পাহাড়ে ভোটের অঙ্ক: আগ্রহ, ভয় আর অদৃশ্য শক্তির ছায়া

পাহাড়ে ভোটের অঙ্ক: আগ্রহ, ভয় আর অদৃশ্য শক্তির ছায়া

পাহাড়ে ভোটের অঙ্ক: আগ্রহ, ভয় আর অদৃশ্য শক্তির ছায়া
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

তিন আসনের নির্বাচন বিশ্লেষণ | পর্ব–১

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচন কমিশনের সূচি অনুযায়ী ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা, ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বাছাই, ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত আপিল এবং ২০ জানুয়ারি প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। ২১ জানুয়ারি প্রতীক বরাদ্দের পর ২২ জানুয়ারি শুরু হবে নির্বাচনী প্রচারণা, যা চলবে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। কাগজে-কলমে এই নির্ধারিত সময়সূচি যতটা নিয়মতান্ত্রিক ও শান্ত দেখায়, পাহাড়ের তিন জেলা—রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে—নির্বাচনের বাস্তবতা ততটাই জটিল ও বহুমাত্রিক।

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারি হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এই নির্বাচন পাহাড়ে এক ভিন্ন রাজনৈতিক আবহ তৈরি করেছে। গত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতায় পাহাড়ি ও বাঙ্গালি—উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেই ভোট দেওয়ার প্রতি যে গভীর অনীহা, অবিশ্বাস ও ভয় জমে উঠেছিল, এবারের নির্বাচনকে ঘিরে তার জায়গায় তুলনামূলক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অনেকেই এটিকে পাহাড়ে ‘নতুন সুযোগ’ হিসেবে দেখছেন। তবে এই আগ্রহ শেষ পর্যন্ত স্বাধীন ভোটে রূপ নেবে, নাকি আবারও নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ায় আটকে যাবে—সেটিই এখন মূল প্রশ্ন।

পাহাড়বাসীর স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বলে রয়েছে শেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা। তিন আসনেই অভিযোগ ছিল একতরফা রাতের ভোটের। বহু কেন্দ্রে হাতে গোনা দুই-একটি ভোট পড়লেও ব্যালট বাক্স ভরে নেওয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করা হয়েছিল বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। কোথাও কোথাও ভোটই হয়নি, অথচ ফলাফলে শত শত ভোট পড়ার হিসাব দেখানো হয়। সহিংসতা, কেন্দ্র দখল ও প্রকাশ্য ভয়ভীতির সেই অভিজ্ঞতা পাহাড়ে নির্বাচনকে কার্যত অর্থহীন করে তুলেছিল। ফলে ভোট মানেই যে নিজের পছন্দের প্রতিফলন—এই বিশ্বাস পাহাড়ে বহু আগেই ভেঙে পড়েছে।

ভোটার ডেমোগ্রাফির দিক থেকে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বাঙ্গালি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভোটার সংখ্যা প্রায় অর্ধেক-অর্ধেক। এই সমীকরণ পাহাড়ের নির্বাচনকে বরাবরই স্পর্শকাতর করে রেখেছে। শহরাঞ্চলে তুলনামূলকভাবে ভোটারদের আচরণ কিছুটা স্বাধীন হলেও দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ভিন্ন বাস্তবতায় চলে। সেখানে ভোটারদের একটি বড় অংশ সরাসরি আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকে। স্থানীয়দের ভাষায়, পাহাড়ি ভোট অনেক সময় ব্যালটের আগে ‘নির্ধারিত’ হয়ে যায়। সেসব এলাকায় ভোটের রাশ কার্যত থাকে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর হাতে। ফলে পাহাড়ি ভোটারদের একটি বড় অংশ ব্যক্তিগত পছন্দের চেয়ে ভয়, সামাজিক চাপ ও সংগঠনের নির্দেশনাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

এই নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রে রয়েছে পাহাড়ের প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তিগুলো। প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ, সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস, এম এন লারমা সমর্থিত জেএসএস, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) আর নতুন করে যোগ হওয়া কেএনএফ ও এমএনপি—এই সংগঠনগুলোর প্রভাব কেবল রাজনৈতিক নয়; তা সামাজিক ও নিরাপত্তাগত বাস্তবতার সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। স্থানীয়দের অভিযোগ, দুর্গম এলাকাগুলোতে এসব সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করা হয়। ফলে অনেক পাহাড়ি ভোটার নিজের মতামতের চেয়ে সংগঠনের নির্দেশনাকেই নিরাপদ মনে করেন।

নির্বাচনের আগে নিরাপত্তা পরিস্থিতিও বাড়তি উদ্বেগ তৈরি করছে। সাম্প্রতিক সময়ে খাগড়াছড়ি সদর ও গুইমারার রামসু বাজার এলাকায় ইউপিডিএফের সহিংস ঘটনার পর পাহাড়জুড়ে আতঙ্ক বেড়েছে। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষ যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, তেমনি নির্বাচন ঘিরে প্রশ্ন উঠছে প্রশাসনের সক্ষমতা নিয়েও। প্রশাসন প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশ্বাস দিলেও গত ১৭ বছরের অভিজ্ঞতা পাহাড়বাসীর মনে গভীর সংশয় তৈরি করেছে। অনেকের মতে, পাহাড়ে স্বাভাবিক নির্বাচন সম্ভব, তবে তার জন্য নির্বাচনের অনেক আগেই সেনাবাহিনীকে কার্যকর শৃঙ্খলা রক্ষার এক্সেস দিতে হবে এবং পাহাড়িদের ভীতি দূর করতে মাঠে দৃশ্যমান প্রভাব নিশ্চিত করতে হবে।

জাতীয় রাজনীতির টানাপোড়েন পাহাড়ে বরাবরের মতোই সীমিত প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রভাবের কারণে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো দুর্গম এলাকায় কার্যকর প্রচার চালাতে প্রায়ই ব্যর্থ হয়। ফলে পাহাড়ের তিন আসন অতীতের মতো এবারও কেন্দ্রের প্রতি বিরূপ বার্তাই দিতে পারে। স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ এবং রাঙামাটি ও বান্দরবানে জেএসএস তুলনামূলকভাবে বেশি প্রভাব রাখবে।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত মিলছে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর ভেতরের নীরব তৎপরতা থেকে। মাঠপর্যায়ের তথ্য বলছে, এবারের নির্বাচন সামনে রেখে তারা প্রকাশ্য সংঘাত নয়, বরং নির্বাচনী অ্যালায়েন্স ও সমঝোতার পথে হাঁটতে চাইছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জেএসএস ও ইউপিডিএফের দুই প্রতিদ্বন্ধী গোষ্ঠীর নীরব সমঝোতার মাধ্যমে রাঙামাটিতে জেএসএস প্রার্থীর জয় সেই বাস্তবতার একটি বড় উদাহরণ। এবারও ভোটের আগে গোপন বোঝাপড়া, নীরব সমঝোতা ও অস্বাভাবিক তৎপরতা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত ভোটের ফল নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

বলতে গেলে, পাহাড়ের তিন আসনে ভোটের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে শুধু ব্যালট বাক্সে নয়; বরং ভয়, নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও অদৃশ্য রাজনৈতিক সমীকরণের টেবিলে। এই বাস্তবতা না বদলালে, নির্বাচন যতই অংশগ্রহণমূলক হোক না কেন, পাহাড়ে গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে। পরবর্তী পর্বে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি আসনের ভেতরের শক্তির লড়াই, সম্ভাব্য প্রার্থী ও ফলাফলের দিকনির্দেশনা বিশ্লেষণ করা হবে।

পরবর্তী পর্বে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি আসনের ভেতরের শক্তির লড়াই, সম্ভাব্য প্রার্থী ও ফলাফলের দিকনির্দেশনা বিশ্লেষণ করা হবে।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may have missed