রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়ার আহ্বান
নিউজ ডেস্ক
রাখাইনে নিপীড়নের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে ‘বন্ধ সীমান্ত’ নীতি থেকে সরে আসতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসঙ্ঘে স্পেশাল রেপোর্টিয়ার থমাস অ্যান্ডুস।
গতকাল জেনেভা থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, রাখাইনে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তারা সীমান্তের দিকে আসছে। আরো একবার বাংলাদেশের উদারতা তাদের একমাত্র ভরসা। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জরুরি হস্তক্ষেপ ও সমর্থন ছাড়া এই সঙ্কটের চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। রেশন কর্তন, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সহিংসতা এবং রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বাংলাদেশে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের জীবন ও মানবিক সহায়তা হুমকির মুখে ফেলেছে।
রাখাইনের সঙ্ঘাত থেকে পালানো এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর পরিস্থিতি উন্নয়নে জরুরি তহবিল নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন থমাস অ্যান্ডুস। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসা বা পিছিয়ে যাওয়ার ওপর অগণিত রোহিঙ্গার জীবন-মরণ নির্ভর করছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে হাজারো নির্যাতিত সংখ্যালঘুকে বাস্তুচ্যুত করার অভিযোগ উঠেছে। রোহিঙ্গা অধিকারকর্মীরা সেখানে সক্রিয় জাতিগত সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে এ অভিযোগ এনেছেন। একটি যৌথ বিবৃতিতে বিদেশ থেকে সক্রিয় রোহিঙ্গাদের কয়েকটি অধিকার সংগঠন অভিযোগ করেছে, রাখাইন রাজ্যের বুথিডং শহর থেকে গত সপ্তাহে রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করেছে আরাকান আর্মির যোদ্ধারা। শহরটির বাড়িঘরে লুটপাট চালানো হয়েছে, পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, বুথিডং শহর থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নেয়া হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে, আরাকান আর্মির যোদ্ধারা রোহিঙ্গাদের জোর করে উদ্বাস্তু করেছে। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।
মিয়ানমারের রাখাইনে এখন প্রায় ছয় লাখ সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমের বসবাস। ২০১৭ সালে দেশটির নিরাপত্তাবাহিনীর জাতিগত নিধন অভিযানের মুখে রাখাইন রাজ্য ছেড়ে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার মামলা চলছে।
গত নভেম্বরে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সাথে আরাকান আর্মির সংঘর্ষ শুরুর পর থেকে রাখাইন রাজ্য উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে। আরাকান আর্মি বলছে, তারা স্থানীয় রাখাইনদের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়ে যাচ্ছে।
রাখাইনে নতুন সঙ্ঘাতে বাস্তুচ্যুতি নিয়ে তদন্ত করছে জাতিসঙ্ঘ
এএফপি জানায়, মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সঙ্ঘাত-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন সেখানকার মানবাধিকার কর্মীরা। এর মাঝেই বৃহস্পতিবার জাতিসঙ্ঘের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক তদন্তকারীরা সঙ্ঘাতে বিপর্যস্ত রাখাইনের ক্রমবর্ধমান লড়াইয়ের ওপর নজর রাখছেন বলে জানিয়েছেন। নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছেন তারা।
মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের স্বাধীন তদন্ত কমিটি আইআইএমএম এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘রাখাইনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ এবং সেখানে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না তা মূল্যায়ন করছে তারা।’
২০২১ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের পর রাখাইনের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সাথে জান্তা বাহিনীর সঙ্ঘাত বৃদ্ধি পায়। আরাকান আর্মি বলেছে, তারা রাখাইনের জাতিগত রাখাইন জনগোষ্ঠীর অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করছে। রাখাইনে বর্তমানে নির্যাতিত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রায় ছয় লাখ সদস্য রয়েছেন।
২০১৭ সালে দেশটির সেনাবাহিনীর রক্তাক্ত অভিযানে লাখ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এ ঘটনায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের গণহত্যা আদালতে মামলা চলছে। আইআইএমএম বলেছে, ‘আমরা বুথিডং শহরে সহিংসতা বৃদ্ধি ও সম্পত্তি ধ্বংসসহ মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান সেনাবাহিনীর তীব্র লড়াইয়ের অসংখ্য ঘটনা যাচাই-বাছাই করছি।’
