দৃশ্যপট আরাকান- আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির রুপরেখা পরিবর্তন ও অস্থিরতা সৃষ্টির সম্ভাব্য অনুঘটক
![]()
পারভেজ হায়দার
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মায়ানমারের রাখাইন তথা আরাকান রাজ্যেকে ঘিরে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির রুপরেখা পরিবর্তন ও অস্থিরতা সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে বর্তমান রাখাইন রাজ্যে আরাকানীদেরই বসবাস ছিলো। যদিও সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর দখলদারিত্বের কারণে ১৭৮৪ সালের পর থেকেই মূল আরাকানী জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে “আরাকান” অনেকটা হাতছাড়া হয়ে যায় অথচ তাদের রয়েছে কয়েক হাজার বছরের গৌরবজ্জল ইতিহাস। কিন্তু সেনা প্রভাবিত বার্মিজ তথা মায়ানমার সরকার আরাকানীজদের ঐতিহ্যগত আদি আবাসস্থল “আরাকান”র নাম পরিবর্বতন করে “রাখাইন” হিসেবে পরিচিতি দিয়ে তাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য ধ্বংশ করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাখাইন রাজ্য ও তদসংলগ্ন এলাকায় বিভিন্ন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় এই রাজ্য এশিয়া, দক্ষিন এশিয়া এবং দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেরই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। চীনের বহুল আলোচিত বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই), কোয়াইকফুতে গভীর সমুদ্র বন্দর, ভারতের সিটওয়ে এলাকায় সমুদ্র বন্দরে বিনিয়োগ ছাড়াও জাপান, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য অনেক দেশ এই রাখাইন রাজ্যে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। দীর্ঘ সামরিক শাসনামলে মায়ানমারের অর্থনীতি পিছিয়ে পড়লেও ১৯৮৮ সালের পর বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্কারের কারণে ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। ২০১১ সাল থেকে মায়ানমার আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রায় পুরোপুরি যুক্ত হয়ে পড়ে। ঐতিহ্যগতভাবে মায়ানমারের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কাঠ ও খনিজ পাথর হলেও বর্তমানে পর্যটন, তৈরি পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মায়ানমার গুরুত্ব দিচ্ছে। রাখাইন প্রদেশকে ঘিরে নতুন নতুন অর্থনৈতিক ক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে। ইতিমধ্যেই মায়ানমার এশিয়ার অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলক দেশ এবং নতুনভাবে ১০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ও বিপুল পরিমান তেলের মজুদের সন্ধান পাওয়া গেছে। মায়ানমারে তেল ও গ্যাসের সম্ভাব্য উত্তোলন ও বাজার সৃষ্টি হওয়ায় বিষয়টি পশ্চিমা দেশ গুলোর বড় বড় কোম্পানীর জন্য বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। ২০১২-১৩ অর্থ বছরে মায়ানমারে বিদেশী বিনিয়োগ ছিলো ১৪২ কোটি ডলার যা ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছিলো ৬৬৫ কোটি ডলার। সামগ্রীক অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে রাখাইনেও অন্যান্য বিনিয়োগের পাশাপাশি উন্নতমানের হোটেল নির্মান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু রাখাইন তথা আরাকান রাজ্যের মূল অধিবাসী আরাকানীদের এবিষয়ে কতটুকু সাঁয় আছে?
