বান্দরবানে অভিযানের এক ঘণ্টা পর আবার চালু অবৈধ ইটভাটা - Southeast Asia Journal

বান্দরবানে অভিযানের এক ঘণ্টা পর আবার চালু অবৈধ ইটভাটা

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

একপাশে খুঁটির ওপর টাঙানো— হাইকোর্টের নির্দেশে বন্ধ ঘোষণা। আরেক দিকে সমানভাবে চলছে ইট প্রস্ততকরণের সব আয়োজন। কোনো শ্রমিক ইট তৈরি করছে। কেউ মাটি ভাঙছে। কোনো শ্রমিক ব্যস্ত চুল্লির ভেতর আগুন দিতে। কিছুক্ষণ পরপর মাটি নিয়ে ঢুকছে ট্রাক। ট্রাকে করে নিয়ে আসা হচ্ছে বনের কাঠও। দেখে বুঝার কোনো উপায় নেই যে, একদিন আগেও এই ইটভাটায় অভিযান চালিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

বান্দরবান সদর উপজেলার ১২ কিলোমিটার দূরে কয়েকটি খেয়াং পাড়ার মাঝখানেই এবিসি নামে এই ইটভাটা। ইটভাটার কয়েক গজের সামনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া ও অনুমোদনহীনভাবে গড়ে ওঠা এই অবৈধ ইটভাটায় শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) দুপুরেই অভিযান চালিয়েছিল প্রশাসন। অভিযানে ফায়ার সার্ভিস নিয়ে গিয়ে ভাটার আগুন নিভিয়ে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইটভাটাও। কিন্তু অভিযান শেষের এক ঘণ্টার পর ইটভাটাটি আবার চালু করা হয় বলে জানান গুংগুরু পাড়াবাসী।

শনিবার( ২৫ নভেম্বর) বিকালে ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, তখনও দেড় শতাধিক শ্রমিক এবিসি নামে এই ইটভাটায় স্বাভাবিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সাংবাদিক আসছে বুঝতে পেরে সব শ্রমিক কাজ বন্ধ করে সরে যায়। পাশের কয়েকটি দোকানে গিয়ে এড়িয়ে থাকে সবাই। কয়েকজন মাঝিকে (শ্রমিক দলনেতা) কোথাও ফোন করতেও দেখা গেছে। ধারণা করা হয়, মালিককে বলে দেওয়া হচ্ছে সাংবাদিক আসার ব্যাপারটি।

পরে আলমগীর নামে এক শ্রমিক জানান, অধিকাংশ শ্রমিকরা নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে কাজ করতে এসেছেন। আসার পর ১৫ দিন ধরে তারা স্বাভাবিকভাবে কাজ করে যাচ্ছিল। শুক্রবার দুপুরে প্রশাসন থেকে লোক (ম্যাজিস্ট্রেট) এসে আগুন চুল্লির আগুন বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইটভাটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তারা চলে যাওয়ার এক ঘণ্টার পর আবার চালু করা হয় ইটভাটা।

দোকানে থাকা কয়েকজন শ্রমিক জানান, একটা লোক আইছিল। মনে হয় ম্যাজিস্ট্রেট। দুপুরে ১২টা কি ১টার দিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়ার এক ঘণ্টার পর আবার ভালভাবে চালু করা গেছে। এই ইটভাটায় ১৬০ জনের অধিক শ্রমিক কাজ করে। তার মধ্যে শুধু নোয়াখালী থেকে ১০০ জনের মত শ্রমিক কাজ করার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে।

আব্দুর রব নামে আরেকজন শ্রমিক জানান, তার বাড়ি নোয়াখালীর সুবর্ণচরের। তাকে অগ্রিম দেড় লাখ টাকা দিয়ে কাজ করার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। এভাবে কাউকে এক লাখ আবার কাউকে ৫০ টাকা অগ্রিম টাকা দিয়ে বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়ে আসা হয়েছে।

সুখেন্দু বড়ুয়া নামে আরেক শ্রমিক বলেন, তারা একজন মাঝির অধীনে ১২ জন শ্রমিক ১৫ দিন ধরে কাজ করছেন। তাদেরকেও অর্ধেক টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছে।

ইটভাটায় ইট তৈরির কাজে কয়েকজন শিশু শ্রমিককেও দেখা গেছে। জিজ্ঞেস করা হলে আরাফাত ও ইউসুফ নামে দুই শিশু শ্রমিক জানায়, তাদের জানামতে এই ইটভাটায় ৭ জনের মত ১৮ বছরের কম বয়সী শ্রমিক রয়েছে। তাদের কারও বয়স ১২ বছর, কারও ১৫ পনের বছর হবে। তবে তারা শুধু ইট তৈরির কাজটাই করছেন।

