পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মোঃ সাইফুল ইসলাম

স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আজ বুধবার (২৩ এপ্রিল) চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “পাহাড় এখন পুরোটাই শান্ত”। তিনি অতীতের সহিংসতার উদাহরণ টেনে বর্তমান পরিস্থিতিকে তুলনামূলক শান্ত বলে উল্লেখ করেছেন। তবে বাস্তবতা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ, খুন, গোলাগুলি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি ঘটনা বেড়েছে, যা এই মন্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সাম্প্রতিক সহিংসতা ও অপরাধের চিত্র

সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে একাধিক সহিংস ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী খাগড়াছড়িতে অপহরণের শিকার হন, যা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। এছাড়া, বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজি, খুন, এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ইঙ্গিত দেয়।

এছাড়া পাহাড়ি জনগণের অভিজ্ঞতা বলছে ভিন্ন কথা। খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির অনেক এলাকাতে আজও সাধারণ মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। বান্দরবানে ইউপিডিএফ ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে গুলিবিনিময়, রাঙ্গামাটিতে চাঁদাবাজদের আধিপত্য এবং স্থানীয়দের অভিযোগ, খাগড়াছড়িতে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীদের গুলিতে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসী নিহত, পাহাড়জুড়ে নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করা ও টাওয়ারের টেকনিশিয়ান অপহরণ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ জটিল।

এছাড়া গত বছরের সেপ্টেম্বরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ইন্ধনে পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে তিনজন পাহাড়ি যুবক নিহত হন এবং শতাধিক আহত হন। এই ঘটনায় প্রায় ১০২টি দোকানে আগুন দেওয়া হয়।

​খোদ পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক সংগঠনের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ওই বছর পাহাড়ে ২০০টিরও বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, মারধর, হত্যা, গুলি করে আহত করা, প্রাণনাশের হুমকি, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু ছিনতাই, অর্থ ও মোবাইল ফোন ছিনতাই, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।

এর আগে, পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সহিংসতার পেছনে মূল কারণ হিসেবে চাঁদাবাজি ও অবৈধ অস্ত্রের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেই। তিনি বলেছিলেন, এই চাঁদাবাজি বন্ধ না করা গেলে এই অঞ্চলে সহিংসতা নির্মূল করা সম্ভব হবে না।

ভারতীয় সংযোগের আশঙ্কা

বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সহিংসতায় ভারতের কিছু গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। তারা সীমান্তবর্তী এলাকায় অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ সরবরাহ করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে পাহাড়ি সংঘটনের দীর্ঘদিনের যোগাযোগ রয়েছে। অনেক সময় সীমান্ত পেরিয়ে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পাচার হয়। এসব বিষয় পাহাড়ি সহিংসতার পেছনে অন্যতম চালিকাশক্তি।​ এমন পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্য বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

প্রশাসনের ব্যর্থতা ও তথ্যপ্রবাহের সংকট

যদিও সরকারের তরফ থেকে উন্নয়নের নানা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, কিন্তু পাহাড়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ এখনো অনেকাংশে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর হাতেই। পুলিশ ও প্রশাসন অনেক জায়গায় কার্যত “লোক দেখানো উপস্থিতি”। পাহাড়ে সংবাদকর্মীদের প্রবেশের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ থাকায় বাস্তব চিত্র গণমাধ্যমে কম উঠে আসে।

অতীত অভিজ্ঞতা বনাম বর্তমান বাস্তবতা

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হয়তো তার চাকরিজীবনের সময়কার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মন্তব্য করেছেন। তিনি হয়তো ঠিকই বলেছেন—তখন পাহাড় ছিল আরও সহিংস, আরও রক্তাক্ত। কিন্তু বর্তমানে সহিংসতা রূপ বদলেছে—এটা এখন অদৃশ্য, ছদ্মবেশী, কিন্তু ভয়ংকর। এই ধরনের সহিংসতাকে অবমূল্যায়ন করা ঝুঁকিপূর্ণ।

সরকারি অবস্থানের পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যে পাহাড়ের বাস্তবতা উপেক্ষিত হয়েছে। সরকারের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এছাড়া, স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় নজরদারি বাড়াতে হবে।

আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চিত্রের প্রতিফলন। তাই পাহাড়ে বাস্তব সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা হালকা করে দেখা—এটা সমস্যাকে দীর্ঘায়িত করে। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে হলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও অংশগ্রহণমূলক প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন। শান্তি শুধুই গন্তব্য নয়—এটা একটি প্রক্রিয়া, যেখানে প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি অভিযোগ গুরুত্ব পায়। সেই গুরুত্বের জায়গা থেকেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের পুনর্বিবেচনা জরুরি।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।