মায়ানমারের প্রায় সকল রাজ্যেই বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের কার্যক্রম রয়েছে। প্রায় প্রতিটি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোর মূল দাবি মূলতঃ ফেডারেল পদ্ধতির সরকারের অধীনে রাজ্য পর্যায়ে সীমিত হারে স্ব স্ব জনগোষ্ঠীর রীতি-নীতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় রেখে পরিচালিত হওয়া। কিন্তু আরাকানীজ জনগনের অধিকার আদায়ে গঠিত ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান (ইউএলএ) এবং ঐ দলের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি (এএ) নিজস্ব সংস্কৃতি চলমান রেখে “ওয়া” রাজ্যের মতো বিশেষ একটি স্বায়ত্বশাসন দাবি করে, যা অনেকটা স্বাধীনতারই নামান্তর।

সাম্প্রতিক বছর গুলোতে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর মায়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচারে প্রায় দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজার শরণার্থী শিবির সমূহে অবস্থান করার বিষয়টি বিশ্ব গণমাধ্যমে যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে আরাকান আর্মির ক্রম উথান, রাখাইনের মূল জনগোষ্ঠী আরাকানীজদের বার্মিজদের প্রতি তীব্র ঘৃনা ও যুদ্ধ প্রস্তুতির বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। তবে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী রাখাইন ত্যাগ করতে বাধ্য হবার পর ক্রমান্বয়ে আরাকান আর্মির কার্যক্রম দৃশ্যমান হচ্ছে। যদিও ২০১৮ সালের অক্টোবরের পর থেকেই মূলতঃ আরাকান আর্মি মায়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে উল্লেখযোগ্য প্রস্তুতি নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। নীতিগতভাবে রাখাইন রাজ্যে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগের বিষয়ে আরাকান আর্মির খুব একটা আপত্তি না থাকলেও তারা মনে করে মায়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার আরাকানী জনগনের সাথে কোন প্রকার পরামর্শ না করেই আরাকান রাজ্য ভিত্তিক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অর্থনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে।
মায়ানমার তথা বার্মার ৭টি রাজ্য ও ৭টি রিজিয়নের মধ্যে “রাখাইন”অন্যতম রাজ্য। বাংলাদেশের কক্সবাজারের দক্ষিনে এবং মায়ানমার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেষা এলাকাটিই রাখাইন রাজ্য, পূর্বে যা “ আরাকান ডিভিশন” নামে পরিচিত ছিলো। ১৯৭৪ সালে এই রাজ্যকে “আরাকান রাজ্য” নামে নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে এই রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে “রাখাইন” হিসেবে নামকরণ করা হয়। মায়ানমার সরকার প্রভাবিত বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণের মতে আরাকানের প্রাচীন নাম ছিলো “রাখাইন পিয়ে”। মূলত “রক্ষা” শব্দ থেকে রাখাইন শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে দাবি করা হয়। ১৭৮৪ সালের পূর্বে রাখাইন একটি সমৃদ্ধশালী রাজ্য ছিলো, যদিও এর আয়তন ছিলো বর্তমান আয়তনের প্রায় দ্বিগুন। ১৯৫২ সালে আরাকানের কিছু অংশ চিন রাজ্যের সাথে এবং ১৯৫৩ সালে কিছু অংশ লোয়ার বার্মার সাথে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এখানে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে ১৯৩৭ সালে বৃটিশ শাসনামলে আরাকানের কিছু অংশ চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত করা হয়েছিলো। ১৯৮৪ সালে বার্মার রাজাদের আক্রমনে আরাকানের তৎকালীন রাজা পরাজিত হলে আরাকান বার্মার অধীনে চলে যায়। তখন আরাকানীজরা বৃটিশদের সাথে যোগাযোগ করে এমন একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যাতে বার্মিজদের কাছ থেকে আরাকান মুক্ত করতে সহায়তা করলে তারা তাদের (বৃটিশ) সাথে সমন্বয় করে দেশ পরিচালনা করবে। সেই চুক্তি মোতাবেক ১৮২৪ সালে বৃটিশরা বার্মিজদের সাথে যুদ্ধ করে ১৮২৬ সালের মধ্যেই আরাকানকে বার্মিজ মুক্ত করে। কিন্তু আরাকানীজরা বার্মিজ মুক্ত হলেও স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। ১৮২৬ সাল থেকে বৃটিশরা আরাকানের পূর্ন নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে। আরাকান সেই সময় ৩টি জেলায় বিভক্ত ছিলো; আকিয়াব, কাইয়াকপু ও সান্দোওয়ে। বৃটিশদের এই দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হতে তৎকালীন আরাকানীজ জাতীয়দাবাদী নেতা আং খইয়ে জান এর