পাড়াবাসীরা জানান, ২০০৫ সালের দিকে এবিসি নামের এই ইটভাটা স্থাপন করা হয়। স্কুল সংলগ্ন ও পাড়ার মাঝখানে হওয়ায় শুরু থেকে ইটভাটা বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিয়ে আসছেন তারা। এমন কি শহরে গিয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পর্যন্ত পালন করা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালালেও কখনও বন্ধ করা যায়নি। বিভিন্ন সময় ইটভাটার মালিক উচ্চ আদালত থেকে অনুমতি নিয়ে বছরের পর বছর ভাটাটি চালু রেখেছেন।

গুংগুরু পাড়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, এবিসি ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে পাড়ার একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন করে। কালো ধোঁয়া ও ট্রাক চলাচলের কারণে ধুলাবালিতে শ্রেণিকক্ষগুলো সবসময় ময়লা থাকে। শিশু শিক্ষার্থীদের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। শিক্ষকদেরও পাঠদানের সমস্যা হয়। কত অভিযোগ করা হয়েছে। এখনও সমাধান মেলেনি।

গত বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম সাত দিনের মধ্যে বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এক আইনজীবী জনস্বার্থে দায়ের করা রিট আবেদনের শুনানিতে এই আদেশ দেওয়া হয়। পরে তিন জেলার ইটভাটার মালিকরা রিট পিটিশন দায়ের করলে শুনানিতে হাইকোর্ট বিভাগ এ বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি রিট পিটিশন খারিজ করে দেয়।

এ প্রেক্ষিতে এ বছর অক্টোবর মাসে গুংগুরু খেয়াং পাড়ার এবিসি ইটভাটায় হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন নম্বর ১২০৪/২০২২ নির্দেশনা মোতাবেক এবিসি ইটভাটাটি বন্ধ ঘোষণা করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই ইটভাটার মালিক নির্দেশনা অমান্য করে আবারও ইটভাটা চালু করেন। পরে পাড়াবাসীর লিখিত অভিযোগ পেয়ে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুক্রবার দুপরে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু অভিযান চালানোর এক ঘণ্টার পর আবারও চালু করা হয় ইটভাটা।

অভিযানের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বান্দরবান সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে হাবীবা মীরা বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরকে সঙ্গে নিয়ে শুক্রবার দুপুরেই অভিযান চালানো হয়েছে। ইট পোড়ানোর চুল্লির আগুন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরের দিন আবার ইটভাটা চালু করা আমাদেরকে অবজ্ঞা করার সামিল। খবর নিয়ে আবার দ্বিতীয় অভিযান চালানো হবে।

জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরে সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন চৌধুরী জানান, গুংগুরু খেয়াং পাড়ার ইটভাটায় গতকাল প্রথম অভিযান চালানো হয়েছে। এবার আমরা দ্বিতীয় অভিযানে যাব। তবে অভিযান চালাতে গেলে আমাদের কয়েকটা অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়।

ফখন উদ্দিন বলেন, আমাদের তালিকায় মোট ৬৭টি ইটভটা রয়েছে। তবে সবগুলো ইটভাটা চালু আছে কিনা আমরা নিশ্চিত নই। যেহেতু অবৈধ। গত বছর চলছে ৬০টি ইটভাটা সেহেতু আমরা ধরে নিচ্ছি ৬০টি ইটভাটা রুয়েছে। লামা উপজেলার ফাইতংয়ে ইটভাটা করবে কিনা নিশ্চিত নয়। এগুলো সবই বন্ধ। একটাতেও আগুন দিতে দেওয়া হয়নি। একটা ইটভাটা আগুন দিতে চেষ্টা করেছিল। আমরা খবর পেয়ে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে আসছি। আলীকদমেও একটা চালু করার চেষ্টা করেছিল। সেটাতেও অভিযান চালানো হয়েছে। নাইক্ষ্যছড়িতেও একটা ইটভাটা ভাঙা হয়েছে। অপর তিনটা ইটভাটা চালু করেনি। তাও দুই লাক টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

এছাড়া যতটুকু তথ্য পেয়েছি, লামা ফাইতংয়ে এ বছর ইটভাটা চালু করবে না। তারা কোর্ট থেকে রায় পেলে চালু করবে তার আগে করবে না। বান্দরবান সদরেও তারা রায় পেলে করবে। যতটুক শুনেছি তারা একটাতে কোর্ট রায় পেয়েছে। যেহেতু রায়ের কপি আমরা এখনও পায়নি তাই অ্যাকশনে আছি।

প্রশাসন অভিযান চালানোর এক ঘণ্টার পর আবার ইটভাটা চালু বিষয়ে জানতে এবিসি ইটভাটার মালিক মোহাম্মদ ইসলাম কোম্পানি মোবাইল নম্বরে কল দেওয়া হলে তিনি বলেন, গাড়িতে করে শহরে ফিরছি। পনের মিনিট পর পৌঁছলে ফোন দেওয়া হবে বলে কেটে দেওয়া হয়। এরপর তার মোবাইল নম্বরে আর সংযোগ পাওয়া যায়নি।