প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মংমংচিং: অম্লান ব্যক্তিত্ব - Southeast Asia Journal

প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মংমংচিং: অম্লান ব্যক্তিত্ব

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

অংসুই মারমা

খাগড়াছড়ি সদরে সবচেয়ে পুরাতন যে দু’একটা লোকালয় টিকে আছে এখনো, তারমধ্যে পানখাইয়া পাড়া অন্যতম। এটি মারমা জনগোষ্ঠীর পাড়াও। এ পাড়ার প্রকৃত নাম কোঁয়াইজা রোয়া। যে ব্যক্তি অনবরত পান খেতেন তাঁকে লোকে মজা করে ডাকত পাংখাইয়া। তার আসল নামটি এ পাংখাইয়ার আড়ালে হারিয়ে গেছে। পাড়ার বর্ষীয়ান কংচাই কার্বারীও তার আসল নাম জানেন না। তার নামে নাম। পাংখাইয়া থেকে পানখাইয়া পাড়া। এ পাড়ার যে কজন বেশী পরিমাণে ভূ-সম্পত্তির মালিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন, তার মধ্যে আক্য মগ একজন। এ আক্য মগ কার্বারী-হেডম্যান না হয়েও তাদের মত সামাজিক বিচার সম্পন্ন করতেন। অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে গোলা থেকে ধান দিয়ে দিতেন। তারই জ্যৈষ্ঠ পুত্র মংমংচিং মারমা। যে সময়ে এ জনগোষ্ঠীর যুবকেরা আধুনিক শিক্ষার প্রতি অবহেলা-অনীহা দেখাতো, দুরন্তপনায় পাখি শিকারে ঘুরে বেড়াতো এখানে ওখানে ওই সময়েই ম্যাট্রিকুলেট মংমংচিং। তিনি গত প্রায় পাঁচ দশক পূর্বে এ দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পিতার অমতে বিয়ে করায় যে কোন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ শেষে সরকারের কোন লাভজনক পদ গ্রহণ করেননি। কোন প্রকার সুবিধাও নেননি। তাঁর সাংসারিক জীবন কেটেছে দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে। একখন্ড জমিও তাঁর নামে বরাদ্দ ছিলনা। তিনি অন্যের খাস জমিতে মাথা গোজার একটি হাঁসফাঁস করা ঘরে বাস করেছিলেন পরিবার নিয়ে। উর্পাজন বলতে কেবল একটি ধান ভাঙার মেশিন। অনটনের মুখে বুক চিতিয়ে সংসার চালিয়েছেন হাসিমুখে। তার এ সংসার চালানোও রনাঙ্গণের লড়াই করার মত দুর্দমনীয় এক অভিযান ছিল।

এ মংমংচিং নিজ যোগ্যতা বলে জীবনের শেষ প্রান্তে খাগড়াছড়িস্থ মুক্তিযোদ্ধা সংসদে জেলা কমান্ডার নির্বাচিত হয়েছিলেন দীর্ঘমেয়াদের জন্য অর্থাৎ মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত। এ অকুতোভয়, সাহসী ও নির্লোভ ব্যক্তি আমৃত্যু প্রায় অবহেলিতই ছিলেন। রাষ্ট্র কিংবা সমাজ তাঁকে ফিরে তাকায়নি। তাই তাঁর শোক সভায় উপজেলা পর্যায়ের এক কমান্ডার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘বর্তমান আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা পর্যায়ের একজন নেতার পারিবারিক অবস্থা যে পর্যায়ে থাকার কথা ছিল, মংমংচিংয়ের অবস্থা তার বহু নীচে। তিনি তাঁর অভাবের কথা কোন দিন কাউকে জানতে দেননি। দু:খ থাকলো এই, তাঁর এ অবস্থা কাটাতে আমরা কেউ এগিয়ে যাইনি। এতটুকু সাহসও দেইনি। আমাদের এটা এক জাতীয় দীনতা নয় কি? সততা ও নির্মোহতা কাকে বলে তার পারিবারিক অবস্থা থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত । কিন্তু আমরা তেমন শিক্ষা গ্রহণ করিনি। নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে সাদা কে কালো বলি!

