আত্মাহুতি
 
                 
আজাদ বুলবুল
এক.
রাঙামাটি বেড়াতে আসবেন ইরানের শাহজাদা পাহলভী। সে কারণে শহরজুড়ে সাজসাজ রব। বিভিন্ন বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পেয়ে অভ্যর্থনার বিবিধ উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। মাস দু’য়েক আগে সংবাদ এলো প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিশেষ মেহমান হিসাবে শাহজাদা পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণ করবেন। এ বিশেষ মেহমানের আদর আপ্যায়ণে যেন কোনরূপ তকলিফ না হয়, আনন্দ-বিহার-বিনোদন যেন জৌলুসপূর্ণ হয়, সেজন্য ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। আয়োজনের সকল দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের উপর ন্যস্ত হলেও তদারকির জন্য পাকিস্তান আর্মির বিশেষ বিভাগের কয়েকজন অবাঙালি অফিসার আগেভাগেই রাঙামাটি চলে এসেছেন। নিজস্ব সিকিউরিটি দল থাকার পরেও পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর কিছু চৌকস জওয়ানকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে শাহজাদার নিরাপত্তার জন্য। ইরানী এই যুবরাজের সন্তুষ্টির উপর প্রেসিডেন্টের সামরিক সহযোগিতা ও গোপন বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছেন যদিও এসবই বিরোধীদলের রটনা হিসাবে সরকারি মুখপাত্র দাবী করে। গেল বছর ইরানের প্রেসিডেন্ট রেজা শাহ পাহলভী পূর্ব পাকিস্তান বেড়াতে এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেছেন। মুগ্ধ হয়েছেন পাহাড়, ঝর্ণা, নদী আর আদিবাসী মানুষদের দেখে। তাদের বর্ণিল বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি, লোকশিল্প আর চিত্রকলা দেখে। আদিবাসী শিল্পী চুনিলাল দেওয়ানের আঁকা অনেকগুলো ছবিও নিয়ে গেছেন ইরান ন্যাশনাল মিউজিয়ামের জন্য। সেবার তাঁর কিছু কিছু বাসনা অপূর্ণ থেকে গেলেও শাহজাদার ক্ষেত্রে যেন কোনরূপ ত্রুটি বিচ্যুতি না ঘটে সেজন্য লাহোর, পিন্ডি থেকে ক্রমাগত নির্দেশনা আসছে। শাহজাদার মনোরঞ্জনের জন্য আয়োজনের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন আইটেম। এ সবকিছুর আয়োজন করতে গিয়ে জেলা প্রশাসক ল্যান্স নিবলেট আর অফিসারদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। ইংরেজ এই জেলা প্রশাসক বুঝতেই পারছেন না যে, যুবরাজকে খুশি করার জন্য পাকিস্তান সরকারের এতো মাতামাতি কেন? যুবরাজ তো ইরানের কোনরূপ রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অধিকারী নন!
নিবলেট এসব কথা সরাসরি বলেন না, বলতে পারেনও না। তিনি ভালো করেই জানেন, একজন আমলার মূল কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করা। কিন্তু আজকাল তার মনে অনেক কিছুই সায় দেয় না। দেশবিভাগের পর অল্প যে ক’জন ব্রিটিশ আইসিএস অফিসারকে সদ্যস্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র নিজেদের প্রয়োজনে রেখে দিয়েছিলো ল্যান্স নিবলেট তাদের অন্যতম। এইতো, বছর কয়েক আগে সাতচল্লিশে ভারত বিভক্তির সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানভুক্ত হবার পরও রাঙামাটিতে ভারতীয় পতাকা উত্তোলনের ঘটনা ঘটেছে। সেই থেকে রাষ্ট্রের সন্দেহ এখানে সুপ্ত আছে বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ। ডিসি মেজর জে. এল হাইড বিভিন্ন প্রশ্ন ও সমালোচনার জবাব দিতে দিতে তখন ক্লান্ত। মেজর হাইড বুঝতেও পারেন নি, এতো চেনাজানা ঘনেশ্যাম দেওয়ান অল্প ক’জন অনুসারী নিয়ে হুট করে একটা পতাকা তুলে ভারত-পাকিস্তান জুড়ে বিরাট হৈ-চৈ ফেলে দেবে! কচুনালা, সিঙিনালা, মাটির রাস্তা, দেবানের চর সবকটি রাস্তায় প্রিয় কুকুর জ্যাককে নিয়ে হেঁটে বেড়িয়ে বেশ ভালোই কাটছিলো তার। কেবল ব্রিটিশ রাজশক্তি পতনের দুঃখজনক ঘটনাটি হাহাকার হয়ে বুকে বিঁধলে হাইড অন্যমনষ্ক হয়ে পড়তেন কিছুক্ষণের জন্য। মোটা পাইপের ভেতর হাভানা তামাকের সাথে দু’চিমটি মোহিনী হাস্সি মিশিয়ে গলগল করে টেনে নিলে মাথাটা হালকা হয়ে উঠতো, নিজকে মনে হতো ভারমুক্ত।
ভারতীয় পতাকা উত্তোলনের ঘটনায় বিব্রত সরকার মেজর জে.এল হাইডকে অবসরে পাঠিয়ে ল্যান্স নিবলেটকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগ দেয়। নিবলেট সাবেক জেলা প্রশাসক লুইনের অনুকরণে পার্বত্যবাসীর হৃদয়ে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেন আপন প্রতিভাবলে। শাসকের গাম্ভীর্য ত্যাগ করে আদিম অরণ্যচারী সংস্কৃতিতে লালিত এখানকার মানুষদের সাথে গভীরভাবে মেলামেশা শুরু করেন নিবলেট। অচিরেই টমাস হার্বাট লুইনের নাতি হিসাবে নিবলেটের ব্যাপক পরিচিতি গড়ে উঠে। নিবলেট বোঝেন, দ’ুবছর সাফল্যের সাথে ডিসির দায়িত্ব পালন করার পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব অনেকটা জোর করেই দ্বিতীয়বারের মতো তাকে ডেপুটি কমিশনার হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন। পাকিস্তানের লৌহমানব হিসাবে খ্যাত আইয়ুব খান স্বদেশি পাকিস্তানি অফিসারের চাইতে কেন পরাজিত ব্রিটিশ অফিসারদের বিশ্বস্ত ভাবেন, এ প্রশ্নটি মাথায় এলেই মনে মনে হেসে উঠেন ল্যান্স নিবলেট।
দুই.