‘এই সহিংসতায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং রাখাইন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরও এর প্রভাব পড়ছে।’
আরাকান আর্মি বলেছে, তারা গত সপ্তাহে বুথিডং শহরের দখল নিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে জান্তার বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির সর্বশেষ বিজয়ের ঘটনা এটি। শহরের বাসিন্দাদের চলে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিল আরাকান আর্মি। পরবর্তী সময়ে লোকজনের নিরাপদ এলাকায় সরে যেতে সহায়তা করেছে তারা। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি রাখাইনের এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী।
তবে চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে প্রবাসে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের কয়েকটি সংগঠনের প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, আরাকান আর্মির যোদ্ধারা রোহিঙ্গাদের বুথিডং ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছেন। পরে তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জান্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষের সময় আরাকান আর্মির যোদ্ধারা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে যান। বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ ঘটনার অবসানের আহ্বান জানানো হয়েছে।
তরুণ বিদ্রোহীরা পাল্টে দিয়েছে যুদ্ধের গতিপথ : এ দিকে বিবিসি জানায়, মিয়ানমারে ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর সম্প্রতি সবচেয়ে বড় সঙ্কটে পড়েছে সামরিক জান্তা। গত কয়েক মাসে জান্তা বাহিনীর ওপর হামলার মাত্রা বাড়িয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা। কয়েক দশকের সামরিক শাসন ও নৃশংস দমন-নিপীড়নের জেরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও তরুণ বিদ্রোহীদের সাথে সেনাবাহিনীর সঙ্ঘাত এ সঙ্কটকে আরো তীব্র করে তুলেছে। গত সাত মাসে দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় বিদ্রোহীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছে জান্তা বাহিনী।
বিদ্রোহীদের ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধ ঠেকাতে মরিয়া জান্তা প্রতিনিয়ত বেসামরিক লোকজন, স্কুল ও উপাসনালয়ে বোমা হামলা চালিয়েছে। জান্তা ক্ষমতা দখলের পর শিশুসহ হাজারো মানুষ নিহত হয়েছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ। সম্প্রতি বিবিসির প্রতিনিধিদল মিয়ানমার সফর করেছে। দেশটির পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহীদের সাথে মাসখানেক কাটিয়েছে দলটি।
এখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী কারেনি প্রদেশ এবং চীন সীমান্তবর্তী শান প্রদেশে থেকে লড়াই করছে। মিয়ানমারে জান্তা ও বিদ্রোহীদের যে লড়াই চলছে, তা শুধু আদর্শগত লড়াই নয়, বরং প্রজন্মগত যুদ্ধ। ব্যর্থ বিপ্লবের গল্প শুনে বড় হওয়া তরুণরা এবার নিজেরাই বিপ্লব ঘটাতে রাজপথে নেমেছে। অর্ধশতাব্দীর সামরিক শাসনের পর ২০১৫ সালে অং সান সু চি ও তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির নেতৃত্বে গণতন্ত্রের স্বাদ পায় মিয়ানমারের মানুষ।
তবে স্বাধীনতার এই স্বর্ণযুগ বেশিকাল স্থায়ী হয়নি। অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করায় তরুণদের হত্যা ও গ্রেফতার করা হয়। বিদ্রোহীদের পক্ষে লড়াই করা তরুণদের অনেকে বলেছেন, অস্ত্র হাতে লড়াই ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না তাদের। চিকিৎসক, গণিতবিদ, মার্শাল আর্ট যোদ্ধার মতো পেশা ও পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে হাজারো তরুণ। ইয়াঙ্গুনের মতো বড় বড় শহর ছেড়ে তারা যোগ দিয়েছে সামরিক শাসনবিরোধী জাতিগত ও সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে।
তাদের একজনের নাম রি। ২২ বছর বয়সী এই তরুণ কারেনি ন্যাশনালিটিস ডিফেন্স ফোর্সে (কেএনডিএফ) যোগ দেয়ার ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘কুকুররা (সামরিক বাহিনী) অন্যায় করেছে। তারা বেআইনি সামরিক অভ্যুত্থান করেছে। এতে আমার মতো যুবকরা অসন্তুষ্ট।’ অভ্যুত্থানের পর তরুণ যোদ্ধা ও কমান্ডারদের নিয়ে উত্থান কেএনডিএফের। কয়েক দশক ধরে কারেনি প্রদেশে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একতা ও যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য এনে দিয়েছে কেএনডিএফ।