বীর মুক্তিযোদ্ধা চউলাপ্রু’র দেশ ভাবনা ও মূল্যায়ন
![]()
পারভেজ হায়দার
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কিংবা তার আগে ও পরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে নিরপেক্ষ এবং কার্যকরী গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। সুনির্দিষ্ট অপউদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কিছু গোষ্ঠীদের সমর্থনকারী কিংবা স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাবে এ যাবৎকালীন প্রচারিত অধিকাংশ প্রকাশনা সমূহেই অনেক ক্ষেত্রে সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছে। সঠিক ও সত্য তুলে ধরার প্রয়াসের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছেও সঠিক বিষয়গুলো সম্পর্কে এক প্রকার ধোঁয়াশা কাজ করছে। অনেকের কাছে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হলেও, উত্তর সঠিক ভাবে মিলে না। যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় রাঙ্গামাটিতে ভারতের পতাকা উত্তোলন করলেও কেন পরবর্তীতে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের নেতৃত্বাধীন ব্যক্তিবর্গ পাকিস্তানকে সহযোগীতা করলো, কেনইবা মুক্তিযদ্ধের সময় ত্রিদিব রায়ের নেতৃত্বাধীন চাকমা সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ রাজাকারে রুপান্তরিত হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই পাহাড়ী উপজাতি নেতৃবৃন্দের একাংশ কেনইবা স্বায়ত্বশাসন চেয়ে বসলো; স্বায়ত্বশাসন বা যেকোন ধরণের প্রতিবাদ যদি করতেই হতো তাহলে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কাপ্তাই বাঁধ সৃষ্টির ফলে উপজাতি ব্যক্তিবর্গের যেসময় ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছিলো তার পরপরই কেন বড় ধরণের কোন প্রতিবাদ আসলো না, কাপ্তাই বাঁধ নির্মানের কারণে ব্যক্তিগত ভাবে ত্রিদিব রায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেনইবা তিনি পাকিস্তানের পক্ষ নিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর উপজাতি নেতৃবৃন্দের একাংশ স্বায়ত্বশাসন দাবি করার পরপরই শান্তিবাহিনীর কার্যক্রম শুরু না হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর শুরু হলো, কেনইবা এমএন লারমা বঙ্গবন্ধু সৃষ্ট বাকশালে যোগদান করলেন?
এতক্ষন যে প্রশ্নগুলো উথাপিত হলো, তার উত্তরগুলো একেকজন একেকভাবে নিজেদের ব্যক্তিগত চিন্তাধারা অনুযায়ী দিয়ে থাকে। প্রকৃত সত্য নিয়ে আসলেই ধোঁয়াশা রয়েছে। বিষয়টি অনুধাবন করে সাউথইস্ট জার্নাল কর্তৃক সাক্ষাৎকার ভিত্তিক কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সাউথইস্ট জার্নালের সম্পাদক পারভেজ হায়দার কথা বলছিলেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মহালছড়ি উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জনাব চউলাপ্রু চৌধুরীর সাথে। তার পিতা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মহালছড়ি এলাকার একজন প্রভাবশালী হেডম্যান ছিলেন। এছাড়া তার দাদা কংহ্লাপ্রু চৌধুরীর বাবা তং চৌধুরী ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের সময়ে ব্রিটিশ কর্মকর্তা এবং তিন সার্কেল চীফদের মধ্যকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন বৈঠকগুলোতে একজন হেডম্যান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
জনাব চউলাপ্রু চৌধুরী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা যথাক্রমে মহালছড়ি ও খাগড়াছড়িতে গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে নাজিরহাট কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকত্তোর ডিগ্রী অর্জন করেন। সাউথইস্ট জার্নালের সাথে কথা বলার সময় তিনি অনেকটা খোলামেলা ভাবেই নিজেকে প্রকাশ করেছেন। নিম্নে সাক্ষাৎকারটির মূল অংশবিশেষ বর্ণিত হলো:-
সাউথইস্ট জার্নাল- আপনার বর্তমান সময় কিভাবে কাটে?
চউলাপ্রু চৌধুরী- আমি বর্তমানে মহালছড়ি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি ঠিকাদারির কাজ করি।
সাউথইস্ট জার্নাল- আপনি পড়ালেখা কোথায় করেছেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- আমি অনেক বয়স্ক হয়ে লেখা-পড়া করেছি তৎকালীন সময়ে। কারণ তখন আশে-পাশে কোথাও তেমন স্কুল-কলেজ ছিলোনা। অনেক দূরে গিয়ে মহালছড়ির দেবলছড়িতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে হয়েছে। ১৯৬২ সালে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি স্কুল ছিলো। রাঙ্গামাটিতে একটি হাইস্কুল, খাগড়াছড়িতে ৬ষ্ঠ শ্রেনী পর্যন্ত একটি স্কুল, মহালছড়িতে ২য় শ্রেণী পর্যন্ত একটি স্কুল, সিঙ্গিনালায় একটি ও রামগড়ে একটি স্কুল ছিলো।
সাউথইস্ট জার্নাল- তৎকালীন বৃটিশ ও পাকিস্তান সরকার আমলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকার কিংবা তিনজন সার্কেল প্রধান থাকতে কেন প্রয়োজনীয় স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলো না?
চউলাপ্রু চৌধুরী- রাজারা, বিশেষ করে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় তখন লেখাপড়ার বিষয়ে কোন কথা বলতেন না। কারণ তিনি নিজস্ব হিসাব-নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এছাড়া তখনকার রাজারা আরাম-আয়েশ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। তবে লেখাপড়ার দিক দিয়ে চাকমা রাজারা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের লেখাপড়ার বিষয়ে কিছুটা এডভান্স ছিলো। তারা কলকাতা গিয়ে লেখাপড়া করতো। বোমাং সার্কেল প্রধানের পরিবারের সদস্যরা ব্রিটিশ আমল থেকে কিছুটা লেখাপড়া করলেও আমাদের মং সার্কেলের সে সুযোগ ছিলো না। তৎকালীন সময়ে মং সার্কেলের মুব্বাই মাষ্টার নামের একজন রামগড় থেকে কলকাতা গিয়ে ডিগ্রী পাশ করেছিলো, কয়েকবছর পূর্বে তিনি মারা গেছেন।

সাউথইস্ট জার্নাল- চাকমা রাজারা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের জন্য কলকাতায় লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতেন, তারা কি তাদের নিজ এলাকায় স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন না?