নেতৃত্বে কিছুটা প্রতিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। তাদের এই প্রতিরোধ চেষ্টার মধ্যে ঐ সময়ে তারা গেরিলা যুদ্ধ করার জন্য গোপনে ফ্রান্সের সহায়তা পাওয়ারও চেষ্টা করে। কিন্তু বৃটিশদের গোয়েন্দা তৎপরতার কারনে তা সম্ভব হয়নি। বরং ঐ গেরিলা সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ আং খইয়ে জান, আং খ রিহি এবং যুবরাজ শ উই বান বৃটিশদের হাতে গ্রেফতার হন। তাদেরকে ঢাকার একটি কারাগারে বন্দি রাখা হয়। ১৮৩৪ সালে ঢাকার কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় আরাকানীজ ঐ নেতৃবৃন্দ মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে আরাকানীজরা বেশ কিছু ছোট-খাট বিদ্রোহ প্রচেষ্টা করলেও বৃটিশরা তা শক্ত হাতে দমন করে। এই প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯১৮ সালে রাখখাপুরা লীগ এবং ১৯৩০ সালে আরাকান লীগ নামে ২টি সংগঠন জন্ম লাভ করে। ঐ সময়ে আরাকানীজ নেতা ইউ ওত্তামা পুরো বার্মা জুড়েই বৃটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তির জন্য সাধারণ মানুষদের উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেছিলেন। বার্মার বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবে গড়ে উঠা নেতৃবৃন্দ তখন একটি ঐক্যমতে পৌঁছান যে, বিচ্ছিন্নভাবে বৃটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সফলতা লাভ করা যাবে না বরং ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করে বিজয়ী হলে জাতিস্বত্ত্বা ভিত্তিক স্বায়ত্বশাসনের অধিকার সম্বলিত একটি ফেডারেল ধর্মী বার্মা গড়ে তোলা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ্য, ১৭৮৪ সাল থেকে বার্মিজদের বিরুদ্ধে আরাকানীদের সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে ১৮২৬ সাল থেকে বৃটিশদের বিরুদ্ধে আরাকানীদের সংগ্রাম এই উভয় ক্ষেত্রেই বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী নেতৃত্বের পর্যায়ে ছিলো। ১৮২৬ সালের পর থেকে বৃটিশদের মাধ্যমে বাংলাভাষী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আরাকান রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস শুরু হলেও মূল আরাকানীজ বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কখনোই নিজেদের বলে মনে করতে পারে নি।
বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর বার্মিজ ইউনিয়ন গঠিত হলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষন নিয়ে বিভক্তি, দীর্ঘ সময়ের সামরিক শাসন ও “বামার” জনগোষ্ঠীর একক আধিপত্য গ্রহনের চেষ্টা ইত্যাদি কারনে বার্মার রাজ্যগুলো সবসময় অস্থিতিশীল ছিলো। আরাকানীজদের মধ্যেও কেন্দ্রীয় সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং বৈষম্যমূলক আচরণের কারনে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছিলো। একসময়ের অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ রাজ্য আরাকানের বর্তমান অর্ধেকের বেশী জনগোষ্ঠী দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করে। বার্মার সকল রাজ্য গুলোর মধ্যে আরাকান তথা রাখাইন দরিদ্রতম। ২০১৫ সালের নির্বাচন পরবর্তী কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থায় আরাকানীজদের একেবারেই প্রাধান্য দেয়া হয়নি। দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ এবং মায়ানমারের ফেডারেল ভিত্তিক সরকারের চরম দূর্ণীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে ক্রমান্বয়ে আরাকানী জনগনের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন অঞ্চল ভিত্তিক স্থানীয় সংগঠন গড়ে উঠেছিলো, যার মধ্যে আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি) অন্যতম। কিন্তু আভ্যন্তরীন কোন্দল ও দূর্বল নেতৃত্বের কারণে এএলপির সাংগঠনিক অবকাঠামো ক্রমান্বয়ে দূর্বল হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে ন্যাশন ওয়াইড সিজফায়ার এগ্রিমেন্ট (এনসিএ)’র আওতায় এএলপি মায়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। বর্তমানে এএলপির সদস্যগণ আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মায়ানমার সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করছে।

