‘অখন্ড বাংলাদেশ ও সবাই বাংলাদেশি এই পরিচয়কে ধারণ করতে হবে’

‘অখন্ড বাংলাদেশ ও সবাই বাংলাদেশি এই পরিচয়কে ধারণ করতে হবে’

‘অখন্ড বাংলাদেশ ও সবাই বাংলাদেশি এই পরিচয়কে ধারণ করতে হবে’
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বহু বছর ধরে একটা ষড়যন্ত্র চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে জাতীয় আন্তর্জাতিক কোনো রকম ষড়যন্ত্র যাতে সফল হতে না পারে সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। কুকি চিনসহ সাম্প্রতিককালের কয়েকটি ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি দেশের সশস্ত্র বাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও গবেষকসহ সকল মহলকে সচেতন থাকার আহবান জানান।

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে শনিবার (৯ আগস্ট) দুপুরে সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আদিবাসী, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী প্রসঙ্গ ও জাতীয় নিরাপত্তা ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান।

সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান পলাশের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, কুকি চিনের ঘটনার পেছনে কিংবা পর্দার অন্তরালে অনেক কারণ আছে। আমাদের পার্বত্য অঞ্চল, ভারতের একটি অঞ্চল এবং মায়ানমারের একটি অঞ্চল নিয়ে হয়ত একটি পরিকল্পনা, আবার আরেকটি হলো এই অঞ্চল নিয়ে বৈশ্বিক কোনো কোনো শক্তির পরিকল্পনা আছে। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এই খণ্ডটাকে হয়তবা তারা অন্যভাবে সাজাতে চায়। সেজন্য আমাদেরকে সজাগ থাকতে হবে। যাতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক এ রকম যেকোনো পরিকল্পনা সফল হতে না পারে।”

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, দেশকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সব নৃ-গোষ্ঠী, উপজাতি, আধা উপজাতিসহ সবাইকে বাংলাদেশি হতে হবে। অখন্ড বাংলাদেশ ও সবাই বাংলাদেশি এই পরিচয়কে ধারণ করতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা সবাই যদি অখণ্ড বাংলাদেশে বিশ্বাস করি, আমরা যদি একই সংবিধানে বিশ্বাস করি, আমরা যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগলিক অখণ্ডতাকে বজায় রাখতে চাই, তাহলে আমাদের সবাইকে বাংলাদেশের সিটিজেন হিসেবে সংবিধানিক অধিকার ধারণ করতে হবে।

তিনি বলেন, ঐক্যবদ্ধ জাতি, ঐক্যবদ্ধ সমাজ ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্যই আমরা একাত্তরের পরে চব্বিশে আবারো রক্তদান করেছি।

তিনি বলেন, যেহেতু আমরা বিগত দিনে বিভক্তি দেখেছি। আমরা দেখেছি বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ জাতিকে বিভক্ত করার মানসিকতা। এদেশে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বলে বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে রাজনৈতিকভাবে বাণিজ্য হয়েছে। চেতনা বিক্রি করতে করতে বাংলাদেশে এতবেশি বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

‘অখন্ড বাংলাদেশ ও সবাই বাংলাদেশি এই পরিচয়কে ধারণ করতে হবে’
অনুষ্ঠানে উপস্থিতির একাংশ।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের সমস্ত মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছে। সবাই হয়ত সশস্ত্র সংগ্রামে সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি। তবে তারা মানসিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। বাংলাদেশের সমস্ত মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। যারা স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল বলে যাদেরকে আমরা বিভক্ত করতে চাই, তাদের মধ্যেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশকে অস্বীকার করার মতো প্রকাশ্য মানসিকতা আমরা দেখিনি। যারা হয়ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে গ্রহণ করতে পারেনি,

তাদের মধ্যে কিছু কিছু ভিন্ন চিন্তা থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করার মতো বক্তব্য দিয়ে সে রকম দুঃসাহস বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কেউ দেখায়নি। আমরা মনে করি স্বাধীনতার পক্ষে বিপক্ষে বক্তব্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করা কাম্য হতে পারে না। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে আমরা এটি কেউই আশা করতে পারি না।

তিনি বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ও প্রত্যাশা, এবং ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা, শহীদদের রক্তের আকাঙ্ক্ষা হলো- আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে এগিয়ে যাব। এই জাতির একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে সাম্য, মানবিক মর্যাদাভিত্তিক ও সামাজিক সুবিচার ভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণ। যার মধ্য দিয়ে আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে এবং সেই লক্ষ্যেই আমরা রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের জন্য অবিরাম চেষ্টা করছি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের বিএনপির পক্ষ থেকে আরো বছর দুয়েক আগে আমরা ৩১ দফা প্রণয়ন করেছি। জাতির সামনে আমরা এটা উপস্থাপন করেছি। তার প্রধান বক্তব্য হলো এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত করতে হবে। সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার করতে হবে। সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কার আনতে হবে। যাতে করে আমাদের স্বাধীনতার মূল আকাঙক্ষা আমরা পূরণ করতে পারি। সেই আকাঙক্ষা হচ্ছে আমরা একটি বৈষম্যহীন শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করব।

তিনি বলেন, আজকে যে আলোচনা এখানে হয়েছে তাতে আমার কাছে প্রায় সময়ই মনে হয়েছে যে, আমাদের টার্গেট এরিয়া হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। আমাদের টার্গেট এরিয়া কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পারে না। কারণ যারা উপজাতি হিসেবে নিজেদেরকে পরিচয় দিচ্ছে, সংবিধানে আমরা যাদেরকে উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃতাত্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করছি, তারা সকলেই শুধু পার্বত্য ধারণ করে আছে তা নয়।

দেশের সমস্ত বর্ডার লাইন এরিয়াতে এ রকম নৃতাত্তিক জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তারা বেশ ভালো জনসংখ্যায় আছে। যেমন আমাদের উত্তরাঞ্চলের খাসিয়া, গারো এবং শাওতাল। এছাড়াও আরো কয়েকটি জাতিগোষ্ঠী আছে। অনেকগুলো জাতিগোষ্ঠী তারা বর্ডার ল্যাণ্ড এরিয়াতে আছে। তাই কেবল পার্বত্যাঞ্চল নয়, যারা সমতলে আছে তাদেরকে সেই সুযোগ সুবিধা কি আমরা দেব না? যেটা আমাদের সংবিধান স্বীকার করেছে। আমাদের সংবিধানে যেহেতু আর্টিকেল ২৭ এ সমতার কথা বলেছে, প্রত্যেক নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান।

তিনি বলেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতে আনতে কিছু বিশেষ সুবিধা বা ব্যবস্থা রয়েছে। যাতে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ে। এটি বিশ্বের প্রায় সব দেশেই রয়েছে। আগামী ৫০-১০০ বছর পর তা হয়তো প্রয়োজন নাও হতে পাড়ে। তাদেরকে সরকারি চাকরি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেই সুবিধাটা রাখতে হয়, যাতে করে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ে।

সেজন্য এই সুবিধাটা আমাদের এখানেও আছে। সেটা সরকারি চাকরি ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে, এটা রাখতে হবে। সেই সুবিধাটা সীমান্তবর্তী সমতল এলাকায় যারা উপজাতি বা আধা উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃতাত্তিক জনগোষ্ঠী আছে তাদের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি। অবশ্যই আমাদের এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখতে বাংলাদেশের সবাইকে নিয়ে আমরা সিটিজেন হিসেবে আমরা একসাথে থাকতে পারি। আমাদের সবারই পরিচয় হবে আমরা বাংলাদেশি। আমরা আমাদের ন্যাশনালিটি বাংলাদেশি। আমরা সিটিজেন হিসেবে সবাই বাংলাদেশি পরিচয় দিই এবং এই পরিচয় দিতে পারি এবং সেটাই হবে হবে আমাদের ঐক্যের মূল শক্তি। ঐক্যই হবে আমাদের ন্যাশনকে এগিয়ে নেয়ার মূল শক্তি।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে যে কথাগুলো আমরা বারবার বলি, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যটাকে আমরা শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে নিয়ে নিয়ে যাব। আমি জেনারেল সাহেবদেরকে বলি, আপনারা মনোযোগ দেবেন, পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তি বাংলাদেশের জন্য ন্যাশনাল সিকিউরিটি থ্রেট। তারা বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। তারা বাংলাদেশিদের জন্য কোনোদিন রাজনীতি করেনি। তাদের গোড়া আরেক জায়গায়।

‘অখন্ড বাংলাদেশ ও সবাই বাংলাদেশি এই পরিচয়কে ধারণ করতে হবে’
বক্তব্যে রাখছেন বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর নায়েবে আমির শাহজাহান চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর নায়েবে আমির শাহজাহান চৌধুরী বলেন, আদিবাসী শব্দটা পাহাড়িদের জন্য নয়, উপজাতিদের জন্য নয়, এটা একটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এটার মাধ্যমে আমাদের পার্বত্য এলাকাকে জম্মুল্যান্ড করতে চায়। এই জম্মুল্যান্ড করার জন্যই আজকে এই ষড়যন্ত্র। সেখানে শুধু শান্তিবাহিনীই নয়, সেখানে কুকি চিন বাহিনী, মগদের সশস্ত্র বাহিনী, অর্থাৎ সমগ্র এলাকাটা একটা অশান্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, পাহাড়ি সশস্ত্র বাহিনীদের দমন করার জন্য শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেই পদক্ষেপ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে আদিবাসী প্রশ্নটা কোনোদিন উঠতো না।

শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‌‌পাহাড়িদের সাথে সমতলের মানুষের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো যারা পাহাড় নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে, গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ফায়দা লুটছে তাদের সাথে। পাহাড়ের সমস্যা সমাধানের জন্য জনগণকে দোষ দিয়ে লাভ নেই । পাহাড়ি সশস্ত্র বাহিনী যারা সেখানে চাঁদাবাজি করছে, নৈরাজ্য চালাচ্ছে, অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে, তাদেরকে দমন করার জন্য শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ফর্মুলার ভিত্তিতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সমস্যা দীর্ঘ দিন ধরে চলছে। বিশেষ করে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই সমস্যা সমাধানের জন্য অত্যন্ত বাস্তব কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সমস্যার সৃষ্টি কখন হয়েছে আপনারা মনে হয় সবাই জানেন। উল্লেখ করার দরকার নেই। আমাদের সাথে উপজাতিদের সাথে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকদের সাথে একটা ওতপ্রোত সামাজিক বন্ধন ছিল। আমরা সেখানে গিয়ে ব্যবসা করতাম। ওনারাও আমাদের এখানে এসে ব্যবসা করতেন। এই সমস্যা সৃষ্টি হবার পর থেকে সমাধানের জন্য শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান উদ্যোগ গ্রহণ করলেন, সমস্যা কারা সৃষ্টি করেছে।

শাহজাহান চৌধুরী আরও বলেন, পাহাড়িদের সাথে সমতলের মানুষের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো যারা এইটা নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে, গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ফায়দা লুটছে তাদের সাথে। এই সমস্যাটা সৃষ্টি করা হলো প্রথমে জম্মুল্যান্ড নামক একটি স্লোগান বের করে। বলা হলো যে এটাকে আলাদা করা হবে। এটা হবে জম্মুল্যান্ড। একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে একটা পুস্তিকা দেয়া হলো। এই পুস্তিকা সব জায়গায় বিতরণ হলো। আমি বিশেষ করে ১৯৯১ সালে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে যখন সরকার গঠিত হলো, তখন আমাদের তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের নেতৃত্বে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একটি কমিটি করে দিলেন। সেটার নাম ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত সরকারি কমিটি। এই কমিটিতে আমি সদস্য হিসেবে কাজ করেছি। আমরা প্রায় ৩৩ বারের মতো সন্তু লারমার সাথে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি বৈঠক করেছি। সেই সময় কোনো অবস্থায় আমরা সন্তু লারমার সাথে শুনি নাই, যে আমরা আদিবাসী। এই আদিবাসী শব্দটা কখন আসলো এটা বর্ণনা করতে গেলে আমার একটু সময় লাগবে। তখন সন্তু লারমারা বলেছিলেন, যে আমরা অধিকার চাই।

তিনি বলেন, পাহাড়ে প্রায় ১৫টি নৃগোষ্ঠী আছে। এই নৃগোষ্ঠী শব্দটি কখন আসছে সে নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। ১৯৯১ সালে বিএনপির এই কমিটির উদ্যোগে আমরা সমাধান করতে চেয়েছিলাম। আমরা সমঝোতায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। সন্তু লারমা রাগ করে চলে গেলেন। বললেন যে, শরনার্থীদের না আনলে সমঝোতা চুক্তি হবে না। তখন শরনার্থী তুলে আনার জন্য ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি হলো। আমি ছিলাম সেখানে একজন সদস্য। শেষ পর্যন্ত আমরা সফল হলাম। শরনার্থী সবাইকে আমরা বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনলাম। তাদের শর্ত যা ছিল সব আমরা মেনে নিলাম। তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেয়া, তাদেরকে ঘর বানিয়ে দেয়া, তাদের জমি ফেরত দেয়া।

আওয়ামী লীগ সরকারের শান্তিচুক্তির সমালোচনা করে তিনি বলেন, পরে ১৯৯৭ সালে পাহাড়ে শান্তিচুক্তি হলো। এটাকে শান্তিচুক্তি হিসেবে পাহাড়িরা মেনে নিল না। এই চুক্তিটা হয়েছিল শুধু মাত্র শান্তিবাহিনীর সাথে। সন্তু লারমা এবং জনসংহতি সমিতির সাথে। উপজাতিরা বললো যে, এটাতে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। শেষ পর্যন্ত এই শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে আমরা ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সংগ্রাম করলাম, লংমার্চ করলাম। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, জামায়াত ইসলামীর জনাব গোলাম আজম সাহেব, তারপরে আরো অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে খাগড়াছড়ি লং মার্চ করলাম। আমরা বললাম, আমরা শান্তিচুক্তি মানি না। আমরা ক্ষমতায় আসলে বাতিল করব। দুর্ভাগ্য ২০০১ সালে আমরা চার দলীয় জোট ক্ষমতায় আসলো। পার্লামেন্ট মেম্বার হলাম। আমাকে আবারো সংসদীয় কমিটির মেম্বার করা হলো। আমরা বারবার বললাম যে, শান্তিচুক্তি বাতিল করেন। তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি মান্নান সাহেবের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটা কমিটি হলো।

তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত আমরা চুক্তি বাতিল করার সময় পেলাম না। ওয়ান ইলেভেন এসে গেল। সেই থেকেই এই সমস্যা। আসলে পাহাড়িদের সাথে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো পাহাড়ের সশস্ত্র বাহিনী যারা আছে তাদের সাথে। এই সশস্ত্র বাহিনীদের দমন করার জন্য শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেই পদক্ষেপ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে আজকে আদিবাসীর এই প্রশ্নটা কোনোদিন উঠতো না। আদিবাসী এই শব্দটা পাহাড়িদের জন্য নয়, উপজাতিদের জন্য নয়, এটা একটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এটার মাধ্যমে আমাদের পার্বত্য এলাকাকে জম্মুল্যান্ড করতে চায়। এই জম্মুল্যান্ড করার জন্যই আজকে এই ষড়যন্ত্র। সেখানে শুধু শান্তিবাহিনীই নয়, সেখানে কুকি চিন বাহিনী, মগদের সশস্ত্র বাহিনী, অর্থাৎসমগ্র এলাকাটা একটা অশান্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে।

তিনি আবারও বলেন, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী সব সময় ১৯৯১ থেকে এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা এবং বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যখনই ক্ষমতায় এসেছে তাদের সাথে আমরা কাজ করেছি। এই সমস্যা সমাধানের জন্য জনগণকে দোষ দিয়ে লাভ নেই । সশস্ত্র বাহিনী যারা সেখানে চাঁদাবাজি করছে, নৈরাজ্য হচ্ছে, অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে, তাদেরকে দমন করার জন্য শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের যে ফরমূলা, সেই ফরমূলার ভিত্তিতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান হতে পারে। এক নম্বর হলো জমি সমস্যা। ওরা এখানে এসে বসবাস করতে পারবে।

শাহজাহান চৌধুরী বলেন, আমরা সেখানে কোনো জমি ক্রয় করতে পারব না। এই নীতি প্রত্যাহার করতে হবে। ওখানে বসবাস করার যে বাধা বিঘ্ন সরিয়ে দিতে হবে। শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। আমি মনে করি, জনসংখ্যার অনুপাতে সেখানে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার যাতে হতে পারে। সবকিছুতে সমান অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে সব সম্প্রদায়ের লোকেরা থাকবে। সেখানে মারমারা থাকবে, ত্রিপুরা থাকবে, তঞ্চঙ্গারা থাকবে, চাক, শাক অর্থাৎ সবাই থাকবে। এভাবে যদি আমরা একটা সমঝোতা করতে পারি, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বিরাজ করবে। এটা হলো একটা সুন্দর জায়গা। যারা আমরা সমতলে বসবাস করি, সম্মিলিতভাবে সবাইকে সাথে নিয়ে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে অবশ্যই সমস্যার সমাধান হবে। এখানে আদিবাসী শব্দ কোনো অবস্থায়ই মেনে নেয়া, স্বীকার করা প্রশ্নই ওঠে না।

‘অখন্ড বাংলাদেশ ও সবাই বাংলাদেশি এই পরিচয়কে ধারণ করতে হবে’
বক্তব্য রাখছেন প্রফেসর ডা. আলমগীর মোহাম্মদ মওদুদ।

একই অনুষ্ঠানে বিএনপি মিডিয়া সেলের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. আলমগীর মোহাম্মদ মওদুদ বলেন,  আমাদের ঠিকানা যেখানেই হোক পাহাড়ে কিংবা সমতলে, প্লাবন ভূমি, দ্বীপাঞ্চল কিংবা উপকূলে আমাদের সবারই পরিচয় অভিন্ন হওয়া দরকার যে আমরা সবাই বাংলাদেশী। আমরা বাংলাদেশী চাকমা হই, বাংলাদেশী মারমা হই, বাংলাদেশী গাঢ় হই, বাংলাদেশী শাঁওতাল হই, বাংলাদেশী রাজবংশী হই, বাংলাদেশী মুন্ডা হই, বাংলাদেশী খাঁসি হই- তাদের সাংস্কৃতিক যে বিকাশময়তা রয়েছে, যে ঐতিহ্য রয়েছে সেটি সংরক্ষিত হোক।

তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশে যারা আপামর জনগোষ্ঠী যারা বসবাস করি তাদের মধ্যে তো ভাষাগত বা সাংস্কৃতিগত বিভাজন রয়েছে। চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট কিংবা উত্তরাঞ্চল, তাদের প্রত্যেকের ভিতরে যেমন একটা অভিন্ন জাতিসত্তা রয়েছে, আবার সাংস্কৃতি জগতেও ছোট ছোট নিজস্ব স্বকীয়তা বা নিজস্বতা রয়েছে। আমরা সমাধানের যত গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করব। সেখানে একটি জিনিসই প্রকৃত পক্ষে সামনে এসে দাঁড়াবে তাদের কথা শোনা, তাদের সাথে আন্তরিকভাবে মিশবার চেষ্টা করা। শক্তি দিয়ে নয়, বরং ভালোবাসা দিয়ে তাদের সবাইকে যদি আমরা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সাথে এক জায়গায় আনতে পারি, তাদের সংস্কৃতিকে যদি রক্ষা করি, তাহলে প্রকৃত সমস্যার সমাধান হবে।

তিনি বলেন, আমরা অগ্রাধিকার কোনটিতে দেব, শুধুমাত্র কি সেই সংজ্ঞার জটিলতার মধ্যে- যে তারা আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এই জায়গায় নাকি তাদের প্রজন্মের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, তাদের শিক্ষা, তাদের স্বাস্থ্য, তাদের অর্থনীতি, সর্বপরি তাদের দেশপ্রেমকে সামনে এনে।

প্রফেসর ডা. আলমগীর মোহাম্মদ মওদুদ আরো বলেন, আমরা বাংলাদেশের জনগণ, তাদের সকল জনগোষ্ঠীকে দেশের মূলধারায় মূল স্রোতের সাথে যদি মেশাতে চাই তাহলে আমাদের পুরো নিরাপত্তা বিশ্লেষণটা শুধুমাত্র সামরিক নিরাপত্তা না ভেবে সামাজিক নিরাপত্তা এবং একই সাথে রাজনৈতিক নিরাপত্তার ভঙ্গিতে দেখা দরকার। আমরা জানি যে, এখানে যারা বসবাস করছেন তাদের মধ্যে এখানে যারা বসবাস করছেন তাদের মধ্যে শুধু মাত্র যে, আদিবাসী সংজ্ঞা একমাত্র জটিলতা সামনে আছে তেমন নয়, যে গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে কথা বলছি তাদের ভেতরে সংখ্যানুপাতের পারস্পরিক উন্নয়ন সংক্রান্ত একটা বিভাজন এবং বৈষম্য রয়েছে। আমি একজন শিক্ষক এবং আমি জানি যে, মেডিকেল কলেজে তাদের একটা কোটা আছে। ছাত্রদের একটা নির্দিষ্ট কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এটি রয়েছে। কিন্তু এটাও সাথে জানা দরকার যে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজন শক্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত্তি। কিন্তু আমরা কি সত্যি সত্যিই সেই জায়গাগুলোতে কাজ করেছি?

‘অখন্ড বাংলাদেশ ও সবাই বাংলাদেশি এই পরিচয়কে ধারণ করতে হবে’
বক্তব্য রাখছেন আম জনতা পার্টির সাধারণ সম্পাদক মো. তারেক রহমান।

আম জনতা পার্টির সাধারণ সম্পাদক মো. তারেক রহমান বলেন, বাংলাদেশে কে আদিবাসী, কে অ-আদিবাসী এ নিয়ে সুচিন্তিতভাবে শয়তানি করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, তাহলে তো কাগজ কলম নিয়ে বসতে হবে যে, আমরা কারা কারা এক হাজার বছর ধরে আধিভূত, আর কে কে মায়ানমার থেকে আসলাম। কে কে চায়না থেকে আসলাম। যোগ-বিয়োগ করতে হবে না? আমরা সেই যোগ বিয়োগে কেনো যাচ্ছি। আমার স্পষ্ট কথা, এই জাতিগত যে ভাগ বা গোষ্ঠীগত যে ভাগ, এটা সারাদেশেই কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় আছে। আমাদের এখানে হয়ত প্রামাণিক, চৌধুরী হিসেবে বা খান হিসেবে আছে, পাহাড়ে চাকমা, মারমা, শাওতাল এইভাবে আছে। সবাইকে বাংলাদেশি বললে সমস্যা কোথায়?

বৈঠকে তারেক রহমান আরও বলেন, আমার বগুড়াতে দুটি ক্যান্টনমেন্ট। একটা জাহাঙ্গীর নগর ক্যান্টনমেন্ট, আরেকটা মাঝিরা ক্যান্টনমেন্ট। আমার জন্য এই ক্যান্টনমেন্ট কোনো সময় অস্বস্তির কারণ হয় না। আমি এই ক্যান্টনমেন্ট দেখলে ভয় পাই না। আমি এই ক্যান্টনমেন্ট দেখলে নিরাপদ মনে করি। আমার প্রশ্ন যারা ক্যান্টনমেন্ট দেখে ভয় পাচ্ছেন, আপনারা কেনো এই ভয়টা পাচ্ছেন, আমরা তো ভয় পাই না। তার মানে আপনি এমন কিছু কার্যক্রম করেন যে কার্যক্রমগুলো ভয় পাওয়ার মতোই আসলে। যে সংগঠনগুলো এই কার্যক্রমগুলো করছে আদিবাসীকেন্দ্রীক সংকট, এই কার্যক্রমগুলো তাদের রুটি-রুজির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো বেঁচে খায়। এটা কাদের কাছে বেচে খায়, ওই চাকমাদের কাছে বেচে খায়, শাঁওতাল, মারমা, ম্রো, তাদের কাছে বেচে খায়। এদের কাজ নাই, এরা চাঁদাবাজি করে, মানুষকে কষ্ট দেয়।

তিনি আরও বলেন, আমি বলছি,১০টা বা ৫০টা জাতিগোষ্ঠী আলাদা আলাদা জাত, এই জাতিগোষ্ঠীগুলো তাদের নিজ নিজ নামে পরিচিত হতে সমস্যাটা কোথায়? একজন চাকমা- চাকমা হিসেবেই বাঁচবে। চাকমা এদেশের নাগরিক তাতে কোনো সমস্যা আছে আমাদের? কেনো এদের এক জায়গায় করে আদিবাসী বানানো হয়? এটা আমার জিজ্ঞাসা। তারপরে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা ব্যবস্থা আছে। আমরা এটা খুবই সমর্থন করি। এটা খুবই দরকার। আমার জিজ্ঞাসা হলো- পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর যে কোটা ব্যবস্থাপনা এটার মেজরটি শেয়ার কেনো চাকমারা পায়? সবগুলো উপজাতিকে এক জায়গায় করে, সবগুলো নৃগোষ্ঠীকে এক জায়গায় করে যে কোটা দিয়ে দেওয়া হলো। দেশের প্রেক্ষাপটে বড় গোষ্ঠীর সাথে আপনারা ছোট গোষ্ঠীগুলো পারছেন না। সে কারণে কোটা নিচ্ছেন। খুব ভালো কথা। সেইটা শাক জাতি পায় না কেনো, মারমা পায় না কেনো? ম্রোরা পায় না কেনো? গাঢ়রা পায় না কেনো, শাঁওতালরা পায় না কেনো? এই সুবিধাটা তারা পাচ্ছে না। পাচ্ছে না কেনো? আমরা সঠিক ভাবে এই সমস্যাগুলো নিরূপণ করি না।

May be an image of 12 people, people studying, table, dais and text

তারেক রহমান বলেন, আমাদের স্পষ্ট কথা। আমাদের এই সরকারের আগে বিগত যে সরকারগুলো ছিলো, সেই সরকারের কোনো সরকার, উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, আদিবাসী, বিতর্ক করার কোনো সাহস বা হিম্মত কখনো করেনি। কিন্তু বর্তমান সরকার এসে এই বিষয়গুলো নাড়া দিচ্ছে। আমি বলি, এই এনজিওভিত্তিক চক্রান্ত যদি বন্ধ না করেন, এই ভূঁতটাকে আমরা উল্টায়ে দিব একেবারে। কোথায় কোন ভূঁতের কয় হাত, কয় পা, এগুলো আমরা খুঁজে বের করব। ভারতে যে এনজিওগুলো এনজিওর কাজ করে একই সাথে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের কাজ করে। ভারত খুব সুনির্দিষ্টভাবে আইডেনটিফাই করেছে, যে তারা জাতিগত এই ভাগটা ঘটাচ্ছে। আমাদের এখানোও দেখেন, ধর্মীয় আগ্রাসন হচ্ছে। কোনো মুসলিম সম্প্রদায়, কোনো আদিবাসীর উপরে ধর্মভিত্তিক আগ্রাসন চালায় নি। এই যে ময়মনসিংহে আমাদের যে জাতিগোষ্ঠীগুলো আছে, তাদের ওপর কোনো আগ্রাসন চালানো হয় নি। অথচ তাদের অনেককে খ্রিস্টান বানানো হয়েছে। তাদের ওপর ধর্মীয় আগ্রাসন চালানো হয়েছে। যদি পুরনো শিকড়ের কথা বলা হয়, তাহলে একজন ম্রো, একজন মারমা, একজন শাক তার জাতির ধর্মকে ধর্মান্তরিত করার জন্য কেনো এখানে অর্থায়ন করা হচ্ছে। তারা যে যে ধর্মে আছে, যে যে পরিচয়ে আছে, সেটিতে থাকুক।

তিনি বলেন, এখানে অনেক গুণীজন আছেন। এখানে বসা যেনো শেষ না হয়। এখান থেকে শুরু হোক। নিয়মিত আলোচনা হোক। আমরা পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীদের বলি যে, আমরা বাংলাদেশি হিসেবে বেশ ভালো বোধ করি। আপনাদেরকেও বাংলাদেশি হিসেবে ভালো বোধ করতে হবে। আমরা সবাই একসাথে থাকতে চাই। একই অধিকার নিয়ে থাকতে চাই একভাবে। আপনাদের পাহাড়ে অনেক সমস্যা আছে। ইলেকট্রিসিটি, মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যাসহ অনেক সমস্যা আছে। আমরা সমতলের মানুষেরা পাহাড়ের সমস্যা অনুধাবন করতে পারব না। ওই খানে একটা বই পড়তে বসলে ওই বইয়ের ওপরে টুপ করে ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে। এটা আমরা জানি। ওখানে লেখাপড়া করতে অনেক কষ্ট। ওখানে কেয়ারিং প্রয়োজন। সেই কেয়ারিংটা রাষ্ট্রকে করতে হবে। কিন্তু জাতিগত বিভেদের মধ্য দিয়ে কেয়ারিংয়ের প্রয়োজন নেই। ইচ্ছা করলেই সেই কেয়ারিংটা করা যায়।

সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান পলাশ তাঁর বক্তব্যে আদিবাসী বিতর্ক নিয়ে বিস্তারিত ধারণা দিয়ে বলেন, ‌’আদিবাসী’র যে একাডেমিক্যালি চিরাচরিত সংজ্ঞাগুলো আছে তার বাইরে গিয়ে হঠাৎ করে ১৯৮৬ সালে নতুন করে একটা সংজ্ঞা জাতিসংঘের মাধ্যমে আসে এবং সেই সংজ্ঞায় সারা বিশ্বে একটি বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। এই বিশৃঙ্খলাতার একটা প্রভাব আমাদের বাংলাদেশেও পড়েছে। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি এই দেশে আদিবাসী বলতে যে মূল জনগোষ্ঠী বুঝায়, তা মূলত বাঙালিরাই। এর মধ্যে বাঙালি মুসলিম, বাঙালি বৈদ্য, বাঙালি খ্রিস্টান রয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) ড. মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন যে, আজ আমরা এমন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলবো যার সাথে আমাদের প্রাণপ্রিয় এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও ভূমির অখণ্ডতা জড়িত। বাংলাদেশে আদিবাসী কে, বাংলাদেশে আদিবাসীদের অস্তিত্ব আছে কিনা, এ দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কেউ কেউ নিজেদের এ অঞ্চলের অধিবাসী হিসেবে দাবি করছেন তার যৌক্তিকতা আছে কিনা, তাদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে দেশের কি অসুবিধা, জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট ফোরাম আদিবাসী ও উপজাতি হিসেবে কাদেরকে চিহ্নিত করতে চেয়েছে, আদিবাসী হিসেবে যাদের চিহ্নিত করতে চাচ্ছে তাদের কী কী অধিকার দিতে চাচ্ছে, এর সাথে বাংলাদেশের সংবিধানের কোনো সাংঘর্ষিক বিষয় আছে কিনা- সে সব বিষয়ে তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনা আজ আমরা এই বৈঠকে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

তিনি আরো বলেন, এদেশে বসবাসরত সকল বৈধ নাগরিকের সমান অধিকার যা আমাদের সংবিধানে কমপক্ষে ২৭, ২৮(১), ২৮(২) এবং ২৯(৩) অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করা হয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে আমরা সকল নাগরিককে, বিশেষত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চেতে যথেষ্ট কাজ করছি কিনা অথবা সদিচ্ছা আছে কিনা তা পর্যালোচনা করা। তিনি বলেন, আজকের এ আলোচনাংশে ৪টি মূল প্রতিপাদ্য আঙ্গিক জড়িত। প্রথমত ঐতিহাসিক, দ্বিতীয়ত আইনগত, তৃতীয়ত আর্থ সামাজিক এবং চতুর্থটি নিরাপত্তা বিষয়ক।

ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম উল্লেখ করে মূল প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন যে, শান্তিচুক্তির পূর্বে যেখানে একটি পাহাড়ি সন্ত্রাসী দল ছিল, আজ সেখানে ছয়টি দল পাহাড়ে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। প্রতিনিয়ত হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও ভূমি দখলের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমরা বাঙালিরা জন্ম থেকেই বৈষম্যের শিকার। এই বৈষম্যই আমাদের লড়াই করতে শিখিয়েছে। এই বৈষম্যই আমাদেরকে রক্ত দেওয়া শিখিয়েছে। এই বৈষম্যের মাধ্যমেই আমরা একাত্তরের স্বাধীনতা পেয়েছি। আবার ২০২৪ এর ৫ আগস্ট দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি। এই বৈষম্যই আমাদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখে একটি শক্তিশালী জাতীয় সংহতি। আমি মনে করি এই বৈষম্য ঐক্যের প্রতীক। যখনই আমরা বৈষম্যের শিকার হই, তখনই আমরা ইউনাইটেড হই। আমরা আজ এখানে বৈঠকের শুরুতে তথ্যভিত্তিক একটা ভিডিও দেখতে পেলাম। সেখানে জানা গেল যে, দেশের ১৩টি উপজাতি রয়েছে, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে না। তারা দেশের বিভিন্ন জেলায় বসবাস করছে। আমরা জানি, সরকার মাইনরিটির জন্য কিছু বিশেষ সুবিধা বা অধিকার দিয়েছে। এটা আমাদের সংবিধানেই দেয়া আছে। কিন্তু সেই সুবিধা বা অধিকারসমূহ আমরা সঠিকভাবে বণ্টন করতে দেখি না। ক্ষেত্র বিশেষ এ সুবিধা যাদের প্রভাব বেশি তারাই সব লুটে নিচ্ছে। এটা যদি সব জাতি, উপজাতিদের মধ্যে সমান ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে পৌঁছে দেয়া গেলে তাদেরকে দেশের মূলস্রোতে একীভূত করা সহজ হবে।

তিনি আরো বলেন, আজকে দেশের তরুণ প্রজন্ম শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক উন্নত হয়েছে। এরা কেউ যুদ্ধ করতে চায় না। সবাই তারা নতুন জীবনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই নতুন প্রজন্ম- এদেরকে integrate করতে হবে। এদেরকে integrate করতে পারলে আমার মনে হয় পাহাড়ের অশান্তি আর থাকবে না। আমরা জানি, এই অশান্তি এই যুদ্ধ কত কষ্টকর। সুতরাং পাহাড়ের সাধারণ মানুষেরা বা তরুণরা ইচ্ছা করে সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত হচ্ছে না বা যুদ্ধে যাচ্ছে না। এদেরকে জোর-জবরদস্তি করে নেওয়া হয়। আমরা যদি এমন একটি সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি, তরুণদের চাকরির ব্যবস্থা করতে পারি, তাদেরকে যদি রাষ্ট্রের মূলস্রোতে একীভূত করতে পারি, তারা অবশ্যই অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা থেকে বিমূখ হবে বলে মনে করি।

তিনি আরো বলেন, আজকে যে ইস্যুতে এখানে আলোচনা হচ্ছে, এখানে পাহাড়ের লোকজন আছে। আমি আশা করেছিলাম আরো বেশি থাকবে। যারা আজকে আদিবাসী হওয়ার দাবি তুলছে এ রকম সভা, সেমিনার বা বৈঠকে তাদেরকেও এনে বসানো উচিৎ। তাদের কাছ থেকে জানতে চাওয়া উচিৎ আপনারা কোন যুক্তিতে, কেনো আদিবাসী হতে চাচ্ছেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী কোনো রাষ্ট্রে আদিবাসী স্বীকৃতি দেয় নি। তাদের সাথে আমাদের সামনা-সামনি যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে কনভিন্স বা রাজি করাতে হবে। বিশ্বের বড় বড় দেশ তারা তো তাদের সব আদিবাসীদের চিরিয়াখানায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। একটা মিউজিয়ামে পরিণত করেছে।

মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর পাহাড়িদের আহবান জানিয়ে বলেন, আসুন, আপনারা যারা আদিবাসী দাবি করছেন, তারা মিউজিয়ামে বা চিড়িয়াখানায় না গিয়ে আমরা এদেশে একসাথে বসবাস করি। বাঙালি জাতির মন পলিমাটির মতো নরম। আমরা সবাই মিলে মিলে একসাথে স্বাধীন-সমৃদ্ধ সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব, ইনশাআল্লাহ।

ওসমানী সেন্টার ফর পিস এন্ড সিকিউরিটি স্ট্যাডিজের চেয়ারম্যান লে. জেনারেল (অব.) ড. মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে আমি ১৫ বছর পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছি। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে আমার একটা আবেগময় অনুরাগ আছে। আমি যখন আমার প্রথম জীবনে ১৯/২০ বছর বয়সে পার্বত্য এলাকায় গিয়েছি, তখন শান্তিবাহিনীর দুর্দান্ত প্রতাব। তার ভেতরেও সেখানকার মানুষের ব্যবহার আমাদের প্রতি বেশ ওয়েলকামিং ছিল। আমরা তাদের বাড়িতে গেলে তারা পানি, ফল অফার করত। আন্তরিক একটা পরিবেশ ছিল। আমি লাস্ট চাকরি করেছি ২০১২ সাল পর্যন্ত। তখন আমি পাহাড়ের ওই সমস্ত গ্রামে গিয়ে লক্ষ্য করেছি, তারা আমাদেরকে আর আগের মতো সেভাবে দেখে না। হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত এগিয়ে দিলেও হ্যান্ডশেক করতে চায় না। মুুখ ফিরিয়ে নেয়। এর কারণ হলো একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে সেখানে। বিভিন্ন স্যোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই ন্যারেটিভ তৈরি হওয়ার কারণেই এই পরিস্থিতি হয়েছে।