চউলাপ্রু চৌধুরী- এটাতো তাদের মন-মানসিকতার ব্যাপার, পরবর্তীতে একটা স্কুল হয়েছিলো, সম্ভবত তারাই করেছিলো। তবে নিজ উদ্যোগে অনেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন চারু বিকাশ চাকমা। উনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা মার্কায় মনোনয়ন পাওয়ার পর তার নির্বাচনী ক্যাম্পেইন শুরু করেন। তখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়, বোমাং রাজা অংশেপ্রু চৌধুরী ছিলেন। এই তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিই ছিলো। এটা ছিলো ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি, আর প্রাদেশিক পরিষদে ছিলো উত্তরাঞ্চল আর দক্ষিনাঞ্চল মিলে ২টি আসন। উত্তরাঞ্চলে জেএসএস নেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা, নকুল বিকাশ ত্রিপুরা, নজরুল ইসলামসহ আরো কয়েকজন ছিলেন। আর দক্ষিনাঞ্চলে বোমাং রাজার ছোট ভাই মংশেপ্রু চৌধুরীসহ কয়েকজন প্রার্থী হয়েছিলেন। পরবর্তীতে নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে ত্রিদিব রায় ও প্রাদেশিক পরিষদের উত্তরাঞ্চলে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা বিজয়ী হয়েছিলেন।
সাউথইস্ট জার্নাল- ১৯৪৭ সালে যখন ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়, তখন রাঙ্গামাটিতে স্নেহ কুমার চাকমা ও কামিনী মোহন দেওয়ানরা ভারতীয় পতাকা উড়িয়েছিলো, তখন চাকমা রাজার অবস্থান কি ছিলো?
চউলাপ্রু চৌধুরী- ব্রিটিশরা যখন ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, তখন একজন ব্রিটিশ অফিসার পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন রাজাকে নিয়ে মিটিং করে ভারত বা পাকিস্তান কোন পক্ষে তারা যেতে চান এই বিষয়ে মতামত নিয়েছিলেন। তৎকালীন ত্রিপুরা রাজ্য ও মিজোরাম চলে গেলো ভারতের পক্ষে, যার কারণে তিন রাজার জন্য এটা সমস্যা হয়ে গেলো। এছাড়া মং রাজা যে পক্ষে যাবে বোমাং রাজাও সেই পক্ষে যাওয়ার ঘোষনা দিলেন। চাকমা রাজা ভারতের পক্ষে যাওয়ার ঘোষনা দিলেও মং রাজা সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য একমাস সময় চাইলেন। মং রাজার সিদ্ধান্ত ছাড়া চাকমা রাজাও ভারতের পক্ষে যেতে পারছিলেন না। তখন মং রাজাকে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহনে তিন মাস সময় দিলো। এদিকে চাকমা রাজা মং রাজাকে ভারতের পক্ষে যাওয়ার জন্য কয়েকবার অনুরোধ করলেন। প্রায় তিন মাস ধরে মং রাজা সবার সাথে আলাপ আলোচনা করলেন। পরবর্তীতে তিনি ব্রিটিশ অফিসারকে জানালেন, তিনি পাকিস্তানের পক্ষে যাবেন। এর আগে মং রাজার সিদ্ধান্তকে নিজেদের সিদ্ধান্ত বলে ঘোষনা দিয়েছিলো বোমাং রাজা। ফলে চাকমা রাজা নলীনাক্ষ রায়কেও বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের পক্ষে যেতে হয়েছিলো।
সাউথইস্ট জার্নাল- এই বিষয়গুলো আপনি কিভাবে জানলেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- ব্রিটিশ অফিসার ও তিন সার্কেলের রাজাদের মধ্যকার উক্ত বৈঠকগুলোতে আমার বাবার দাদা তং চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। তিনি মং সার্কেলের অধীনস্ত মহালছড়ির দেবলছড়ি মৌজার হেডম্যান ছিলেন। তার কাছ থেকেই আমি জেনেছি।
সাউথইস্ট জার্নাল- ১৯৪৭ পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা সম্পর্কে বলুন।
চউলাপ্রু চৌধুরী- সাধারণ পাহাড়ীরা তখন অশিক্ষিত থাকার কারণে এতটা সচেতন ছিলো না। কোন পক্ষে গেলে কি হবে, সেটাও তাদের ধারণা ছিলো না। তাদের ধারণা ছিলো, তারা খেয়ে-দেয়ে সুখে থাকতে পারলেই হলো। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় স্নেহ কুমার চাকমা ও কামিনী মোহন দেওয়ান রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা উড়িয়ে ভারত-ভারত চাই স্লোগান দিয়ে ব্যর্থতায় পড়লে পাকিস্তানের পক্ষের যারা ছিলো তারা চাপ সৃষ্টি করার পর স্নেহ কুমার প্রায় ৪৫ হাজার পাহাড়ী নিয়ে ভারতের অরুনাচলে চলে গিয়েছিলো। তবে কাপ্তাই বাঁধ নির্মানের সময় কেউ ভারত যায়নি। সবাইকে তৎকালীন সরকার পূনর্বাসিত করেছে। এমন হতে পারে যারা অন্য স্থানে সেটেল হয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে ২য় বার এসে আবারো দাবি করেছে তারা ক্ষতিপূরণ পায়নি। তবে কেউ যদি ভারতে যায় সেটা হয়তো আত্নীয় স্বজনের কাছে গিয়েছে।

সাউথইস্ট জার্নাল- শেষ পর্যন্ত স্নেহ কুমার চাকমা কোথায় গিয়েছিলেন? কামিনী মোহন দেওয়ানইবা কোথায় ছিলেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- স্নেহ কুমার চাকমা ১৯৯১/৯২ সালের দিকে মারা গেছেন। তিনি ১৯৪৭ পরবর্তী সময় পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার পর থেকে আগরতলা-দিল্লীসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করতেন। তিনি সেখানে একটি ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন। কামিনী মোহন দেওয়ান ভারতে যান নি। সরকার তাকে একটা সুযোগ দিয়েছিলেন। রাঙ্গামাটিতে পাকিস্তান সরকারের মালিকানাধীন ইন্দ্রমনি সিনেমা হলটি তাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন।
সাউথইস্ট জার্নাল- রাজা ত্রিদিব রায় কখন থেকে পাকিস্তানের পক্ষে গিয়েছিলেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- রাজা ত্রিদিব রায় আইয়ুব খানের শাসনামলের সময় থেকেই পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন। পরে ১৯৬২ সালের দিকে অর্থাৎ কাপ্তাই বাঁধ নির্মানের সময় পাকিস্তান সরকারকে সরাসরি সহযোগিতা করেছিলেন।
সাউথইস্ট জার্নাল- বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুথান সহ বিভিন্ন আন্দোলনের সময়ে পাহাড়ী জনগণের যোগদান কেমন ছিলো?
