মুক্তিযুদ্ধ: চট্টগ্রাম মহানগর থেকে রামগড়
![]()
সাথী দাশ
এক
২৫ শে মার্চ ১৯৭১ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম শহর মিছিলের শহর। সকাল থেকে সারা চট্টগ্রাম শহরে মিছিলের স্রোত। ২৪ শে মার্চ সন্ধ্যার পর পর সোয়াত জাহাজ হতে অস্ত্র খালাসের খবর পেয়ে প্যারেড গ্রাইন্ডে (মাঠে) অনুষ্ঠিতব্য সভা ও ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ নাটক প্রদর্শন অনুষ্ঠান থেকে হাজার হাজার ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-কর্মচারী বন্দর অভিমুখে ধেয়ে যায়। বন্দর এলাকায় জোটসহ সকল পথে অবরোধ ও প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিলো তা ২৫শে মার্চেও তাদের অবস্থান সুদৃঢ় রেখেছে। ষোলশহরের দিক ছাড়িয়ে বায়োজিদ বোস্তামি সড়ক দিয়ে সেনাবাহিনী বের হবে এ সংবাদ পেয়ে নাসিরাবাদ শিল্প এলাকার শ্রমিক-ছাত্র-জনতার সেখানে অবরোধ গড়ে তোলে। ২৪শে মার্চ থেকে ক্যান্টনমেন্টের সে রাস্তায় রাস্তায় প্রতিরোধী জনতা রাস্তা কেটে, ভাঙ্গা ট্রাক, ড্রাম ও গাছ কেটে ফেলে ব্যারিকেড করে রাস্তায় রাস্তায়। অক্সিজেনের দিকে আমি জুটমিল ও কালুরঘাট এলাকার শ্রমিকও এলাকার ছাত্র-জনতা মিলে সেখানেও ব্যারিকেড দিয়ে অবরোধ গড়ে রেখেছে।
শহরের মধ্যখানে শহর ছাত্রলীগের মিছিল, দোকান কর্মচারী সমিতির মিছিল, বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শহর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটির নেতৃত্বে হাজারো ছাত্র-জনতার মিছিল লাল দীঘি মাঠে এসে জমা হতে থাকে। জেলা ছাত্রলীগের এক একটা মিছিল পতেঙ্গা-আগ্রাবাদ-হালিশহর থেকে এসে টাইগারপাস মোড়ে এসে মিলিত হয় এবং তা সোজা পূর্বদিক দিয়ে ষ্টেশন রোড হয়ে জুবলি রোড দিয়ে এগুতে থাকে। পাহাড়তলি-লালখান বাজার এলাকার মিছিলগুলি সেটডিয়ামের রাস্তা ধরে আসকার দীঘির পর হয়ে জামালখান রোড হয়ে আন্দরকিল্লার দিকে আসতে থাকে। জুবলি রোডের মিছিলটি এনায়েত বাজার হয়ে মোমিন রোড হয়ে আন্দরকিল্লার দিকে আসতে থাকে। পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম কলেজ, চকবাজার এলাকা থেকে আসা একটা মিছিল এ মিছিল গুলো আসার আগেই চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের দিকে এগিয়ে যায়। সকালে বিনোদা ভবনে খবর এসেছে কোরবানীগিজড এলাকায় বসবাসকারী অবাঙ্গালিরা বাঙ্গালিদের গোডাউন লুট করেছে। সে সংবাদ পেয়ে জেলা নেতাদের একাংশ সরেজমিনে তদন্ত ও তা প্রতিহত করার জন্য মিছিল নিয়ে ঐদিকে যায়। হাজার হাজার ছাত্রের মিছিল আসছে শুনে সেখানে অবাঙালি ব্যবসায়ীরা (যারা ঐ এলাকায পরিবারসহ বসবাস করে অর্থাৎ গুজরাটি ও খোজা সম্প্রদায়ের মুসলিম পরিবার) এসে ছাত্রনেতাদের কাছে বলে ‘‘কয়েকজন বিহারী এ লুটের সাথে জড়িত। তাদেরকে ওরাই প্রতিহত করেছে এবং মালামাল গোডাউনে ফেরত দেয়া হয়েছে। এখানে এমন কাজ আর হবে না। বিহারীদের চিরকালের জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’’ মিছিল খাতুনগঞ্জ ঘুরে আসাদগঞ্জ হয়ে লালদীঘি পার হয়ে বিনোদা ভবনের দিকে যেতে থাকে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন দিক থেকে আসা মিছিলের কিছু কিছু ছাত্র নেতার মিছিল টেরি বাজারের দিকে অগ্রবর্তী মিছিলের সাথে মিলিত হয়ে যায়। অন্যরা লাল দীঘি হয়ে কোতোয়ালীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। লালদীঘি ময়দানে তখন শহর ছাত্রলীগের সভা হচ্ছে, হাজারো ছাত্র-জনতার মিছিল দেখে শহর ছাত্রলীগের ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও ছাত্ররা তাদেরকে করতালি দিয়ে, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’’ স্বাধীনতা , স্বাধীনতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা’’ শ্লোগান দিয়ে অভিনন্দন জানাতে থাকে।
২৫শে মার্চ দুপুরের পর থেকে আবারো মিছিল। লালদীঘি ময়দানে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কুচ্কাওয়াজ অনুষ্ঠানে, সে অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগ-আওয়ামীলীগ, শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ভিন্ন ভিন্ন ভাবে মিছিল আসতে শুরু করে। লালদীঘি ময়দান জনতার জোয়ারে পরিপূর্ন। কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান ও সভা শেষ হতে হতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে।
দুই
দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে। জেলা ছাত্রলীগের মিছিল শেষে সবাই যে যার মতো চলে যাচ্ছে। নেতৃবৃন্দ সন্ধ্যার দিকে অফিসে আসার জন্য অনেকেই বলে দিচ্ছেন। অনেকেই আবার অফিসে থেকেই যাচ্ছে। দুপুরের দিকে মিছিল শেষ করে আমি বাসায় চলে এসেছি। ভাত খেয়ে একটু গড়িয়ে নিয়ে সন্ধ্যার আগেই অফিসে এসে গিয়েছি। জেলা ছাত্রলীগের সব কর্মকর্তার হাজির। হাজির ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতারা, হালিশহর, পতেঙ্গা, পাহাড়তলী, ঝাউতলা, অক্সিজেন, বায়োজিদ বোস্তামী-পাঁচলাইশ, কালুরঘাট এলাকার ছাত্র নেতৃত্বে থাকা সংগঠকদের কাছ থেকে জেনে নিচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি ও অবস্থা। একের পর এক বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে শহর চট্টগ্রামের প্রতিরোধী গণমানুষের প্রতিরোধ সংগ্রামের চিত্রটা সকলের সামলে ভেসে উঠছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এর ঘন্টা খানেক পর এ.বি.এম. নিজামুল হক, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, শাহী-ই-জাহান চৌধুরী, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল রায়হানসহ আমরা। আমি, আনোয়ারুল আজীম, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাজির উদ্দিন, (পরবর্তীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা), চট্টগ্রাম কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শহীদুর রহমান (সাতকানিয়া) একই বিভাগের টাঙ্গাইলের আব্দুল মাবুদ (পরবর্তীতে টাঙ্গাইলের শহীদ মুক্তিযোদ্ধ), অফিস থেকে নীচে চা খাওয়ার জন্য নামার সময় দেখা হলো চট্টগ্রাম সিটি ছাত্রলীগের মধ্যে সিটি ছাত্রলীগের ভিন্নতর সংগঠক মাহফুজুর রহমান (পরে ডাক্তার), তোহাগাজী, আবুল কাশেম, ফাইম উদ্দিন আহম্মদ সহ এক ঝাঁক তরুন তুর্কি। তিনিই আমাদের জানান দিেেলন ‘‘আজকের রাতটা ভয়ানক রাত হিসেবে দেখা দিতে পারে। সবাই সবাইয়ের কাছাকাছি, নাগালের মধ্যে থাকলে ভালো হবে।’’ শাহী-ই-জাহান ভাই প্রশ্ন করেন ‘‘কি হতে পারে মনে করো? ’’ কি হবে জানি না, কি ভাবে হবে তাও জানিনা। তবে সমস্ত শহর থমকে গেছে, নিস্তব্ধ। মাঝে মধ্যে ছাত্র-জনতার শ্লোগান শহরের নিঃশব্দকে সরব করে তুলছে। তাই বলছি, কি জানি কি হয় জানি না’’ ওরা অফিসের উপরে উঠে গেলো, আমরা নীচে শাম্মী হোটেলের পেছনের চিপা স্থানে বসে চা খাওয়ার সাথে সাথে মাহফুজুর রহমানের কথাগুলো নিয়ে রুশ্নি ভাই বিশ্লেষণ করে কি হতে পারে প্রশ্নটা সবার সাথে আলাপ করছি। এর মধ্যে শাম্মী হোটেলের মালিক মীর আহম্মদ সওদাগর ভেতরে এসে দাঁড়ায় এবং ছাত্রনেতাদের প্রশ্ন করে ‘‘ও ভাই এখন কি অবস্থা? কি অই বো কিছু ক-অন, মাথার মধ্যে কিছু ন-ঢুকের। হোটেল বন্ধ করি যাইতাম গোয়, কিন্তু যাইনরে বাড়ীতে কিরগ্যম, বেশী ডর লাগের।’’ রুশ্নিভাই বলে উঠে ‘‘অসুবিধা নাই, তেমন কিছু হবে না, ভয় পাবার কোন দরকার নেই। আমরা আছি তো’’এর মধ্যে কাজী সিরাজ ও তাজুল ইসলাম এসে ঢুকে শাম্মী হোটেলে। ওরা পেছনে সিট না পেয়ে সামনে বসে চা খাচ্ছে। রুশ্নি ভাই সিগারেটের জন্য উঠে বাইরে গিয়েছে। আমি সামনে এসে তাজুল ইসলামের সামনে বসি। কাজী সিরাজ কি একটা বলতে চাইছিলো, ঐ সময়ে একটু দ্রুত গতিতে রুশ্নিভাই ঢুকে বলে, সবাইকে হান্নানভাই অফিসে ডেকে পাঠিয়েছে। সবাই দ্রুতগতিতে শাম্মী থেকে বের হয়ে আওয়ামীলীগ অফিসের দিকে যেতে থাকে। এর মধ্যে ছাত্রলীগের অফিস থেকে হাসেমভাই, সাবের ভাই, মাহফুজভাইয়েররা সহ অনেকেই দল বেঁধে এদিকেই যাচ্ছে। ঐখানে গিয়ে জানা গেলো ইপিআর বাহিনীর ক্যাপ্টেন করিম বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে তিনি বিভিন্ন স্থানে ঘাঁটি ও বাংকার প্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়ে নিজেই সব স্থানে টহল দিচ্ছেন। হানান ভাই, হারুন ভাই ছাত্রনেতাদের করণীয় সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করে ঢাকার সাথে যোগাযোগের জন্য বের হয়ে পড়েন।
আমরা সবাই নীচে নেমে আসি। এরমধ্যে প্রায় ৯টা বেজে গেছে। রুশ্নিভাই সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে রাত ১১টার মধ্যে অফিসে জমায়েত হওয়ার কথা বলে উনি বাসায় দিকে যেতে থাকেন টেরি বাজার দিয়ে। আমি ও রাজুভাই (আবদুল্লাহ-আল-রায়হান) রিক্সা করে বাসার পথে যাচ্ছি। রাজুভাই ঈশ্বরনন্দী লেইন, আমার বাসা রুমঘাটা; তাই তিনি আমাকে নিয়ে রিক্সায় উঠে বললেন, ‘‘তাড়াতাড়ি করে চলে এসো।’’
আমি বাসায় গিয়ে ভাত খেয়ে উঠে চুপি চুপি মামীকে (মিনতি দাশ, যাঁর স্বামী নারায়ণ সাধন দাশ আনোয়ারা থানার পরেয়করা গ্রামে শহীদ হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও লজ্জাকর বিষয় এই যে, সেদিনের ৩০ জন শহীদ হওয়া গণহত্যায় পাকিস্তানি সেনাদের সাথে যারা নিজের হাতে এক গণহত্যা চালিয়েছেন তারা হলেন চট্টগ্রামের স্বাধীনতার পরবর্তী এক আওয়ামীলীগ নেতার অত্যন্ত কাছের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত। তাদের কারোই ঘাতক-দালাল হিসেবে বিচার হয়নি)। ও আমার দিদিমনি (আমার মায়ের মা)কে বলে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে সোজা অফিসের সামনে অন্যান্যদের সাথে শহরে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার কথা শুনছিলাম। হাসেম ভাই, সাবের ভাই, নিজাম ভাই, শাহী-ই-জাহান ভাইয়া শাম্মী হোটেলেই খেয়ে বের হয়ে এসেছেন। সাথে অন্যান্যদের মধ্যে কাজী সিরাজ, তাজুল ইসলাম, চট্টগ্রাম কলেজের জিএস মনিরুজ্জামান মন্টু, সেলিম নেওয়াজ, নুরুল আলম মন্টু, জাকারিয়াসহ আরো কয়েকজন ছিলেন। ওরা অফিসের দিকে রওয়ানা দিচ্ছে এমন সময় রিক্সায় নিজামভাই এসে নামলেন। তিনি বললেন, চারিদিক থেকে নিরস্ত্র পুলিশ, ই.পি.আর সদস্যরা এদিকে আসছে। ওরা অনেকেই চট্টগ্রাম কলেজে গিয়েছিলো, সেখানে কারো দেখা না পেয়ে এদিকে অফিসের দিকে আসছে। এরমধ্যে রুশ্নিভাই এসে গেছে। হাজারী লেইনের গল্লির মুখে জটলা। নিজাম ভাইয়ের কথা মতো পুলিশ ও ই.পি.আর মিলিয়ে ১০জনের মতো সদস্য এসে হাজির হয়েছে। ওরা আমাদের কাছে অস্ত্র চায়, আমাদের কাছে তো ভারী কোন অস্ত্র নেই। তারপরেও সকালে রাইফেল ক্লাব ও কলেজিয়েট স্কুলের উত্তর পাশের কোনায় অস্ত্র গুদাম থেকে নিয়ে অস্ত্রগুলো ওদের হাতে দিয়ে স্টেশন রেডস্থ রেস্ট হাউসের দিকে পাঠিয়ে দিলাম। কারণ ক্যাপ্টেন করিমের বাহিনী নিশ্চয় নৌবাহিনী ও জেটিতে অস্ত্র খালাসে থাকা পাকিস্তানী সেনাদের মোকাবেলায় টাইগার পাস মোড়ে আগ্রাবাদের বড় বিল্ডিং এর পজিশন নেবে। পরবর্তী সময়ে আমাদের ধারনায় ঠিক, এটা জানিয়ে দিয়ে গেলো চট্টগ্রাম কলেজের শহিদুর রহমান (সাতকানিয়া) ও ওমর ফারুক। শহীদ ভাই তাঁর বাবার গাড়ী ও বন্ধুক নিয়ে ওমর ফারুক সহ আগ্রাবাদ পর্যন্ত ঘুরে এসে বলে, ওরা দেখে এসেছে এখন রাস্তায় ব্যারিকেড আছে। পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা আগ্রাবাদের তিন/চার তলার বিল্ডিং এর পজিশন নিয়েছে। কর্নফুলী মার্কেট এর ইআইসি’র ১১তলা বিল্ডিং এর পজিশনটা খুব স্ট্রং করে রেখেছে। ওমর ফারুককে পরবর্তীতে সাকা চৌধুরীর অনুসারীরা প্রথমে গুলি করে আয়ত্ব করে। পরে তাঁকে নিয়ে যায় সাকা চৌধুরীর বাসভবন ‘‘গুডস হিলে” সেখানে অকথ্যভাবে নির্যাতন করে তাকে হত্যা করে। চট্টগ্রাম মহানগরীয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুকের হত্যাকারীর এখনো জামাল খানে প্রকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রাত বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার জটলাও। এমন ভাবে সময় পেরিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে দ্রুত গতিতে একটা জীপ এসে থামে চৌ-মাথায়। জিপ থেকে নামেন দানেশ ভাই এবং কালাম ভাই। কালাম ভাই রুশ্নি ভাইকে ডাক দিতে সবাই তাদের ঘিরে ধরে। উনি জোর গলায় বলেন, ‘‘এই মাত্র বাংরাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বঙ্গবন্ধু। জহুর ভাইয়ের বাসায় টেলিফোন এবং ওয়্যারলেস মেসেজও এসেছে। নেতৃবৃন্দ ওখানে বসে চারিদিকে যোগাযোগ করছেন। আমাদের এখন এই সংবাদ চারিদিকে জানিয়ে দিতে হবে মাইকিং করে। রেস্ট হাউসেও এ ব্যাপারে নির্দেশনা পাঠিয়েছে।’’ রুশ্নি ভাই হাতে লেখা মেসেজ কপিটা নিয়ে পড়ে শোনালেন। এই সময় জমায়েত স্থানে। মুহুমুহু স্লোগানে চারিদিক প্রকাশিত হতে লাগলে, এর মধ্যে রুশ্নিভাই সাবের ভাইকে বললেন, ‘‘মাইক নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠানের প্রয়োজন। বেবি টেক্সি পেলে এখানে থামাতে হবে। মাইকিং কি বলবে লিখে দিচ্ছি’’ বলে শাম্মী হোটেলের ভেতর ঢুকে গেল এবং মালিক মীর আহম্মদ সওদাগরের কাছে কিছু কাগজ চাইতেই তিনি কাগজ আর কলমটা রুশ্নিভাইকে দিতে দিতে প্রশ্ন করলেন ‘‘এখন কী হবে?’’ রুশ্নিভাই বলে উঠলেন ‘‘কি হবে মানে? বাংলাদেশ স্বাধীন হলো এটাই এখন সত্য।’’ রুশ্নিভাই একটা টেবিলে বসে মাইকিং এর বক্তব্যগুলো লিখছে একটার পর একটা। সামনে আমি কলম নেই; কপি করতে পারছি না। এর মধ্যে রাজুভাই ঢুকে রুশ্নিভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে একটা একটা কপি একেক জনকে দিচ্ছে আর বলছে ‘‘ধীরে ধীরে বলবে।’’ যাতে সবাই শুনতে পাই। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে যাবে রিক্সা, বলার পর চলতে বললে।’’ এর মাইক লাগানো রিক্সা বেবিটেক্সি আট/দশটা এসে গেছে হোটেলের সামনের রাস্তায়। দুইজন করে সবাই বের হয়ে যাচ্চে এবং বলে দেওযা হচ্ছে কোনটা কোন দিকে যাবে। আরো কয়টা রিক্সা-টেক্সি মাইকিং এর জন্য পাঠিয়ে রুশ্নিভাই রাস্তায় এসে সাবের ভাইকে বললো, মেসেজটা সাইক্লোস্টাইল করে, রাস্তায় রাস্তায় বিলি করতে হবে। এর মধ্যে কারা যেন (নামগুলো মনে নেই, আমার বইটি লেখার সময়েও মনে করতে পারিনি; দুঃখিত)। এক গাদা মেসেজ এর সাইক্লোস্টাইল কপি একটা হিলম্যান গাড়ী করে এসে সাবের ভাইয়ের হাতে (সাবের ভাইয়েরও নামগুলো মনে নেই বলেছেন) দিলে তিনি অর্ধেক নিলেন আর অর্ধেক কাজী সিরাজ, জাকারিয়া ও হাসেমভাই নিয়ে অফিসের দিকে নিয়ে যেতে বললেন কয়েকজন। এর মধ্যে সম্ভবত: মহাফুজভাই ও তোহাগাজী ভাই কিছু কপি মেডিকেল কলেজ ও পাহাড়তলীর জন্য নিয়ে উনার সাথে আসা সবাইকে নিয়ে রওয়ানা দিলেন। অফিসের মুখ ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে চর্তুদিকে গোলা-গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ঘড়িতে তখন প্রায় ২টার কাছাকাছি। আমরা মানে রুশ্নিভাই, নিজাম ভাই, শাহ-ই-জাহানভাই, রাজুভাই, মন্টুভাই ও আব্দুল মাবুদ ভাই এবং আমি সেদিনের মতো শেষ বারের জন্য চা খেলাম। চা খেতে খেতে দেখি রুশ্নিভাইকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে। হঠাৎ নিজামভাই ও রাজুভাই প্রায় এক সাথেই প্রশ্ন করলো রুশ্নিভাইকে ‘‘রুশ্নি এখন কি হবে? আমরা কি করবো এখন?’’ রুশ্নিভাই খুব স্বাভাবিক গলায় বললো, ‘‘প্রশ্নটা আমারো, তবে কাল একটা হদিস পাবো, সবাইকে একত্রে যোগাযোগ রাখতে হবে, বিচ্ছিন্ন হওযা যাবে না।’’ গুলির আওয়াজটা এখন জোরালো শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলা। আমরা মোমবাতির আলোয় বিল দিয়ে রাস্তায় নামতেই বিদ্যুৎ পুনরায় এসে গেলো এবং সাথে সাথে প্রচন্ড শব্দে কয়েকটা বিস্ফোরনের আওয়াজে আমরা আসলেই ভয় পেয়ে গেলাম। বিস্ফোরণের শব্দের সাথে সাথে আকাশটা আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে মীর আহম্মদ সাহেব হোটেল বন্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছেন বয়দের। রাস্তায় এখন আমরা ছাড়া কেউই নেই। রাত প্রায় তিনটা। গোল্লার আওয়াজ ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে, এখন সে আওয়াজের সাথে সাথে সাপের ছোবল মারার মতো হিস হিস ধরনের শব্দ হচ্ছে। মন্টুভাই বহুক্ষণ পর বল্লো ‘‘পাকিস্তানী সৈন্যরা নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে গুলি করছে বিভিন্ন দিকে। চলো সবাই আমার বাসায়, এখানে থেকে আর কাজ নেই।’’ আমরা ৭জন হাজারী লাইনের গল্লিতে ঢুকে মন্টু ভাইয়ের বাসায় এসে পৌঁছলাম। মন্টু ভাইয়ের (মনিরুজ্জামান মন্টু)। রুমটা মূল বাসায় কাঠামো থেকে আলাদা। তাই এখানে ঢোকার বা বের হবার ক্ষেত্রে মুল বাসিন্দাদের সাথে তেমন মুখোমুখি হতে হয়না। রুমের মধ্যে বিকালে বিশাল দুইটা খাট বিছালো। মন্টু ভাইয়ের ছোট ভাইও নাকি মাঝে মধ্যে এখানে থাকে। যদিও বা মূল ঘরের সংলগ্ন একটা রুমেই সেখানে। আমরা বাইরের গুলি-গোল্লার শব্দ শুনতে শুনতে নিজেদের মধ্যে আগামীর কথা বলতে বলতে এক সময়ে সবাই ঘুমিয়ে পরলাম।
তিন
২৬ শে মার্চ শুক্রবার আটটা সাড়ে আটটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে গেলাম সবাই, আমরা বের হবার জন্য প্রস্তুতি নিতেই মন্টুর ভাই এসে বললো, ‘‘নাস্তা করে বের হবেন। মুখ ধোয়ার পানি নিয়ে এসেছি, হাত মুখ ধুয়ে নিন।’’ এর কিছুক্ষন পর আমরা সবাই অফিসের সামনে এলাম। এরমধ্যে খবর পেলাম সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্ট কাল রাত্রে ২টার দিকে ষোলশহর-ঘাঁটি ছেড়ে রাস্তায় সেনাবাহিনীর প্রতিরোধে বিভিন্ন স্থানে পজিশন নিয়েছে। এর মধ্যে দলছুট ইপিআর, পুলিশ ও সেনা সদস্যরা (কাল রাত্রে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা) আমাদের অফিসের সামনে একে অন্যরা কোথায়, আমাদের এখন করনীয় কি এসব প্রশ্নের উত্তরে বেশির ভাগ লোকদের রেস্ট হাউসের দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম। কারণ এইখানে অনেকেই প্রতিরোধ পজিশনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখছে। অন্যদিকে কারো কারোকে বায়োজিদ ফতেয়াবাদ পাহাড়ে প্রবর্তক পাহাড়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে পিক-আপ গাড়ি দিয়ে।
আমরা এখানে ঘন্টা খানেক থাকার পর এর মধ্যে ইউসুফ ভাই (এস.এম.ইউসুফ) এসে রুশ্নিভাইদের বললেন, ‘‘চট্টগ্রাম কলেজে সবাই চলো, ওখানেই কথা হবে।’’ আমরা সবাই উনার কথা মতো চট্টগ্রাম কলেজের দিকে রওযানা দিলাম। আন্দরকিল্লায় এসে রুশ্নিভাই বললো, ‘‘আমি একটু বাসা থেকে ঘুরে আসি। টাকা পয়সা কিছু আনতে হবে তো, তবে আধ ঘন্টার ভেতর আসছি।’’ অন্যরা এগুতো থাকে। আমি বাসার সামনে এসে নিজাম ভাইকে বললাম, ‘‘আমি বাসায় গিয়ে শুধু প্যান্ট খোলে রাত্রে লুঙ্গি পরে বের হয়েছিলাম। পরে বের হয়ে আসবো। আপনারা হাঁটুন আমি পেছনে ধরছি।’’ আমি রুম ঘাটায় গিয়ে প্যান্ট পরে বের হতে হতে মামীকে বললাম, ‘‘আপনারা সবাই গ্রামের দিকে চলে যাবার চিন্তা করুন, অবস্থার পরিবর্তন হলে চলে যেতে বলুন বড়ো মামুকে। মা’দেরও ডেকে নিবেন। এখানে উল্লেখ্য যে, সপ্তাহ খানেক পূর্বে আমার মা ও আমার ছোট বোন সিলেট থেকে চট্টগ্রাম এসেছে। ওরা এখন আমাদের গ্রামের বাড়ি ধলঘাটে অবস্থান করছেন। অন্যদিকে সিলেটে অবস্থান করেছেন আমার দাদা (উনি চট্টগ্রাম থেকে গিয়েছেন), আমার এক বোন ও আরো ভাই বাবা ও ঠাকুরদিবা সিলেটে আমার বাবার কার্যক্ষেত্রে আছেন। সে যা হোক, আমি বাসা থেকে দ্রুত বের হয়ে আসলাম। মামাদের মুখোমুখি হলে কখনো বের হতে দেবে না। দিদিমনি সামনে অতএব পেছনের গেইট দিয়েই বাসা থেকে বের হলাম। আমি দ্রুত হেঁটে প্রায় নিজামভাইদের পেছন পেছন কলেজের পূর্বদিকে ঢুকে পশ্চিম দিকের গেইটের দিকে এগুলাম। ক্যামোস্ট্রির প্রফেসর আখন্দ স্যারের সামনেই ইউসুফসহ সবাই আছেন। এর মধ্যে একে একে অনেকেই আসতে লাগলো। রুশ্নি ভাইও পৌঁছে গেছে। ইউসুফ ভাই বললেন, ‘‘আমি কাল রাত্রেই লিডারদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। শেষ পর্যন্ত সিরাজ ভাইয়ের (সিরাজুল আলম খান) সাথে যোগাযোগ করলে উনি শুধু বললেন, স্বপন যাচ্ছে (ছাত্রনেতা স্বপন কুমার চৌধুরী); সে গেলে সব খবরই পাওয়া যাবে।’’ অতএব, আমাদের এখন উনার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু নেই। এখানে প্রয়োজনীয় নির্দেশনায় আমরা বিভিন্ন কাজ করতে শুরু করলাম। এরমধ্যে অনেকেই এসে উপস্থিত হয়েছে। সবার মধ্যে গত রাত্রে মনের ভয় লাগা ভাবটা এখন কমে এসেছে। সারাদিন বিভিন্ন স্থানে খাবার সরবরাহ কাজে সম্পৃক্ত থাকলেও বারে বারে চট্টগ্রাম কলেজেই ফিরে এসেছি আমরা। এভাবেই দিন শেষে সন্ধ্যা নামে শহরে। সন্ধ্যার পর থেকে দলছুট সেনাবাহিনীর সদস্যরা (যারা কাল ভোর রাতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে লুকিয়ে ছিলো), ইপিআর সদস্য (এসেছে ওরা কেউ কাপ্তাই থেকে) চট্টগ্রাম কলেজে আসলে আমরা তাঁদেরকে বিভিন্ন স্থানে পাঠানের ব্যব্স্থা করে দিচ্ছি সাথে সাথে। এখানে জমায়েত হওয়া অনেকেই রাত নামার সাথে সাথে অন্যত্র চলে গেছে আবার নতুন অনেকেই আমাদের সাথে জমা হচ্ছে। আমরা রাতের ভাত খাওয়ার জন্য হোস্টেল গেইটের পূর্বদিকে চির পরিচিত সেই হোটেলে যাবার জন্য গেইটের কাছে পৌঁছতেই হঠাৎ করে শুরু হলো প্রচন্ড বিস্ফোরন অর্থাৎ কালকের রাতের মতো শেলিং। যুদ্ধ জাহাজ থেকে ছাড়া শেলিং আমাদের চলার পথের বাম পাশ ঘেঁষে মাঠের মধ্যে পরে একটা। একের পর এক বিস্ফোরনের শব্দের সাথে কিসের শব্দ একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম, আমরা ভয় পেয়ে রাস্তা পার হয়ে হোটেলে না ঢুকে তার বাম পাশ দিয়ে ছোট গল্লি দিয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে ছোট খাল পার হয়ে পাশের এক বস্তিতে ঢুকলাম। আমাদের (ওসমান গনি খাঁন, কামরুল ইসলাম, বোরহান উদ্দিন, রবিউল হোসেন কচি, ফখরুল ইসলাম মনি) দেখে একটি ঘর থেকে এক লোক বের হয়ে, ডেকে ঘরে ঢুকাতে বসতে দিলো। আমরা সবাই মাটিতে পেতে দেওয়া চাটায়ে বসলাম। শেলিং এর সাথে সাথে বিদ্যুৎ ও নিয়ে গিয়েছিলো। মাটির কুপি জ্বলছে, শেলিং ও হচ্ছে, তবে থেমে থেমে। আমরা প্রথমে মনে করে ছিলাম, চট্টগ্রাম কলেজটাকে গুড়িয়ে দিয়েছে। এখন বসে ঠান্ডা মাথায় সবাই একমত হলাম কালকের রাত্রের মতোই টার্গেটহীন শেলিং করছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। এর মধ্যে কলেজ মাঠে একটা পরেছে। আমরা বের হয়ে পুনরায় কলেজ হোস্টেলে ফিরে যাবার কথা বললে বাড়ীর মালিক বা কর্মকর্তা আমাদের থেকে অনুরোধ করেন এবং আমাদের জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা করার কথা বলে ভেতরের ঘরে ঢুকে গেলেন। খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা সে রাত ঐ মাটির চাটাই এ শুয়ে পরলাম। আজ ভাবছি যুদ্ধের সূচনা লগ্নেই এই মহানুভব (এখন এই ভদ্রলোকটির নামও কারো মনে নেই) ব্যক্তিটি আমাদেরকে যে আন্তরিক সাহায্যের হাত খানা বাড়িয়ে দিয়েছেন তাও তো মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ঘটনাবহুল ঘটনার একটা ক্ষুদ্রাংশ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত হয়তো না।
চার
২৭ মার্চ শনিবার সকলেই আমরা চট্টগ্রাম কলেজে পৌঁছে গেলাম, এরা সবাই আমাদের না দেখে কাল রাত থেকেই বিচলিত হয়ে পরেছিলো। আমরা যেতেই রুশ্নিভাই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘‘কাল সারারাত তোমরা কোথায় চলে গিয়েছিলে? বলে গেলে ভাত খেয়ে আসছো, তোমরা খেয়ে এলে আমরা খাবো এমন কথা ছিলো। কিন্তু তোমাদের সারারাতই খবর নেই? এ সময়ে ঐ ধরনের করাটা খুবই বিপদজ্জনক। ‘‘ওসমান খান হাসছে, রবি হাসছে ঐ হাসি দেখে রুশ্নি ভাই আরো গরম হয়ে যায়। ইউসুফ ভাই এতক্ষন চুপচাপ সব শুনছিল। এখন এগিয়ে এসে সবাইকে ডেকে বললেন, আসলে ঘটনাটা কী বলো তো দেখি?’’
কামরুল তখন গত রাতের আমাদের ভাত খেতে যাওয়ার সময়কার সবঘটনাগুলো এক এক করে বলে যায়। ইউসুফ ভাই একটু হেসে বলেন, ‘‘আমরা এখানে ছিলাম, যা ঘটছে, যা ঘটতো সবই তো আমাদের যৌথভাবেই ঘটতো, তোমরা এদিকে না এসে ঐদিকে দৌঁড়ে যাওয়াটা যুদ্ধের নীতি নিয়মের বিরুদ্ধে, কমান্ডিং ভঙ্গের অপরাধে অপরাধি। যা হোক সবাই এখন এসেছ, অন্যরাও আসছে। আমরা এখন কলেজ চত্বর ছেড়ে যাবো।’’
তিনি এ বলে আমাদেরকে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিলেন। চট্টগ্রাম কলেজের ইউ.ও.টি.সি কোর্সের প্রশিক্ষক জনাব শফিকে দিয়ে এর মধ্যেই ইউ.ও টি.টিস কোর্স অফিসের তালা ভেঙ্গে ঐখানে রক্ষিত রাইফেল, বন্ধুক ও ডামি রাইফেল কিছু গুলিসহ বের করে একখানে জড় করে রাখলেন। এদিকে বোরহান নিজে কামরুলকে ডেকে নিয়ে হোস্টেলের দোতালার দিকে উঠে গেলো। কিছুক্ষণ পর মনিও ওদের পিছু পিছু এগিয়ে গেলা। এর মধ্যে জালাল ভাই (চট্টগ্রাম কলেজের ভিপি মো: জালাল উদ্দিন আহমেদ) একটা পিক আপ থেকে নামলেন। এরমধ্যে একটা প্রাইভেট কার একটা হুট খোলা জীপ পূর্বে থেকেই এখানে ছিলো। এর মধ্যে এসে গেলো ওলি আহাম্মদ, মো: ইউসুফ (ইন্টারমিডিয়েট কলেজ)। চট্টগ্রাম কলেজের জকেরুল আলম খান, সাইফুদ্দিন, আহম্মদ, ফজলুল করিম। বোরহান কামরুল মনি উপর থেকে লেপ-তোষক-বালিশ এক গাদা নিয়ে নীচে নেমে এলো, বোরহান বললো-অরুন্য কচ্যা উপরে আর কিছু গুছিয়ে রেখে এসেছি মাতুদের রুমে। ওগুলো নিয়ে আয় নইলে খালিতে ঘুমাবি। অগ্যতা আমি আর কচি গিয়ে ঐগুলো নিয়ে এসে একটা পিক-আপ এর পেছনে তুলে দিলাম। তবে বোরহানরা খুব সুন্দর করে বান্ডিল করে রেখে এসেছিলো। তারাও বান্ডিল করে এনেছে, বোহানের এই বুদ্ধি বিএলএফ ট্রেনিং এ যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের কাজে এসেছে। আমরা চলে আসার পর হরিনা ক্যাম্পের ১নং ও ২নং টেন্ট এর মধ্যে এ গুলো ছিলো এবং স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত হাসেম ভাই, জালালভাই নিজমা ভাই মন্টু ভাই সহ হরিনা ইয়ুথ ক্যাম্পের পরিচালকবৃন্দ ব্যবহার করেছে। আমরা চট্টগ্রাম কলেজ থেকে প্রায় সাড়ে এগারটা দিকে রওয়ানা হয় চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের উদ্দেশ্যে। ছাত্র নেতা এস.এম. ইউসুফের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলা ও চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সক্রিয সংগঠক ও জঙ্গী কর্মীদের মধ্যে ছিলেন। যথাক্রমে শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, জালাল উদ্দিন আহম্মদ, ডা. মাহবুবুল আলম, ডা. জাফর উল্লাহ, ডা. আমিন আহমেদ, আনোয়ারুল আজিম, ওসমান গনি খান, মো: বোরহান উদ্দিন, কামরুল ইসলাম, অরুন দাশ, ফখরুল ইসলাম মনি, রবিউল হোসেন কচি, জাফরুল ইলম খান, ফজলুল করিম, সাইফুদ্দিন আহম্মদ, ওলি আহম্মদ, সো: ইউসুফ খান, পার্থ প্রতীম বড়–য়া, মো: হারুনুর রশিদ (তিনি ট্রেনিং যাননি, বাড়ী ফিরে যান), মো: শফি (তিনি চট্টগ্রাম কলেজের ইউ ও টিসি কোর্সের প্রশিক্ষক ছিলেন। তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ফেরত যান পরিবার একা থাকার কারণে)। তিনি চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মাঠে কয়দিন আমাদের সবাইকে প্রাথমিক ট্রেনিং দেন।
আমরা দুইটা আড়াইটার দিকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রবেশ করি এবং বিশেষ অনুমতিতে একটা ডাইনিং হলে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তাই আমাদের এই ব্যাপারে কোন প্রকার সমস্যায় পরতে হয়নি।
ঐ রাত্রেই আমাদের ওখানে হাসেম ভাই, সাবের ভাই, নিজাম ভাই, স্বপন দাকে (ছাত্রনেতা স্বপন কুমার চৌধুরী) নিয়ে হাজির হলেন এবং সবার সাথে আলাপ করলেন এবং বললেন ‘‘দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বের প্রাথমিক ধাপ পেরিয়ে গিয়ে অস্তিত্বের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হচ্ছি। এরপর শুরু হবে যুদ্ধ জয়ের প্রস্তুতি। এখান থেকে কখন, কোথায় যেতে হবে তা তোমাদের বর্তমান কমান্ড বস ইউসুফ ভাই বলবেন উনার দিক নির্দেশনায় তোমরা পরিচালিত হবে।’’ এই বলে ইউসুফ ভাইদের সাথে বসে কথা বলতে লাগলেন। ওরা দুইটা গাড়ীতে করে এসেছিলেন। সাবের ভাইরা একটা গাড়ি নিয়ে রাত্রেই চলে গেলেন। স্বপন দা, হাসেম ভাই, নিজাম ভাই, ডা. শাহ আলম (উনি দেশের বাড়ী ফিরে যান এবং পরবর্তীতে নৌ-কমান্ডার হিসাবে সাহসিকতার জন্য বীরোত্তম উপাধীতে ভূষিতে হন), মাহবুবুলু আলম (চট্টগ্রাম কলেজ, তিনি যুদ্ধে যাননি), রাজভাই (তিনি আলাদাভাবে হরিনা ক্যাম্পে ও সাবরুম গেছেন), সেদিন রাত্রে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালবেলা উনারা চলে গেলেন শহরের দিকে।
২৮শে মার্চ রবিবার সকালে মোঃ শফি’র কমান্ডে ঘন্টা তিনেক বন্দুক নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পজিশন প্রশিক্ষণ, ক্রোলিং প্রশিক্ষণ, ব্যালট প্রশিক্ষণসহ হালকা দৌঁ ঝাঁপের মধ্য দিয়ে শেষ হয়, বিকেল বেলা আমরা একটা গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন পর্যন্ত আমি এবং কতক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। এদিকে এসে দেখি ফজলুল করিম, ওলি , ইউসুফ (আর্মি ট্রেনিং শেষে তাকে এক বিশেষ অপারেশনের দায়িত্ব দিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীতে পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু সে পরবর্তীতে মু্িক্তযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে) সহ কয়েকজন গাড়ি নিয়ে কাপ্তাই গিয়েছিলো। আসার পথে একটা এ্যাক্সিডেন্ট করে, এতে জনগন ধাওয়া করলে কোন মতে প্রান বাঁচিয়ে চলে যায়। বিপদ থেকে বাঁচাতে ইউসুফ ভাই গাড়িটা নিয়ে হোস্টেলের পেছনের ঝোপের মধ্যে রাখতে আর ওদের সবাইকে ডাইনিং হল থেকে বের না হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন।
সেদিন রাত্রে পুনরায় নিজাম ভাই, মন্টুভাই, মহামুদুল ইসলাম চৌধুরী (তিনি পরে বাড়ি থেকে বিদায় নিতে গিয়ে পিতার কঠোর নির্দেশনা আমাদের সাথে কিংবা আলাদাভাবে ট্রেনিং এ যেতে পারেননি) রব্বান ভাই আসলেন। রাত্রেই সবাই চলে গেলেও রব্বান ভাই আমাদের সাথে থেকে গেলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ডাইনিং হলে একটা বড় রেডিও ছিলো। এটা প্রায় সময়েই চালু থাকতো। আমরা বাইরে থাকলেও হোস্টেলের কর্মরত অন্যান্যরা এটা সর্বক্ষন শুনতো। এর মধ্যে প্রথম দিনেই আমরা সকলে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠ শুনেছি। শহরে থাকতেই শুনেছি। রাখাল বনিকের প্রথম বেতার কন্ঠস্বর এবং হান্নান ভাইয়ের স্বাধীনতার ঘোষণা। শুনেছি চট্টগ্রাম থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আসার পথে ২ শে মার্চ সকালের অধিবেশনে ইংরেজীতে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র চালুর অল্প সময়ের কার্যক্রম। সেদিন সন্ধ্যায় আমরা ডাইনিং হল রুমে বসে রেডিও শুনছিলাম।শুনছিলাম বিবিসি সংবাদ আজাদাকালীন কোলকাতার সংবাদ পরিক্রমা, ভয়েস অব আমেরিকা’র সংবাদ এক সময় ইউসুপ বলেন, ‘‘আজ সকাল সকাল ঘুমাতে যাও সবাই, কাল আমরা রামগড়’ এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো। আমরা সবাই তাঁর নির্দেশমতো ঘুমাতে গেলাম।
পাঁচ
২৯শে মার্চ সোমবার সবাই ঘুম থেকে উঠে মাঠে চলে গেলাম প্রশিক্ষনের জন্য। ঘন্টা তিনের পর সবাই ফিরে সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার তোড় জোড় শুরু করে দিলাম। কেউ কেউ সকালের খানাও শেষ করে নিয়েছি। আমরা কয়জন বিছানা গুছিয়ে খাওয়া খেতে বললাম। এর মধ্যে সকলের সাথে সকলের একটা আলাদা রকমের আন্তরিক সম্পর্কের বন্ধন গড়ে উঠেছে। বোরহানের একটা কথায় সবাই উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেও সকলের মধ্যে একটা প্রাণ খোলা ভার স্পষ্ট হয়ে উঠে। যেমন- খাওয়া খেতে খেতে বোরহান বললো: ‘‘৩ বাজি, আঁরা কজন এই বিছানা পাত্তি¡ গুচ্ছাইর, দেইবা ঘুম যনত সময় ঘুম যাইতে দিতাম ন।’’ সবাই হেসে উঠে স্বরে, ডা. জাফর খুবই ভোলা-ভালা মানুষ, একটু রেগে গেলে তোতলায়। তিনি বলে উঠলেন, ‘‘ও বোরহান তুমি চিন্তা করো না, আমি উঠানো নামানোর সময় তোমাদের সাথে আমি আছি। আমার কথা মাথায় রেখো।’’ এর ঘন্টা খানেক পর অর্থাৎ প্রায় এগারটা দিকে আমরা তিন গাড়িতে করে রওয়ানা হলাম রামগড় অভিমুখে। আমরা রাউজান দিয়ে ফটিকছড়ি হয়ে প্রায় বিকেল নাগাদ রামগড় পৌঁছি। এখানে স্কুলের মাঠের ভেতর গিয়ে রামগড় পোষ্ট অফিস ঘেঁষা ছাত্র হোস্টেলের এক কামরা ছাড়া সবটাই অর্থাৎ টানা ঘরটায় আমরা ঢুকলাম এবং আমাদের সাথে আনা সবসামগ্রী ঘরে সাজিয়ে রাখলাম। আমরা যে ছাত্র হোস্টেলে ছিলাম তার সামনে একটা মাঠ, মাঠের সাথে লাগানো একটা রাস্তা স্কুলের সামনে দিয়ে এসে পোস্ট অফিসের সামনে দিয়ে থানায় গিয়ে শেষ হয়েছে। স্কুলের সামনের দিকের রাস্তা ধরে সামান্য এগুলো পাক রাস্তা সেটা দিয়েই আমরা এসেছি। এ রাস্তা সামনে গিয়ে বাজারে পড়েছে। বাজার থেকে একটা কাঁচা পাশ রাস্তা স্কুলের পেছনের দিকে গিয়ে ঐ রাস্তাটার সাথে মিশে গেছে, যে রাস্তাটা আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছি সে হোস্টেলের পাশ দিয়ে থানা পর্যন্ত পৌঁছেছে। রাস্তাটার একদিকে হোস্টেল, মাঠ, স্কুল, বাজার এবং বাজারের সামনে একটু উঁচু টিলা ও পাহাড় ধরে ইপিআর ক্যাম্প রেজিমেন্ট ঘাঁটি। তার সামনে দিয়ে বর্ণনা দিয়ে আসা রাস্তার অপর পার্শ্বে ফেনী নদী কুল বয়ে যাচ্ছে। নদীর ওপারে ভারত। অর্থাৎ ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রæম। রামগড়ের মতো সাব্রæমও এখন একটা থানা পর্যায়ে ছিলো। রামগড় থানার সামনে দিয়ে এই কয়দিনে ফেনী নদীর উপর একটা পুল দেওয়া হয়েছে। মোটামুটি মজবুত্ ছোট ছোট গুলো গাড়ি যেতে পারে। এর মধ্যে আমাদের খাওযাটা খুব জরুরী হয়ে পরেছে বিধায় আমরা সবাই খাওয়ার খোঁজে বের হলাম। এদিক থেকে মাঠ পেরিয়ে আরেকটা ছাত্র হোস্টেল, তারপরই স্কুল, স্কুলের এক্সটেনশান মাঠের এ কিনারেও আছে বাজারকে পেছনে রেখে। স্কুলের দিকে অনেক অনেক মানুষ আছে। সামনে গিয়ে সবাই দেখলাম, খানার ব্যবস্থা আছে তবে এখন খানা শেষ। খানা ব্যবস্থাপনায় যাঁরা আছে তাঁরা জেলা আওয়ামীলীগের সাথে সংশ্লিষ্ট স›দ্বীপ, সীতাকুন্ড, মিরসরাইয়ের নেতৃবৃন্দ। অনেককেই আমরা ব্যক্তিগত ভাবেই চিনি। ইউসুফ ভাই ও রুশ্নি ভাই আমাদের আসার খরচ এবং আমার কোথায় অবস্থান নিয়েছি তাদেরকে জানিয়ে দিয়ে আমরা বাজারের দিকে গেলাম। সেখানে সবাই বিস্কুট মুড়ি চা খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত করলাম। কতক্ষন আমরা সামনে ইপিআর ক্যাম্পের দিকে গিয়ে দেখে শুনে চলে আসলাম, ইপিআর ক্যাম্পের পাহাড়টা তেমন ছোট কিন্তু নয়। কারণ ঐখান থেকে ফেনী নদীর অস্তিÍত্বটা দেখা যাচ্ছে সামান্য শীর্ণ স্রোতের খালের মতো। আমরা আমাদের অবস্থানে ফিরে এসে হোস্টেল ঘরের ভেতরে একটু ঝাড়পোজ করে দুইটা ছোট টেবিল, তিনটা কাঠের চেয়ার রাস্তার পাশের জানালার দিকে সরিয়ে রেখে আমাদের আনা বিছানার বান্ডিলগুলো খুলে খুলে পরিপাটি করে বিশ্রামের আয়োজনটা সেরে ফেলাম। আমরা সবাই বাইরে বের হয়ে এবার আমাদের থাকার অবস্থানটা ঘুরে দেখলাম, আমাদের ঘরের শেষ মাথায় একটা বন্ধ রুম। তারপরের রুমটাতে কেউ একজন আছে বুঝতে পারলাম; তারপরের বড় কামরার রুমটাতেই আমরা আছি। অতঃপর ছোট একটা পুকুর হল একদম নীচে মনে হয় কুয়ো। কিন্তু পারটা বৃহৎ আকারেও। পুকুরের ডান কোনে ছোট একটা বাংলা পায়খানা। একটু আগে পুকুরের মাঝপার বরাবর একটা বড়ই গাছ। গাছের একটু নীচে বনজ লতা পাতার জঙ্গল, জঙ্গলের পর অনাবাদী জমি, জমিতে ছোট ছোট খাস। তাপরপাশ দিয়ে পুকুরে ওপারে একটা অনাবাদী জমি ছাড়িয়ে মূল পাকা রাস্তা থেকে একটা বড়ো সারা মেঠো পথ থানা কম্পাউন্ডে ঢুকে গেছে। ওদিকে মেঠোপথের লাগালো একটা পুকরও দেখা যাচ্ছে। এদিকে হোস্টেল ঘরের শেষ কিনারায় অর্থাৎ পূর্বে উল্লেখিত বন্ধ ঘরের পার্শ্বে হোস্টেল ঘর থেকে পুকুরে যাবার ডানদিকের কোন ঘেঁষে একটা বাথরুমও আছে। সেখানে পানির ব্যবস্থা করা গেলে স্থানের উপযোগি হয়ে উঠবে।
সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। আমাদের ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। দুইটা ফ্যানও আছে। বাতি দুইটা জ্বলছে। কিন্তু আলোর শক্তিটা কম হয়তো বাল্ব এর পাওয়ার কম। এর মধ্যে দেখি মাঠে বিস্তর লোক জটলা জটলা করে অবস্থান করছে, কুপি বাতি জ্বলছে এখানে ওখানে, বুঝলাম, শরনার্থীরা আসছে এবং মাঠে অবস্থান করছে। দূরে তাকিয়ে দেখলাম রাস্তায় মানুষের সারিবদ্ধ মিছিল। মিছিল আসছে মাঠের মধ্য দিয়ে। সামনের মাঠ প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে, আরো আসছে….। রাত প্রায় আটটা, আমরা খাওয়ার উদ্দেশ্যে স্কুলে দিকে গেলাম, ভীড় নেই তত বেশি। আমরা গিয়ে সবাই বসতে পারলাম। ডাল-ভাত সবজি দিয়ে খেয়ে চলে এলাম নিজেদের ঘরে। সবাই ঘরে এসে বিছানায় বসে বিভিন্ন কথা আলাপ আলোচনার এক পর্যায়ে ইউসুফ ভাই বললো, ‘‘রুশ্নি তুমি এখন থেকে সবার দায়িত্ব নাও, আমি কাল আগরতলার যাবার প্ল্যান করেছি। ওখান থেকে আসার পর হয়তো কিছু বলতে পারবো। এর মধ্যে স্বপনবাবু হয়তো চলে আসবে এখানে। রুশ্নি ভাই বলো ‘‘আপনি একা কোথায় যাবেন? কোথায় খুঁজবেন? স্বপন বাবু আসুক দু’জন এক সাথেই যাবেন।
জাল্লাল ভাই প্রশ্ন করলেন ‘‘ইউসুফ ভাই, স্বপন বাবু এখানে কার সাথে আসবেন? নিজাম সাবের ভাইদের সাথে আসে এটা আপনাকে বলে দেয়নি? ইউসুফ ভাই বল্লেন, উনি বলেছিলেন ২৯ তারিখ রামগড় আপনারা পৌঁছান, আমি ঠিক সময়ে রামগড় পৌঁছে যাবো। আরো বেশ কিছু সময় আলাপ আলোচনা চলার পথ সবাই ঘুমিয়ে পরার জন্য তৈরি হয়ে ওঠে। অনেকে বাথরুমে যেতে বাইরে বের হয় এবং ঘুরে এসে বাথরুম সেরে ফিরছি। এমন সময় কামরুল বোরহান, মানি একসাথে বের হয়ে বাথরুম সেরে ফিরছি, এমন সময় কামরুল বলে উঠে ‘‘নিস্তব্ধ নিরবতায় হাজারো মানুষের ভিড়/অসহায় মানুষেরা ক্লান্তি শ্রান্তিতে বিপন্ন অসাড়/কালকেও মাথার ওপরের ছাদ্র ছিলো। ছিলো স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসার প্রলেপ বিস্তা। আজ ওরা ছিন্নমূল হয়ে ঘুরে ফিরে পথ থাকে খানা খন্দকে, মাঠ-ঘাসের উপরে/ছাদহীন হাওয়ায় খোলা আকাশের নীচে রুশ্বি ভাই পেছন থেকে বলে উঠে অদ্ভুত, অদ্ভুত তোমার কবিতা বিস্তার। এই শরণার্থীর অবস্থান দুঃখ যন্ত্রনার মধ্যেও এক আম্ভুত দৃশ্যের ক্যানভাস। নিস্তব্ধ-নীরবতা, মাঝে মধ্যে শিশুর কান্নার ধ্বনি আলো-অন্ধকার কুপির আলো সবকিছুতেই ছায়ার বিস্তার। তোমার কবিতাকে খুব ভালো হয়েছে।’’ কামরুলের উচ্চ হাসিতে নিঃস্তবন্ধতা ভেঙ্গে টুুকরো টুুকরো হয়ে ঝড়ে পরে। হাসিটা থামিয়ে কামরুল বলে’ রুশ্নি ভাই এটা আমার কবিতা নয়। এটা আপনার কবির, মানে অরুনের। এটা আমরা কথা বলার সময় বিছানার বসে লিখে আমাকে দিয়েছে। আমি মুখস্ত করে নিয়েছি। আসলেই তাৎক্ষনিকভাবে ভালো কবিতাই হয়েছি।’’ রুশ্নিভাই, সাবাস- সাবাস বলে সিগারেট খেতে খেতে বলে ‘চলো সবাই, ইউসুফভাই আবার কিছু মনে করবে।’’ আমরা সবাই ঘরের ভেতর গিয়ে যার যার জায়গার ঘুমিয়ে গেলাম। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমরা বিছনা ঠিক করার সময়েই নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলাম কে কোথায় কোনদিকে থাকবে। আমরা বিছানাতে শরীর ছাড়িয়ে দিতে ঘুমের আমেজ এসে যায়। ঘুমিয়ে পরি আমরা সবাই।
ছয়
৩০ মার্চ মঙ্গলবার সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাইরে বের হয়ে দেখি সারামাঠ খালি, দূরের মাঠেও সে একই চিত্র। অর্থাৎ শরণার্থীদল ওপারে চলে গেছে। পরে শুনলাম, ঐ সাব্রুমে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে যাবার পর ভারত সরকার বিভিন্ন স্থানে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। অনেকেই আবার নিজেরাই নিজেদের অবস্থান ঠিক করে নিতে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে।
তখন থেকে আমরা আমাদের মতোর করে জীবন যাপন করতে শুরু করলাম। সকালে সবাই মিলে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে মহাকুমা শহরটাকে ভালো করে দেখে নিয়ে ফিরে এলাম নিজেদের আস্তানায়। রামগড় স্কুলের মাঠটা দু’ভাগে বিভক্ত প্রথমে পাকা রাস্তা থেকে নেমেই স্কুলের দিকে আসার দু’পাশটায় খালি, যেন সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত মখমলের গালিচা বিছানো। স্কুলের বাম পাশে ঘেঁষে হোস্টেল লাইব্রেরী, ডান পাশে স্কুলের এক্সটেনশন ক্লাশরুম। এ দু’য়ের মাঝখানে পাকা রাস্তা থেকে আসা বিরাট এলাকা জুড়ে মাঠ। বামের হোস্টেলের পাকা দিয়ে বামে ঘুরলেই আবার মাঠ, মাঠের বামে আমাদের আস্তানা (হোস্টেল), মাঠের শেষে রাস্তা, রাস্তার পাশেই স্থির, শান্ত কখনো কখনো উত্তাল স্রোতের নৃত্য পটিয়াসি ফেনী নদী। ওপারে সাব্রুম। ঐদিকে নদীর পার ঘেঁষে শাল গাছের সারি, পেছনের সারি সারি শাল, গাছের নীচের দিকে হালকা পাতলা আগাছার ঝোপ-ঝাড়। ভেতরে ভেতরে হাঁটাহাঁটি করছে ভারতীয় সীমান্ত প্রহরী।
দুপুরে ভাত খেয়ে সবাই বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে আমরা মাঠের মাঝখানে গেলে হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করছিলাম। ইউসুফ ভাইও আছেন। তিনি এখনো আগরতলা যেতে পারেননি। সেহেতু স্বপনদা এখনো রামগড় পোঁছাননি। সকাল থেকে চট্টগ্রাম শহর ও জেলা ছাত্রলীগ, আওয়ামীলীগ শ্রমিক লীগের কর্মীবৃন্দের ভিড় বাড়ছে। পরিচিতদেরকে মাঠের চত্বরে ডেকে বসিয়ে শহর এলাকার খবরাখবর জেনে নিচ্ছে আমরা জানলাম। গতকাল রাতে অর্থাৎ ২৯মার্চ রাত থেকেই চট্টগ্রাম শহর এলাকার অনেক কিছুতেই দখল নিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা। জায়গায়-জায়গায় সাধারণ জনগনের উপর অত্যাচার করা শুরু করেছে সেনাবাহিনী। এলাকায় এলাকায় বিহারীরা বাঙালীদের বাড়িঘর লুট করছে, নির্যাতন করছে, পাইকারিভাবে হত্যাও শুরু করেছে। আমাদের জোওয়ানরা পরিকল্পিত আক্রমনের মুখে নিজেদেরকে পিছিয়ে নিচ্ছে এবং যেতে যেতে পেছনে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে পাল্টা জবাবও দিয়ে যাচ্ছে।
আমরা এখানে এসে শুনেছিলাম, আমাদের এখানে আসার কিছু সময় পূর্বেই বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সদস্যদের নিয়ে মেজর জিয়াউর রহমান সাহেব রামগড় এসে পৌঁছেছেন এবং পোস্ট অফিসের দোতলায় অবস্থান করছেন। তাঁদের আসার সংবাদ শুনে ভারতয়ি সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর (বিএসএফ) সাব্রæম কমান্ডার ইনচার্জ তাঁদের সকলকে আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানান। সেদিন দুপুরের দিকে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা কর্নেল ঘোষের কাছ থেকে ভারী অস্ত্রের চালান গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। নিজেদের আর্টিলারী কামান এবং গ্রহণ করা অস্ত্র সৈন্যদের নিয়ে ক্যাপ্টেন মতিন করের হাটের দিকে রওয়ানা হয়েছে। সাথে গিয়েছে আমাদের সাথে আসা ডাঃ আমিন আহমেদ (ডাক্তার হয়েছে সবাই স্বাধীন বাংলাদেশ হবার পর)। এখানে উল্লেখ্য যে, ক্যাপ্টেন মতিনের বাড়ী সিলেটে। আমাদের ডা. আমিনের বাড়ীও সিলেটে। কথা প্রসঙ্গে দু’জনেই এক আত্মীয়ের বন্ধনে পারিবারিক সূত্রে সম্পর্কীত। তাই ডা.আমিন সরাসরি যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করাতে ক্যাপ্টেন মতিন অন্যান্যদের সঙ্গে তাকেও নিয়ে সরাসরি করের হাটের প্রতিরোধ যুদ্ধে অগ্রসর হন। চার-পাঁচদিন পর ডা. অমি পুনরায় রামগড় প্রত্যাবর্তন করেন।
আমরা গোল হয়ে বসে বিভিন্ন জনের কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ জীপের হর্ন শুনে দূরে দেখলাম, একটা টয়োটা জীপ ধীরে ধীরে আমাদের মাঠের দিকে আসছে। এর মধ্যে দলে দলে শরণার্থীরা আসা শুরু করেছে। আমাদের মাঠের প্রায়ই জায়গায় তাদের সাথে আনা টুকিটাকি সামগ্রী রেখে বিশ্রাম নিচ্ছে। কেউবা কথা বার্তা বলছে, কেই কেউ আবার ফেনী নদী পার হয়ে ওপারের সাব্রুমে চলে যাচ্ছে। সবকিছুই ঘটছে আমাদের সামনেই। পুকুরের পার ঘেঁষে জীপটা দাঁড়াতেই জীপ থেকে একে একে নেমে এলো স্বপন চৌধুরী, এটিএম নিজামুল হক, সাবের আহমেদ, আবু আহম্মদ হাসেম ও নুরুজ্জামান মন্টি। ওরা নামতেই, ভাই ডাক দিলো। সবাই এদিকে চলে আসে এবং আমাদের সাথে বসে পড়ে। এরপর তাদের মধ্যে কথা চলে বহুক্ষণ। আমরা কামরুল মনি, বোহনা ও আমি চা খাওয়ার জন্য উঠে বাজারের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম। রবি কিছুক্ষন পর আসবে বলে আমাদের থাকার রুমের দিকে হেঁটে গেল। এরমধ্যে সূর্য ধীরে ধীরে তার নিজস্ব আলো কমাতে শুরু করেছে। চারিদিকে কুরকুরে হাওয়া, আমরা কথা বলতে বলতে মাঠের মধ্যদিয়ে মাঠ পেরিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছি। মাঠের চারিদিকে শরনার্থীর জটলা, নিজেরা নিজেদের থাকার বিশ্রামের জায়গাটা পছন্দ করে নিচ্ছে। মাত্র এক রাত, সকালে উঠেই চলে যাবে ওপারে, রাত্রে। মানে সন্ধ্যার পর সাব্রুমে পারাপারে নিষেধ আছে। প্রয়োজনীয় মূহুর্তে কাঠ বাঁশের সেতু দিয়ে যাওয়া-আসা চলে; তবে দু’দিকেই চেক পোস্ট রেখেছে দু’দিকের পরিচালন কর্তৃপক্ষ। চা খেতে গিয়ে রামগড় আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে আলাপ হলো, এখানে একটা কথা না বললেই নয় যে, এখানে আমাদের সকলের খানার এবং শরনার্থীদের নানা সুবিধা-অসুবিধার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন রামগড় আওয়ামীলীগের নেতারা। সেখানে তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের সীতাকুন্ড, মীরসরাই, ফটিকছড়ি, স্বন্দীপ ও হাটহাজারীর কয়েকজন আওয়ামীলীগের নেতা, রামগড় থাকাকালীন তাঁদের এই শ্রম আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক স্বর্ন উজ্জ্বল অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার দাবী রাখে। প্রতিদিন সকাল-বিকাল হাজার হাজার মানুষকে খাওয়ানোর যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রামগড় পতনের পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত; সে কর্মযজ্ঞের সে নিষ্ঠা, সে শ্রম এখন চোখের সামনে ভেসে উঠলে আমি আত্মহারা হয়ে যায়। তাই রামগড়বাসীকে আমার হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা জানায়। সাথে সাথে সেদিনের ঐ কর্মকান্ডে যাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে আমাদেরকে পরিচর্যা করেছেন, স্বানন্দে আপ্যায়ন করেছেন তাঁদের সকলের প্রতি রইলো আমাদের রক্তিম অভিবাদন।
সাত
বৃহস্পতিবার ১লা এপ্রিলের দিন আর তারপরে কযেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে কাছাকাছি সময়ে। এই দিন হয়েছিলো। কিন্তু যাওয়ার আগে অর্থাৎ সকাল দশটার দিকে একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের যাওয়াটা একটু দেরী করে হয়। ঘটনা ঘটেছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও তৎকালীন অসংগঠিত সামরিক কর্তৃপক্ষ মুখোমুখি হয়ে পরেছে এটা ঠিক। কিন্তু কথায় ব্যবহারিক উপস্থাপনার কারণে যে ঘটনা দূঘর্টনার কারণ হয়ে উঠতে পারে তারই একটা উদাহরণ হয়তো বা সেদিন হয় হয় করেও হয়নি। আর তারজন্য সব কৃতিত্বের দাবীদার সেই ক্যাপ্টেন বাবুল কেই দেয়া যেতে পারে। ক্যাপ্টেন বাবুল এর আসল নামটা এখন কিছুতেই মনে পড়ছে না। তবে তিনি স্বাধীনতা পূর্বাপর সময়ে চলচ্চিত্র জগতে সফল প্রয়োজক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কবরী-রাজ্জাক, সুচন্দা-রাজ্জাক অভিনীত ছাড়া অন্যান্য বেশ কয়েকটি ছবি তিনি পরিচালনা করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘‘জেমস কিনলে’’ এর পরিবেশক ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শিক্ষিত ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন কেরিং কনস্ট্রাক্টর হিসেবে সুনামের সাথে কাজ করেছেন। সে যাই হোক, ঘটনায় ফিরে আসি। ১লা এপ্রিল সকাল দশটা সাড়ে দশটার দিকে কয়েকজন আমাদের সেনাবাহিনীর লোক আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে এসে ঢুকে যেতে চাইলে সে সময়ে ঘরে থাকা আমাদের মধ্য থেকে বোরহান তাদেরকে ঘরে ঢুকতে বাধা দেয় এবং সাথে সাথে ঘরে ঢোকার কারন জানতে চাইলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এই সেনাবাহিনীর লোকদের ঘরে, ঢুকলে ফায়ার করবে বলে বোরহান উত্তেজিত হয়ে উঠলে আমারা আমাদের ঘরের কোনে রাখা অস্ত্র (যা আমরা চট্টগ্রাম শহর থেকে আসার পথে নিয়ে এসেছিলাম) নিয়ে পজিশনে দাঁড়িয়ে গেলে ওরা পিছু হটে যায়। এরমধ্যে আমাদের অন্যান্যরা ইউসুফ ভাই আমাদের ঘরের সামনে ভীড় দেখে দৌঁড়ে চলে আসে এবং ঘটনার কারন জিজ্ঞাসা করলে আমরা বিস্তারিত ঘটনা জানাই। এদের মধ্যে কয়েকজন পেছন থেকে সরে গেছে। যারা আছে তারা বেস্টনির মধ্যে প্রায় বন্দি অবস্থার শিকার। উত্তেজিত ছাত্র-শ্রমিক-জনতা তাদেরকে উত্তম-মধ্যম দেয়ার জন্য ক্ষেপে উঠেছে। স্বপনদা ইউসুফ ভাই রুশ্নিভাইরা ওদেরকে শান্ত করে সেনাবাহিনীর লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে ‘‘কেন আপনারা এ ঘরে ঢুকেছে? উদ্দেশ্যটাই কী? উনারা বলেন, আমাদের চীফ মেজর জিয়াউর রহমান সাহেব বলেছেন, এখানে অস্ত্র আছে, সেই অস্ত্রগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। এই আমরা ঘরে ঢুকে অস্ত্রগুলো নিতে যাচ্ছিলাম।’’ ইউসুফ ভাই বলেন, ‘‘ভালো কথা, অস্ত্রগুলো আপনারা নিবেন। কিন্তু এখানে যারা আছেন তাদের অনুমতিটা আপনারা নেবেন না? নাকি মগের মুল্লুক পেয়েছেন যে, নির্দেশের সাথে সাথে কম্বাইন্ড অপারেশন চালাচ্ছেন। জানেন, এখানে যারা থাকে উনারা কে? উনাদের পরিচয়? আপনি যেমন মেজর সাহেবের নির্দেশনা নিয়ে এসেছেন অস্ত্র নিতে এখন আমি বা আমরা নির্দেশনা দিলে আপনাদের কি হাল হবে ভেবে দেখেছেন। আপনাদের এখান থেকে একজনকে ছাড়া হবে উনি যাবেন এবং আপনাদের নির্দেশদাতাকে ডেকে নিয়ে আসবেন। উনার সাথে কথা বলে তারপর আপনাদের ছাড়া হবে।’’ এদের মধ্য থেকে একজ কে ছেড়ে দেয়া হলো মেজর সাহেবকে খবরটা পৌঁছানোর জন্য। এমনিতেই উনার উপর ছাত্র-শ্রমিক-জনতা ক্ষেপে আছে, গত সপ্তাহের ঘটনাবহুল ঘটনার কারনে। লোকটা ভীড় ঠেলে যেতে যেতে একটু থমকে যায় এবং সৌম্য সুন্দর লম্বা চওড়া ফর্সা গোছের একজনকে সেল্যুট করে সরে দাঁড়াই। ভদ্রলোক ভীড় ঠেলে এসে স্বপনদা ইউসুফ ভাইয়ের সামনে এসে জোর হাত করে ‘‘সরি –সরি বলে তাঁর নামটা বলেন এবং এও বলেন যে, এখন আমাকে ক্যাপ্টেন বাবুল বলেই আপনারা সম্বোধন করতে পারেন। আসলে সকল ঘটনা জন্য আমি এবং মেজর জিয়াউর রহমান সাহেব দুঃখিত। আমি স্বপনদাকে ইউসুফ ভাই আপনাকে এখানে অনেককেই চিনি, জানি। অতএব, এই অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য আমরা অবশ্যই লজ্জিত, দুঃখিত। আটকে রাখা সেনা সদস্যদের ছেড়ে দেয়া হলো, ক্যাপ্টেন বাবুল সাহেব ভেতরে ঢুকে আমাদের সাথে বসলেন এবং মুল বিষয়টা আমাদেরকে জানালেন যে, এখানে কিছু অস্ত্র থাকার সংবাদটা আমরা পেয়েছি গতকাল। এর মধ্যে আমি তো প্রায়ই এদিকে আসি ঘোরাঘুরি করি। আপনাদের আলাপ-আলোচনা শুনি যেতে যেতে। মেজর সাহেব বল্লেন এভাবে অস্ত্র রাখা তো টিক নয়, যে কোন সময় যে কোন দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। ওদিকে আবার সীমান্ত অন্যদেশ অন্য আইন। তাই অস্ত্রগুলি নিরাপদে রাখার জন্য তিনি বলেছিলেন। এতে সেনাসদস্যরা কাউকে ঘটনা না জানিয়ে হুট করে ঘরে ঢোকা এটা অন্যায় তো বটেই, তা ছাড়া আমারও দুর্মতি যে, আমি এদিকে আসি অথচ কথাটা আপনাদের সাথে বলে নিতেই পারতাম। তাহলে এমন একটা ঘটনার সৃষ্টি হতো না। সে যাই হোক, মেজর জিয়া সাহেবও ঘটনা বুঝতে পেরেছেন এবং আমাকে বলেছেন দ্রত যান ওখানে, ছাত্র-নেতৃবৃন্দকে বুঝিয়ে বলেন এবং আমার তরফ থেকে উনাদেরকে ‘জয় বাংলার’ শুভেচ্ছা জানাবেন। এই বলে তিনি আমাদের সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে গেলেন। এরপর মাঝেমধ্যে প্রায় আমাদের সাথে এসে গল্প গুজব করতেন, আমাদের যুদ্ধরত মুক্তিফৌজের (বাঙ্গালি সেনা বাহিনী ও ইপিআর বাহিনী) প্রতিরোধের সাহসী সংবাদ জানাতেন।
দ্বিতীয় ঘটনা হলো শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের ( শহীদ হয়েছেন পরবতীতে) সাথে আমাদের পরিচয়। বেশ কিছুদিন ধরে বিকেলের দিকে আমরা যখন মাঠে বসে গল্প করতাম বিভিন্ন বিষয়ে তখন প্রায় দেখতাম আমাদের বয়সি একজন ফর্সা ঋজুদেহী দামি, ট্রাইজার পরনে, গায়ে হালকা গোলাপী ইউনিয়ন শার্ট (তৎকালীন সময়ে ইউনিয়ন শার্ট যথেষ্ট দামী), পায়ে কেটস পরে মাঠের এদিকে ওদিকে হাঁটাহাঁটি করতো। একেকদিন এক এক রকমের শার্ট পরতো। কিন্তু সব শার্টই ছিলো ইউনিয়ন ব্র্যান্ডের। এটাই আমাদের কাছে বিশেষ বিষয় হয়ে উঠেছিলো। আর এটা সবার দৃষ্টিতে আনে আমাদের বোরহান। ঐ যুবকটাকে সবাই দেখলেও বোরহান একদিন বলে উঠে ‘কি রে ভাই, এই ছেলেটা প্রতিদিন দামি শার্ট প্যান্ট পরে হঘারা ঘুরি করে কিন্তু পরিচয়টা কী? রুশ্নিভাই বোরহানকে বলে, তোমার দরকারটা কী জানাও? নিশ্চয় কয়দিন এখানে আছে, তারপর একদিন চলে যাবে।’’ বোরহান বল্লো , না স্মাট ছেলেটা, চোখের পড়ার মতো। তাই বলছিলাম। কামরুল বলে উঠে ‘‘বোরহান, তোমার থেকে সুন্দর নিশ্চয় নয়। তবে ফিগারটা একদম স্লিম এটা ঠিক। এর কয়েকদিন পর এক বিকেলে আমরা সবাই গেলে হয়ে বসলেও রবি সেদিন আমাদের সাথে ছিলো না। অনেকক্ষণ পর আমাদের পেছনের মাঠ পেরিয়ে রবি (রবিউল হোসেন কচিকে আমি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রবি নামেই ডাকতাম) আলোচিত ঐ যুবকসহ আমাদের দিকেই আসছে। আজ ঐ যুবকের গায়ে হালকা টিয়া রং’র ইউনিয়ন শাটর্, পরনে ছাই রং এর জাপানী কাপড়ের ট্রাউজার। দুজনে কথা বলতে বলতে আসছে। রবি সামনে এসে বাস পরে রুশ্নিভাইয়ের পাশে এবং পাশে একটু সরে গিয়ে ঐ আগন্তুক যুবককে বসতে বললে তিনি বসে পরেন। রবি এবার সবার দিকে তাকিয়ে নতুন অতিথিকে পরিচয় করে দেয়। রবি’র কথায় মূল সারাংশ হলো বিকেলে চা খেতে গিয়ে এই যুবকের সাথে পাশাপাশি বসার সুযোগ। সে সুযোগ থেকে দু’জন দু’জনের সাথে কথোপকথনের সূত্রপাত। নিজেই নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন সদস্য কমিশন প্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের। সম্প্রতি উনার বিয়ের আক্দ উপলক্ষে বাড়ি গিয়েছিলেন ছুটি নিয়ে। আসার পথেই স্বাধীনতার ঘোষণা তাই চট্টগ্রাম এসেই আর কোথাও যাওয়া হয়নি। ঘুরতে ঘুরতে একটা ব্যাগ নিয়ে যুদ্ধে যুদ্ধে এখানে এসে স্থিতি হয়েছেন। এখন শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। শেষ যুদ্ধক্ষেত্র ছিলো শুভপুর ব্রীজ। হাতে এখনো মেহেদি লাগানো আছে। আঙ্গুলে বিবাহ বন্ধনের রিং। তাবে ডান হাতের আঙ্গুলের সোনার একটা ও রূপের একটা পাথরের আংটি দেখা যাচ্ছে। কথা-র্বাতায় খুবই আন্তরিক, বন্ধুত্বের গাঢ়তা হাসিতেই প্রকাশ পাচ্ছে। আমরাও উনাকে স্বাভাবিক হৃদয়তার গ্রহন করে নিলাম। সন্ধ্যার হয়ে আসছে পেছনে কাছে খালি মাঠ শরনার্থীতে আস্তে আস্তে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এরপরে দিন থেকে আমাদের এই বেঠকে তিনি নিত্য সঙ্গী। সাথে সাথে কথলে আমাদেরকে সেনাবাহিনী ও গেরিলা টেনিং এর কিছু কিছু বিষয় আমাদেরকে শিখাচ্ছেন। কখনো গ্রেনেড ছোঁড়ার প্রসেস, গ্রেন্ডে থেকে বেঁচে যাওয়ার জন কৌশলি ভূমিকা যেমন হবে তার শিক্ষা ইত্যাদি। এমনি প্রতিদিন কিছু না কিছু তত্ব ও তথ্য জ্ঞান আমাদের শেখাচ্ছেন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের। আমরাও খুব মনোযোগ সহকারে শিখছিলাম। কারণ আমরা জানতাম, এগুলো অচিরেই আমদের ব্যবহারি ভাবে শিখতে হবে। এই জন্যই তো স্বপনদা ও ইউসুফভাইয়েরা আগরতলা গেছেন খবরাখবরের জন্য। হয়তো কোনো বিশেষ বার্তা নিয়ে আসবেন উনারা।
এর কয়েকদিন পরই তৃতীয় ঘটনাটা ঘটলো অর্থাৎ আমরা রামগড়ে অবস্থানরত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী এবং কিছু সংখ্যক আওয়ামীলীগ ও শ্রমিকলীগ মিলিয়ে প্রায় শ দেড়েক প্যারামিলিটারি ট্রেনিং এ চলে গেলাম। প্রশিক্ষণটা আমরা নিয়েছিলাম বগাফা বিএসএফ হেড কোয়ার্টাসে। প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়াদের মধ্যে আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে যারা গিয়েছিলাম তারাসহ শহরের অন্যান্য রাঙ্গুনিয়া হাটহাজারী, ফটিকছড়ি সীতাকুন্ড, মিরসরাইয়ের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীবৃন্দ। প্রায় ১৫দিনের প্রশিক্ষণ শেষে আমরা ফিরে এলাম পুনরায় রামগড়ে। রামগড়ে এসে পৌঁছার পর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অনেককেই গ্রুপ করে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর সাথে সংযুক্ত করা হয়। অনেককেই আবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাঠানো হয়। বিভিন্ন অস্ত্র ও গোলাবারুদ অর্থসহ কয়েকজন করে গ্রুপ ভাগ করে বিভিন্ন থানায় যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়। তাদের প্রয়োজন না পরলে যুদ্ধ করা বারন এই মূহুর্তে। প্রশিক্ষণ নিজেদের আত্মরক্ষা কবচ। ওরা এখন এলাকায় মনোবল বাড়াবে, জনগনকে সংগঠিত করবে এবং প্রশিক্ষনের জন্য পাঠানোর সুযোগ তৈরি করবো, সুযোগ বুঝে এলাকায় পরিবেশ স্থান ও সময় অনুকূলে যুবকদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি প্রয়োজন হলে শত্রু কিংবা দালালদের উৎখাত করার কৌশলি ভূমিকাও নিতে হবে। তবে পারলে নিজেদের (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) সাথে নিজেদের সংযোগ স্থাপন করার মধ্যদিয়ে প্রয়োজনীয় খবরাখবর আদান-প্রদান সহ মূল বিষয়াবলী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ন্ত্রনকারী কমান্ডের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের প্রথম প্রশিক্ষনের পর পরবর্তীতে জেলা পঞ্চাশের আরেক ব্যাচকে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য সম্ভবতঃ পাঠানো হয়েছিল। সে গ্রুপ প্রশিক্ষণ শেষে ফেরত যায় ছোট হরিনা ইয়ুথ ক্যাম্পে। হরিনা ইয়ুথ ক্যাম্প পূর্নাঙ্গ মাত্রায় চালু হয়েছে আমরা রামগড় থেকে যাবার পর। সে পরের কথা আমরা যখন রামগড় পৌঁছলাম প্রশিক্ষন শেষে সেদিন রাত্রে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের সাথে দেখা হয়। তিনি আমাদের আসার সংবাদ শুনে এসেছিলেন প্রশিক্ষণের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলাপ-আলোচনার পর খাওয়ার সময় হয়ে গেলে উনি যাবার জন্য পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন, আমি কাল মহালছড়ির দিকে যাবো। সেখানে মেজর শওকত সাহেবের সাথে দেখা করার পর পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে। ফিরে এসে সবার সাথে দেখা করবো; সবাই ভালো থাকুন; খোদা হাফেজ, জয় বাংলা’ বলে আলো-আঁধারিতে হেঁটে মাঠ পেরিয়ে সড়ক ধরে আমাদের পেছনে পোস্ট অফিসের দিকে এগুলেন। আমরা সবাই খানা খাবার জন্য স্কুল ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম।
আট
চট্টগ্রাম ডিভিশনের মধ্যে এখন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর কব্জায় আছে শুভপুর ব্রীজ, করেরহাট দিয়ে রামগড় পৌঁছার রাস্তা, মহালছড়ির পৌঁছার অগ্রবর্তী চেঙ্গী নদী ওপারের কিছু ভেতরের অংশ। অন্যদিকে হেয়াকো, নারায়নহাট হয়ে জুজখোলা, নেপচুন, চা বাগান দিয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ অবস্থান সুরক্ষিত ছিলো। এ সবের অবস্থান মুলত: রামগড় সীমান্ত এলাকায় বা দখলে থাকা রামগড় পৌঁছার বিভিন্ন স্বাভাবিক গতিপথ। এই দুর্গমপথ থেকে আরো বিপদসংকুল দুর্গম পাহাড়ি পথেও ডান দিক থেকে এসে রামগড় পৌঁচা সম্ভব। এ সব কথা বলার কারন একটাই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রামগড় দখল নেবার সময় উল্লেখিত স্থান সমূহ দিয়ে তাদের সৈন্যবাহিনী আমাদের মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে বিপুল ভাবে তাদের পরাস্ত হতে হয়েছিলো। তারপরে ওয়া এগুতে পেরেছিলো তাদের ডিফেন্স বাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতায়।
পাকিস্তানী সেনারা মূলত: ২০ এপ্রিল মঙ্গলবার রাত থেকেই রামগড় দখলের অভিপ্রায় যুদ্ধ শুরু করে। সেনাবাহিনীর কাছে এ দুর্গম পথ ও অচেনা টার্গেট হওয়াতে তাদেরকে প্রতিপদে বাধার সম্মুখিন হতে হচ্ছে। আমাদের মুক্তিবাহিনীর সাথে স্থানীয় জনগন থাকাতে সেনাবাহিনীর অবস্থান মুক্তিবাহিনীরা জেনে নিচ্ছে এবং তাদের উপর সরসরি আক্রমন পরিচালনা করতে সহজ হয়ে উঠছে। আমাদের মুক্তিফৌজের হৃদয়ে মুক্তির আকাঙ্খা, সীমিত অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে শত্রুকে পরাস্ত করার সাথে সাথে তাদের প্রাণ ক্ষয় ও বিপর্যস্ত করা। সামনে সমানে সমানে যুদ্ধ, শত্রুর ক্ষয়-ক্ষতির আবাস পেলে অত:পর পিছিয়ে আসা। পেছনে পূর্বে থেকে প্রস্তুত প্রতিরোধ বাহিনী পুন: প্রতিরোধ এগিয়ে আসে। এইভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে। ওরা যেখানে দখল নিচ্ছে সেখানেই আশপাশের সাধারণ মানুষদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন, লুটপাট, ধর্ষণ, নৃশংস গণহত্যা চালিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ওদের হিংস্রতায় জিঙ্গাসাং, অত্যাচার-বর্বতায়, পৈশাচিক নিষ্ঠুরতায় একটা আকাঙ্খায় বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্যে ক্ষ্যাপা মহিষের মতো এগুচ্ছে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সেটা হলো স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনীও তাদের ইন্দনকারী বাঙালি প্রতিরোধসৃষ্টিকারী জয় বালা’ ধ্বনিতে ঐক্যবদ্ধ জনশক্তিকে।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী শুভপুর ব্রীজের দিকে, করেরহাটের দিকে, হাটহাজারী ফটিকছড়ি ফেলে রামগড়ের দিকে ত্রি-মুখি আক্রমন করার কৌশল অবলম্বন করে। দুইদিন পর অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ২২এপ্রিল ইতিপূর্বে রাঙ্গামাটি দখলে যাওয়া কিছু সৈন্য ওখানে রেখে (সাথে মিলিশিয়া বাহিনী, যা পাকিস্তান থেকে নিয়ে এসেছে) বাকী সৈন্যদের পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে রামগড় অভিমুখে যাত্রা করে। হাটহাজারী ফটিকছড়ির দিক থেকে আসা পাকিস্তানী সৈন্যরা বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে বাঙালি মুক্তিবাহিনীর কাছে। পাকিস্তানী বাহিনীর ক্ষয় ক্ষতি হচ্ছে ব্যাপক। কারণ এখানে আসা সৈন্যরা এই এলাকায় রাস্তাঘাট তেমন চেনে না। সেদিকে আসবে সোজা পথে আসতে হবে বলে মুক্তিবাহিনীরা সে স্কেলে ২”-৩” মটার সেলগুলো ঠিক র্যাঞ্জে টার্গেট নিয়ে ছুঁড়ে। এতে শত্রুর হতাহতের সংখ্যা বাড়ে, শত্রুরা বিপর্যস্ত হয়ে পরে প্রাথমিক দফায়। পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনী তাদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির আশংকায় ধীরৈ ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। তবে যেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে সেদিকেই প্রতিরোধের সম্মুখিন হচ্ছে। এই কারনে পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনী ডিফেন্স থেকে সাঁজোয়া বাহিনীকে সামলে রেখে পথ অতিক্রম করার কৌশল অবলম্বন করেছে। সেখানে সাঁজোয়া কামানের ব্যবহারও তারা করছে। তারপরেও মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের শিকারে পরতে হচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র গোলা বারুদ সীমিত। এ সীমিত সংখ্যক অস্ত্র দিয়েই কিন্তু ব্যাটালিয়ান ব্যাটালিয়ান চৌকুশ সৈন্য বাহিনীর সাথে পাল্লা দিয়ে যুদ্ধ করছে দেশ প্রেমিক মুক্তিবাহিনীর লড়াকু সদস্যরা।
২৬শে এপ্রিল সোমবার অবশেষে পাকিস্তানী সৈন্যরা মির্জাহাটের কাছাকাছি পৌঁছলে প্রতিরোধের মুখে পরে। পর পর নারায়হাট, জুজখোলা, নেপচুন চা বাগান আমাদের মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধে সুরক্ষিত, ভীষন লড়াই শুরু হয়। পাকিস্তানী সাঁজোয়া বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমন, মর্টার কামানের সম্মিলিত আক্রমনেও মুক্তিবাহিনীর কৌশলি ভূমিকায় আক্রমনে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্যকে নিধন করে পিছু হটে আসে মুক্তিবাহিনীরা। থেকে থেমে সারারাত যুদ্ধ চলে। আমরা রামগড় থেকে গোলারুদ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। এর মধ্যে রামগড় মাঠে শরনার্থীর ভীড়। রাত্রের অন্ধকারেও অগনিত শরনার্থী আসছে। রমগড় মাঠে শরনার্থী ভীড়। রাত্রের অন্ধকারেও অগনিত শরনার্থী মতো বসে আছি। মাঠে অন্ধকারে মিট মিট আলো লন্ঠনের, বাতাসে মৃদু মৃদু কাঁপছে। মাঝে মধ্যে আবছা-আবছা গোলার শব্দ। এভাবেই বসে বসে একসময় ঘরের ভেতরে ঘুমাতে গেলাম। ২৭এপ্রিল মঙ্গলবার সকাল থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা ‘‘নারায়নহাট দখলে নিয়ে মুখখোলা, নেপচুন চা-বাগান ঘুরে এসে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। রাঙ্গামাটি থেকে আসা পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনী দুর্গম পাহাড়ী এলাকা দিয়ে মহালছড়ির ডান কোন ঘেঁষে এগুতে থাকে। অন্যদিকে নারায়নহাট হয়ে এক ব্যাটালিয়ান সোজাপথ ধরে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা দুই দিকেই প্রতিরোধের সম্মুখিন হচ্ছে। প্রচন্ড যুদ্ধ, সে যুদ্ধ ক্রমে এক ভয়াবহতায় রুপ নিলো। মুক্তিবাহিনীর দেশ প্রেমিক সদস্যরা ছোট ছোট পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ করছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা সমতল ভূমিতে। ওরা আসছে সামনের পথ ধরে। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী সুযোগটা পাচ্ছে শত্রু পক্ষকে ঘায়েল করার। এভাবে সারাদিন ধরে যুদ্ধ চলে, শত্রু পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়। কিন্তু আমাদের কাছে সবচেয়ে মারাত্মক আঘাতের কারন হয়ে ওঠে হৃদয়ের বন্ধনে বন্ধুতের নিবিড়তম সম্পর্ক গড়ে তোলা ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের আত্মত্যাগের কারনে। সেদিন তিনটার দিকে ত্রি-মুখী কৌশলে (এ্যাম্বশের মতোই) পাকস্তিানী সৈন্য বাহিনীকে পর্যদুস্ত করে তেলে মুক্তিবাহিনীরা। গুলি-গোলা চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেলো, আবার পুন: উদ্যমে শুরু হয়ে যায় গোলা-গুলি। এভাবে চলছিলো। ঐ সময়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাঁজোয় বাহিনী ও কামান বাহিনীর অর্তকিত আক্রমন গড়ে তোলে রিইন ফোর্স মেন্ট (পেছনে রেখে দেওয়া ডিফেন্স ফোর্স) এর সাহায্যে।
সে যুদ্ধে শহীদ ক্যাপ্টেন কাদের যে নবো চেতনা ও দেশ প্রমিক যোদ্ধা হিসাবে যে সাহসের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন তা আমরা পরে চট্টগ্রাম কলেজের আমাদের অগ্রজ রামগড়ে ও হরিনায় এক সাথে থাকা শওকত ও ফারুক (পরে ওরাসহ ও ওলি ও ইউসুফ সরাসরি সেনাবাহিনীতে যোগদেয়) এর কাছে শুনেছি। শহীদ কাদের মৃত্যুকালীন সময়ে ঐ দু’জনকে বলে গিয়েছিলেন হাতের আংটি গুলো আমাদের রবিকে দিয়ে দিতে। রবি সুযোগ বুঝে ঐগুলো অন্য জায়গায় হস্তান্তর করবে।
সেদিন রাত প্রায় নয়টার দিকে শহীদ আফতাবুল কাদেরের মৃতদেহ রামগড় এসে পৌঁছে। রামগড় কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম সাহেব ঐদিন শহীদ কাদেরের জানাজা পড়ান এবং রামগড়ের তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
নয়
২ শে এপ্রিল বুধবার আমরা সবাই ভারাক্রান্ত, কম সময়ের সম্পর্ক অথচ আমাদের সবার মনে দাগ কাটিয়ে দিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কতোদিনের পরিচিত, কতো গভীর সম্পর্ক। মাঝে মধ্যে কিছু কিছু সম্পর্ক মানুষের মনকে ছুঁয়ে যায়, নাড়া দিয়ে যায়। গভীর আলোড়ন তুলে দেয় হৃদয়ের দেশে। শহীদ ক্যাপ্টন কাদের এ ভাবে আমাদের সবার মনকে ছুঁয়ে দিয়ে গেছে। নির্বাক, নিঃস্তব্ধতায় আমরা সবাই চুপচাপ। সকাল বেলা থেকেই মনটা ভালো নেয়। রবিসহ চা খেতে গিয়েছি আমরা ক’জন (রুশ্নিভাই, কামরুল, বোরহান, মনি, নাজিমভাই)। রবির হাতে ক্যাপ্টেন কাদেরের আংটিগুলো। ওখানেই দেখা হলো শওকত ভাই ও ফারুক এর সাথে। ওরা কালকের যুদ্ধের বর্ণনাটা সবিস্তারে বলে আমাদেরকে। ওরা একই সাথে পাশাপাশি ছিলো। চোখের সামনেই যুদ্ধের চিত্র ভেসে ওঠে। এই সাহসী বীরের বীরত্ব গাথা আজীবন আমাদের মনে থাকবে আর শওকত ও ফারুকের চোখে আজীবন ভেসে উঠবে ঐ যুদ্ধের দৃশ্যচিত্র।
এই মাত্র শওকত ও ফারুক রুশ্নিভাইকে বলছে যুদ্ধ চলছে। আমাদের প্রতিরোধ শক্তি। ওদের অগ্রসরে ক্ষয়-ক্ষতি। তারপরেও পাকিস্তানী সৈন্যারা এগিয়ে আসছে। ওদের রামগড় দখলের বাসনা গন্তব্য। শুভপুর ব্রীজে আমাদের শক্ত অবস্থান। যতদিন পারা যাবে ধরে রাখা হবে। প্রয়োজনে বিনা ক্ষতিতে পিছিয়ে আসা যাবে। করেরহাট দিয়ে রামগড় আসার বা দখল করার জোর তৎপরতা পাকিস্তানী সৈন্যরা অব্যাহত রাখলেও মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রচন্ড শক্তিশালী। ফলে রাস্তা ধরে কিংবা পাহাড়ী পথে কোনভাবেই প্রতিরোধ র্যুহ শিথিল করা সম্ভব হচ্ছে না।
আমরা সবাই আবার নিজেদের আবাসস্থলে ফিরে আসছি। মাঠ পেরিয়ে আসতে আসতে শোনা যাচ্ছে গোলা-গুলির আওয়াজ। কালকে যা শুনছিলাম তারচেয়ে আজকের আওয়াজ স্পষ্ট। অর্থাৎ পাকিস্তানী সৈন্যরা আরো সামনে এগিয়ে এসেছে। পরে শুনেছি শান্তির হাট, হেয়াকো এলাকায় এসে পাকিস্তানী সৈন্যরা থেকে গিয়ে পর্যবেক্ষন করছে।
আমরা স্নানাদি সেরে ভাত খেয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার করতে করতে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম সবাই। কায়েক ঘন্টা মাত্রা। এরমধ্যে মাঠ দিয়ে শরনার্থীর ঢল। ওরা কিন্তু মাঠে থামছে না। ওরা সবাই নদী পার হয়ে সাব্রুম পাড়ি দিচ্ছে। হাজার হাজার শরনার্থী আসছে মাঠ পেরিয়ে। সবার চোখে মুখে ভয় এক ধরনের। যুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করাতে ওরা বলে ‘‘আমরা কালকে আসতে পারতাম, যুদ্ধের জন্য আমরা অন্য রাস্তা ধরে আসাতে এত দেরি হলো। তাদের কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা প্রশ্ন করলে তাদের মধ্যে একজন বলেন- হ্যাঁ, আমাদের সাথে আসা এক পরিবারের একজন মারা গেছে যুদ্ধের গুলিতে। আমরা তো দূরে দিয়েই আসছিলাম কিন্তু হঠাৎ কোনদিক থেকে ছুটে এলো গুলি কে জানে? আহতও হয়েছে দু’জন’’। কেউ বলে ‘‘আসার সময়ে পথে পথে ডাকাতের হাতে পরেছে প্রায় সবাই, অনেকের যা ছিলো তাই লুট করে নিয়েছে, এখন খাওয়ার পয়সাও অনেকের কাছে নেই।’’ গোলা গুলির শব্দটা আরো স্পষ্ট হচ্ছে মাঝে মধ্যে। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছে ক্রমশ: আলো কমে যেতে অন্ধকার ছায়া ফেলে সাড়া মাঠের উপর। মাঠ জুড়ে শরনার্থীদের ছোট ছোট জটলা, ভীড় বাড়ছে মাঠে। মাঝে মধ্যে হাঁক-ডাক শোনা যায়। তারপর আবার নিঃশব্দতা গ্রাস করে চারিদিক। দূরে মাঝে মধ্যে গোলার শব্দ ভেসে আসছে স্পষ্ট ভাবে। শত্রুরা যে রামগড়ের কাছাকাছি হচ্ছে এটা শব্দের মধ্যে দিয়েই বোঝা যাচ্ছে। রাত্রে খাওয়ার পর আমরা যখন আমাদের ঘরে বসে কথা বলছিলাম বিভিন্ন বিষয়ে তথা ক্যাপ্টেন বাবুল চৌধরী এসে আমাদের রুমে বসলেন এবং বর্তমান সার্বিক অবস্থা বর্ননা করার সাথে সাথে আগামী কাল রামগড় ছেড়ে যেতে হতে পারে বলে একটু সন্দেহ প্রকাশ করলেন এবং বললেন ‘‘আপনারাও প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন মানসিকভাবে। তবে রাত্রের মধ্যেই একটা সিদ্ধান্ত আসবে কিভাবে কি হবে। আসলে, এটা ছেড়ে দিলে কিছুই সমস্যা হবে না। তবে শরনার্থীদের আসা যাওয়ার রুট হিসেবে এই স্থানটা চিহ্নিত হওয়াতে ওদের হয়তো যাত্রা পথে বেশ কিছু বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। যা হোক সার্বিক চিন্তা-ভাবনা করে একটা সিদ্ধান্ত হয়তো আসবে-এই বলে তিনি- শুভ রাত্রি বলে চলে গেলেন। আমরাও ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত নিতে যাবো এমন সময় ইউসুফ ভাইসহ জালাল ভাই ও নিজাম ভাই এসে হাজির হলেন। রুশ্নি ভাই প্রথমেই উচ্চসিত হাসিয়ে স্বাগত জানিয়ে বলে উঠলেন, কি রে ভাই মনে কী পরিল আমাদের? ইউসুফ ভাই হেসে বলেন, না-না, কাজকর্ম, কথাবার্তা সবকিছু বুঝে নিতে বুঝে উঠতে সময় লেগেছে বৈকি। তবে, আমরা বিছানায় শোয়ার আরামে নেই। এই বলে তিনি আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ করনীয় সম্পর্কে বেশ কিছু আলাপ করলেন। প্রায় ঘন্টা দু’য়েক কথার মধ্যে কাল রামগড়, ছাড়ার সম্ভাব্যতা বললেন। আমরা রামগড় ছেড়ে যাওযার পর কোথায় যাবো তাও বলে দিলেন। তিনি সময় মতো এসে যাচ্ছে বলে পুনরায় চলে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে উঠে দাড়ালেন। আমরা সবাই উনার সাথে সাথে পেছন দিকের ব্রিজের দিকে এগিয়ে দিতে গেলাম। ফিরে আসার পথে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম চারিদিকে নিঃশব্দ নিরবতায় কাছে দূরে ছোট ছোট শরনার্থী হুটলার লন্ঠনের আলো জ¦লছে, কোনখানে কেরোসিনের মৃদ্যু সকালের আলো ফেঁপে ফেঁপে রাত্রির আধাঁরে কিছু আলোর রশ্মিতে আলোকিত করছে। অনেকক্ষণ ধরে রুশ্নিভাই, বোরহান, কামরুল, রবি, মনিসহ এই দৃশ্য দেখলাম। অত:পর সবাই যে যার বিছানায় ঘুমাতে গেলাম ঘরে ঢুকে।
দশ
২৯শে এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকাল-বেলা বাজারের দোকানে খাওযার খেতে গিয়ে সবার মুখে একটা কথা উত্তেজনা আকারে ঘুরছে। আজ যেকোন সময় রামগড় ছেড়ে যেতে হবে। পাকিস্তানি সৈন্যরা এলো বলে। ওরা যেদিকে আসছে পুড়িয়ে দিচ্ছে ঘর-বাড়ি। হত্যা করছে নিরীহ গ্রামবাসীদের। আমরা ওদের মুখে উত্তেজনা, ভয়-কাতরতা দেখে নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করলাম। অর্থাৎ গতকাল রাত্রে আমরা এমন তারা হতে পারে তারই বার্তা তো জেনেছিলাম। আসলে এখন তারই সত্যতা বাস্তবে শুনছি। চা খেতে খেতে রুশ্নি ভাই চা দোকানের মালিককে কি একটা প্রশ্ন করলো দেখলাম। দূর থেকে আমরা কেউই শুনতে না পেলেও রুশ্নিভাই কিছু একটা প্রশ্ন করেছে এটা আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি। রুশ্নিভাই চা-দোকানের পাশেই বসেছিলো, সাথে আছে রবি আর মনি। চা-দোকোনের কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, এমন সময় দোকানে এসে ঢুকেন রামগড় সংগ্রাম কমিটির নেতা কাজী রুহুল আমিনের সঙ্গে সংগ্রামে কমিটির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। সে সময় ওদের ছিলো সুলতান আহম্মদ নামক (পরে রুশ্নিভাইরে কাছ থেকে জেনেছিলাম) এক আওয়ামীলীগ নেতা, সে রুশ্নি ভাইকে দেখে সামনে এসে কথা বলতে থাকে এবং কাজী রুহুল আমিন সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। পরে জেনেছিলাম সুলতান আহম্মদের সাথে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। উনি প্রায় চট্টগ্রাম যেতেন এবং থাকতেন। যেতে যেতে অনেকের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং সাংগঠনিক ভাবেও অনেক কিছুই জেনে আসতে। এখানে নঙ্গরখানার দায়িত্বেও উনারা আছেন অন্যান্যদের সাথে। পরিচয় শেষে তিনি বিশদ বিবরণ দিয়ে যা জানালেন, তার সার সংক্ষেপ হলো, মুক্তিবাহিনীর অথরিটি জানিয়ে দিয়েছেন সন্ধ্যার মধ্যে সাধারণ জনগন রামগড় ত্যাগ করবে। আমাদের মুক্তিবাহিনীর বিরাট অংশ রামগড় পৌঁছাবে, অন্য অংশ যাবে করেরহাটের দিকে। রামগড় খালি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানেও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। তাই আমরা ঠিক করেছি। আশপাশের গ্রামগুলো থেকে লোকজনকে নিয়ে আসা। এদিকে নঙ্গরখানার কার্যক্রম দুপুরের মধ্যে শেষ করে ওপারে চলে যেতে হবে সবাইকে নিয়ে যাতে রাত্রের খাওয়াটা ওখানে সময় মতো করতে পারি। আমরা এসেছি বাজারে লোকালয়ে খবরটা ছড়িয়ে দিতে। রুশ্নি ভাই সবাইকে চা পানে আপ্যায়িত করতে চাইলে সুলতান সাহেব জিব কেটে বলেন, কি যে বলেন ভাই, চট্টগ্রাম গেলে আপনি কতবার চা-নাস্তা করিয়েছেন। এখন এখানে এসে সে একই কাজ করবেন-এটা কী শোভা পায়। আপনারা এখন আমাদের অতিথি, আপনারা তাহলে সে ছাত্রাবাসে আছেন, যেখানে আমাদের সেনা সদস্যদের সাথে নাকি কি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।’’ রুশ্নি ভাই মাথা নাড়তেই তিনি আফসোসের ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘কাজী সাহেব দেরীতে দেখা হলো উনার সাথে, আগে দেখা হলে বসিয়ে দিতাম আপনাকে উনার সামনে, তারপর গুনতেন রাজনীতির রকমারি ইতিহাস। আমাকে তো উনি আজকের এই বাস্তবতার কথা দুই বছর পূর্বে বলে দিয়েছেন। বলেছিলেন প্রস্তুতি নেন, মনে প্রানে যুদ্ধ করতে। দেশ স্বাধীন করার পর আজ বুঝতে পারছি তাঁর কথাই সত্য হলো।’’ আরো কিছুক্ষণ ওখানে ছিলাম উনাদের চা আপ্যায়নে আমরা সবাই অংশগ্রহণ করলাম। উনারা আমাদের অনেক সম্মান জানালেন, প্রায় বারোটা বাজে, আমরা চলে এসে ঘরে আমাদের বিছানাপত্র গুলো ঠিকঠাক করে বেঁচে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। একে একে সবাই ভাঁজ করে বিছানা গুলো বান্ডিলের মতে করে রাখলাম। তবে রশি লাগবে। রশ্নি ভাই সিগারেট আনতে দিলে, আনতে ভুলে গেছেন বলে উনি গেছেন রশি আনতে, সাথে ঐ সিগারেট ও নিয়ে আসবে, সাথে গেছে মনি। রুশ্নি ভাই রশি নিয়ে আসার সাথে সাথে আমাদের যাবতীয় বাঁধাধরা সবশেষ করে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। না, আজ আমাদের কারো স্থান করা হবে না। পরনে যার যেটা আছে সেটা নিয়েই তৈরি থাকবো সবাই। প্রয়োজনে দ্রুত সাঁড়া হবে ঠিকানা বদলের কাজ। মাঠের মধ্য দিয়ে সকাল থেকেই গ্রুপ গ্রুপ করে শরনার্থীরা আসছে। পূর্বের দিনের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে বা সারি সারি শরনার্থীদল আসছে না। হয়তো যুদ্ধের প্রচন্ডতায় যাত্রাপথের রুট বদলে গিয়েছে। দূর পথে আসতে হচ্ছে তাই শরনার্থীদের আগমনক্রম সীমিত হয়ে গেছে। মাঠের ডান দিকে রাস্তা-রক্ষত গাছের সারির ওপর দিয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলি। গোলা-গোলির আওয়াজ তীক্ষ্ন, জোরালো। মনে হচ্ছে এই তো সামনে। না, কিছুক্ষণ পূর্বে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একটা জীপ এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতির সংবাদ দিতে। রামগড় থানায় তো পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রন কেন্দ্র কার্যকরী ভূমিকা চালিয়ে যাচ্ছে। ওখান থেকে অন্যত্র পরিস্থিতি সংবাদ পাঠানো হচ্ছে। সে সূত্রেই জানা গেল পাকিস্তানী সৈন্যরা রামগড় থেকে হাঁটা পথে এখনো ৮-১৩ মাইল দূরে। ওরা ভারী কামান ও মর্টার সেল মারছে নিজেদের ভয় কমাতে এবং শত্রুদের ভয় লাগাতে। ওরা প্রতিরোধ কোথা থেকে, কোন দিক দিয়ে হচ্ছে ওরা টের পাচ্ছে না বলে ওদের মধ্যে আতঙ্কতা সার্বক্ষনিকভাবে দেখা দিয়েছে। কালরাতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী সৈন্যকেদর গেরিলা এ্যাটাকে সৈন্যর প্রাণহানি ঘটিয়েছে। আমরা সবাই বারান্দা থেকে নেমে মাঠের পাশ দিয়ে রাস্তা ধরে ডানদিকে গিয়ে স্কুলে খানা খাওয়ার স্থানে পৌঁছে গেলাম। সেদিন খুব দ্রুতই খানা ছেড়ে নিয়ে যে যার কাছে চলে যাচ্ছে। আমরা সবাই খেয়ে আমাদের নিদিষ্ট স্থানে চলে এলাম। এর মধ্যে প্রায় আড়াইটা তিনটা বেজে গেছে। খানার পাট প্রায়ই শেষ। খানার সাথে সংশ্লিষ্ট লোকরা এখন জিনিসপত্র নিয়ে ফেনী নদীর পড়ে একত্রিত করছে। বড় বড় কড়াইগুলোর কয়েকটা ধীরে ধীরে ওপারের গড়িয়ে নদীতে নামাচ্ছে এবং কয়েকজন লোক ওগুলো পরিষ্কার করে ওপারের দিকে ওঠিয়ে রাখছে। ওপারের সীমান্ত প্রহরীরা আজ প্রকাশ্যে সামনে এসে দাড়িয়েছে। এতদিন ওরা গাছের আড়ালে আবডালে থেকে এদিক পানে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখতো। আজ প্রকাশ্যে বুঝলাম, এদিক থেকে সবাই যাচ্ছে আজ তাই সবার উপর করা নজর রাখছে। এর মধ্যে সবাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে; সবাই যেন তাড়াতাড়ি রামগড়রের আবাসভ’মি ছেড়ে দিয়ে যায়। আমরা এখনো কিছু সিদ্ধান্ত নেইনি, তবে প্রস্তুত হয়ে আছি। সবাই লুঙ্গি পরনে। কারন নদীতে পানি আছে হাঁটু পরিমান। গোলাগুলির শব্দ ক্রমে তীব্র হচ্ছে। আকাশে দেখা যাচ্ছে ফাঁকা গুলি, এই গুলিতো রাত্রে মারার কথা, দিনে মারছে কেন? এগুলো কি সংকেত? কারা মারছে? এ সব ভাবতে ভাবতে আমি বারান্দায় দাঁড়ানোর বোরহানকে বলে লেট্রিনে গেলাম। পুকুর থেকে পানি নিয়ে বড়ই গাছের পাশ দিয়ে লেট্রিনের কাজ শেষ করে পুকুরের পার দিয়ে বড়ই গাছের কাছে আসতেই দেখি অমল দাঁড়িয়ে আছে। সে বলছে “দাদা লেট্রিনে যাবো।’’ (যুদ্ধকালীন সময়ে অমলরা আমাদের ছোট ভাইয়ের মতোই ছিলো। বয়সে ছোট তাই সবাইকে দাদা, ভাই বলে সম্বোধন করতো) আমি বললাম, ‘‘যাও, বদনাটা নিয়ে পুকুর থেকে পানি তুলে নাও।’’ তাকে বদনাটা দিতে আমি হোসেটল বারান্দায় দাঁড়িয়েছি। এমনি সময় হু-হু-হুস করে একটা প্রচন্ড শব্দ করে এক মর্টার সেল এসে পরলো পুকুরের ভেতর। অমল হুশিয়ার প্রশিক্ষণ জানা। সে পুকুরের পারে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে। আমি হাঁপু গেড়ে বসে পড়েছি। সামান্য কয়েক মূহুর্ত, হিস হিস শব্দ তুলছে গোটা কয়েক। অমল উঠে দাঁড়িয়ে সোজা বারান্দায় দিয়ে দৌঁড়ে একটা রুমে ঢুকতে গিয়ে ভীষন চিৎকারে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো এবং রুম থেকে বের হবে। এলো ছিটকে। সাথে সাথে একজন লুঙ্গি পরিহিত শার্ট গায়ে উজ্জ্বল বর্নের পেটানো শরীরে ভদ্রলোক রেরিয়ে এসে অমলকে ইংরেজীতে গালি-গালাজ করেছে। আমি পেছন থেকে যতই ঘটনা ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছি। উনি ততই উত্তেজিত ভাবে কথা বলে যাচ্ছেন। এই চিৎকারে আমাদের রুম থেকে সবাই বের হয়ে এলো দ্রুত। রুশ্নি ভাই বোরহান কাছে এসে আমাকে প্রশ্ন করলো, কি হয়েছে?’’ আমি সবিস্তারে বিষয়াবলী বর্ণনা করার রশ্নিভাই বোরহান রেগে আগুন। এরপর উনাকে এই যুদ্ধের সময় মধুর সময় ব্যয় করার জন্য ধন্যবাদ থেকে শূরু করে আজ রামগড় ছাড়তে যে হবে তা না জানা আছে কী না প্রশ্ন করে করে যখন অতিষ্ঠ করে তুলছে তখন ঘর থেকে উনার মিসেস উনাকে ঢেকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন।
১লা এপ্রিল বৃহস্পতিবার লেখার শুরুতেই কয়েকটা ঘটনার কথা উল্লেখ করার কথা ছিলো। এরমধ্যে তৃতীয় পর্যন্ত উল্লেখ করেছি ইতিপূর্বে। এটা হলো চতুর্থ ঘটনা। বাকবিতন্ডার সময়ে অনেক কথায় হয়েছে। সরি রুশ্নি ভাই, বোরহান ও কামরুলই বলেছে, তার বিশদ বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ-তিনি এখন সরকারি দলের মাননীয় সংসদ সদস্য, যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন, পরবর্তীতে তিনি মেজর জেনারেল পদবী লাভ করে অবসর নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান প্রশংসনীয় ছিলো এটা অবশ্যই স্বীকার্য।
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। রামগড় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। অমলের মুখে ঘটনা শুনে পুনরায় এসে হাজির হয়েছে। ফজলুল করিম (সে এখানে আসার পর থেকে ওদের সাথে) মুকুল শফিউল বসার, সামছুদ্দিন আহম্মদ (সাতকানিয়া) এবং আরো কয়েকজন। রুশ্নি ভাই সবাইকে বুঝিয়ে শান্ত করলেন। এদিকে আমাদের বিছানাপত্র গুলো নিয়ে আমরা আস্তে আস্তে নদীপথে ওপারে নিয়ে গিয়ে একটা স্থানে (গাছের তলায়) রাখছি। রবি ওখানে থাকবে। এদিকে রুশ্নিভাই অমল-মুকুলদের বলেছে আমাদের পারাপারে সাহায্য করতে। ওরা ওদের জিনিসপত্র (তেমন কিছুই ছিলো না) সব ওপারে রেখে এসেছে, ওদের সাথে আমাদের মতো রাইফেলের গুলির বাক্স আছে একটা। ওদের রুমে ফেলে গিয়েছে কেউ। ঐটা ওরা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে।
সবাই হাতাহাতি করে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আমাদের সব জিনিসপত্র ওপারে নিয়ে গিয়েছি। তারপরেও পুনরায় আমরা রামগড়ে ফিরে এসেছিলাম। আমাদের মধ্যে কামরুল, মনি-অমল, মুকুল-শফিকুল, বক্কর ও সামছ ুছিলো। গুলির বাক্সগুলো নেয়া হয়নি সে অজুহাত দেখিয়ে রুশ্নি ভাইকে বোঝানো গিয়েছে। রুশ্নি ভাই বলছে, ‘‘সবাই এর জায়গায় থাকো। ইউসুফ ভাই গাড়ী পাঠাবে। ওখান থেকে আপাতত ইয়ুথ ক্যাম্পে। অতএব, ওপার থেকে তাড়াড়ি চলে এসো। আমরা এপারে এসে গুলির বাক্স গুলো নীচের দিলে পানির পাশে শুকনা স্থানে রেখে উপরে উঠলাম। গেলাম আমাদের হোস্টেলের বারান্দায়। নাহ, ক্যাপ্টেন সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে চলে গিয়েছেন। ওদিকে প্রসাব করলাম সবাই, বদনা আছে। অমলকে বললাম, ‘‘অমল, তখন তো বাথরুমে যেতে পারেনি। এখন করে নাও রাত্রে ওখানে কিছুই পাবে না। অচেনা না হয়।” সে ঠিকই বুঝেছে আমার কথায় বাস্তবতা। সে পানি নিয়ে লেট্রিনে গেলো, আসলো। মুকুলও সে কাজটা সেরে ফেলে। আমরা সবাই পুকুরের পায়ে গিয়ে মর্টার সেলটার পেছনটা দেখতে পেলাম। এখান থেকে মাঠঘুরে অমলদের থাকার স্থানে গেলাম, সেখানে খালি, গুনগুনা সব। এলাম লঙ্গরখানায়, সেখানে কয়েকজন আছে যারা ওপারে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা একটু ঘুরে বাজারের দিকে গেলাম। ছোট বাজার দুই সারিতে কয়েকটা করে দোকান, সব বন্ধ দূয়ারে তালা মারা। মানুষজন নেই। উপরের দিকে ইপিআর ক্যাম্প, যা এখন আমাদের মুক্তি বাহিনীর কব্জায় এবং বর্তমানে আমাদের ঘাঁটি। আমরা ওখান থেকে বের হয়ে আসছি। প্রচন্ড গোলাগুলির আওয়াজ, ধোঁয়ার রেশ এখনো দেখা যাচ্ছে। জন মানব শূন্য মাঠ, স্কুল, হোস্টেল ঘর। আমরা কয়েকজন হাঁটছি গাঁয়ের মধ্যে। সন্ধ্যা ধরে এগিয়ে আসছে। চারিদিকে কালো ছায়া। ফুরফুরে বাতাস। বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া অন্ধকার ছায়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ায় নিজস্বতা নেই ছায়া ফেলা অন্ধকারে। দূরে গোলা-গুলির আওয়াজ ক্রমে জোরদার হচ্ছে কখনো, আবার কিছুক্ষন চুপচাপ। আমরা এবার সবাই যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। রাস্তা থেকে নীচের দিকে নেমে ফেনী নদীর পানি পা ঢুকলাম। রামগড়েরর দিকে দাঁড়িয়ে সবাই স্যালুট করে বুলেটের বাসগুলো দু’জন দু’দিকে ধরে পার করলাম। আমি ও অমল মনি ও বশার, মুকুল ও সামছু তিনটা বক্স নিয়ে ওপারে ওঠা মাত্রই বিএফএফ’র জেয়োনরা দ্রুত কাছে এসে আমাদের হাত থেকে বুলেটের বাক্সগুলো নিয়ে নিলো। প্রশ্ন করলে- উত্তর এলো- ‘‘নো আমর্স, নো এ্যামুনেশান ইধার এরালাও লোই।’’ আমরা কোন কথা না বলে উপরে উঠে গিয়ে আমাদের নির্ধারিত স্থানটায় এসে দেখলাম, জমা রাখা মাল সামানা কিছুই নেই। রুশ্নিভাইয়েরাও কেউ নেই। কিছুদূর গিয়ে বাজারের মতো দোকান পাট, লোকজনের আনাগোনার মধ্যে একটা দোকানের বারান্দায় দেখলাম রুশ্নিভাইকে। আমরা ওখানে গিয়ে উঠতেই বলেন, ‘আর ১ রাত এখানেই কাটাতে হবে। জিনিসপত্র সব গাড়িতে চলে গেছে। কাল সকাল দশটায় গাড়ি আসবে আমাদের নিতে।
আমরা আজ অন্য দেশের আশ্রিত। মনের মধ্যে কিছু একটা লাগছে, বোঝানো সম্ভব নয়তো। এটাই কী মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা। এখানে কেমন অসহায় অসহায় মনে হচ্ছে। ভোজভাজির মতো মনে হলো সব কিছু যেন। কিছুক্ষণ পূর্বেই মাঠে ঘুরতে ঘুরুতে মনের মধ্যে একটা সাহসী চেতনার ঢেউ নড়েচড়ে ওঠতো, পিছন ফেরে দেখা স্মৃতিগুলো তেমন আলোচিত করতো না মনকে। এখন এখানে বসে মনে মনে সেই ছেড়ে আসা চট্টগ্রাম শহরের। বাড়ি-বাসার, আন্দোলনের-সংগ্রামের বিভিন্ন ছবিগুলো দেখতে পাচ্ছি। সবাই আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু সবার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মতো বাস্তবতার স্থির চলমান চিত্রসব। রাত ৮টার দিকে আমরা ভাত খেয়ে নিয়ে এক দোকানের বারান্দায় রাত কাটিয়ে দিয়েছিলাম সেদিন।
৩০ এপ্রিল শুক্রবার আমরা সাব্রুম থেকে প্রায় এগারটায় দিকে ছোট হরিনা ইয়থ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রামগড় শহর অর্থাৎ রামগড় মূল অংশ ১লা মে শনিবার, ২রা মে রবিবার পর্যন্ত আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে থাকে। পাকিস্তানী সৈন্যরা কাছাকাছি অবস্থান করলেও কৌশলগত কারনে ভারী পাল্লার অস্ত্র ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। কারণ, রামগড়ের অবস্থানে অস্ত্রবাজি করলে তা সাব্রুম অংশে এসে যাবে। এতে করে পাকিস্তানী সৈন্যরা সমূহ বিপদে পড়বে। তাই আমাদের মুক্তিবাহিনীরা ২রা মে রোববার রামগড় ছেড়ে দেন তবে, মতান্তরে ৩রা মে সোমবার পর্যন্ত আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ে।
লেখক- বীর মুক্তিযোদ্ধা, কবি ও প্রাবন্ধিক।