পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালীদের আঞ্চলিক রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে? – পর্বঃ ৩
![]()
ফিচার ডেস্কঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাঙ্গালীদেরকে ঘিরে বিভিন্ন মহল থেকে পরস্পরবিরোধী মূল্যায়ন পাওয়া যায়। পাহাড়ীদের একাংশ, যারা সক্রিয়ভাবে আঞ্চলিক রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত তারা বাঙ্গালীদের বড় একটি অংশকে “সেটেলার” বলে দাবি করে। তারা পার্বত্য অঞ্চলকে একটি “বিশেষ অঞ্চল” বলে প্রতীয়মান করে, বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো সকল নাগরিকদের প্রচলিত অধিকারের বিষয়টি মানতে চায়না। অপরদিকে বাঙ্গালীদের মধ্যে যারা সক্রিয় আঞ্চলিক রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত তারা বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সকল নাগরিকের অধিকার সমান, এমন যৌক্তিক দাবি করছে। এছাড়া গত শতকের ৮০’র দশকে তৎকালীন সরকার প্রদত্ত যেসকল ভূমি অসহায় বাঙ্গালীদেরকে বন্দোবস্তি দেয়া হয়েছে তার পূর্নবাস্তবায়নসহ সম অধিকার চায় তারা। তবে আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাঙ্গালীদের অধিকার নিয়ে যারা কাজ করে তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত। বাঙ্গালীদের মধ্যে এই অনৈক্যর সুযোগ নিচ্ছে উপজাতি আঞ্চলিক দলগুলো। অপরদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে সাধারণ উপজাতিদের মধ্যে যে পরিমান আগ্রহ রয়েছে বাঙ্গালীদের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে গুনগতমান ধরে রাখার বিষয়ে ঐ পরিমান আগ্রহ নেই। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা সরকার প্রদত্ত বিশেষ কোটা সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি নিজ যোগ্যতাতেও দেশে ও বিদেশে সুনামের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। অপরপক্ষে বাঙ্গালীরা আন্তঃকলহ, গুনগত শিক্ষা অনুপস্থিতি এবং সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেইভাবে এগুতে পারছে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন অবস্থানের পরেও বাঙ্গালীদের মধ্যে থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের গুনগত নেতৃত্ব বেড়ে উঠার ক্রমধারা মন্থর গতিতে এগুচ্ছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থিতিশীলতা অনয়নে বাঙ্গালীদের মধ্যে থেকে যোগ্য নেতৃত্ব এবং বাঙ্গালী ভিত্তিক আঞ্চলিক দলের ঐক্যবদ্ধ সক্রিয় কর্মকান্ড একান্ত প্রয়োজন।
সাউথইস্ট জার্নালের পক্ষ হতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালীদের মধ্যে থেকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে যারা উল্লেখযোগ্য ভাবে সম্পৃক্ত তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজকের ৩য় পর্বে পার্বত্য অধিকার ফোরামের অঙ্গ-সংগঠন বৃহত্তর পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি শাখার সভাপতি মোঃ জাহিদুল ইসলামের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হলো। তিনি খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে চট্টগ্রাম ল-কলেজে অধ্যায়ন করছেন।
সাউথইস্ট জার্নালের সাথে তার কথোপকথন নিম্নরুপঃ
সাউথইস্ট জার্নাল: বর্তমানে পাহাড়ে বাঙ্গালীদের রাজনীতির বর্তমান গুনগত মান এবং এর ভবিষ্যৎ কি বলে মনে করেন?
জাহিদ: আমার মতে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের গুনগত মান যৎসামান্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের অখন্ডতা রক্ষায় সংগঠনগুলোকে এগিয়ে নিতে হবে এবং মেধাভিত্তিক ছাত্রদের বাঙ্গালী সংগঠনগুলোতে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর মেধাবী ছাত্ররা সম্পৃক্ত না হলে এই রাজনীতি বেশীদূর এগুবে না বলে আমি মনে করি।
সাউথইস্ট জার্নাল: বাঙ্গালীদের যে আঞ্চলিক রাজনীতি আছে সেটার সাথে জাতীয় রাজনৈতিক দলের কোন সাংঘর্ষিক অবস্থা আছে কি? অনেকেই মনে করেন ইতিপূর্বে বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অনেকের সাথেই বিএনপি-জামাতের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
জাহিদ: আঞ্চলিক বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর সাথে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কোন সাংঘর্ষিক অবস্থান নেই। পূর্বে যারা বাঙ্গালী ছাত্রপরিষদের জন্ম দিয়েছেন তাদের সাথে জামাত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা ছিলো বলে আমি জানি। কিন্তু যেহেতু আমরা এত বড় বড় আন্দোলন করছি, যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নতুনভাবে সংগঠনকে ঢেলে সাজিয়েছি। যারা ক্লীন ইমেজের আছেন, যারা বাঙ্গালীদের জন্য সত্যিকার অর্থে কাজ করেন, যারা ফায়দা লোটার জন্য কাজ করে না, যারা বাঙ্গালীর ভালো চায় তাদের সম্পৃক্ত করে আমরা নতুনভাবে এগিয়ে যাচ্ছি।
সাউথইস্ট জার্নাল: অনেক বাঙ্গালী আছে যারা আঞ্চলিক রাজনীতি করে, তাদের বিরুদ্ধেতো এলাকার জনগনই মামলা করেছে, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির কারণে! এবিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
জাহিদ: অনেকেই মন্তব্য করে আমরা চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের সাথে জড়িত, আসলে এসব মন্তব্য যারা করেন তারা কেউ বুঝে আবার কেউ না বুঝে করেন। আমরা আসলে তাদের সেভাবে মেসেজটা দিতে পারি না যে, আমরা জাতির জন্য, আপনার জন্য কাজ করতেছি। যখনই আমাদের কাজের পরিধি তাদের মাঝে পৌঁছাবে তখনই তারা বুঝতে শিখবে যে আসলে আমরা চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসী না বরং তাদের জন্য কাজ করছি। ভুল ধারণা দূর হবে।
সাউথইস্ট জার্নাল: আপনার কাছে কি মনে হয়, বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর মধ্যে যে বিভেদ আছে সেগুলি একসময় ঐক্যে রুপান্তর করা সম্ভব?