চউলাপ্রু চৌধুরী- পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬৯ এর আন্দোলন পরবর্তীতে ৭০ এর নির্বাচনে সার্বিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছিলো। তখন আমি মোটামুটি প্রাপ্ত বয়স্ক ছিলাম। চাকমা রাজা আমাকে মাঝে-মধ্যে ডেকে বলতেন নির্বাচনে তার পক্ষে কাজ করার জন্য। আমার বয়স তখন ২২ বা ২৩ বছর হবে। আমি ডিগ্রীতে পড়তাম। তবে আমি ১৯৬৬-৬৭ সাল থেকে আওয়ামীলীগের পক্ষে কাজ শুরু করি। তখন নাজিরহাট কলেজে আমি ইন্টার ১ম বর্ষের ছাত্র। পরবর্তীতে ডিগ্রী পড়ি চট্টগ্রাম কলেজে। বলা যায় কলেজে পড়ার সময় থেকেই আওয়ামীলীগের পক্ষে কাজ করা শুরু।
সাউথইস্ট জার্নাল- আপনি কবে ত্রিদিব রায়ের বাসায় গিয়েছিলেন, কি কি আলোচনা হয়েছিলো?
চউলাপ্রু চৌধুরী- ১৯৭০ এর নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে আমি ত্রিদিব রায়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে তার পক্ষে নির্বাচন করার অফার দিলেন। আমি বললাম, আমি ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে আমাকে আওয়ামীলীগের পক্ষে কাজ করতে হবে। তাছাড়া আপনি রাজা আর আমি একজন ছাত্র। আমার বিষয়টা একান্তই আমার ব্যক্তিগত। আর আপনি এখানে দীর্ঘদিন রাজার দায়িত্বে থাকলেও পাহাড়ের উন্নয়নে বা শিক্ষার উন্নয়নে কিছুই করতে পারেন নি। আওয়ামীলীগ এসব উন্নয়নের কথা বলতেছে এবং তারা করবে। তারা অন্ন, বস্ত্র, খাদ্যসহ ৬দফা বাস্তবায়ন করবে। এসব শুনে তিনি বললেন, আমি রাজা, রাজা জয়ী না হলেও রাজা, আমি জয়ী হলে এমপি না হয় মন্ত্রী হবো। বোমং রাজা ৬৭/৬৮ সালে পূর্ত মন্ত্রী হয়েছিলো। তুমি ছাত্র মানুষ, চুপচাপ থাকো, তোমাদের ভবিষ্যৎ আছে। আমি বললাম, আমি পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি, মানুষকে নৌকার কথা বলেছি সবাই নৌকার পক্ষে আছে, নৌকা সবার ভাবনার মধ্য স্থান করে নিয়েছে। তিনি বললেন, তোমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই, তুমি তোমার মতো কাজ করো আমিও আমার মতো কাজ করি , কারণ আমি একজন প্রতিদ্বন্দ্বি।
সাউথইস্ট জার্নাল- আপনাকে কার মাধ্যমে ত্রিদিব রায় ডেকেছিলো?
চউলাপ্রু চৌধুরী- ত্রিদিব রায়ের স্ত্রী আবার মংশ্রেপ্রু চৌধুরীর বোন। তিনি আমার আত্নীয় হন। ত্রিদিব রায়ের পক্ষে লোকজন কমে যাওয়ায় তিনি তার স্ত্রীর মাধ্যমে আমাকে ডেকেছিলেন। পরবর্তীতে নির্বাচনে তিনিই বিজয়ী হয়েছেন।
সাউথইস্ট জার্নাল- চাকমা রাজা কি নির্বাচনের সময়ে তার অধীনস্ত হেডম্যানদের দিয়ে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করেছিলেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- হ্যাঁ, উনার এলাকায় হেডম্যানদের তার পক্ষে ভোট দেওয়ার বিষয়ে তিনি জোর করেছিলেন এবং প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তিনি আমাকেও বলেছিলেন যে তার হেডম্যানদের বলা আছে, তাদের ভোট বাহিরে যাবে না। সবাই তাকেই ভোট দিবে।
সাউথইস্ট জার্নাল- যদি ত্রিদিব রায় হেডম্যানদের উপর চাপ প্রয়োগ না করতেন তাহলে কি আওয়ামীলীগের প্রার্থী চারু বিকাশ চাকমা নির্বাচনে বিজয়ী হতেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- মানুষ সব সময় নতুন কিছু চায়, যদি ত্রিদিব রায় হেডম্যানদের উপর চাপ প্রয়োগ না করতেন তাহলে চারু বিকাশ জিততেন। এছাড়া রেডিওতে জয়বাংলা শুনে তখন মানুষ ভাবতো আওয়ামীলীগই সরকার গঠন করবে।
সাউথইস্ট জার্নাল- ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কি চাকমা রাজপরিবারের সদস্য কোকনাক্ষ রায় অংশ নিয়েছিলেন? তিনি কোন দলের প্রার্থী ছিলেন?

চউলাপ্রু চৌধুরী- ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে কোকনাক্ষ রায় আওয়ামীলীগের প্রার্থী ছিলেন। তবে নির্বাচনে জয়ী হতে পারেন নি।
সাউথইস্ট জার্নাল- আপনি চট্টগ্রাম কলেজে পড়াকালীন আপনার পরিবার কোথায় থাকতো? চট্টগ্রামে তখন কোন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- আমি চট্টগ্রাম কলেজে পড়াকালীন সময়ে আমার মা-বাবা সিন্দুকছড়ির দেবলছড়িতে থাকতেন। তখন মোটামুটি বিভিন্ন আন্দোলনে আমি অংশ নিয়েছি। তখনকার লোকজনের আন্দোলনের স্লোগান ছিলো ‘আমাদের সংগ্রাম, চলছে, চলবেই এমন। ১৯৭১ সালের ৩-৪ মার্চে আমরা কয়েকজন কলেজের পুকুর ঘাটে একত্রিত হলাম, রেডিও শোনার জন্য। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিলো, তা দুপুর ২টার খবরে সম্প্রচারের কথা ছিলো। কিন্তু সেদিনের বৈঠক আর হলোনা, পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ২৩-২৪ মার্চ বৈঠকটি হবে বলে জানা গেলো। এসময় আমরা সবাই হতাশ হয়ে গেলাম, বুঝে গেলাম এভাবে আর হবেনা। যার যার মতো করে আমরা হোস্টেলে চলে গেলাম এবং প্রস্তুত হতে থাকলাম। আমার কলেজে তখন পাহাড়ী ছাত্রদের সংখ্যা খুব বেশী ছিলো না, তিন থেকে চার জন ছিলো।
সাউথইস্ট জার্নাল- মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময়কার অবস্থা সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
চউলাপ্রু চৌধুরী- যুদ্ধ শুরু হওয়ার মুহূর্তে কলেজে বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন আসতো, সবাইকে বই দিতো, সংগ্রামের বই। লোকজন জড়ো হচ্ছিলো, বলাবলি করছিলো অমুক-তমুক জায়গায় সংগ্রাম শুরু হয়েছে। পরে আমি কলেজ থেকে বাড়িতে আসলাম সবাইকে জানানোর জন্য। বাড়িতে সবাইকে বলে আবার কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেও আর কলেজে ফেরত যেতে পারিনি। শুনেছি সেখানেযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, গেলে ধরে নিয়ে যাবে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষনের পর আবারো মাঝ পথ থেকে গ্রামে ফিরে আসলাম। বঙ্গবন্ধুর ২৫শে মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষনার সময়ে আমি সিন্দুকছড়িতে গ্রামের বাড়িতে ছিলাম, রেডিও সম্প্রচারকৃত ঘোষনা সম্পর্কে আমি পরবর্তীতে শুনেছি। ঘোষনাটি শুনে আমি আবারো চট্টগ্রামে গেলাম। চট্টগ্রামের অবস্থা ভয়াবহ দেখে আমি সাথে সাথে গ্রামে ফিরে আসি এবং ২-১জন বন্ধুকে বিষয়গুলো জানাই। এরপর দেশের অবস্থা খারাপ দেথে আমরা কয়েকজন ভারতে চলে যাই।
সাউথইস্ট জার্নাল- কিভাবে ভারতে গেলেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- মহালছড়ি থেকে হেঁটে গুইমারা, সেখান থেকে রামগড়ের নাকাপা হয়ে আমি, সুজন মার্মা ও মংলাপ্রু, এই তিন জন বর্ডার পার হয়ে ভারতে চলে যাই। পরে সেখানে এক সপ্তাহ পর আবারো একই স্থান দিয়ে ফিরে আসি। এরপর মানিকছড়ি, রামগড়, গুইমারা, মহালছড়িসহ কয়েকটি জায়গায় ঘুরে ঘুরে আমরা তিনজন আলো লোক সংগ্রহ করতেছিলাম ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য, প্রায় ত্রিশজন যোগাড়ও করেছিলাম কিন্তু এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষ হঠাৎ দলে দলে ভারতের দিকে ছুটতে শুরু করলো। রাউজান, ফটিকছড়ি থেকে দলে দলে মানুষ মানিকছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি হয়ে এসে নাকাপা ও গুইমারা দিয়ে বর্ডার পার হয়ে ভারতে যাওয়া শুরু করলো।
সাউথইস্ট জার্নাল- ভারতে যখন আপনারা ট্রেনিং করেছেন সেখানে কি কোন নেতিবাচক অভিজ্ঞতা ছিলো?
চউলাপ্রু চৌধুরী- আমরা যখন ভারতে ছিলাম, সাব্রুমের পূর্বে বৈষ্ণবপুরে একটা ট্রানজিট ক্যাম্পে শরণার্থীদের অবস্থানের একটা কেন্দ্র ছিলো। সকাল সাতটা থেকে শুরু হয়ে যা আসে, পরদিন সকালে গননা করে সব লিখে সেখান থেকে মেজর সাহেবের সই নিয়ে সাব্রুম থানায় পাঠানো হতো, সেখান থেকে পরে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ নিজ ঠিকানায় পাঠানো হতো। সথাই মারমা নামে বৈষ্ণবপুরে একটা মেম্বারের বাড়ি আছে, আমার পূর্ব পরিচিত, আমি উনার বাড়িতে গিয়েই উঠলাম। উনি বিএসএফের মেজর সাহেবের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরে ট্রানজিট ক্যাম্পে আমি ঐ মেজর সাহেবের পরিবর্তে আমি লোক গননার পর সই করা শুরু করলাম। ওখানে নোয়াখালী থেকে যাওয়া এক প্রফেসর ছিলো উনি লোকজনের নাম-ঠিকানা লিখতেন আর আমি সই করতাম। কয়েকমাস ওখানে আমি অবস্থান করেছি। মাঝে মধ্যে এসে বাংলাদেশ থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যেতাম।
এর মধ্যে একবার দেশে আসলে নাজিরহাটের একটি পাড়ায় গিয়ে কয়েকজনকে মুক্তিযুদ্ধে যাবার কথা বললে তারাও আগ্রহী হলো। আমি সেসময় কয়েকটি চিঠি লিখে বিভিন্ন জায়গায় পাঠালাম পটিয়া, রাউজান সহ বিভিন্ন স্থানে পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে। তারপর মে মাসে সেখান থেকে আবার ফিরতে শুরু করলাম। গুইমারা এসে জালিয়া পাড়া মোড়ের পাশে বড় ব্রীজটার সাথে এক হিন্দু ভদ্র লোকের চায়ের ও মিষ্টির দোকান ছিলো। দোকান খোলা দেখে আমিও গেলাম মিষ্টি খাওয়ার জন্য। ওখানে আমাকে দেখলো হাসু মিয়া নামের এক লোক, সে আমাকে পাকিস্তানী পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিলো, পুলিশ আমাকে বেঁধে রেখে রামগড়ে পাকিস্তানীদের কাছে খবর পাঠালো ওয়্যারল্যাসে। এসময় দেখলাম গুইমারার দেওয়ান পাড়ার এক লোক আসতেছে বাজারে। তাকে ঘটনা খুলে বললাম ও জালিয়াপাড়ার স্কুলের হেডমাষ্টারের কাছে পাঠালাম তাকে, মাষ্টারও আমার পরিচিত, বললাম, উনাকে গিয়ে বলো আমাকে তার ছোট ভাই পরিচয় দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে। হেডমাষ্টারও স্কুল বন্ধ করে তালা মারতেছে বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য। ওই সময় লোকটি মাষ্টারকে গিয়ে ঘটনা বললো। হেডমাষ্টার এসে পুলিশের হাবিলদারকে বললো, আমার ভাই রাত্রে আসছে আমাকে আমার মায়ের খবর দিতে তাকে গ্রেফতার করলেন। তখন পুলিশ আমাকে ছেড়ে দিলো। দোকান থেকে দুই প্যাকেট সিগারেট নিয়ে মাষ্টারকে দিলাম, আমিও ছয় প্যাকেট সিগারেট নিয়ে তাড়াতাড়ি উসাই মহাজনের বাড়ির দিকে পাহাড়ের উপরের দিকে উঠে চলে গেলাম। খাল পাড় হবার সময় মহাজন আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ভাগিনা কোথা থেকে বাহির হইলা? আমিও ঘটনা খুলে বললাম। তিনি আমাকে তার বাসায় পাঠালেন, বললেন কিছু হলে খবর দিবেন। কিছুক্ষন পরেই পাকিস্তানীরা জালিয়াপাড়া আসলো, তখন মহাজন আমাকে খবর পাঠানোর পর, আমিও জঙ্গলের রাস্তা ধরে ভারতে চলে গেলাম।
হঠাৎ একদিন ভারতে যে বাড়িতে আমি ঘুমাই সেবাড়ির লোক খবর দিলো বাংলাদেশ থেকে ১৮৭জন আসছে যুদ্ধ করতে। ঐ যে আমি চিঠি পোষ্ট করেছিলাম সেই চিঠির মাধ্যমেই তারা আসলো। তারপর সকালে শরণার্থী ক্যাম্পর গেলাম, গননাকারী নুর ইসলাম আমাকে মুক্তিযোদ্ধা দলটাকে দেখিয়ে বললো এরা ১৮৫জন। আমাকে রাতে বললো ১৮৭, এখন ১৮৫ জন হয় কি করে? আমি এটা জিজ্ঞেস করলাম একজনকে। পরে তারা বললো দুই জন চাকমা ছেলে বাদ গেলো। আমি বললাম কেন? বললো, দুই মাস আগে ৩০জন চাকমা এসে ১৫ দিন মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং করে পালিয়ে গেলো বাংলাদেশে, সেজন্য তাদের দুই জনকেও বাদ দেয়া হয়েছে, তাদেরকে মেরে ফেলার জন্য ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি বললাম, এ কথাটা আমাকে বা মেজর সাহেবকে জানাতে পারতেন? বললো, না। আমি একটু রেগে গেলাম। পরে একজনকে পাঠালাম তাদেরকে নিয়ে আসতে। তাদেরকে চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে আসলো। এক এক জন করে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। নাম, পিতার নাম জানার পর জিজ্ঞেস করলাম কেন আসছো এখানে? চাকমা ছেলেটি বললো, আমার বাবাকে পাকিস্তানীরা মেরে ফেলছে, এজন্য আমিও যেকোন এক পাকিস্তানীকে মেরে ফেলতে চাই তাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আসছি। পরে আরেকজনকে নিয়ে এসে একই প্রশ্ন করলাম, সে বললো- পাকিস্তানীরা আমাকে রাজাকারে যোগ দিতে বলেছে কিন্তু আমি যাইনি। পরে তারা আমার বাড়িতে এসে আমার আমার চোখের সামনে বাবাকে মেরে ফেলছে, বোন ও মাকে ধর্ষন করে হত্যা করেছে, তাই আমি যুদ্ধে অংশ নিতে আসছি। দেখলাম তাদের মধ্যে আক্রোশ আছে। পরে তাদেরকে যুদ্ধের ট্রেনিং এ পাঠালাম।
সাউথইস্ট জার্নাল- তখন মং রাজা মং প্রু সাইন কোথায় ছিলেন?

চউলাপ্রু চৌধুরী- আমি মং প্রু সাইন বাবুকে বললাম যে, পরিস্থিতি খারাপ। অবস্থা খুবই ভয়াবহ, আপনি যদি এই অবস্থায় চলে না যান তবে ক্ষতি হবে। তিনি বললেন, চাকমারাতো যাচ্ছে না! আমি বললাম, আপনি চাকমাদের সাথে নিজেকে তুলনা করবেন না। চাকমা রাজা হয়তো পাকিস্তানের ফেভারে চলে যাচ্ছেন। উনাকেও পাকিস্তান সাপোর্ট করছে, কাজেই উনি থাকতে পারবেন।
সাউথইস্ট জার্নাল- মুক্তিযুদ্ধের সময় মং রাজা মংপ্রু সাইন কোথায় অবস্থান করছিলেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- তিনি ভারতের রুপাইয়ে মংশে মারমার বাড়িতে পরিবারসহ আশ্রয় নিয়ে প্রাথমিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। তবে ব্যক্তিগত ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় তিনি তার সম্পদের বড় অংশ ব্যয় করেছিলেন। আমি রাঙ্গামাটি গিয়ে কোকনাক্ষ রায়ের সাথে দেখা, তাকেও পরামর্শ দিয়েছিলাম ভারতে চলে যাবার জন্য। তিনি ৪-৫ জন নিয়ে ভারতে চলে গেলেন। সবাই রুপাইতে মংশে মারমার বাড়িতে উঠলেন। অন্যদিকে এখানে মানুষ লাইন ধরে পালাতে শুরু করেছে, কে কোথায় যাচ্ছে, কার কাছে যাচ্ছে তার কোন হিসেব নেই। লক্ষীছড়ি, মানিকছড়ি, মাটিরাঙ্গা, জালিয়াপাড়া হয়ে মানুষ দলে দলে ছুটছে। আবার একটা দল রাস্তায় ডাকাতিও শুরু করেছে। পাড়ায় পাড়ায় পাকিস্তানী ও মিজোরা ঢুকছে, অত্যাচার করছে। আমরা কয়েকজন সীমান্তে গাইড করে মানুষজনকে ভারতে পার করেছি।
সাউথইস্ট জার্নাল- কারা ডাকাতি করছিলো?
চউলাপ্রু চৌধুরী- সেটা জানার উপায় ছিলোনা, হয়তো পাকিস্তানের পক্ষের রাজাকাররা।
সাউথইস্ট জার্নাল- মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনারা পার্বত্য চট্টগ্রামে কিভাবে অগ্রসর হলেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- বড় হরিণার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে আসলাম। কয়েকদিন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে না খেয়ে হেঁটে এসে জামছড়ি, দূরছড়ি, মারিশ্যা, লংগদু, বরকল ক্যাপচার করলাম। আমরা তখন সাড়ে তিন মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশে ঢুকে আরো ১২শ এর মতো লোকজনকে ট্রেনিং দিলাম। তখন আমার নেতৃত্বে ৩৫০জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ধীরে ধীরে দীঘিনালার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলাম। দীঘিনালা পৌঁছে আমরা একটু বিশ্রাম করতে বসলাম, জানতে পারলাম মিজো বাহিনী আসতেছে সামনের দিকে, সম্ভব বর্ডার পার হবে। আমরাতো পজিশনে ছিলাম, শুরু হলো মুখোমুখি যুদ্ধ। দুপুর ১টার দিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে প্রায় বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত চললো, আমাদের সাথে গোলাগুলিতে মিজোদের একজন ক্যাপ্টেন মারা গেলো ও ২জন সদস্য আহত হয়েছিলো। আমরা পিছনে মারিশ্যায় আমাদের কর্ণেল সাহেবকে খবর দিলাম, শেষ পর্যন্ত মিজোরা পালিয়ে গেছে। সেখান থেকে পালিয়ে মিজোরা খাগড়াছড়ি হয়ে পানছড়িতে ঢুকেছে। সেখানেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তাদের মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। পরে সেখানেও পরাস্ত হয়ে তারা মহালছড়ি হয়ে মবাছড়ির দিক দিয়ে রাঙ্গামাটির সুভলং এর একটি এলাকায় গিয়ে চারদিক থেকে জড়ো হয়েছে। আমরাও মারিশ্যার ফেরত গেলাম, রাত প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে মারিশ্যায় গিয়ে পৌঁছালাম। এরপর দুই দিন পর অর্থাৎ নভেম্বরের শেষ সময়ে আমরা ২৫০ জনের মতো রাঙ্গামাটির দিকে মুভ করলাম। সুভলং এর কাছাকাছি বিরাট এক পাহাড়ের উপরে একটি চাকমা পাড়ায় গিয়ে অবস্থান নিলাম। আমাদের বাকি মুক্তিযোদ্ধারাও পিছনে আসতেছিলো। মাইনীমুখ হয়ে ভারতীয় মিত্র বাহিনীও আসছিলো। পরে চাকমা পাড়ায় লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, মিজোরা আর রাজাকাররা কোথায় আছে, তারা বললো সুভলংএ, জিজ্ঞেস করলাম সেখানে যেতে নৌকা পথে আপডাউন কত সময় লাগবে, একজন বললো দুই ঘন্টা। পরে দুই জনকে পাঠালাম চিঠি দিয়ে মিজোদের কাছে, সময় দিলাম আড়াই ঘন্টা, না ফিরলে চাকমা পাড়া পুড়িয়ে দিবার হুমকি দিলাম। পরে তারা খবর দিয়ে দুই ঘন্টা পর ফিরে আসলো। এরপর ওয়্যারলেসে মিজোদের সাথে যোগাযোগ হলো আমাদের। প্রথমে মিজোদের একজন কথা বলতেছিলো, কয়জন আছো জিজ্ঞেস করলাম, সে আমতা আমতা করতে লাগলো। পরে তাদের এক মেজর আসলো ওয়্যারলেসে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কয়জন আছো? বললো তারা ১২শ আছে, আমাকেও পাল্টা প্রশ্ন করলো আমরা কয়জন আছি, আমি বললাম- আমরা চার হাজার আছি এখানে, ভারতীয় মিত্র ফৌজও আসতেছে। পরে মিজোদের মেজরকে আমি ৩টা শর্ত দিলাম, প্রথমত, মোকাবেলা করলে করতে পারো মুখোমুখি, দ্বিতীয়ত, আত্নসমর্পন করলেও করতে পারো, তৃতীয়ত, যদি তোমরা চলে যেতে চাও, আমরা রাস্তা করে দেবো চলে যেতে পারবে। পরে ওরা নিজেদের মধ্যে ওদের ভাষায় অনেকক্ষন কথা বলে জানালো তারাও, মুক্তিযোদ্ধা আমরাও মুক্তিযোদ্ধা, আমাদের রাস্তা করে দাও আমরা চলে যাবো। বললো, তাদেরকে দেড় ঘন্টা সময় দিতে, আমরাও দুই ঘন্টা দিলাম। আধাঘন্টার মধ্যে মিজোরা হরিণা হয়ে মিজোরাম চলে গেলো। একটা বোটের সাথে ৪-৫টা নৌকা বেঁধে চলে গিয়েছিলো মিজোরা। আমরাও সবাই চারদিক থেকে গিয়ে সেখানে একত্রিত হলাম। পরে রাঙ্গামাটির ডিসি সাহেব আমাদের রিসিভ করলেন।
সাউথইস্ট জার্নাল- আপনারা যখন রাঙ্গামাটি পৌঁছালেন তখন কি ত্রিদিব রায় ছিলো রাঙ্গামাটি?
চউলাপ্রু চৌধুরী- না, এর আগেই সে চলে গেছে পাকিস্তান।
সাউথইস্ট জার্নাল- চাকমা রাজা নলীনাক্ষ রায়ের মেয়ের সাথে এক ব্রিটিশ অফিসারের বিয়ে হয়েছিলো, সেটি জানেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- হ্যাঁ, বিষয়টি সত্য। সেটি ছিলো তাদের লাভ ম্যারেজ। পরবর্তীতে ত্রিদিব রায়ের আরেকটি বোনেরও একই ব্যক্তির সাথে বিয়ে হয়েছিলো।
সাউথইস্ট জার্নাল- রাজাকার কখন গঠন হলো? পাহাড়ে রাজাকার কিভাবে গঠন হলো?
চউলাপ্রু চৌধুরী- পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজাকার বাহিনী মূলত ১৯৭১ সালের মে মাসের দিকে গঠিত হয়েছে। পাকিস্তানীরা বিভিন্ন পাড়ায় গিয়ে লিস্ট করে লোকজনকে তুলে এনে প্রশিক্ষন দিয়ে রাজাকার তৈরী করেছে। ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজন বেশী সংখ্যায় রাজাকার হয়েছিলো।
এদিকে আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতে ট্রেনিং করতে গেলাম সেসময় উগ্যজাই মারমা, আমি, কংক্যও মারমা ও মেকান্জি এই চারজন মারমা ছেলে নেতৃত্বের পর্যায়ে নিয়োগ পেয়েছিলাম। আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো আগরতলা হয়ে দেরাদুনের তান্দুয়া ক্যাম্পে। সেটা ভারতের ১নম্বর সেক্টর। এক মাস ট্রেনিং নিয়ে আবারো প্লেনে করে শীলচর, পরে সেখান থেকে মিজোরাম আসলাম। এক দিন গেলো আইজল, এক দিন গেলো লুংলাই, তৃতীয় দিন দেমাগ্রীতে এসে আমরা অবস্থান করলাম। পথে যারা ছিলো তারাও আসতে লাগলো। প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধা জড়ো হলাম। আসম আব্দুর রব, চট্টগ্রাম সিটি কলেজের তাহের, নোয়াখালীর নুরুন্নবী চৌধুরী, ঢাকার সাজু, পার্বত্য অঞ্চল থেকে আমি ছিলাম। পরে ওখানে থাকলে তো হবেনা, দেশে আসার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। তাই আমি মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের দায়িত্বে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনির সাথে যোগাযোগ করলাম। মনি ভাই প্রথমে দায়িত্ব দিলেন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে প্রফেসর তাহের ভাইকে। তাহের ভাই রাস্তাঘাট চিনেনা বিধায় তিনি দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহী হয়ে উঠলেন, নুরুন্নবী, কুমিল্লার শাহজাহান কেউই দায়িত্ব নিতে আগ্রহী না হওয়ায় পরে মনি ভাই আমাকে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করলো। আমাকে ভারতীয় মেজর মালহোত্রা, ক্যাপ্টেন চান্দা ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ উৎসাহ দিলেন। পরে মনি ভাই আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, আপনি পাহাড়ের ছেলে, আপনি দায়িত্ব নেন, উপর ওয়ালা সহায় হবে।
সাউথইস্ট জার্নাল- পাহাড়ে রাজাকার বাহিনী গঠনে ত্রিদিব রায়ের ভূমিকা কি ছিলো?
চউলাপ্রু চৌধুরী- রাজাকার বাহিনী গঠনে যথেষ্ট ভূমিকা ছিলো, তিনি তার হেডম্যানদের দিয়ে অনেক কিছু করেছিলেন। নির্বাচনের আগেই তিনি হেডম্যানদের ম্যাসেজ দিয়েছিলেন, উনি বলেছেন কোন কিছু হলে উনি পাকিস্তান চলে যাবেন, বাংলার ফেভারে থাকবেন না। হেডম্যানদেরকে যুদ্ধের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে লোকজন সংগ্রহ করে রাজাকার গঠন করা হয়েছিলো।
সাউথইস্ট জার্নাল- আপনি যে সমস্ত লিডারদের নাম বললেন, শেখ ফজলুল হক মনি, শাহজাহান সিরাজ, তোফায়েল আহমেদ, সবাই কি আপনারা একসাথেই ছিলেন? দেরাদুনে ট্রেনিং করেছেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- হ্যাঁ, আমরা একসাথেই ট্রেনিং করেছি।
সাউথইস্ট জার্নাল- আপনারা কতজন ট্রেনিং করেছিলেন দেরাদুনে?
চউলাপ্রু চৌধুরী- ১২ হাজার। ধাপে ধাপে অর্থাৎ ১২ ব্যাচে ১২ হাজার। প্লেনে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো আমাদের। ২য় ব্যাচে বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামালও ছিলো।
সাউথইস্ট জার্নাল- বঙ্গবন্ধু ১৯৭২এর জানুয়ারিতে রাঙ্গামাটি আসার পর ফেব্রুয়ারিতে এমএন লারমা স্বায়ত্বশাসনের দাবি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। এর আগে কি কখনো পাহাড়ীরা স্বায়ত্বশাসন দাবি করেছিলো? উনি কেন দাবি করলেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- এর আগে স্বায়ত্বশাসনের দাবি নিয়ে কোন পাহাড়ী নেতা কথা বলেনি। এমএন লারমার হয়তো ধারণা ছিলো, দেশ স্বাধীন হয়েছে, বিভিন্ন লোকজন এখানে আসবে, সেক্ষেত্র আমাদের জাতিস্বত্তার জন্য কিছু করার দরকার। এজন্য হয়তো এমন দাবি করেছিলেন।
সাউথইস্ট জার্নাল- এই দাবিটা তো তারা পাকিস্তান আমলেও করতে পারতেন, কিন্তু তখন করলেন না কেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- কারণ হতে পারে, পাকিস্তান আমলে তো এখানে কোন দল ছিলো না, পাহাড়ীদের মধ্যে কোন পার্টি ছিলো না, দলটাতো শুরু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে।
সাউথইস্ট জার্নাল- পাহাড়ীদের মধ্যে আঞ্চলিক দল কেন তৈরী হলো?
চউলাপ্রু চৌধুরী- দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চাকমা সম্প্রদায়ের রাজাকারদের উপর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনাত্নক প্রভাব পড়তে পারে, এই ভেবে হয়তো।
সাউথইস্ট জার্নাল- তখনতো তিনি রাঙ্গামাটিতে জনসভায় বক্তব্য রেখেছিলেন। সেখানে কি আপনি উপস্থিত ছিলেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- হ্যাঁ, আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। অনেক বিষয়ে কথা হয়েছিলো। আমি তখন ছাত্রনেতা হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধু আসার আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো একজন মন্ত্রী এসেছিলেন, আব্দুর রব সেরিনিয়াবাত। সেসময়ের পূর্ত মন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বোন জামাই। উনি আসার পরে রাঙ্গামাটি ইন্দ্রপুড়ি সিনেমা হলের ভিতরে সভা হয়েছিলো। সেদিন জেএসএসর পক্ষ হতে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা মন্ত্রীকে উদ্দেশ্যে করে তার দাবিগুলো পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন।
সাউথইস্ট জার্নাল- বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট কতবার এসেছিলেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- আমি দেখেছি একবার, ৭৩ এ নির্বাচনের আগে। তবে তিনি আরো দুইবার পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছিলেন বলে শুনেছি।
সাউথইস্ট জার্নাল- ৭৩ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ত্রিদিব রায়ের ভাই সুমিত রায়কে কেন মনোনয়ন দিয়েছিলেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- বঙ্গবন্ধু এর মাধ্যমে চাকমা রাজাকে দেশে ফিরিয়ে এনে সবাইকে নিয়ে একসাথে বসবাস করতে চাইছিলেন।
সাউথইস্ট জার্নাল- মিজোরামের মিজো বাহিনী নাকি ক্যাপ্টেন কাদেরকে মেরেছিলো মহালছড়িতে?
চউলাপ্রু চৌধুরী- হ্যাঁ। মহালছড়িতে একটি ক্যাম্প ছিলো, থানা ছিলো। ক্যাপ্টেন কাদেরকে মারার এক সপ্তাহ আগে আমি বাড়ি আসছিলাম বেড়াতে। একদিন আমি বাজারে নরেন্দ্র চৌধুরীর চা দোকানে বসা ছিলাম, ক্যাপ্টেন কাদের ১৫ জন সৈনিকসহ বাজারে আসলেন। আমাকে হাতে ইশারা করে ডাকলেন। সেদিন রবিবার ছিলো হাট বাজারের দিন। উনি আমাকে বললেন, তুমি কি করো, আমি বললাম আমি ছাত্র। তিনি আমাকে বললেন থানায় ওসি আছে কি না, একটু খবর দিতে। পরে আমি বাজারে থাকা এক পুলিশ সদস্যকে দিয়ে ওসি সাহেবকে খবর দিলাম। ওসি সাহেব খবর পেয়ে সেকেন্ড অফিসার সহ আসলেন। উনাদের সাথে কথা বার্তা বললেন, উনারা চলে গেলো।
পরের শনিবার আমি আমার বাড়ির পাশের পুকুর ঘাটে বসা ছিলাম বিকেল টাইমে। দেখলাম সিন্দুকছড়ি রাস্তা হয়ে লাইন করে সেনাবাহিনী হেঁটে আসতেছে। সেদিন দেবলছড়ি বাজার বার। কাছে আসার পর দেখলাম সামনে ক্যাপ্টেন কাদের সাহেব, উনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি এখানে? আমিও প্রশ্ন করলাম আপনি এখানে কেন? বললো যে রুটিন কাজ করতেছেন। ডেকে আনলাম বাড়িতে, তারা ৪৫জন ছিলো। আমার নিজের গাছের ডাব কেটে খাওয়ালাম তাদের। আমার দাদা তখন তাদের বললো, আমার নাতিকে দোয়া করে দিয়ে যান। আমি বললাম আজকে থাকেন, উনারা চলে গেলেন।
পরদিন রবিবার পেরিয়ে সোমবার মুবাছড়ি হয়ে সিঙ্গিনালার একটি পাহাড়ে উঠে উনারা বিশ্রাম নিলেন, সেখানে তারা রান্না করতেছিলেন, ওখানে রাত্রে থাকবেন বলে। খাবারের সময় হওয়ার পর ক্যাপ্টেন কাদের এক সৈনিককে, জঙ্গলের ভেতর ঢুকে একটি ফাঁকা গুলি করতে বললেন, সে গুলি করলো। তাৎক্ষনিক দেখা গেলো জঙ্গলের ভেতর থেকেও আরেকটি গুলির আওয়াজ আসলো। এসময় খাবার ফেলে তারা পিছু হটতে লাগলো, পাকিস্তানী ২-১জনের সাথে অনেক মিজো সৈন্য অনবরত গুলি করতে লাগলো। ক্যাপ্টেন কাদের গুলি করতে করতে থানা ঘাটে এসে বাঙ্কারে ঢুকলেন। বাহিরে সৈনিকরা পাল্টা যুদ্ধ চালাতে লাগলো। পরে খাগড়াছড়িতে আসার জন্য রেডি হয়ে বাঙ্কার থেকে বের হতেই ক্যাপ্টন কাদের গুলিবিদ্ধ হলো। সৈনিকরা ক্যাপ্টেন কাদেরকে কাঁধে করে হেঁটে হেঁটে রাতে খাগড়াছড়ি পৌঁছাতে ক্যাপ্টেন কাদের পরদিন শহীদ হন।
সাউথইস্ট জার্নাল- পাকিস্তানীদের সাথে কি মিজোরা একসাথেই যুদ্ধ করেছিলো?
চউলাপ্রু চৌধুরী- হ্যাঁ। পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় ৫০-৬০জনের মিজোবাহিনীর সাথে পাকিস্তানী ছিলো ৩-৪জন করে। খাগড়াছড়ি, পানছড়ি, দীঘিনালা, মহালছড়ি, মানিকছড়ি, গুইমারাতে মিজোদের আধিপত্য ছিলো। পাশাপাশি রাঙ্গামাটি-বান্দরবানেরও ছিলো। মিজোরা থাকাতেই পাকিস্তানীরা পাহাড়ে আসতে পেরেছিলো। পাকিস্তানীরাতো পাহাড়ের রাস্তাঘাট চিনতো না।
সাউথইস্ট জার্নাল- মং রাজা নাকি মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক অবদান রেখেছেন? উনি কেমন মানুষ ছিলেন?
চউলাপ্রু চৌধুরী- হ্যাঁ, তারতো অস্ত্র ছিলো অনেক, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, অস্ত্র দিয়েছেন, খাবার দিয়েছেন। পরে পাকিস্তানীরা তার ব্যাপক ক্ষতি করেছে। তার পালিত ভেড়া, গরু, ছাগল সব নিয়ে গেছে, গোলার ধান নিয়ে গেছে। রাজা হিসেবে তিনি উপযুক্ত ছিলেন। তিনি চাকমা মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। উনারতো বাচ্চা হয়নাই। একটা মেয়েকে লালন-পালন করেছে।
সাউথইস্ট জার্নাল- মং রাজা কে হবেন এ বিষয়ে নাকি মামলা চলছে?
চউলাপ্রু চৌধুরী- হ্যাঁ, তবে পালিত মেয়ে হলেও তো তার সম্পত্তিতে অধিকার আছে। সমস্যা রাজার আমল থেকেই। রাজা মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন চাকমা ছেলের সাথে, তো রাজার মৃত্যুর পর যদি মেয়েকে ক্ষমতা দেয়া হয় তাহলেতো তার স্বামী রাজা, আর চাকমা ছেলে যদি রাজা হয় তাহলে রাজ্যটা চাকমার অধীনে চলে গেলো না! যার পরিপ্রেক্ষিতে মারমা তাকে ক্ষমতা দিতে চায় নাই।
বীর মুক্তিযোদ্ধা চউলাপ্রু সত্য উন্মোচনে তার মূল্যায়ন ব্যক্ত করেছেন। তিনি ত্রিদিব রায়ের আহবানে সাড়া না দিয়ে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামীলীগের পক্ষে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকীর এই ক্ষনে চউলাপ্রু’র গৌরবোজ্জল ভূমিকার কথাও স্মরণ করছি।