প্রকৃতপক্ষে মংমংচিং কারোর সহানুভূতি পাননি। এ জন্য তার একটা অভিমানও থাকতে পারে। তিনি যেমন রাষ্ট্রের কাছে কখনো কোন প্রকার সুযোগ নেননি, তেমনি কারোর কাছে হাতও পাতেননি জাগতিক স্বচ্ছলতার জন্য। অথচ এ স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা না রেখেও অনেকে নৈতিক-অনৈতিকভাবে অনেক রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন। অনেকে শুন্য থেকে কোটিপটি হয়ে গিয়েছেন। নানা রকম বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তাদের অনেকে আপন যুদ্ধের স্মৃতিচারণ ঠিকভাবে করতে পারেন না । এ সব ঘটনার খোরাক সভা-সেমিনারে এমনকি সংবাদ পত্রের পাতায়ও পাওয়া যায়। অথচ মংমংচিং বলতেন, ‘খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধারাই শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধা। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরের তকমা দিয়ে প্রকৃত বীরকে উপহাস করার শামিল। অন্তত: আমার তাই মনে হয়।’

মংমংচিং প্রথম জীবনে স্থানীয় সাতভাইয়া পাড়ায় একটি ধান ভাঙ্গার মেশিন স্থাপন করে পরিবার চালাচ্ছিলেন। পরবর্তীতে একই পেশা নিয়ে পানখাইয়া পাড়ার নিজ গ্রামে স্থানান্তর হয়ে আসেন। তার পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ চাকুরি নিয়েছেন নতুবা ব্যবসাপাতি করে একটু উন্নত জীবনের সন্ধান করেছেন। কিন্তু এ ভাগ্য তার হয়নি। এ নিয়ে তিনি কখনো বিচলিত ছিলেন না। মৃত্যুর বছর কয়েক আগে খাগড়াছড়ি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে কমান্ডার নির্বাচিত হন। এ প্রতিষ্ঠানকে তিনি কখনো নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেননি। কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণার্থে এর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। তাই সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাগণ তাকে এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। খেটে-খাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট তিনি নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন। তার পর্ণ কুটিরে এদের ভিড় লেগেই থাকতো। দু:খ করে একবার বলেছিলেন যে, একজন স্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা তিনিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের কথা বলে অর্ধ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করার পরও তার কোন শাস্তিই হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা সংসদে নিয়োজিত থাকার এক পর্যায়ে তিনি পানখাইয়া পাড়াস্থ সামাজিক সংগঠন মারমা উন্নয়ন সংসদেরও দু’দফা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। একেও চালিয়েছেন স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সাথে। আর্থিক তাড়নার মধ্যেও উক্ত দু প্রতিষ্ঠানকে সমাজের স্বার্থে পরিচালনা করেছিলেন। কখনো কালিমা লিপ্ত হতে দেননি। কিন্তু সমাজের মানুষ তাঁকে কখনো চিনতে চায়নি, বুঝতেও চায়নি। পার্বত্য চুক্তি উত্তর একবার পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াতে প্রস্তাব করা হয়েছিল, যা তিনি প্রত্যাখান করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি দরিদ্র মানুষ, অর্থ বিত্ত নাই। কারোর অর্থ সহায়তা বা করুণা নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে আমাকে চুরি করে কিংবা অবৈধ পন্থায় এ সবের প্রতিদান দিতে হতো, যা করা আমার পক্ষে কখনো সম্ভব ছিলো না। জনসেবা এখন মনোপলি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।’