জাহিদ: বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর মধ্যে বর্তমানে যে বিভেদ-ফাঁটল আছে তা দূর করে ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব বলে আমি মনে করি। যারা ঐক্য প্রক্রিয়ায় বাঁধা সৃষ্টি করছে তাদেরকে চিহ্নিত করে আলাদা করতে পারলেই ঐক্য সম্ভব।
সাউথইস্ট জার্নাল: স্থানীয় অনেকেরই শঙ্কা, বাঙ্গালী আঞ্চলিক রাজনীতির নামে আরেকটি চাঁদাবাজ ইউপিডিএফের সৃষ্টি হলো কি না? এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
জাহিদ: পাহাড়ে আমাদের অনেক প্রতিপক্ষ আছে যারা আমাদের কাজ বন্ধ করার জন্য, আন্দোলন সংগ্রামে বাঁধা দেবার জন্য আমাদের নামে বিভিন্ন জায়গায় কুৎসা রটায় যার কারণে কিছু কিছু লোক মনে করে বাঙ্গালি সংগঠনের নামে নতুন কোন ইউপিডিএফ জন্ম নিলো কিনা? সবার সামনে এই বিষয়টা যখন পরিস্কার হয়ে যাবে তখন আর এই ধরণের মনোভাব থাকবে না।
সাউথইস্ট জার্নাল: বাঙ্গালী সংগঠনগুলোতে শিক্ষিত ও উন্নত মানসিকতার কর্মীর অভাব রয়েছে কি?
জাহিদ: বাঙ্গালী সংগঠনগুলোতে যথেষ্ট শিক্ষিত লোকবলের অভাব রয়েছে, কারণ শিক্ষা ও আঞ্চলিক রাজনীতির দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। বাঙ্গালী আন্দোলন গতিশীল করতে হলে অবশ্যই মেধাবী ছাত্র তৈরী করতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে হবে।
সাউথইস্ট জার্নাল: গ্রাম পর্যায়ে যারা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে তাদের বিষয়ে আপনাদের কোন পদক্ষেপ আছে কি ?
জাহিদ: আমরা গ্রাম পর্যায়ে যারা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে তাদের সহায়তা ও উন্নয়নের জন্য কাজ করছি। কারণ জাতির উন্নয়নের জন্য সুশিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষিত না হলে এ জাতির উত্তোরণ সম্ভব নয়।
সাউথইস্ট জার্নাল: শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেতে আপনাদের গ্রাম পর্যায়ে কোন পরিসংখ্যান কমিটি আছে কি না?
জাহিদ: শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেতে আমরা ইতিমধ্যে গ্রাম পর্যায়ে একটা পরিসংখ্যান শুরু করেছি, শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে আমরা কাজ করছি। ছাত্র কল্যাণ ফাউন্ডেশন নামে আমরা একটা টিম গঠন করেছি যার মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
সাউথইস্ট জার্নাল: বাঙ্গালীদের ও বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর মানোন্নয়নে আপনি কি স্বপ্ন দেখেন?
জাহিদ: বাঙ্গালীদের মানোন্নয়নে আমি স্বপ্ন দেখি, বাঙ্গালীদের মানোন্নয়নে ও শিক্ষাক্ষেত্রে সরকার যদি একটু সহায়তা করে তাহলে বাঙ্গালীরাসুশিক্ষিত হয়ে জাতিকে নেতৃত্ব সুযোগ পাবে, আমি স্বপ্ন দেখি এ জাতি একদিন সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের নেতৃত্ব দিবে।
সাউথইস্ট জার্নাল: চাকমা সমাজে দেখা যায়, বর্তমানে ২০-২৫ জন পিএইচডি হোণ্ডার আছেন যারা দেশে-বিদেশে কর্মরত আছেন। বাঙ্গালীদের শিক্ষার গুনগত মান ঐ পর্যায়ে যেতে পারছে কি না, যে পর্যায়ে গেলে কার্যকরী নেতৃত্ব দিতে পারবে?
জাহিদ: আপনি দেখেন, পাহাড়ে সরকারী সুযোগ সুবিধা ভোগ করে শিক্ষা-চাকরী, রাজনীতি ও সামাজিক ভাবে উপজাতিরা অনেক এগিয়ে গেছে, সেদিক থেকে আমরা কোন সাপোর্ট পাচ্ছি না। এখানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আসলে আমরাই। কোটাসহ না সুবিধা না থাকায় বাঙ্গালীরা শিক্ষায় এগুতে পারছেনা। পাহাড়ী-বাঙ্গালী উভয়কে সমান সুযোগ দিলেই বাঙ্গালীরা এগিয়ে যেতে পারবে।
সাক্ষাৎকারের ভিডিও: