জিরুনাকে সরিয়ে দেয়ার নাটক কি আদতে সুপ্রদীপ-কংকনের অপকৌশল?
![]()
মোঃ সাইফুল ইসলাম
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় গতকাল ৭ জুলাই খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরাকে পরিষদের সকল কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। সরকারি ভাষায় বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে পরিষদের ১৪ সদস্যের একযোগে অভিযোগ, যার মধ্যে রয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য, সদস্যদের অবমূল্যায়ন, বদলি বাণিজ্য ও প্রকল্পে কমিশন দাবি—এইসব অনিয়মের অভিযোগ তদন্তাধীন থাকায় তিনি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। প্রশ্ন হলো—এতোদিন এসব কিছু চলছিল, তখন কেন চুপ ছিল মন্ত্রণালয়? এবং হঠাৎ করেই এখন কেন এমন ‘দৃষ্টান্তমূলক’ পদক্ষেপ?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—এটা কোনো দুর্নীতির বিরুদ্ধে সৎ প্রশাসনিক উদ্যোগ নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক অপকৌশল। উদ্দেশ্য একটাই—পার্বত্য চট্টগ্রামে মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা।
গত কয়েক সপ্তাহে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা ও যুগ্ম সচিব কংকন চাকমার বিরুদ্ধে তিন পার্বত্য জেলাতেই মিছিল, বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। স্থানীয় বাঙ্গালিরা ছাড়াও মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী তাদের বিরুদ্ধে বরাদ্দ বণ্টনে বৈষম্য, একপাক্ষিকতা ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে পদত্যাগ দাবি করেছে। সুপ্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরও গুরুতর—তিনি একজন স্বঘোষিত ‘আদিবাসী’ হিসেবে দেশের জাতীয় পরিচয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, মন্ত্রণালয়ের ভেতরে একটি বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছেন, এমনকি সম্প্রতি সরকারি এক বৈঠকে ‘চাকমা’ পরিচয়ের বদলে ‘আদিবাসী’ হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা স্পষ্টতই সংবিধান, রাষ্ট্র ও জাতিসত্তার বিরুদ্ধে অবস্থান। যা শুধু সরকার নয়, রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
সুপ্রদীপ ও কংকনের বিরুদ্ধে জনমতের চাপ, সামাজিক মাধ্যমে ট্রল, অনলাইন-অফলাইন আন্দোলন—all in all পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে— এই প্রেক্ষাপটে সুপ্রদীপ ও কংকনের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া গণআন্দোলন থামাতে একটি ‘বলি’ দরকার ছিল এবং দুর্বল, অদক্ষ, বিতর্কিত হলেও নারী পরিচয়ের আবরণে তুলনামূলকভাবে সহজ টার্গেট হিসেবে বেছে নেওয়া হলো জিরুনা ত্রিপুরাকে, ঘুরিয়ে দেয়া হলো সবার নজর। অভিযোগ সত্য হোক বা মিথ্যা—প্রশ্ন হলো, রাঙামাটি বা বান্দরবানে যখন পরিষদ নিয়ে আরও ভয়াবহ অভিযোগ উঠেছে, তখন সেখানে কেন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়?
যদি দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারই অপসারণের কারণ হয়, তাহলে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের বর্তমান কাঠামো নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সেখানে তো শুরু থেকেই ‘দেবর-ভাবীর পরিষদ’ বলে সমালোচিত হচ্ছে।
রাঙামাটি জেলা পরিষদে সদস্য পদে হত্যা মামলার আসামি রয়েছেন, সেখানে শতভাগ চাকমা নিয়োগ হয়েছে, চেয়ারম্যান বিতর্কিত ‘আদিবাসী দিবস’ পালনে সরকারের নীতিমালা অমান্য করেছেন—এছাড়া কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হাইকোর্ট পর্যন্ত নির্দেশনা দিয়েছে। এসব কিছু সত্ত্বেও সুপ্রদীপ কিংবা মন্ত্রণালয় সেখানকার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অথচ খাগড়াছড়িতে, যেখানে মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের অভিযোগ জমে আছে, সেখানেই এমন আকস্মিক ‘তৎপরতা’।
সুপ্রদীপ চাকমা ও কংকন চাকমার বিরুদ্ধে চাপ বাড়ছিল। তিন জেলার জনগণের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙার মুখে ছিল। এমনকি প্রশাসনের মধ্যেও সুপ্রদীপের একক কর্তৃত্ব, স্বেচ্ছাচারিতা ও দলীয় দাসত্ব নিয়ে অস্বস্তি বিরাজ করছিল। ইতিমধ্যে অবরোধ দিয়ে তিন জেলা অচল করে দেয়ার আল্টিমেটাও এসেছিলো। এই অবস্থায় জিরুনা ত্রিপুরাকে শাস্তি দিয়ে আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা হলো। বলা হচ্ছে, এটা এক ধরনের ‘বার্তা’—অন্য যারা বেঁকে বসছে, তাদের কী পরিণতি হতে পারে, তা যেন সবাই দেখে শেখে। অনেকে মনে করছেন, এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি ‘স্ট্র্যাটেজিক পলিটিক্যাল স্ক্রিপ্ট’।
তাহলে কি বিষয়গুলো ধামাচাপা দেওয়ার কৌশল হিসেবে জিরুনা ত্রিপুরাকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হলো?
জিরুনা ত্রিপুরা যে সাধু, এমন দাবির জায়গা নেই। বরং শুরু থেকেই তার বিরুদ্ধে কাজের অযোগ্যতা, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সেই দুর্বলতা ও বিতর্ককে পুঁজি করে যদি মূল দুর্নীতিবাজদের আড়াল করা হয়, সেটি গণতন্ত্র, প্রশাসনিক ন্যায়বিচার ও জনগণের অধিকার—সব কিছুর উপরেই আঘাত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযানের মুখোশ পরে যদি আরও বড় দুর্নীতির হোতাদের রক্ষা করা হয়, তবে সেটি শুধু ভণ্ডামি নয়, রাষ্ট্রের সাথে প্রতারণা।
ভাবছি, খাগড়াছড়ির এই বরখাস্ত-সদৃশ আদেশ কি শুধুই বিচ্ছিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত, না এর পেছনে রয়েছে গভীর প্রশাসনিক রাজনৈতিক এজেন্ডা?
সুপ্রদীপ চাকমার রশিতে যখন টান পড়ছে, তখন তিনি হয়তো এখন যে কোনো মূল্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চান। তাঁর বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন এবং সামাজিক চাপকে থামিয়ে দিতে এই নাটকীয় সিদ্ধান্ত একটি বুদ্ধিদীপ্ত বিভ্রান্তি হতে পারে। যেন আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায়, সবাই জিরুনা বিতর্কে ব্যস্ত থাকে, আর মূল কুশীলব নির্বিঘ্নে তাঁর চেয়ারে আসীন থাকেন। হয়েছেও তাই। গতকাল থেকে জিরুনার অপসারণ নিয়ে পাহাড়ের নেটিজেনরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মাতিয়ে রেখেছেন, আর নেতিয়ে গেছে আন্দোলনের পাল।
এভাবে যদি পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়, তবে শুধু জিরুনা নয়—পুরো পার্বত্য প্রশাসনের নৈতিক ভিত্তিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দুর্নীতি, বৈষম্য, বিভাজন ও আদিবাসীবাদী অপচেষ্টার বিরুদ্ধে যারা সত্যিকারের প্রতিবাদ করছে, তারা যদি পর্দার আড়ালে থাকা দুর্বৃত্তদের শিকার হয়ে পড়ে—তবে রাষ্ট্রের দায় থেকে কেউ মুক্ত নয়।
সুপ্রদীপ চাকমা, আপনি নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ ও জাতিগত আধিপত্যের জন্য যদি পুরো পাহাড়কে জিম্মি করতে চান, তাহলে আপনার অপসারণই এখন পাহাড়ের শান্তি ও ন্যায়ের প্রথম শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি হয়তো জিরুনাকে বলি দিয়ে নিজের গদি বাঁচাতে চেয়েছেন, কিন্তু সময় আপনাকে ভুল প্রমাণ করবে।
মনে রাখতে হবে, পাহাড়ের জনগণ এখন আগের মতো নিরব নয়। জিরুনার অপসারণ কোনো ‘উন্নয়নশীল দৃষ্টান্ত’ নয়, বরং আরও বড় স্বৈরাচারকে রক্ষা করার জন্য একটি রাজনৈতিক বলির পাঁঠা মাত্র। পাহাড়ে বাস্তব উন্নয়ন ও শান্তির জন্য চাই স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ন্যায়ভিত্তিক প্রশাসন। জিরুনা যদি দোষী হন, তাহলে সুপ্রদীপও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।