সমঝোতা বৈঠকের শর্ত মানছে না কেএনএফ, বান্দরবানে আবারও অস্থিরতা

ডেস্ক রিপোর্ট
আবারও তৎপর হয়ে উঠেছে কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট- কেএনএফ। শান্তি আলোচনা ও সমঝোতার পরেও সশস্ত্র এই সংগঠনটির চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী তৎপরতায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এলাকার লোকজন।
সাম্প্রতিক সময়ে এই সংগঠনটির চাঁদাবাজি, অপহরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় পর্যটকদের ভ্রমণ আশঙ্কজনকভাবে কমে গেছে। দুর্গম এলাকায় সাধারণ লোকজন চলাচল করছে আতঙ্কের মধ্যে। সশস্ত্র এই সংগঠনটি আবারও দখলে নিয়েছে রুমা রোয়াংছড়ি সড়কটি।
এছাড়া রুমা বগালেক কেউক্রাডং এসব এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে সংগঠনটি। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়ন কাজ। থমকে দাঁড়িয়েছে এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। সম্প্রতি রোয়াংছড়ি রুমা সড়কে মাটি কেটে তৈরি করা বাঙ্কারের মত বেশ কয়েকটি স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। নির্বাচনের সময়ে সড়কটি দখলে নিতে এ ধরনের স্থাপনা তৈরি করেছিল কেএনএফ। এই সড়কে বেশ কয়েকজন পর্যটককে মারধর করেছে তারা।
গত ১৪ জানুয়ারি রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান উহ্লামং মারযাকে অপহরণ করে কেএনএফ। পরে ৫ ঘন্টা পর মুক্তি দেওয়া হয় তাকে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন রোয়াংছড়ি ও রুমার দুর্গম গ্রামগুলোতে নিয়মিত ভাবে চাঁদাবাদি চালাচ্ছে সংগঠনটি। এছাড়া ঠিকাদার, ব্যবসায়ী, পর্যটক সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী এমনকি বম সম্প্রদায়ের কাছ থেকেও ব্যাপক চাঁদাবাজি করছে সংগঠনটি। সংগঠনটির সশস্ত্র তৎপরতায় এই দুটি উপজেলার অন্যান্য সম্প্রদায়ও এখন আতঙ্কে আছে।
গত নভেম্বরে বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লাকে প্রধান করে করা শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সাথে কেএনএফ’র সরাসরি শান্তি আলোচনা ও কয়েকটি বিশেষ সমঝোতা হয়। সেখানে সশস্ত্র তৎপরতা বন্ধ রাখার বিষয়ে উভয়পক্ষে সমঝোতা স্বাক্ষর হলেও বর্তমানে কেএনএফ তা উপেক্ষা করে তারপর তা চালাচ্ছে। এ নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্যরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নিরাপত্তা বাহিনীও সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধে এলাকায় অভিযান জোরদার করেছে।
শান্তি আলোচনার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসলেও বর্তমানে কেএনএফ’র তৎপরতায় এলাকায় পর্যটন ব্যবসায় আবারো স্থবিরতা নেমে এসেছে।
২০২২ সালের অক্টোবরে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি সীমান্তের সাইজাম পাড়া এলাকায় প্রথম হামলা চালিয়ে কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেএনএফ নিজেদের পরিচয় জানান দেয়। সে সময় এক শিশুসহ তিন জন নিহত হয় এ হামলায়। পরবর্তীতে টানা এক বছরের বেশি সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘাতে ৫ সেনা সদস্য সহ ২৭ জন নিহত হয়। কেএনএফ’র ১৭ সদস্যকে আটক করা হয়। হামলায় কেএনএফ’র সমর্থক ও গ্রামবাসী সহ আট জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনা সারাদেশে আলোচনায় উঠে আসে। এ সময় বম সম্প্রদায়ের সহস্রাধিক নারী পুরুষ বিভিন্ন পাড়া ছেড়ে পালিয়ে যায়। অনেকে ভারতের মিজোরামে গিয়েও আশ্রয় নেয়। বর্তমানে এসব পাড়া গুলোতে গ্রামবাসীরা ফিরে আসতে শুরু করেছে।
কেএনএফ সবচেয়ে আলোচনায় আসে নতুন গজিয়ে ওঠা জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে। অর্থের বিনিময়ে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিত এই কেএনএফ। এই সংগঠনটির প্রধান নাথান বম। বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
সন্ত্রাসী তৎপরতায় বান্দরবানে যখন পরিস্থিতি একেবারেই খারাপ পর্যায়ে ছিল তখন এলাকায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে গঠন করা হয় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। এ কমিটির সাথে কেএনএফ’র শান্তি আলোচনা ও কয়েকটি বিষয়ে সমঝোতা স্বাক্ষরের পর পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। কিন্তু ডিসেম্বরের শেষের দিকে কেএনএফ আবারো তখন তো শুরু করে। বর্তমানে আতঙ্ক উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে দুর্গম এলাকার লোকজন।
প্রশাসন যা বলছে
রুমা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুল হক জানান হঠাৎ করে কেনএফ-এর তৎপরতায় এলাকায় পর্যটক কমে গিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় পর্যটকরা ভ্রমণ করছে। মোটরসাইকেলে পর্যটকদের যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন জানিয়েছেন সন্ত্রাস প্রবন এলাকাগুলোর দিকে প্রশাসন নজর রাখছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
যা বলছে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি
সমঝোতা বৈঠকের পর হঠাৎ করে কেএনএফ’র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও তৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কমিটির সদস্যরা। কমিটির মুখপাত্র কাঞ্চন জয় তঞ্চঙ্গ্যা জানান বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। বহু প্রতীক্ষার পর সংগঠনটির সাথে সরাসরি শান্তি আলোচনার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সন্ত্রাস ভবন এলাকা গুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে অপহরণ ও সন্ত্রাসী তৎপরতায় পরিস্থিতি আবারও খারাপ হয়ে উঠছে। কমিটির সদস্য জারলম বম জানিয়েছেন কেএনএফ যদি আবারও তৎপরতা চালায় তবে এলাকাযর পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে উঠবে। পিছিয়ে পড়া বম সম্প্রদায়ের জন্য তা ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে। আমরা আশা করছি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
কেএনএফ যা বলছে
কেএনএফ’র মিডিয়া উইংয়ের সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে সেটি সঠিক নয়। তাছাড়া রুমা রোয়াংছড়ি সড়কে কোন বাঙ্কার তৈরি করা হয়নি। নির্বাচনের সময়ে একটি সশস্ত্র সংগঠন ওই এলাকায় আসার খবরে আমরা কিছুটা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তাছাড়া নভেম্বরে শান্তি আলোচনার পর দীর্ঘ সময় পার হয়েছে কিন্তু দ্বিতীয় বার আলোচনার জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বম সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়ন নির্যাতন এখনো চলছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বলে তিনি মনে করছে।