। পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কোটার পরিবর্তে পার্বত্য কোটা ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ বলেন, কোটার বেশির ভাগ সুবিধা একচেটিয়াভাবে চাকমা এবং কিছু ক্ষেত্রে মারমা ও ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা পাচ্ছে। পার্বত্যাঞ্চলের বাকি ১০-১১ টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বঞ্চিত।
তিনি আরও বলেন, পাহাড়ের দুর্গম ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বসবাস করেও পার্বত্য বাঙালি জনগোষ্ঠী কোটা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। পার্বত্য বাঙালিরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। পার্বত্যাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে বাঙালিদের জন্য কোটা সুবিধা অর্ধেক হওয়া উচিত। বাঙালিরা এখানে অবহেলিত, প্রান্তিক এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এজন্য পিছিয়ে পড়া ও বঞ্চিত পাহাড়ি-বাঙালিদেরও কোটার আওতায় আনতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সুষমা উন্নয়ন ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল স্রোতে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা সুবিধা রাখা হলেও এই অঞ্চলের ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীর লোকজন প্রত্যাশিত সুবিধা পাচ্ছে না। পার্বত্যাঞ্চলে পার্বত্য বাঙালিসহ ১৩ টি জাতিগোষ্ঠীর সমান উন্নয়ন নিশ্চিত করতে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা কী নতুন করে বৈষম্য তৈরি করছে? তাহলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে কী আরও প্রান্তিক করে ফেলছে?