বান্দরবানে ডিসি সনদপ্রাপ্তিতে অসাংবিধানিক শর্ত: হয়রানির নীলনকশা
![]()
সোহেল রিগ্যান
খাস জমি হোক বা বসতবাড়ি, শিক্ষা হোক বা চাকরি—বান্দরবানে একটি সনদের পেছনে ঘুরতে হয় বছরের পর বছর। এর নাম “স্থানীয় বাসিন্দা (ডিসি) সনদ”। এই সনদ পেতে যে ধরণের জটিলতা, বৈষম্য ও প্রশাসনিক হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়, তা বাংলাদেশের সংবিধান, নাগরিক অধিকার এবং ন্যায়ের মৌলনীতি—সবকিছুর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, দেশের প্রতিটি নাগরিক তার নিজ এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস, জমি ক্রয়-বিক্রয়, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সমান সুযোগ পাবেন—এই মৌলিক অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে যখন পার্বত্য বান্দরবানে একটি সাধারণ সনদ তুলতে গিয়ে মানুষকে ১৫-২০টি নথিপত্র জমা দিতে বাধ্য করা হয়।
সংবিধান যেখানে মৌলিক অধিকার দেয়, বান্দরবান সেখানে দেয় ফাইলের পাহাড়
বান্দরবান জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নির্দেশনায় দেখা যায়, ডিসি সনদ পেতে হলে আবেদনকারীকে দিতে হয়—জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন, পাসপোর্ট সাইজের ছবি, ইউনিয়ন পরিষদের নাগরিক সনদ, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, জমির কাগজপত্র, হেডম্যান রিপোর্ট, বোমাং সার্কেল চীপের সনদ, এমনকি পূর্বপুরুষের জমির দলিল ও ওয়ারিশ সনদসহ আরও বহু নথি।
এখানেই প্রশ্ন—একজন নাগরিকের ভোটার আইডি, জন্মনিবন্ধন এবং ইউনিয়ন পরিষদের সনদ থাকা সত্ত্বেও কেন তাকে এসব অতিরিক্ত প্রমাণ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে?
সনদের নামে উপনিবেশিক আমলের শৃঙ্খল
সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হলো হেডম্যান রিপোর্ট ও সার্কেল চীপের সনদের বাধ্যবাধকতা। এই দুই ‘অনাপত্তি’ পেতে বেশিরভাগ সময় টাকা ঘুষ দিতে হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ—প্রতিবেদনপ্রদানে ইচ্ছাকৃত বিলম্ব, ঘুষ দাবি, এমনকি বাঙালি আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রতিবেদন দিতে অস্বীকৃতির ঘটনাও ঘটছে। অথচ সংবিধানের কোথাও বলা হয়নি যে, জমি বা নাগরিক সনদ পেতে একজন হেডম্যান বা সার্কেল চীপের মতামত অপরিহার্য।
এটি মূলত উপনিবেশিক আমলের একটি দমনমূলক কাঠামো, যা এখন পার্বত্য অঞ্চলে জাতি ও পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য সৃষ্টির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রশাসনের ‘ক্ষমতা কুক্ষিগত’ নীতির পরিণতি
জেলা প্রশাসকগণ এই সনদপ্রদানের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখে মনে করছেন, তারা ইচ্ছেমতো শর্ত আরোপ করতে পারেন। কিন্তু তারা ভুলে যান, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও ১৯৮৯ সালের পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের মাধ্যমে খাস জমি ছাড়া অধিকাংশ জমির বিষয়ে চূড়ান্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা এখন জেলা পরিষদের হাতে।
এরপরও মাঠ প্রশাসনের একটি অংশ এখনো এই ক্ষমতা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে, যার ফলে নাগরিকরা পড়ছে চরম হয়রানির মুখে।
বাঙালিদের প্রতি দমনমূলক বৈষম্য
এপ্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভূমিহীন হলেও হেডম্যানের সুপারিশে সনদ পেয়ে যান; সেখানে বাঙালিদের ক্ষেত্রে জমির দলিল, পূর্বপুরুষের জমা বন্দোবস্ত ও এনআইডির সামঞ্জস্যের অজস্র ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে।
স্থানীয়দের ভাষায়, “এই শর্তাবলি এক প্রকার বাঙালি উচ্ছেদ পরিকল্পনা। শিক্ষা, চাকরি, ভূমি—সব কিছুর পথ আটকে দিতে এই প্রশাসনিক কৌশল।”
অনলাইন আবেদন নেই, ঘুষ-দালালচক্র সক্রিয়
রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সীমিত অনলাইন আবেদন চালু হলেও, বান্দরবানে এখনো পুরোপুরি অফলাইনে প্রক্রিয়া চলে। ফলে দালালচক্র ও দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য সেখানে সবচেয়ে বেশি। অনেক আবেদনকারী জানিয়েছেন, কেবলমাত্র হেডম্যান সনদের জন্যই ১০–২০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।
সমাধানের পথ কী?
সরকারের উচিত হবে—
১. জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদ ও ইউপি সনদের ভিত্তিতে ডিসি সনদ প্রদানের বিধান নিশ্চিত করা।
২. হেডম্যান ও সার্কেল চীপ সনদ বাধ্যতামূলক না রেখে ঐচ্ছিক করা বা বাতিল করা।
৩. আবেদন প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল, স্বচ্ছ ও ঘুষমুক্ত করা।
৪. সব নাগরিকের প্রতি সমান আচরণ নিশ্চিত করে সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করা।
একটি রাষ্ট্র, যখন নাগরিক পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করে, তখন সেটি শুধু অধিকার হরণ নয়—জাতিগত সম্প্রীতির চরম অবমাননা।
বান্দরবানের ডিসি সনদ আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভাজনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনই যদি এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বাতিল না করা হয়, তবে আগামী দিনের ইতিহাসে দায় নিতে হবে পুরো রাষ্ট্রকেই।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।