তিনি বলেন, ঢাকার কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। পলিটিক্যাল স্পেসে ঢাকার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্ষমতায় যাওয়া, ক্ষমতায় গিয়ে টিকে থাকা। গত ১৫ বছরে আমরা তাই দেখেছি। এটাই ঢাকার কাছে মোদ্দা বা আসল কথা। অবশ্যই পলিটিক্যাল স্পেসে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আনতে হবে। পার্বত্য এলাকা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম ডিভিশনের কাছে। অর্থাৎ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের কাছে। মনে রাখতে হবে ২৪ পদাতিক ডিভিশন সিকিউরিটি সিচুয়েশনকে মোকাবেলা করতে পারে। কিন্তু পলিটিক্যাল সিচুয়েশন মোকাবেলা করতে পারে না। জেএসএস, ইউপিডিএফ বা এ রকম সংগঠনগুলোর সাথে এরা টেক্কা দিতে পারবে না। কারণ জেএসএসের কাছে যেমন পলিটিক্যাল উইং আছে, মিডিয়া উইং আছে, ইকনোমিক উইং আছে, কালচারাল উইং আছে। তেমনি আবার প্রপাগান্ডা উইংও আছে। একটা মিলিটারি ইউনিটে তো এগুলো থাকে না। আপনাদের মনে থাকতে পারে যে, ১৯৭৫ সালে যখন শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়, তখন দিল্লি এটাকে ধরে নিয়েছিলো এলিটি ইন দ্য পলিটি বা রাজনৈতিক অবাধ্যতা।

তিনি কিছু সুপারিশ তুলে ধরে বলেন, বিভাজনের ইন্ধনদাতাদের সনাক্ত করতে হবে। বিভাজন সৃষ্টি হতে দেওয়া যাবে না। পার্বত্যবাসীর সাথে সকল পর্যায়ে সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। তাদের অভাব অভিযোগগুলো শুনতে হবে। ধৈর্যহারা হলে চলবে না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এটাকে ন্যাশনাল ইস্যু হিসেবে আলোচনায় আনতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেখতে হবে প্রাইম বিষয় হিসেবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা শক্তিকে আমাদের জাতীয় জীবনে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে। সেটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে জাতি পাবে ঋতু পর্ণা কিংবা রূপা চাকমাদের মতো প্রতিভা।

মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রব বলেন, আমাদের দেশের বরেন্দ্র এলাকায় সাঁওতাল, মুণ্ডা, সিলেট অঞ্চলে খাসিয়ারা বাস করছে। তাছাড়া সিলেটের চা বাগানে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকেরা কাজ করে। গাঢ়দের বাস রয়েছে ময়মনসিংহ এলাকায়। এদেশে মনিপুরিরাও রয়েছে। শুধু পাহাড়ের কথাই বলা হয়, এদের কথা তো ততটা বলা হয় না। তাই বোঝা যায় যে, পাহাড়ি আদিবাসী ইস্যু রাজনৈতিক। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আমরা শ্রদ্ধা করি ওনার দেশপ্রেমের কারণে। তিনি ক্যাটাগরিক্যালি বলেছেন সবাই বাংলাদেশি। সুতরাং মাইনরিটি, মেজরিটি, আদিবাসী, ইনডিজেনাস- এগুলো না বলে আমরা একজাতি এবং এক বাংলাদেশি। আমরা সাম্য, সম্প্রীতি, মমতায় ভালোবাসায় মিলেমিশে এক মহান জাতি হিসেবে বিশ্বে গড়ে উঠতে চাই। আমাদের নীতি হওয়া উচিৎ যে, আমরা সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাব। যারা পিছিয়ে পড়েছে তাদের অগ্রসর হতে সাহায্য করব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া বলেন, আজকে আমরা কথা বলছি, আমরা জানি, এদেশে জাতিগোষ্ঠী প্রায় ৫১টি। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর যারা নেতৃত্বদান করছেন, তাদেরকে এ ধরনের বৈঠকে আমন্ত্রণ জানালে তাদের ভাবনাগুলো, তাদের কথাগুলো শুনলে বোঝা যাবে তারা কি ধরনের সঙ্কটে আছে। তারা কেনো বিপদগামী হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তাদেরও দায়িত্ব আছে। যেহেতু আমি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, তাই পার্বত্য জেলা সম্পর্কে আমি জানি। মাঝে মাঝে সেখানে যেতে হয়। আমি যেহেতু শিক্ষক, এই বিষয়ে আমি গবেষণা করি, বই প্রকাশ করি।

তিনি বলেন, আলোচনায় আমি দ্বন্ধ-সংঘাতে যাব না। আমি পক্ষ-নিরপেক্ষতা গ্রহণ করব না। এই বৈঠকে পাহাড় থেকে এসে যারা অংশ নিয়েছেন, কথা বলেছেন, তাদের কথা আমার খুব ভালো লেগেছে। তাদের কথাগুলোকে যদি আমরা সংগ্রহ করি, তাদের কথাগুলোকে যদি আমরা মূল্যায়ন করি, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। একটি পাহাড়ি তরুণ তার আলোচনায় বলেছেন, আমি চাকমা বুঝি না, আমি মারমাও বুঝি না। এই দেশ আমার। তার এই যে দেশপ্রেম, তিনি তার ভালোবাসার কথাই বলেছেন।

তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর লোকজন আছে। নৃগোষ্ঠী শব্দের একটা সুন্দর অর্থ আছে। নৃ শব্দটি খুবই আদি বা প্রাচীন। মাটির সঙ্গে মিশে আছে। এই নৃ এর তত্ত্বগুলো আমরা যদি নিতে পারি তাহলে আমার মনে হয় এর সমাধান হয়ে যায়।

তিনি বলেন, আজকে প্রকৃত গবেষণা হচ্ছে না। আমার প্রশ্ন পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি কিংবা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় কেনো গঠিত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানগুলো সৎভাবে ব্যবহার করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পার্বত্য চট্টগ্রামকে রক্ষা করা, পার্বত্যবাসীদের রক্ষা করা। পার্বত্যাঞ্চল এদেশেরই অংশ। সমান মর্যাদা দিয়ে এই পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে নিয়ে আসতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. সুফি মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমি একজন শিক্ষক এবং ৩৫ বছর ধরে গবেষণা করছি। আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশে গবেষণার খুব অভাব। প্রকৃত গবেষণার আরো অভাব। যেহেতু আমি ছাত্র জীবন থেকে গবেষণা করেছি। আমি নরসিংদীর উয়ারি বটেস্বর নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করেছি। আমার গবেষণা অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ ছেপেছে।

তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ে শিক্ষকরা গবেষণা করতেই চান না। পার্বত্য বিষয়ে গবেষণা করেন দেখেন কে ফান্ডিং করছে। প্রকৃত গবেষণা ব্যয় বহুল। সরকারের যে এগিয়ে আসতে হবে, সরকারেরই সেই মাথাব্যথা নেই। আমি উয়ারি বটেস্বর নিয়ে যে গবেষণায় দেখেছি, আড়াই হাজার বছর আগে একটা নগর ছিল, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সিল্করুটের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এখন যে প্রশ্নটি আসছে এদেশে কে আদিবাসী, আবার কে অ-আদিবাসী। আমরা যে বাঙালি বলি, এই বাঙালি আসলে কখন থেকে। কেউ কি উত্তর দিতে পারবে? যদি আড়াই হাজার বছর আগে নগর হয়, তারা কি বাঙালি ছিলো? তাই প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা খুবই জরুরি।

লেবার পার্টি বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ডা. মুস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, স্বাধীনতা লাভের পর যখন শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়িদের বাঙালি হতে বললেন, তখন থেকেই পাহাড়ে এই দৃশ্যমান সংঘাত বা হত্যার রাজনীতি শুরু হয়েছে। এই সংঘাতের কিছুটা হলেও পরিসমাপ্তি ঘটে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ফর্মুলার মাধ্যমে। আমাদেরকে একটি নতুন পরিচয় দেয়ার মধ্য দিয়ে। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সমস্যা তার প্রধান কারণ হচ্ছে ১৯৯৭ সালের কালোচুক্তি। এই কালোচুক্তির পরে সেখানে চরম বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। পাহাড়ি সমতল, ওখানে যারা আমাদের বাঙালি যারা অবস্থান করছে তারা অনেকটা চতুর্থ শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেনো থাকতে পারবেন না পার্বত্য চট্টগ্রামে। ওটা তো বাংলাদেশেরই একটা অংশ। মোট আয়তনের দশ ভাগের এক ভাগ। এই পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দেশি-বিদেশি সমস্ত ষড়যন্ত্র আমরা লক্ষ্য করেছি। আমরা নতুন নুতন শব্দের বাস্তবায়ন করতে দেব না। দেশের সার্বভৌমত্ব জলাঞ্জলি দেয়ার সুযোগ কখনোই দেব না। আমরা যেকোন মূল্যে তা প্রতিহত করব, ইনশাআল্লাহ। কারণ এটা বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বাইরে যারা ভিন্ন চিন্তা করবে তাদের চোখ আমরা আঙ্গুল দিয়ে তুলে নেব।

ইরান বলেন, পানছড়িতে ১৯৯২ সালে সন্তু লারমা বলেছিলেন আমরা উপজাতি নয়, আমরা ক্ষুদ্র জাতি। তাদেরকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলা হচ্ছে। এটা এখন তারা মানতে চাইছে না। এটা তো তাদেরই দাবি ছিল। আজকে তারা আবার আদিবাসী সংজ্ঞা দাবি করছে। রাষ্ট্র যদি তাদেরকে আদিবাসী বলা শুরু করে তাহলে তারা আবার ক্ষুদ্র জাতেগোষ্ঠীর দাবিতে আন্দোলন শুরু করবে। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কতিপয় দুষ্ট লোক পাহাড়িদেরকে রাষ্ট্রের বিপরীতে সব সময় দাঁড় করাতে চাইছে। এ বিষয়ে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. কাজী মোহাম্মদ বরকত আলী বলেন, আমি একাধিকবার পার্বত্য চট্টগ্রাম আলোচনা করতে গিয়েছি। দেখেছি সেখানে গুটি কয়েক মানুষের ৬টি গোষ্ঠী আছে। জেএসএস, ইউপিডিএফ, কুকি চিন এরা সন্ত্রাসী স্টাইলে চাঁদাবাজি করছে। এই গোষ্ঠীগুলো যতনা বেশি তাদের অধিকার আদায়ের কথা বলে তারচেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক ও নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কথা বলছে। ২ থেকে ৩ ভাগ মানুষ এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা বা নেতৃত্বের আড়ালে হাইলি ইকনোমিক্যালি ডেভেলপিং করেছে। তারা আমেরিকা, লন্ডনের মতো দেশে বাড়ি বানিয়েছেন। অর্থ কামানো ও সুবিধাভোগীদের মধ্যে শীর্ষে আছেন সন্তু লারমা নিজেও। কয়েক দিন আগে আপনারা দেখেছেন জাতিসংঘের ইমরিপ অধিবেশনে তার নাতনি উদ্ধতপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। উপজাতিদের মধ্যে যারা অত্যন্ত নির্লোভ, সৎ এবং অতি সাধারণ তাদেরকে ব্যবহার করছে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ তারেক ফজল বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি হয়। আমার স্মরণে আছে, আমি তখন জনপ্রিয় লেখালেখিতে সময় ব্যয় করেছি। ঘটনাক্রমে ১৯৯৭ সালের ২ তারিখে আমার প্রথম কন্যার জন্ম হয়। তবে তার নাম শান্তি রাখি নি। এই শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে বিএনপি তখন হরতাল ডেকেছিল। সেই হরতালের কারণে আমার সন্তানকে হাসপাতালে যাওয়া আসার ক্ষেত্রে আমি যথেষ্ট ভূগেছি। বিএনপির পক্ষ থেকে তখন প্রফেসর বি চৌধুরী বলেছিলেন যে, তারা ক্ষমতায় আসলে শান্তিচুক্তি বাতিল করবেন। আমি খুবই আগ্রহের সাথে সেই নিউজ কাটিং রেখেছিলাম। কিন্তু বিএনপি এ বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার সময় পাননি।

তিনি বলেন, আমরা রিপাবলিক গড়ে তুলে তুলে চাই। যেখানে প্রতিজন নাগরিক তার সম্ভাব্য সব সুবিধা ভোগ করবে, সমানভাবে। নির্বিশেষে যার যতটুকু যোগ্যতা আছে। এটা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও নির্বাহী বিভাগে যারা থাকেন, তারা অবহেলা করেন। অনেক ক্ষেত্রে কম মনোযোগ দেন। কাজেই নির্বাহী কর্তৃত্ব যখন অবহেলা করেন তখন অন্যান্য কর্তৃত্ব যা কিছু আছে তখন সেগুলো অসহায় হয়ে যায়। সমাজের অন্য যত গোষ্ঠী আছে, পেশাজীবী আছে, তাদের পক্ষে কার্যকর করার কিছু থাকে না। এটি একটি বাস্তবতা। আমরা পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর কথা বলছি। যারা এ অঞ্চলের অধিবাসী, তারা সেই সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন যে, তারা উপযুক্ত ন্যায্য আচরণ চান রাষ্ট্রের কাছে। ন্যায্য আচরণ নিশ্চিত করে নির্বাহী বিভাগ। যেহেতু আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি জনাব সালাহউদ্দিন আহমেদ এখানে আছেন, আমি জানি না ওনারা এক্ষেত্রে কতটা মনোযোগ দেবেন। আমি আশা রাখি, খুব কাছাকাছিই ওনারা নির্বাহী দায়িত্বে যাবেন এবং এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, পাহাড়ি, জুম্মা, উপজাতি, স্বদেশি অথবা জাতিগোষ্ঠী- এই ধরণের বিভিন্ন অভিধা আমরা দেখতে পাই। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়। আমি মনে করি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের অংশ। তাদেরকে সেভাবেই মূল্যায়ন করতে হবে। এখানে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র বা রাজনীতি, ভূ-রাজনীতির সুযোগ নেই। তাদেরকে এক সময় বাঙালি বলা হয়েছে। আসলে তারা তো বাঙালি না, তারা বাংলাদেশি। বাংলাদেশি জাতীয়তায় তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, আমি রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শিক্ষক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দুটো পরিভাষা বা টার্ম আছে। একটি হলো স্টেট বিল্ডিং আরেকটি হলো ন্যাশন বিল্ডিং। রাষ্ট্র বললেই রাষ্ট্র হয় না। রাষ্ট্র তার নাগরিক সাধারণকে এক অভিন্ন সংহতিপূর্ণ করার জন্য ন্যাশন বিল্ডিং প্রগ্রাম পরিচালনা করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানচিত্রে একটা কাঠামো দিয়েছে। কিন্তু নাগরিক সাধারণকে ঐক্য সংহতির মাধ্যমে একত্রিত করা, বিভেদ বিভাজন ভুলে গিয়ে অভিন্ন রাষ্ট্র কাঠামো গড়ার চেষ্টা করা হয়নি। গায়ের জোরে বলা হলো বাঙালি হয়ে যাও।

তিনি বলেন, সাউথ সুদান স্টাইলে এখানে একটি খৃষ্টরাষ্ট্র করার ষড়যন্ত্র চলছে। যখন তারা খৃষ্টরাষ্ট্র করবে, তখন তারা কেবল নামে খৃষ্টরাষ্ট্র করবে না। এইসব এলাকায় যেভাবে ধর্মান্তরিত হচ্ছে মানুষ, তাতে এই এলাকায় একটি ষড়যন্ত্র হচ্ছে সকলেই আমরা জানি। এই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ঠেকাতে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এদিকটায় আমাদের সতর্ক হতে হবে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও একই সাথে রাজনৈতিক উপায়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ওই ভূখণ্ড রক্ষার জন্য আমাদের সেনাবাহিনীকে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিবেদিত ভাবে জাতীয় নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক কাজ করতে হবে।

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. আবদুল্লাহ আল ইউসুফ বলেন, তথা কথিত আদিবাসী দিবসে দু’একটি মহল থেকে অভিযোগ উঠছে বাংলাদেশে পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীরা বৈষম্যের শিকার। আমি এই অভিযোগটির সাথে পুরোপুরি সহমত পোষণ করছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিমতম অধিবাসী হলো বাঙালিরা। আর এই বাঙালিরাই নজিরবিহীন বৈষম্যের শিকার। ইনডিজেনাস কিংবা ফাস্ট ন্যাশনসহ যে ইংরেজি শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়, এগুলোর কোনো উপযুক্ত বাংলা শব্দ নেই। আদিবাসী শব্দটা কখন কীভাবে কোথা থেকে আমদানি হলো এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। কারণ ইংরেজি যে শব্দগুলোর বাংলা অর্থ হিসেবে আমরা আদিবাসী শব্দটা ব্যবহার করছি, সেই শব্দগুলোরও কোনো সার্বজনিন সংজ্ঞা নেই। উপনিবেশ শুরু হবার ৬২ বছর আগে থেকে যে বাঙালি পাহাড় অঞ্চল থেকে শুরু করে মিজোরামের সীমান্ত পর্যন্ত জীবিকার সন্ধানে গিয়েছে। তাদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে যদি এই পরিবেশের সংশ্লিষ্টতা না থাকে তাহলে প্রকৃত আদিবাসী কারা?

তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈষম্যটা হচ্ছে বাঙালিদের সাথে। দেখেন, তারা ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠী। অথচ তাদের জাতীয় সংসদে বা আঞ্চলিক পরিষদে কোথাও কোনো যৌক্তিক প্রতিনিধিত্ব নেই। ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই ৫০ শতাংশ লোকের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য শুধুমাত্র একজন বাঙালি খুঁজে পাই। আপনারা জানেন যে, ২০০১ সালে খাগড়াছড়ি আসনে একজন বাঙালিকে নমিনেশন দেয়া হয়েছিল এবং তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাহলে এই আদিমতম অধিবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে কীভাবে?

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বাবু রুইথি কারবারী বলেন, আমি বলতে চাই, আমরা হলাম বাংলাদেশি মারমা। মারমা জনগোষ্ঠী এককালে মারমা ছিল না। সবাই ছিলো মগ। আকার নাই, ইকার নেই, শুধুই মগ। লেখা নেই, পড়া নেই, শিক্ষা নেই, দীক্ষা নেই। যাকে বলে মগ। আমি বলতে চাই, আমরা হলাম বাংলাদেশি মারমা। আমরা বাংলাদেশে বসবাস করি। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না। আমরা অশান্তি চাই না। যখন ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির পর যখন অস্ত্র সমার্পণ হলো তখন মারমা শান্তিবাহিনী কতজন ছিল? নিশ্চয়ই আপনারা তা জানেন। তাই আমি বলতে চাই, আমাদের পিছিয়ে পড়া সমাজকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বা অধিকার দেয়ার জন্য অনুরোধ রাখছি।

তিনি বলেন, আমরা মারমা শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আমাদের মারমা থেকে এখনো পর্যন্ত একজন ভালো উকিল, ব্যারিস্টার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্মি অফিসার কিংবা সেক্রেটারি হয়নি। আমাদের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে কীভাবে অগ্রসর করে আনা যায় সে লক্ষ্যে আমরা চেষ্টা করছি। আমরা বাংলাদেশি, বাংলাদেশের মারমা হিসেবে পরিচয় দিতে চাই। মারমা জাতি হিসেবে সকলের সাথে সুখে শান্তিতে এবং সকলের সাথে পাহাড়ি বাঙালি চাকমা মারমা বৈদ্য, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সবাই সম্মিলিতভাবে বসবাস করতে চাই।

ইঞ্জিনিয়ার চিং মং শাক বলেন, ২০০৭ সালের আগে আদিবাসী ছিল না। উপজাতি ছিল ট্রাইভাল। এই ট্রাইভাল বাংলায় অনুবাদ করে উপজাতি করা হয়। ২০০৭ সালে আনা হয় ইনডিজেনাস। এখন আমরা হয়ে গেছি আদিবাসী। কেনো ভাই, আমরা কি শাপের মতো কিংবা কাকড়ার মতো মাসে তিন বার খোলোস পাল্টাব নাকি? আমার তো একটা পরিচয় আছে। আমি বাঙালি ভাইদের প্রশ্ন করি, যদি জাতিসংঘ বলে আপনারা বাঙালি নয়, আপনারা কি জাতীয়তা পাল্টাবেন? আমার নিজের কাছে খুবই হাস্যকার লাগে যখন আমার জাতি ভাইয়েরা বলে আমরা আদিবাসী।

তিনি বলেন, যারা আমাদেরকে নিয়ে রাজনীতি করছেন, তারা কি আমাদের কাছে কখনো জানতে চাইছেন যে, আমি কোন পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চাই। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের ৮০ শতাংশ মানুষ আদিবাসী কিনা, উপজাতি কিনা, জুম্মুল্যান্ড কিনা এই বিতর্ক মাথায় ঢুকান না। তারা চিন্তা করে কীভাবে তিনবেলা দুমোঠে খেয়ে বেঁচে থাকা যায়। যারা দাবি করছেন যে তারা পাহাড়ের ৮০ শতাংশ মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলছেন। অথচ তারাই বিতর্কিত কথা বলে সংখ্যাগরিষ্ট বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাহাড়িদের উসকে দিচ্ছেন। তাই সকলের কাছে করজোরে অনুরোধ করব, আমাদের বিতর্কে ফেলবেন না। আমরা এদেশের নাগরিক, আমরা বাংলাদেশি হিসেবে বাঁচতে চাই।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) ড. মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী।

বক্তব্য রাখেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর শাহজাহান চৌধুরী, ওসমানী সেন্টার ফর পিস এন্ড সিকিউরিটি স্ট্যাডিজের চেয়ারম্যান লে. জেনারেল (অব.) ড. মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রব, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুল লতিফ মাসুম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. সুফি মুস্তাফিজুর রহমান, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, লেবার পার্টি বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ডা. মুস্তাফিজুর রহমান ইরান, আমজনতা পার্টির সাধারণ সম্পাদক মো. তারেক রহমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. কাজী মোহাম্মদ বরকত আলী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ তারেক ফজল, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. আবদুল্লাহ আল ইউসুফ, খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রুইথি কারবারী, ইঞ্জিনিয়ার চিং মং শাক, ছাত্রনেতা পাইশিখই মারমা প্রমুখ।

সেমিনারে আরো উপস্থিত ছিলেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী, অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকগণ এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

You may have missed