এএলপির সাংগঠনিক ব্যর্থতা দীর্ঘদিন ধরে দৃশ্যমান হওয়ায় আরাকানী জনগনের মধ্যে অনেকদিন ধরেই নতুন একটি কার্যকরী সংগঠন সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিলো, যেখানে রাজনৈতিকভাবে অধিকার আদায়ের চেষ্টার পাশাপাশি সশস্ত্র সংগ্রামও চালানো হবে। এই লক্ষ্যকে সামনে নিয়েই ২০০৯ সালে ইউনাইটেপ লীগ অব আরাকান (ইউএলএ) এবং এই সংগঠনের সহযোগী সশস্ত্র শাখা আরাকান আর্মি (এএ) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মায়ানমারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কাচিন রাজ্যে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মির (কেআইএ)’র অধিনে আরাকান আর্মির সশস্ত্র শাখার নেতৃবৃন্দ সশস্ত্র প্রশিক্ষন গ্রহণ করে। প্রাথমিকভাবে আরাকানী যুবকদের মধ্যে থেকে কাচিন নিকটবর্তী বিভিন্ন এলাকার খনিতে কর্মরত উৎসাহী শ্রমিকদের মধ্য থেকে স্বল্প সংখ্যক যুবকদের নিয়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষন কার্যক্রম শুরু হলেও মেজর জেনারেল তন ম্রট নিয়ান এর বলিষ্ট নেতৃত্বাধীন আরাকান আর্মির প্রতি আরাকানীজ যুবকদের ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
বর্তমানে আরাকান আর্মিতে প্রায় সাত হাজার সুপ্রশিক্ষিত সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত শত থেকে এক হাজারের মতো নারী সদস্যও রয়েছে। আরাকান আর্মি আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত। বার্মায় একটি কথা প্রচলিত আছে, কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি (কেআইএ)ই সশস্ত্র সংগ্রামী সদস্য তৈরীর উৎপাদন ক্ষেত্র। এই কেআইএ’র অধীনে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত আরাকান আর্মির সদস্যরা বর্তমানে একটি পেশাদার আর্মির রুপ ধারণ করার চেষ্টা করছে। এই আরাকান আর্মি পরিচালনায় অর্থের উৎস সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে। অধিক গ্রহনযোগ্য মতামত হলো, সশস্ত্র দল পরিচালনায় আরাকান আর্মি বিভিন্ন প্রকার মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে। বর্তমানে ব্যাপকহারে ইয়াবা ট্যাবলেট বাংলাদেশ, ভারত ও চীন সীমান্ত দিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে। ইয়াবা ট্যাবলেটের ব্যাপকতা এমন যে, ২০১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি মায়ানমার টাইমস’এ প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায় ২০১৭ সালে সেনাবাহিনী শান প্রদেশে ৩ কোটি ইয়াবা ট্যাবলেট এবং ৪৬২ কিলোগ্রাম হেরোইন জব্দ করেছে। তার আগের বছর আটককৃত ইয়াবা ট্যাবলেটের সংখ্যা ছিলো ৯ কোটি ৮০ লাখ পিস। তাই অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের মতো আরাকান আর্মিও তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য অবৈধ মাদক ব্যবসার সহায়তা নিচ্ছে বলে সুদৃঢ় ভাবে অনুমেয়।
রাখাইন রাজ্যে বিভিন্ন দেশ যেমন, চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, জাপানসহ অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগের এই সময়ে আরাকানীজদের সংগ্রাম যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। আরাকানীজ সাধারণ জনগনের মধ্যে আরাকান আর্মির যথেষ্ট গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে। তবে বৈদেশিক অর্থনৈতিক প্রকল্প সমূহে আরাকান আর্মির কোন ধরণের আক্রমনের ঘটনা এখনো পর্যন্ত ঘটেনি এবং এই বিদেশী বিনিয়োগ বিষয়ে তারা কোন নেতিবাচক মন্তব্যও করে নি। তাই অনুমান করা যায়, আরাকান আর্মি বৈদেশিক অর্থনৈতিক বিনিয়োগের বিরুদ্ধে নয়, যদিও কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক তাদের সাথে আলোচনা না করে সিদ্ধান্ত গ্রহনের বিষয়ে তাদের এক প্রকার অসন্তুষ্টি রয়েছে। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমান সময়ে চলমান মায়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির সহিংসতার প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

ভূ-রাজনীতির পরিক্রমায় যেসকল গোষ্টী/মহল রাখাইন রাজ্যের সম্ভাবনাময়তার উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগের বিরুদ্ধে অবস্থান করবে সেসকল গোষ্ঠী আরাকানী জাতির আবেগ তথা আরাকান আর্মির সুপ্রশিক্ষিত সশস্ত্র দলকে ব্যবহার করতে চাইতে পারে। দীর্ঘদিনের আরাকানীজ ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার মানসে আরাকান আর্মিও চাইবে মায়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে সংগ্রাম চলমান রাখতে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর রাখাইনে ফিরে যাওয়ার কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ঐতিহ্যগতভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকানীজদের বিরোধ বর্তমানে দৃশ্যমান না থাকলেও এক প্রকার অসন্তুষ্টি সব সময় থাকবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। আরাকানীজরা রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়াকে পছন্দের সাথে গ্রহণ করবে না, তা অনুমেয়। অন্যদিকে মায়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে আরাকান আর্মি পরাজয়ে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশের ভূখন্ডে অনুপ্রবেশ করার সম্ভাবনা রয়েছে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় আরাকান আর্মির মতো সুপ্রশিক্ষিত সেনা দল পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উপজাতি দলগুলোর সাথে সমন্বয় করতে পারে। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। তবে এই যুদ্ধে আরাকান আর্মির পরাজয় না ঘটলেও সশস্ত্র দল পরিচালনার প্রয়োজনে অর্থ সংগ্রহের জন্য মাদকের ব্যবসা চলমান থাকবে বিধায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক হারে মাদক প্রবেশ করবে। একবিংশ শতাব্দির বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক স্বার্থ অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানবতাকে ছাড়িয়ে যায়। রাখাইন রাজ্যকে ভিত্তি করে চলমান অর্থনৈতিক বিনিয়োগের সুফল প্রাপ্তির সাথে সাথে রোহিঙ্গা এবং আরাকানী জাতির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একটি সমন্বয় ঘটানো সম্ভব হলে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির স্বাভাবিকতা বজায় থাকতো। কিন্তু বাস্তবতা? না বাস্তবতা সম্পূর্ন বিপরীতমুখী।
রাখাইন তথা আরাকানকে ঘিরে অদূর ভবিষ্যতে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির রুপরেখায় বড় ধরণের পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে। এই অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল নতুন ভাবে আঞ্চলিক জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করে লাভবান হবার চেষ্টা চালাতে পারে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের উপর ভিত্তি করে নতুন কোন জঙ্গীবাদের সৃষ্টি হতে পারে। এতদিন যে দলটির অস্তিত্ব নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা ছিলো সেই আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)’র ন্যায় নতুন কোন জঙ্গী সংগঠনের আবির্ভাব ঘটতে পারে। কোন প্রকার সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও বাংলাদেশের দক্ষিন-পূর্বাঞ্চলের জনগন হয়ে যেতে পারে পরিস্থিতির স্বীকার। অন্যদিকে আরাকান আর্মি আর মায়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে চলমান থাকলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন আরো পিছিয়ে যাবে। দীর্ঘদিন শরণার্থী ক্যাম্প গুলোর অলস জীবন-যাপনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে চরম সিদ্ধান্ত নেবার প্রবনতা সৃষ্টি হতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী একটা জটিল পরিস্থিতি আগামীতে উদ্ভব হতে পারে। সম্ভাব্য এই জটিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে সরকারের পাশাপাশি মিডিয়ারও ভালো ভূমিকা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মিডিয়ার অপরিপক্ক প্রচারণা দেশের স্বার্থ বিরোধী হতে পারে। অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গ পরিস্থিতির গভীরতা আর সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে না বুঝেই অহেতুক প্রচারণা করে থাকে। সম্ভাব্য এই জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলায় সুচিন্তিত গবেষণাধর্মী সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ প্রয়োজন। আমাদের এই প্রিয় দেশটি পরিস্থিতির স্বীকার। এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে যে সকল রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো নিশ্চিতভাবেই সঠিক ও যুক্তিযুক্ত। এই সিদ্ধান্তগুলোতে মানবতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বীরের জাতি বাঙ্গালী নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে যত জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক না কেন তা সহজেই মোকাবেলা করতে পারবে। এজন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারকে সহযোগীতা করতে হবে।
লেখক: আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম গবেষক
Email: parvedgehaider5235@gmail.com