কাজের চাপে নিবলেট ভারি ক্লান্ত। অফিসে বসে এসডিও মিস্টার রহমানকে একটা মিটিং ডাকার নির্দেশ দিলেন। কিছু জরুরি চিঠিপত্র মুসাবিদা করছেন এমন সময় আরদালি এসে খবর দিলো, কয়েকজন বাঙালি ভদ্রলোক হুজুরের সাথে দেখা করতে চায়। নিবলেট কোনরূপ চিন্তা না করেই বললেন,
: যাও, গিয়ে বলো, আমি এখন ব্যস্ত আছি। দুপুরের পরে যেন দেখা করে। কী দরকারে এসেছে তা জেনে নিয়েছো তো?
নিবলেটের কথা শেষ না হতেই চোস্ত পাজামা, শেরোয়ানি, কিস্তি টুপি, কালো আচকান ও নাগরা পরিহিত বড়োসড়ো দেহের কয়েকজন তার অফিসে ঢুকে পড়ে। নিবলেট বুঝতে পারেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের পুরোধা এরা। এদের মধ্যে যিনি নের্তৃস্থানীয় তিনি ডিসির দিকে হাত বাড়িয়ে সহাস্যে বলেন,
: আমি এফ. কে. চৌধুরী। আমার আরো পরিচয় আছে। সেগুলো নয়তো পরে জানবেন।
নিবলেট বুঝতে পারেন ইনি পূর্ব-পাকিস্থানের মুসলিমলীগের ডাকসাইটে নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী। বিষ্ময় প্রকাশ না করে নিবলেট শান্ত গলায় জানতে চান,
: তা আমার কাছে কী মনে করে এসেছেন? আমি আপনাদের কী উপকার করতে পারি?
: কী আর উপকার করবেন আপনি! আপনার ক্ষমতাইবা কতটুকু! শুনুন ইরান থেকে আমাদের যে বিশিষ্ট মেহমান এখানে বেড়াতে আসবেন তার রিসেপসানের জন্য আপনাদের প্রস্তুতি কদ্দুর?
নিবলেট খানিকটা চিন্তা করে বললেন,
: আমরা যথার্থ সুন্দর বর্ণিল বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করবো। কোনরূপ ভুল ত্রুটি হবে না বলে আশা রাখি।
: আর আশা রাখা! দেখুন ডিসি সাহেব, ইরানের শাহজাদা আমাদের প্রেসিডেন্টের বিশেষ মেহমান। তার কোন ধরনের তকলিফ আমরা মেনে নেবো না। আপনি একা তাঁকে তোয়াজ তাজিম করলে চলবে না। স্থানীয়দেরকেও সংশ্লিষ্ট করতে হবে এতে।
: সেটা কেমন?
: চাকমা, মগ, তিবিরাদের নিয়ে মিটিং করুন। তাদের দিয়ে সংবর্ধনার আয়োজন করান। নাচগানের আয়োজন করেন পাহাড়ি মেয়েদের নিয়ে। দেখুন, আমাদের মেহমান কিন্তু এখানে আসবেন আমোদ ফ‚র্তির জন্য। আর এই আমোদ ফ‚র্তির আয়োজনে পাহাড়িদের থাকবে স্বতর্স্ফুত উপস্থিতি।
ফজলুল কাদের চৌধুরী গ্রীবা বাঁকিয়ে আবারও অনেকটা নির্দেশের সুরে বলতে লাগলেন,
: আপনি পাহাড়িদের দিয়ে বিশেষ কিছু প্রোগ্রামের আয়োজন করাবেন।
নিবলেট আইয়ুব শাসনের এই উপদ্রপগুলোকে চেনেন। মৌলিক গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীদের চটিয়ে দেয়া আর জলে নেমে কুমিরের সাথে বিবাদ করা একই কথা। সেজন্য গলার স্বরকে যতোটা সম্ভব নিচু করে নিবলেট বললেন,
: চৌধুরী সাহেব, আপনি তো জানেন, কর্ণফুলীতে বাঁধ দেবার কাজ শুরু হয়েছে। সেজন্য এখানকার পাহাড়িরা, বিশেষকরে চাকমারা মানসিকভাবে ভালো নেই। ভবিষ্যতের আশঙ্কায় তারা ভারি অস্থিরতার মধ্যে আছে।
: কে আপনাকে বললো চাকমারা অস্থির হয়ে পড়েছে?
কৈফিয়ৎ এর সুরে চৌধুরী জানতে চান।
: ঠিক কেউ বলেনি, তবে বাঁধ হলে যা ঘটবে তার আগাম ভাবনায় এখন কারো মনে কিন্তু স্বস্তি নেই।
: আরে তাহলে তো আরো ভালো!
একটা কুটিল হাসির রেখা দেখা গেল চৌধুরীর চোখে মুখে,
: যা ঘটবেই তার জন্য এখন থেকে দুঃখ পেয়ে মন খারাপ করে রাখার দরকার কি! এ সুযোগে আমরা তাদের মন ভালো করার উদ্যোগ নিতে পারি। তাদের জন্য যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, সার্কাস, হাউজিখেলা এসবের আয়োজন করতে পারি।
নিবলেট কিছুটা নির্বাক চোখে বক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
: আরে ভাই, এতোদিন পাহাড়ে চাকরি করলেন আর এদেরকে বুঝতে পারলেন না? এরা তো ফুর্তিই করতে চায়। বিনিপয়সায় যাত্রাগানের কথা বলে তাদের বাজারে আসতে বলবেন। প্যারেড ময়দানে সবাই জমায়েত হবে। সেখানে শাহজাদাকে সংবর্ধনা দেওয়াবেন। আপনি তো দেখছি এদের ব্যাপারে ভারি দরদী। নাচগানের পর যদি আপনার খায়েস হয় তাহলে তাদের জন্য ভাত-মদের ব্যবস্থা করবেন। ব্যাস!
এরপর শাহজাদার বিনোদনের জন্য কিছু স্পর্শকাতর বস্তুর ফরমায়েসের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এলে নিবলেট সাহেব অপ্রসন্ন মুখে ব্যস্ততার ভান করে বললেন,
: দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে, বাকি আলোচনা এসডিও সাহেবের সাথে সেরে নেবেন ক্ষণ?