মুক্তিযোদ্ধত্তোর আমরা তিন ধরণের মুক্তিযোদ্ধার কান্ডকারখানা দেখি। এক- বাংলাদেশের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যাকারীদের মধ্যেও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দ্বিতীয়-বড় একটি অংশ অনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিজেদের দৌলত বানিয়েছেন। সর্বশেষ ক্ষুদ্র অংশটি ভাগ্যের চাকা বদলাতে চাননি বা পারেননি। মংমংচিং মারমা ওই অংশরই অন্তর্গত। কিন্তু তিনি উচ্চ মানসিকতাসম্পন হয়ে উঠেছিলেন। তার উচ্চ মার্গ স্তরে মানসিকতা গঠনের প্রধান নিয়ামক হলো-মেডিটেশন বা বিদর্শনে ব্রতী হওয়া। মেডিটেশন চর্চায় তার মননে উম্মেষ ঘটেছিল। মেধা, ত্যাগ, স্মৃতিশক্তি ও বাগ্মিতার বিকাশ ঘটেছিল। তার কাছে প্রাচুর্য ছিল অর্থহীন। কিন্তু তার এ গুণকে খাগড়াছড়ির মানুষ কখনো বুঝতে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা কমান্ডার হওয়ার সূত্রে কার্যোপলক্ষে ব্রিগেডেও যেতে হতো তাকে। একবার খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের তৎকালীন রিজিয়ন কমান্ডার হাসান মসহুদ চৌধুরীকে পরখ করে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন যে, তিনি একদিন সেনাবাহিনীর প্রধান হবেন। কাকতালীয়ভাবে হলেও সত্য যে ওই কর্মকর্তা এক সময় সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময়ে মংমংচিং আর জীবিত ছিলেন না। তিনি সমাজকে নানাভাবে চর্চা করেছিলেন, পরিবর্তন আনতে পানখাইয়া পাড়ায় ‘রুয়োরা ল্যু তেথং’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে সমাজকে জাগাতে চেয়েছিলেন। কুসংস্কার, অপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলো বাদ দিয়ে যুগোপযোগীর একটা ব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সমাজ তাকে কখনো এর স্বীকৃতি দেয়নি। অবশ্য মারমা সংসদ তার অবদানের জন্য তাকে মরণোত্তর সম্মাননা দিয়েছে, যা জীবদশায় তিনি দেখে যেতে পারেননি। মংমংচিং মারমা তার মৃত্যুর দিন পনেরো আগে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে এক বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, যা আমার প্রকৃত মুল্যায়ন হতে চলেছে। সে আলামত দেখতে পাচ্ছি, যা কম্মিকালেও মানুষ দেখেনি।’ প্রকৃতপক্ষে তার বেলায় সত্য সত্য এক বড় ঘটনাই ঘটেছিল, যা কেউ কল্পনাও করেনি। তার এমন মূল্যায়নের জন্য কেউ প্রস্তুতও ছিল না। চৈত্র মাসের গভীর খরতাপের রাতে নিজ বাড়ীতে হঠাৎ হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মংমংচিং মারমা নামে এক অখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা। সুস্থ সবলদেহী ৫৩ বছর বয়সী এ মানুষ সবার অগোচরেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। সেদিন ১৫ই মার্চ ২০০৩ সাল সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তিনি হয়তো বলে গেছেন যে, তার জন্য কারোর মায়াকান্নার দরকার নেই। সত্যিই তো নিঃস্ব মানুষ নিঃস্বভাবেই বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু অতঃপর তার বাণী ফলতে শুরু করে। যার মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত কোন মূল্যায়ন হয়নি। মৃত্যুর পর হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। ফুলে ফুলে বাণীতে বাণীতে ভরে যায় তার মরদেহকক্ষ। সেদিন খাগড়াছড়িতে বড় বড় নেতাদের ভিড়ে ঠাসাঠাসি। জীবদ্দশায় যারা তাঁকে গণ্যই করেননি, তাদের অনেকেই সেখানে হাজির হয়েছেন। এই এক অদ্ভুত সামাজিক আচরণ। তবে অন্তিম মুহুর্তে বিপুল মানুষের উপস্থিতি মহান কবি মাইকেল মধুসূধন দত্তের মৃত্যুকালকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। যে মাইকেলের মরদেহ সৎকার বিতন্ডার কারণে সেসময়ে আলীপুর হাসপাতালে পঁচতে শুরু করেছিল, সেখানেও এমন জনতার হাজির হয়েছিল। মংমংচিং’র মৃত্যুতে শুধু হাজার জনতা নয় এক অনন্য অনুষঙ্গও যুক্ত হয়েছিল তাঁর বাড়ীতে। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে তার নিষ্প্রাণ দেহখানি জাতীয় পতাকায় আবৃত করা হলো। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে পুলিশের এক চৌকষ দল বিউগল বাজিয়ে গার্ড অব অনার দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হলো আর এভাবেই এক নগণ্য, অবোধ্য এক মানুষের জীবন সাঙ্গ হলো। অপান্তেয় এ মুক্তিযোদ্ধা এমন এলাহী সম্মান কখনো চাননি। কারণ রাষ্ট্র ও সমাজ তার জীবনকালে এতটুকুই এগিয়ে যায়নি। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাকে মনে রেখেছে তার কৃতকর্মের জন্য এটাই তাঁর সার্থকতা হয়তো!

অংসুই মারমা: সাবেক ফিল্ড সুপারিনটেনডেন্ট, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড।