ইউরেনিয়াম যুগে বাংলাদেশ
নিউজ ডেস্ক
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান পাবনার রূপপুরে পৌঁছেছে। গতকাল শুক্রবার বিশেষ নিরাপত্তায় ঢাকা থেকে এ ইউরেনিয়াম রূপপুরের প্রকল্পে নেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাল বাংলাদেশ। এরই মধ্যে বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার ক্লাবের ৩২তম গর্বিত সদস্য হয়েছে। আগামী বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে পারে।
রাশিয়া থেকে বিশেষ বিমানে বৃহস্পতিবার এ পারমাণবিক জ্বালানির প্রথম চালান ঢাকায় আসে। সড়কপথে তা বিশেষ নিরাপত্তায় রূপপুরে নেওয়া হয়। নির্বিঘ্নে যাতে এ ইউরেনিয়াম পরিবহন করা যায়, সে জন্য গতকাল ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকা-পাবনা মহাসড়কে বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, ইউরেনিয়াম দেশে পৌঁছানোর মাধ্যমে নতুন যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। আগামী ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে রূপপুর কর্তৃপক্ষের হাতে এ জ্বালানি হস্তান্তর করা হবে।
ভার্চুয়ালি এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুক্ত থাকবেন। এতে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি, রূপপুরে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী রাশিয়ার রসাটমের মহাপরিচালক আলেপি লিখাচেভ প্রমুখ উপস্থিত থাকবেন।
ইউরেনিয়াম জ্বালানি কী
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম-২৩৮ ও ইউরেনিয়াম-২৩৫–এ দুই আইসোটোপ ব্যবহৃত হয়। খনিতে প্রাপ্ত আকরিকে প্রথমটি ৯৯ দশমিক ৩ শতাংশ পরিমাণে থাকলেও দ্বিতীয়টি থাকে মাত্র ০.৭ শতাংশ। চুল্লিতে ফিউশন বিক্রিয়ায় অংশ নেয় মূলত ইউরেনিয়াম-২৩৫। জ্বালানিতে এর পরিমাণ ৫ শতাংশ পর্যন্ত থাকতে হয়। এ জন্য কারখানায় নানা প্রক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয়।
সাইবেরিয়ায় যেভাবে তৈরি হচ্ছে জ্বালানি
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত রাশিয়ার সাইবেরিয়ার নভোসিবিরস্ক কেমিক্যাল কনসেন্ট্রেটস প্লান্টে (এনসিসিপি) রূপপুরের জ্বালানি প্রস্তুত হচ্ছে। এটি রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রসাটম নিয়ন্ত্রণ করে। কারখানাটিতে ইউরেনিয়াম ডাই-অক্সাইডকে নানা ধাপে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে ছোট ছোট প্যালেট তৈরি করা হয়। প্যালেটগুলো প্রায় চার মিটার লম্বা ফুয়েল রডের মধ্যে রাখা হয়। রূপপুরের জন্য তৈরি একটি রডে ৩১২-৩১৩ টার মতো প্যালেট থাকে। ৩২০টি রড নিয়ে একটা ফুয়েল অ্যাসেমব্লি গঠিত হয়। রূপপুরে একটি চুল্লতে এমন ১৬৩ অ্যাসেমব্লি বসানো হবে। ইউরেনিয়াম জ্বালানির জীবনকাল সাত বছর। একবার বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর পর একবারে সব অ্যাসেমব্লি পরিবর্তন করা হয় না। নির্দিষ্ট সময় পর পর ৩০ শতাংশ করে ফুয়েল পরিবর্তন করা হয়। এভাবে ধাপে ধাপে সব অ্যাসেমব্লি বদলানো হয়।
রোসাটম রূপপুরের জন্য প্রথম তিন বছর জ্বালানি বিনামূল্যে সরবরাহ করবে। প্রথম ইউনিটের জন্য সাত ধাপে ১৬৮টি ফুয়েল অ্যাসেমব্লি (জ্বালানি) আনা হবে, যার প্রথম কার্গো বৃহস্পতিবার দেশে পৌঁছেছে। প্রথম তিন বছর প্রতি ১২ মাস পরপর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জ্বালানি পরিবর্তন করে নতুন জ্বালানি লোড করা হবে। পরবর্তী বছরগুলোতে জ্বালানি পরিবর্তন করা হবে ১৮ মাস পরপর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম জানান, দুই ইউনিটের জন্য ১৮ মাসে ২৫ টন ইউরেনিয়াম লাগবে। তিনি বলেন, বর্তমান বাজারদর অনুসারে ২৫ টন ইউরেনিয়ামের দাম প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, , গ্রিডলাইন প্রস্তুত হওয়ার পরই চুল্লিতে জ্বালানি লোড করা হবে। এরপর বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে দুই মাস লাগবে। উৎপাদন শুরুর পর পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে ৯-১০ মাস লাগবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শৌকত আকবর বলেন, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) নির্দেশনা মেনেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আমদানি, পরিবহন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে।
বিশেষ নিরাপত্তায় রূপপুরে ইউরেনিয়াম
ফুয়েল পরিবহনের কনভয়টি ভোর ৫টায় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়। পথে এক ঘণ্টা যাত্রাবিরতিসহ ৮ ঘণ্টা ১৮ মিনিট পর দুপুর ১টা ১৮ মিনিটে পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছায়। ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে নাটোরের বনপাড়া ও পাবনার ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়া দিয়ে এ ইউরেনিয়াম নেওয়া হয়। পরিবহনে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিশেষ নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন।
শুক্রবার সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে সিরাজগঞ্জের পাঁচিলায় ট্রাক টার্মিনালে বিশ্রাম নেয় কনভয়টি। দুপুর সাড়ে ১২টার সময় ঈশ্বরদীতে প্রবেশ করে। ইউরেনিয়াম বহনকারী বিশেষ কাভার্ডভ্যানগুলো দুপুর দেড়টার দিকে ২ নম্বর গেট দিয়ে রূপপুর প্রকল্পের ভেতরে ঢোকে। এ সময় প্রকল্পের অভ্যন্তরে হাজার হাজার দেশি-বিদেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী বাংলাদেশ ও রাশিয়ার পতাকা হাতে বহরটিকে স্বাগত জানান।
ইউরেনিয়াম আসার খবরে সকাল থেকেই মহাসড়কের পাশে দলে দলে মানুষ জড়ো হন। অনেকে ভবনের ছাদে, রাস্তার পাশে, গাছের ডালে চড়েও ইউরেনিয়াম বহনকারী গাড়িকে স্বাগত জানান।
আর্থিক বিবেচনায় দেশের একক প্রকল্প হিসেবে সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এ প্রকল্পের ৯০ শতাংশ অর্থ ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া, যেটা ২৮ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। রোসাটমের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটোমসট্রয় এক্সপোর্ট। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি প্রায় ৭৪ শতাংশ। দুটি ইউনিটে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট করে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।