গলার টাইয়ের নটটি সোজা করে, হাতে থাকা ফাউন্টেন পেনটি পকেটে পুরে নিবলেট অফিসের বাইরে কাঁঠালছায়ায় থেমে থাকা জিপগাড়ির দিকে এগিয়ে যান।
তিন.
শাহজাদা পাহলভীর রাঙামাটি আগমন উপলক্ষে কারমাইকেল হলে সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দের যৌথসভার ডাক দিয়েছেন ডিসি নিবলেট। কোতোয়ালির দারোগা সোনামিয়া ঘোড়ায় চেপে পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন সভার চিঠি। কামিনী মোহন দেওয়ান, বলভদ্র তালুকদার, প্রেমলাল হেডম্যান, কিংকর দেওয়ান, নবীন কারবারি, প্রতুল দেওয়ান, শশীমোহন দেওয়ান, কুদ্দুস মাস্টার, ওয়ালী মাদবরসহ আরো অনেককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। রাজা ত্রিদীব বিশেষ কারণে অনুপস্থিত থাকলেও রাজপ্রতিনিধি সলিল রায় যথারীতি উপস্থিত হয়েছেন। আরো এসেছেন শিক্ষক প্রভাত কুমার দেওয়ান, লেখক বিরাজ মোহন দেওয়ান, লীগের তরুণ নেতা এস.টি হোসেন প্রমুখ। ডিসি সাহেব রাজমাতা বিনীতা রায়কে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন, তিনি যেন সংবর্ধনা কমিটিতে উপদেষ্টা হিসাবে থাকেন। এছাড়া শিল্পী চুনিলাল দেওয়ানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মঞ্চসজ্জাসহ বিবিধ কাজে তার বিশেষ কদর। নিবলেটের কাছে এসব অভ্যর্থনার আয়োজন কোন চিন্তার বিষয় নয়। এইতো মাস ছয়েক আগে বার্মার রাজা ও রানী জেলা প্রশাসনের অতিথি হয়ে সপ্তাহখানেক কাটিয়ে গেলেন। অবশ্য ইরানের শাহজাদার বিষয়ে আইয়ুব খানের যতটুকু আগ্রহ তার সিকিভাগও বার্মার রাজা-রানীর জন্য দেখানো হয়নি।
সভার শুরুতে নিবলেট পাকিস্তানের বিশেষ মেহমানের পার্বত্য চট্টগ্রামে সফর সংক্রান্ত সরকারি পত্রটি পড়ে শোনান। প্রেসিডেন্টের এই বিশেষ অতিথিকে সর্বোচ্চ সম্মান জানানোর লক্ষে তিনি সবার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। কামিনী দেওয়ানকে উদ্দেশ্য করে নিবলেট সাহেব বলেন,
: আমি জানি দেওয়ান বাবু, আপনাদের মনের অবস্থা সবিশেষ সন্তোষজনক নয়। তবু আপনাদের সহযোগিতা ভিন্ন এ মহৎ কর্মটি সম্পাদন সম্ভব নয়।
কামিনী দেওয়ান জেলার বিশিষ্ট মুরুব্বি। প্রশাসনের যেকোন প্রয়োজনে তিনি উদারভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। খানিকটা কেশে গলায় জড়ানো শ্লেষ্মা পরিস্কার করে তিনি সভার উদ্দেশ্যে বললেন,
: আমন্ত্রিত মেহমান ইরানের মহামান্য সম্রাটের ভ্রাতা। তার সম্মানে প্যারেড গ্রাউন্ডে রাঙামাটিবাসির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা প্রদানের প্রস্তাব করছি আমি। সোনার কালিতে লেখা একটি সুদৃশ্য মানপত্রও তাকে দেওয়া যেতে পারে।
নবীন কারবারি ধুল্যাছড়ির একজন সম্পন্ন গৃহস্থ। তার গিন্নি বদাচোগী তংচঙ্গ্যার রান্নার ভারি সুনাম। তিনি বলেন,
: শাহজাদা এবং তার পরিষদকে উপাদেয় খানা-খাদ্য পরিবেশনের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হলে আমি তা সাদরে পালন করবো।
চুনিলাল দেওয়ান চিত্রশিল্পী। রেজাশাহ পাহলভী তার ছবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। চুনিবাবু অল্পকথায় জানালেন,
: শাহজাদার জন্য সুন্দর কিছু উপহার নির্বাচন করা যায়। তবে চাকমাদের হাতে বোনা কিছু আলাম, চাদর, বর্গি দিলে খুবই ভালো হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কয়েকটি জলরঙে আঁকা ছবি সেগুন কাঠের ফ্রেমে বাঁধিয়ে তাকে দেওয়া যায়।
অতপর সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়, কল্পতরু চাকমার ছেলেরা শাহজাদা পাহলভীর জন্য হাতীর দাঁতের সিগার কেস, ছড়ি ও একসেট সোনায় মোড়ানো গহনা তৈরি করবে। বাঙালি পাড়ার ওয়ালী মাতবর শাহজাদার বিনোদনের জন্য কর্ণফুলি নদীতে নৌকা বাইচের আয়োজন করবে। বাঁশখালীর ভাসাইন্যা মাঝি বাদশা ও আহমদ হোসেন ওয়ালী মাদতরকে সার্বিক সহযোগিতা করবে। বেইন বুননে দক্ষ পঞ্চলতা খীসার বোনা বেশকিছু মহার্ঘ বস্ত্র অতিথিকে উপহার দেওয়া হবে। মমতাজ ইরানি নাচগানের ব্যবস্থা করবে। কুমিল্লা ও ঢাকা থেকে নৃত্যগীত পটিয়সী শিল্পী ভাড়া করে আনবে। বাংলা সিনেমার জনাকয়েক এক্সট্রা নায়িকাকে আনা হবে শাহজাদার মনোরঞ্জনের জন্য। ইন্দ্রপুরী সিনেমা হলের ম্যানজার মুৎসুদ্দি বাবুকে সে কারণে দু’চারদিনের মধ্যে ঢাকায় পাঠাতে হবে। শাহজাদার জন্য শিকারের আয়োজন করা হবে। শিকার সুবিধার জন্য প্রয়োজনে পালিত হরিণ ছেড়ে দেয়া হবে জংগলে। পাহলভী অবশ্য হাতী শিকার করতে আগ্রহী। সেজন্য সবচেয়ে বেশি দরকার জেলা প্রশাসনের হাতী লালবাহাদুরকে শিকারের জন্য প্রস্তুত করা। লালবাহাদুর বহুদিন শিকার সন্ধানে জংগলে যায়নি। ডিসি অফিসের ভাগ্যবান কর্মকর্তাদের মতো লালবাহাদুর ভারবাহী হয়নি, হয়ে উঠেছে ভাগ্যবান লক্ষীমন্ত।
চার.
আরদালি জিৎ বাহাদুর তার সাহেবকে আর কখনো এতো ক্লান্ত অবসন্ন চেহারায় দেখেনি। নিবলেট সাহেব বরাবরই প্রাণবন্ত হাসিখুশি স্বভাবের মানুষ। ব্রিটিশ চালচলন তিনি বহু আগেই ত্যাগ করেছেন। কথাবার্তায় তিনি দোঁ-আশলা ভাষা ব্যবহার করেন না। মাঝেমধ্যে তিনি চট্টগ্রামি বা চাকমা ভাষায় কথা বলেন। তবে সাধারণ্যে তার ভাষা প্রমিত বাংলা। ডিসি বাংলোর সামনে জীপ থামতেই জেলা প্রশাসনের হাতি লাল বাহাদুর শুঁড় উঁচিয়ে সালাম জানায়। মাতৃহীন কন্যা জুন নিবলেট ছবি আঁকার রং তুলি ফেলে রেখে বাবার হাত চেপে ধরে। নিবলেটের আজ কোনোদিকে মন নেই। অন্যমনস্কভাবে বাংলোর চারপাশে খোলা বারান্দায় পেতে রাখা ইজি চেয়ারগুলোর কোনো একটায় গা এলিয়ে দিলে হেড ক্লার্ক কালিরতন খীসা একগাদা ফাইলপত্তর বগলে চেপে নিবলেটের পাশে এসে দাঁড়ায়। কালিতন ডিসি অফিসের পুরাতন কর্মচারী। সরকারি গোপনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কোন চিঠি বা ফাইলের মুসাবিদা ছাড়া কালিরতন পারতপক্ষে বাংলোয় আসে না। নিবলেট মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেও তা চেপে রেখে জানতে চান,
: ব্যাপার কী খীসা বাবু? ফাইল অফিসে না দেখিয়ে একদম বাংলোয় নিয়ে এলেন কেন?
কালিরতন মাথা ঝুঁকিয়ে হাত কচলে জানায়,
: ছার, ফাইলটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গোপনীয়ও বটে।
ফাইলটি হাতে নিয়ে নিবলেট দেখলেন সেচ বিভাগের কিছু জরুরি নির্দেশনা। একটু চোখ বুলিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, এটি কর্ণফুলি নদীর দু’পাড়ে বসবাসরত মানুষের জমি, বাড়িঘর, পুকুর, বাগান জরিপের নির্দেশাবলী। বাঁধের ফলে যেসব যায়গা ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তার পরিমাণ নির্ধারণ করতেই এই জরিপ। কালিরতন বুঝতে না পারলেও চিঠি পড়ে নিবলেটের বুক ধক্ করে উঠে। একটি অনিন্দ্য সুন্দর জনপদ কয়েক বছরের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে! চেনাজানা পথ-ঘাট, বাড়ি-ঘর, শহর-বাজার, অফিস, স্থাপনা, কোন চিহ্নই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না! একটি সমৃদ্ধ শহর হারিয়ে যাবে কালের স্রোতে! আর এই জনপদকে ধ্বংস করার অনুঘটক হিসাবে কাজ করতে হবে তাকে? তার এ অমার্জনীয় অপরাধকে মহাকাল কি ক্ষমা করবে? নিবলেটের মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। কর্ণফুলির মৃদুমন্দ হাওয়ায় বিশাল চাপালিশ গাছের মর্মরধ্বনি হাজারো গৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃহহীন মানুষের বিলাপ হয়ে তার কানে ধরা পড়ে। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর হঠাৎ ধ্যানভাঙা ঋষির মতো নিবলেট জিজ্ঞাস করে,
: আচ্ছা খীসা বাবু, আপনি চিঠিটা পড়েছেন তো?
: জ্বী, পড়েছি ছার।
: বুঝেছেন কিছু?
: হ্যাঁ, কিছুটা বুঝেছি ছার।
: কী বুঝেছেন আপনি? সামান্য কিছু মানুষকে সুবিধা দেবার জন্য বিজলী উৎপাদনের নামে একটি সমৃদ্ধ সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে? এ বড়ো অমানবিক কাজ!
কালিরতনকে নিরুত্তর থাকতে দেখে নিবলেট সাহেব বলতে থাকেন,
: এ বিষয়ে আপনারা এতো নিশ্চুপ কেন? রাঙামাটি জেলায় তো আপনারা সংখ্যাধিক। আপনারা শিক্ষিত সচেতন। আপনারা একটু দেন দরবার করুন। মানুষকে বোঝান। আমার যে পদ ও পদবি, সেখানে বসে এসব কথা বলা যায় না।
ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকা কালিরতনের কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে নিবলেট জানতে চায়,
: খীসাবাবু আপনি অনুমান করতে পারছেন, বাঁধ হলে এখানে কী ভয়ংকর মহাপ্রলয় ঘটে যাবে?
নিরসক্ত গলায় কালিরতন জানায়,
: বুঝতে পারছি ছার।
: না! বুঝতে পারেন নাই। দু’তিন বছরের মধ্যে যে শহরটা হারিয়ে যাবে, সে শহরের মানুষকে এখন নামগোত্রহীন এক কথিত কুমারের সন্তুষ্টির জন্য ব্যতিব্যস্ত হতে হয়। হায় সেলুকাস!
পাঁচ.
ডিনারে বসে অন্যান্য দিনের মতো কন্যা জুনের সাথে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠতে পারলেন না নিবলেট। ছবি আঁকা জুনের কাছে অনেকটা নেশার মতো। অনেকদিন ধরেই ছবি আঁকছে জুন। ওয়াটার কালার তার প্রিয় মাধ্যম। সব ছবিই পাহাড়, নদী, বিস্তৃত শস্যভূমি আর আদিবাসী মানুষের। বাবার সামনে সদ্য আঁকা ছবিগুলো রেখে ভেতরে চলে যেতে চাইলে নিবলেট তাকে আদর করে পাশে বসিয়ে বলেন,
: কতোগুলো ছবি এঁকেছো মা?
মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটিয়ে জুন বলে,
: এ পর্যন্ত ছাব্বিশটা শেষ হয়েছে। আরো পাঁচটা অসম্পূর্ণ আছে বাবা।
নিবলেট ছবিগুলো উল্টেপাল্টে দেখেন। প্রায় ছবিই জলরঙে আঁকা ল্যান্ডস্কেপ। কিছু ফিগার স্টাডিও আছে। চেঙ্গির মরা স্রোত, কর্ণফুলির আঁকা বাঁকা গতিপথ, রাজ মন্দিরের সুউচ্চ চূঁড়া, কাঁদায় আটকে পড়া ভাসাইন্যা মাঝির মালবাহী নৌকা, চাকমা নারীর চেঙ্গী নদীতে জলকেলি, জুম থেকে তোলা শস্য-সবজি নিয়ে জুমিয়া কৃষাণের নদী তীরে অপেক্ষা, লাঙল কাঁধে কাঁদামাখা হাইল্যা চাষীর ঘরে ফেরা, আরো কতো কী! নিবলেট মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে, ছড়ার মুখে বাঁধ দিয়ে কাঁদা সেচে মাছ ধরা, পাহাড়ি ঝিরির পাশে উদোম শরীরের মুরং তরুণী, জুমঘরের সামনে বসে থাকা স্বল্পবসনা কুকি নারী, বাজারের ভীড়ে নেংটি পরা ত্রিপুরা বুড়ো, ভেষজ ঔষধের পসরা সাজিয়ে মাথায় পাগড়ি বাঁধা চিন্তামগ্ন চাকমা বৈদ্যের ছবি। জুন জানতে চায়,
: বাবা ছবিগুলো কেমন হয়েছে?
নিবলেট জবাব দিতে পারে না। তার চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। জুন আবার জানতে চায়,
: বাবা, ছবিগুলো কি ভালো হয়নি?
: হয়েছে মা, খুব ভালো হয়েছে। এসব ছবি কদিন বাদে কেবল ছবিই থাকবে না, হয়ে যাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতœসম্পদ। এ সম্পদ আমি হারাতে দেব না মা। জুনের আঁকা ছবিগুলো বুকে চেপে ধরে নিবলেট। বাবাকে ছোটবেলা থেকে খুব শক্ত স্বভাবের মানুষ হিসাবে জানে জুন। পারতপক্ষে কখনো নিজের মনে কোন আবেগকে জায়গা দেন না তিনি। পরাজয়ের বছর সাতচল্লিশ সালে মা যখন এক বিপত্নীক ইংরেজ পুলিশের সঙ্গে চলে যায় তখনও তাকে অস্থির দিশেহারা মনে হয়নি। জুনের কাছে তার বাবাকে ভারি অচেনা লাগে। নিবলেট মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলেন,
: এই অপরূপ প্রকৃতি, মানুষের নিরপদ জীবনযাপন, এই নদী-পাহাড়, মাঠ-ঘাট, সুখী আদিবাসী জীবন, কোন কিছুকেই আমরা বাঁচাতে পারব না মা! আমেরিকানদের উন্নয়ণ ফর্মূলার কাছে মানুষের জীবন মূল্যহীন।
ছয়.
কামিনী দেওয়ানের সাথে প্রশাসনের সুসর্ম্পক দীর্ঘদিনের। কামিনী বাবু কেবল ধনার্ঢ্য ব্যক্তি নন, শিক্ষায় সুরুচিবোধে এবং জ্ঞানদীপ্ততায় তিনি অগ্রগন্য বুদ্ধিজীবী। জেলার যেকোন জরুরি ও গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শের জন্য ডিসি অফিসে প্রায়শ তার ডাক পড়ে। অনেকসময় প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা জরুরি প্রয়োজনে তার বাড়িতে এসে দেখা করেন। নিবলেট সাহেব ইতোপূর্বে এই চাকমা দেওয়ানের বাড়িতে গেছেন বারকয়েক; প্রতিবারই নিমন্ত্রিত হয়ে। জেলার কর্তাব্যক্তি হিসাবে অনাহুতভাবে কারো বাড়ি যাওয়াকে পছন্দ করেন না তিনি। কিন্তু রবিবার সকালে আরদালি জিৎ বাহাদুরকে সাথে করে যখন বরাদম পৌঁছলেন তখন মেঘ করেছে উত্তর আকাশ আঁধার করে। কালো মেঘের ফাঁক গলে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলছে এক ঝাঁক সাদা বক। একদল গেরুয়া পোষাক পরা ভান্তে রাজঘাটে দাঁড়িয়ে আছে নদী পার হওয়ার অপেক্ষায়। কাছের ছড়াটির কাদাপানিতে হুটোপুটি করছে অনেকগুলো মহিষ। কামিনী বাবু বাগান পরিচর্যা করছিলেন বাড়ির সামনে। পরনে ধুতি, খালি গা, হাতে একটি ছোট্ট দা। দু’জন বাঙালি ভৃত্য ফরমায়েসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে কাছাকাছি। ডিসি নিবলেটকে বাড়ির দিকে আসতে দেখে বাগানের বেড়ার উপর ঝুলানো ফতুয়াটি গায়ে গলিয়ে সহাস্যে সামনে এগিয়ে এলেন কামিনী। হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বললেন,
: কী সৌভাগ্য আমার! মহামান্য ডিসি বাহাদুর ল্যান্স নিবলেট মহোদয় আমার বাড়িতে এসেছেন। এ যে আমার পরম পূণ্যের ফল! আমাকে খবর দিলেই তো আমি আপনার কাছে পৌঁছতাম স্যার। কোন জরুরি বিষয় কি?
: না, না, তেমন জরুরি কিছু নয়। আজ ছুটির দিন। ভাবলাম আপনার সাথে একটু গাল গল্প করে আসি।
: তাতো ঠিকই, তাতো ঠিকই,
বলতে বলতে অতিথি আপ্যায়ণের জন্য কামিনী বাবু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
নিবলেট তাকে নিরস্ত্র করে বললেন,
: এবার বসুনতো দেওয়ান বাবু। এতো ব্যস্ত হবার দরকার নাই।
কামিনী দেওয়ান কাঁধের গামছায় হাত মুছে নিবলেটের মুখোমুখি বসে।
: হ্যাঁ, এবার বলুন স্যার। আমি কি দোষ করেছি?
: দোষ তো অনেক করেছেন, কোনটা ফেলে কোনটা বলি?
: শাহজাদা পাহলভীর সংবর্ধনার যে আয়োজন আমরা সবাই মিলে করছি, তাতে কি আপনি সন্তুষ্ট নন?
: আমি জৌলুসের কথা বলছি। এটা এমনি একটা সময়…
নিবলেটের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কামিনী দেওয়ান বললেন,
: কিছুই ভাববেন না স্যার। আমাদের রাষ্ট্রীয় অতিথির কোন অমর্যাদা যেন না হয় সেদিকে আমরা অবশ্যই খেয়াল রাখবো। শহরজুড়ে আলোকমালার রোশনাই ফুটবে। ফানুস বাতি উড়বে আকাশজুড়ে। আট/দশটা ব্যান্ডদল বাদ্য বাজাবে সারাশহর ঘুরে ঘুরে। বহুবর্ণিল কাপড় আর কাগজ দিয়ে মহাসড়কের দু’পাশ আমরা সাজিয়ে রাখবো। অঢেল নাচগান আর খানাপিনার ব্যবস্থা হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে নৃত্যপটীয়সী কলাকার আনার চেষ্টাও চলছে।
: আপনি আমার কথাটা ভালোভাবে একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমি বলছি সংবর্ধনা কমিটি এতো জাঁকজমক করতে চাইছে কেন? আপনাদের উৎসাহ দেখেতো আমি রীতিমতো অবাক হচ্ছি।
: এতোসব তো আমরা করছি আপনার সন্তুষ্টির জন্য। রাজকুমারকে সম্মান জানানোর নির্দেশ তো সরকার বাহাদুরই দিয়েছেন।
: হ্যাঁ, সরকারের নির্দেশে আমিও আপনাদের ডেকেছি। কিন্তু আমার মন এই উৎসব আয়োজন কোন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। আপনি বোধহয় জানেন কর্ণফুলি প্রজেক্ট কিছুদিনের মধ্যে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।
: হ্যাঁ, জানিতো। কাপ্তাইয়ের শিলছড়িতে নাকি বাঁধ দেওয়ার সিন্ধান্ত হয়েছে। গত সপ্তাহের আনন্দবাজারে দেখলাম আমেরিকার উথাউ কোম্পানী এখানে কাজ পেয়েছে। গাছপালা কাটার জরিপও বোধহয় কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে।
: আপনি তো দেখি সবকিছু জানেন। বাঁধের পর এখানকার পরিস্থিতি কেমন হবে অনুমান করতে পারেন?
: কী আর হবে? সব ডুবেটুবে যাবে।
: সব ডুবে গেলে আপনারা কোথায় যাবেন? দরিদ্র অশিক্ষিত হাজার হাজার চাকমা-বাঙালি কোথায় যাবে?
: রাষ্ট্র নিশ্চই তাদের পূণর্বাসনের ব্যবস্থা করবে।
: যতো পূণর্বাসনই করুক, আপনারাতো আর চারপুরুষের ভিটেমাটি ফেরত পাবেন না।
: না পেলে না পাবো। নতুন কোন যায়গায় ঠিকানা গাড়বো।
: আচ্ছা, আপনারা প্রতিবাদ প্রতিরোধ কিছু করবেন না? সবাই মিলে বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে আপনাদের এই চমৎকার শহরটা হয়তো পৃথিবীর মানচিত্রে টিকে যেতো।
: আমরা কাদের নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করবো। আমাদের কোন গণসংগঠন নাই। অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত, গরীব, পাহাড়ের জুমিয়া। চাকমাদের মধ্যে অনেকেই দেওয়ানদের পছন্দ করে না। মারমা, তংচংগ্যা, ত্রিপুরাদের সাথেও আমাদের তেমন সদ্ভাব নাই।
: তাই বলে এই মাটির জন্য আপনাদের মনে কোন মায়া জাগছে না?
: মায়া অবশ্যই জাগে। কিন্তু সরকারের হুকুম তো মানতেই হবে। না মানলে কী হয় তাতো আপনি ভালোই জানেন। সাতচল্লিশের আগষ্টে যারা এখানে ভারতীয় পতাকা তুলেছিল তারা ত্রিপুরায় চলে গিয়ে বেঁচে গেছে। আমরা যারা এখানে রয়ে গেলাম তারা যে কতোভাবে লাঞ্ছিত আর অপমানিত হয়েছি তার সাতকাহন আর বলতে চাই না।
: শুনুন দেওয়ান বাবু, শুনেছি আপনার একটি সংগঠন আছে। নাম পাহাড়ি জন সমিতি। সেই সংগঠনের মাধ্যমে কিছু একটা চেষ্টা করা যায় না?
: ডিসি বাহাদুর! আপনার বদান্যতা আর উদারতার কথা আমাদের চিরদিন মনে থাকবে। আপনি একজন মহৎ হৃদয়ের মানুষ। আমাদের বেদনায় আপনি সহমর্মী। কিন্তু চাকমারা বাঁধের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করবে বলে মনে হয় না। ইনডিয়ার পতাকা ওড়ানোর ঘটনায় কতো মানুষ যে দেশছাড়া হয়েছে তার গোনাগুনতি নাই। এখন আবার বাঁধের বিরুদ্ধে কথা বলে কেউ আর সরকারের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হতে চাইবে না।
নিবলেট এবার হতাশ গলায় বললেন,
: তাহলে কি আপনারা নিজভূমি থেকে উৎখাত হবার বিষয়টিকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে মেনে নিবেন?
: আমার তো মনে হয় সবাই মেনে নেবে। চাকমারা তো প্রায় যাযাবর গোষ্ঠী। জুমজমির খোঁজে তাদের শত সহস্র বছরের অন্বেষণ তো এখনো থেমে যায়নি।
একটু থেমে খেদের সাথে তিক্ত গলায় জানালেন,
: যাযাবরদের মাটির মায়া থাকতে নেই।
সাত.
জেলা প্রশাসনের হাতী লালবাহাদুরকে জানে না বা চেনে না এমন লোক এ শহরে খুঁজে পাওয়া ভার। তার দেহ সুবিশাল। প্রভূভক্তির প্রমাণ প্রায় কিংবদন্তীত‚ল্য। মাহুত সোনামিয়ার তত্তাবধানে থাকলেও ল্যান্স নিবলেট বা জুন নিবলেটের সাথেই তার আন্তরিকতা বেশি। সোনামিয়া লালবাহাদুরের খাওয়া, বিশ্রাম, এমনকি ঘুমানোর সময়টিকেও একটি ছকে নিয়ে এসেছে। রবিবার ছুটির দিন। সকালে লালবাহাদুরকে গন্ধসাবান মাখিয়ে পূণ্য সলিলা কর্ণফুলির স্বচ্ছ জলে দলাই মলাই করে স্নান করায় সোনামিয়া। তারপর হাতীর কপাল রাঙিয়ে দেয় টকটকে সিঁদুর মেখে। নিবলেট সাহেব বারান্দায় ঝুলানো কলার ছড়া থেকে ডজনখানেক লালবাহাদুরের মুখে তুলে দেয়। হাতী শুঁড় নামিয়ে নতমস্তকে প্রভুর আদর গ্রহণ করে। জুন একটা বড়ো থালায় করে মুড়ি, নারিকেল, সন্দেশ এগিয়ে ধরে। নগরভ্রমণে বেরুবার আগে লালবাহাদুর পা উঠিয়ে শুঁড় নাচিয়ে নিবলেটকে স্যালুট জানায়। দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে স্বর্ণকেশী জুন। সোনামিয়ার নির্দেশে হাতী দীপ্তপায়ে সামনে এগিয়ে চলে। গলায় ঝোলানো বিশাল পেতলের ঘণ্টা ঢং-ঢং-ঢং শব্দে সবাইকে স্বচকিত করে তোলে। লালবাহাদুর প্রথমে যায় পুলিশ সুপারের বাংলোয়। স্যালুট দেয় এসপি সাহেবকে। সে বাসা থেকে হাতীর সামনে বাড়িয়ে দেয়া হয় একধামা ধান। তারপর নদীর ঘাট, প্যারেড মাঠ, ডিসি অফিস, কারমাইকেল হল, কেরানীদের বাসাবাড়ি, বাজার, সিনেমাহল পেরিয়ে মাহুত লালবাহাদুরকে নিয়ে যায় কামিলা ছড়ার মুখে। ফিরতিপথে শহরের লোকজন রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে লালবাহাদুরকে অভিবাদন জানায়। আলো চাল, পাকা কলা, কচি কলাগাছ নিয়ে অনেকেই অপেক্ষায় থাকে। কেউবা উলুধ্বনি দিয়ে হাতীকে শুভেচ্ছা জানায়। ক’দিন বাদে শাহজাদা পাহলভীকে নিয়ে লালবাহাদুর শিকারে যাবে। সেজন্য দৈহিক কসরৎ করিয়ে হাতীকে শিকারে যাবার উপযোগী করে গড়ে তুলতে সোনামিয়া চেষ্টার ত্রুটি রাখে না। লালবাহাদুরের আচরণের বিষয়ে মাহুত কিছুটা চিন্তিত। কারণ জেলা প্রশাসনের তত্ত¡াবধানে থেকে দীর্ঘদিন ধরে আদর-যত্ন, তাজিম-তোয়াজ পেয়ে তার আচরণে একটা অভিমানী অহংবোধ গড়ে উঠেছে। আজকাল তার রুচি বিরুদ্ধ কিছু ঘটলেই লালবাহাদুর বেসামাল হয়ে যায়।
আট.
শিকারে যাবেন যুবরাজ পাহলভী। খবর এসেছে বান্দরবানের চেমী মৌজার গভীর অরণ্যে একদল বন্যহাতী নিরুদ্বিগ্নভাবে বাচ্চাকাচ্চাসহ ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিকারের এই মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া হতে দিতে চান না আয়োজকরা। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব যাত্রা শুরু করা দরকার। নিবলেট পরেছেন শিকারীর পোশাক। পরনে খাকি হাফপ্যান্ট, গায়ে হাফহাতা চামড়ার জ্যাকেট, কোমরে চওড়া বেল্ট, মাথায় ব্রিটিশ হ্যাট, পায়ে জাংগল কেডস। পাহাড়ি জোঁকের হামলা থেকে রেহাই পেতে হাঁটু পর্যন্ত গোটানো শাদা মোজা। মাহুত সোনামিয়ারও আজ বহুবিচিত্র সাজ। পরনে খাকি ফুলপ্যান্ট, গায়ে বেনিয়ান, তার উপরে জরির কাজ করা কোটি, পায়ে নাগরা, মাথায় পাগড়ি, হাতে চাবুক। হাতী লালবাহাদুরের সাজও কম নয়। জরি বসানো মখমলের পর্দা তার পিঠে। উপরে কারুকাজ করা সুদৃশ্য হাওদা। কপালে লাল টকটকে সিঁদুর, গলায় বিশাল এক ঘণ্টার মালা। নিবলেটকে বিদায় জানাতে বাংলোর সামনে জড়ো হয়েছে বেশকিছু বিশিষ্টজন। নিবলেট হাতীতে চেপে সার্কিট হাউস যাবেন। সেখান থেকে যুবরাজ পাহলভীকে সাথে নিয়ে শিকারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। শিকারীদের বিদায় জানাতে কুমিল্লা থেকে ভাড়া করা হয়েছে চৌকস ব্যান্ডদল। জমকালো পোশাক পরা ব্যান্ডদল দাঁড়িয়ে আছে সার্কিট হাউসের সামনে। কার্নেট, সানাই, বিউগেল, ড্রাম আর ঢোলের শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।
বেশ কিছুদিন থেকে এক গোপন বিষন্নতায় ভুগছিলেন নিবলেট। সেচবিভাগ এখানে বাঁধের কাজ তাড়াতাড়ি শুরু করতে চায়। ডিসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রজেক্টের কাজে স্থানীয়দের নিয়োগ দিতে। কিন্তু স্থানীয়দের কোথায় পাবেন তিনি? নিবলেট জানে স্বাধীনচেতা পাহাড়ি লোকেরা অন্যের দাসত্ব বা গোলামি করতে নারাজ। এসব আদিবাসী জুমিয়াদের শিল্প কারখানার চাকরিতে ইতোপূর্বে আকৃষ্ট করা যায়নি। কর্ণফুলি পেপার মিলে তারা চাকরি নিতে আসেনি। মুক্তপাখির স্বাধীনতায় যাদের জীবন, চাকরির মতো নিয়মের খাঁচায় তাদের বন্দি করা অসম্ভব। পার্বত্যবাসীর সামনে এখন মহাদুর্যোগ। সে দুর্যোগ-ভাবনা নিবলেটকে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। ফলে শিকারের উল্লাস আর হিংস্রতাকে সে সাদরে গ্র্রহণ করতে পারে না। শাহজাদার সাথে শিকারে সে যেতে চায় না, এমন অভিপ্রায় লিখে জানিয়েছিল উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। কারণ দেখিয়েছিল বার্ধক্যজনিত অবসন্নতাকে। চট্টগ্রাম বন্দরের প্রকৌশল শাখায় কর্মরত এক দেশিবন্ধু কিলপ্যাট্রিককে দায়িত্ব দিয়েছিল কমিশনার অফিসে তদবির করতে। নিবলেটের চিঠি পেয়ে কমিশনার অবাক হলেন এবং রেগে গেলেন ভীষণভাবে। ইংরেজরা দুর্ধর্ষ জাতি। তাদের শিকারপ্রিয়তার কথাও সর্বজনবিদিত। কমিশনার জানিয়ে দিলো, পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিশেষ মেহমান ইরানী যুবরাজকে প্রটৌকল দেয়ার দায়িত্ব ডিসির। একজন দক্ষ অফিসার হিসাবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এরূপ চিঠি প্রেরণ করা বালখিল্যতা মাত্র। তাছ্ড়াা শিকারের মতো স্পর্শকাতর স্থানে বিদেশি মেহমানকে একাকী পাঠানো হবে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। রাষ্ট্রের একজন গুরত্বপূর্ণ অতিথিকে প্রটৌকল না দেবার দায় নিবলেট কিভাবে এড়াবেন? সরকারি চাকরিতে নির্দেশ পালন হচ্ছে বড়ো কথা। এখানে ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই।
নয়.
ডিসি বাংলোর সামনে একটা কাঠের কফিনের উপর রাখা আছে নিবলেটের নিথর দেহ। পরনের শিকারীর পোশাক রক্তে রঞ্জিত। নিবলেটের দুচোখ বোজা। ঠোঁটের কোনে যেন একটু মৃদুহাসির রেখা। শিকারী দলের অন্যতম পার্শ¦চর বান্দরবানের কানুনগো প্রভাত কুমার চাকমা লাশের পায়ের কাছে মাথা নিচু করে বসে আছে। দক্ষিণপাশে মোটা চাপালিশ গাছের সাথে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে অপরাধী লালবাহাদুরকে। হাতীর দুচোখে অবিশ্রান্ত জলের ধারা। কামিনী দেওয়ান সেন্ট্রি পোস্টের বাইরে কাঁঠালছায়ায় পায়চারি করছেন গম্ভীরমুখে। তিনিও জানেন শিকারে যেতে মোটেও ইচ্ছে ছিলো না নিবলেটের। মাত্র দুদিন আগেও নিবলেট তাকে বলেছিলো,
: যে জেলার মানুষকে আমি জলমগ্নতা থেকে রক্ষা করতে পারবো না, সে জেলার প্রশাসক হয়ে শিকার বিলাসিতা! সে-তো মানুষের অসহায় অবস্থাকে নিয়ে প্রতারণা মাত্র।
কামিনী দেওয়ান প্রভাত কুমারকে কাছে ডাকলেন,
: আচ্ছা বলতো, কীভাবে ঘটনাটি ঘটলো?
: বলতো ভারি কষ্ট হচ্ছে দাদু। ২২৪ নং চেমী মৌজার জঙ্গলে যখন সবাই পৌঁছায় তখন সূর্য গড়িয়ে গেছে পশ্চিমে। দলবল নিয়ে বেশকটি বন্য হাতী বাচ্চাকাচ্চাসহ শুয়ে বসে আছে। এসময় মূর্হুমুহ গুলির শব্দ। ৫০০ বোরের রাইফেল থেকে গুলি ছোঁড়া হলো ৮/১০ রাউন্ড। গুলি খেয়ে হাতীর দল পড়িমরি এদিক ওদিক ছুটে পালালো। এসময় লালবাহাদুর ক্ষিপ্ত হয়ে এলোমেলো পায়ে লাফালাফি শুরু করলো। মাহুত সোনামিয়া বহুকষ্টে হাতীর পিঠ আঁকড়ে বসে থাকতে পারলেও নিবলেট এবং শাহজাদা পাহলভী পড়ে গেল নিচে।
: তারপর? তারপর কী হলো?
: লালবাহাদুরের এলোমেলো দৌড়াদৌড়ির এক ফাঁকে নিবলেট সাহেবের পাঁজরের উপর হাতীর পায়ের চাপ পড়ে। এতে তার উরুস্থল সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে যায়।
ততক্ষণে চারপাশে ছোটখাট ভীড় জমে উঠেছে। অশ্রুসজল চোখে সবাই উৎকর্ণ হয়ে প্রভাত কুমার চাকমার বর্ণনা শুনছে।
: মৃত্যুর আগে কি নিবলেট সাহেব কিছুই বলেন নি?
: না-তো! তেমন কিছু বলেননি। আমরা ক’জন তাকে ধরাধরি করে একটা বড়ো গর্জন গাছের নিচে শুইয়ে দিলাম। বোতল থেকে পানি নিয়ে তার মাথায় ঢাললাম। অনেকক্ষণ বোধহয় অচেতন ছিলেন। জ্ঞান ফিরতেই আমার হাত চেপে জানতে চাইলেন “শাহজাদা বেঁচে আছেন তো?” আমি বললাম- “হ্যাঁ সাহেব, শাহজাদা বেঁচে আছেন এবং অক্ষত আছেন।” একথা শোনার পর নিবলেট সাহেব প্রশান্তভাবে চোখ বুজলেন। আর চোখ খুললেন না।
লেখক- উপপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম অঞ্চল। ৯ মে, ২০১৮।
