মহা-সংকটের অক্সিজেন

মোঃসাইফুল ইসলাম
এক.
আমরা জানি, বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ৮ মার্চ। এর পর দিন থেকে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ক্রমে বাড়ছে। আজ ( ৮ এপ্রিল, ২০২০) পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ২০জন, আক্রান্ত হয়েছেন ২১৮জন। সিভিল এভিয়েশনের প্রাথমিক এক হিসাবে জানা যায়, গত দুই মাসে বিভিন্ন পথে দেশে এসেছে প্রায় ৭ লাখ লোক। যারা ছড়িয়ে পড়েছেন সারাদেশে। এদেরকে বিমানবন্দরে, স্থল বন্দরে প্রাথমিক পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হলেও বেশিরভাগই তা মানেননি। হয়তো পরিস্থিতি এতো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে তা বিদেশ ফেরত লোকজনের চিন্তাতেও আসেনি। দেশ জুড়ে ঘরবন্ধী হয়ে পড়েছে মানুষ। কর্মহীন অবস্থায় সবাই । পরিবার-পরিজন নিয়ে যেন এক দীর্ঘ আঁধারে পড়েছেন শ্রমজীবী, স্বল্পআয়ের লোকজন ও মধ্যবিত্তরা। চারদিকে মৃত্যুর আতঙ্কে আতঙ্কিত বিত্তশালীসহ সবাই। দেশের সব জেলা বর্তমানে লকডাউনে। চলাচল ও সকল ধরণের যোগাযোগ বন্ধ। অচল হয়ে পড়েছে সকল ব্যবস্থা। উত্তরণে কিংকর্তব্যবিমুঢ় সবাই। কিন্তু সরকার প্রধান মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের কল্যাণে কাজ করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছেন। দেশের মানুষকে প্রাণঘাতি করোনার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে দেশ জুড়ে দুর্যোগকালীন এই মুহর্তে সেনাবাহিনী মোতায়েন। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে করোনা মোকাবিলার কার্যক্রম শুরু হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি এসেছে। মহাসংকটের আঁধারে যেন মানুষ অক্সিজেন পেয়েছে, বাঁচার আলো পেয়েছে-নিশ্বাস নিতে পারছে।

দুই.
আমরা সকলেই জানি এবং বিশ্বাস করি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন অস্থীতিশীল দেশে শান্তিমিশনে কর্মরত থাকাকালীন বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমন শুরু হবার আগেও বিভিন্ন সময় বন্যা, খরা, সাইক্লোন, পাহাড় ধস, ভুমিকম্প, অগ্নিকান্ড, ঘুর্ণিঝড়, অস্থীতিশীল রাজনৈতিক কর্মকান্ডসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম দুর্যোগ মোকাবেলায় সেনাবাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের সাথে কাজ করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল এবং সেনাবাহিনীর সদস্যগণ সেই দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেছে।
সুশীল সমাজের লোকজন মনে করেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা বেসামরিক প্রশাসনের সাথে কাজ করার সময় কারো (জনগণের) প্রতি রাগ বা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি; বরং নিয়ম-নীতি অনুযায়ী নির্মোহভাবে কাজ করেছে, তাছাড়া অনিয়মসহ নানা কারণে সিভিল প্রশাসন বা অন্য বাহিনীর লোকজনের নির্দেশনা সাধারণ মানুষরা শুনতে চায়না, মানতে চায়না। কিন্তু সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে সাধারণত তেমনটি করেনা, কারণ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা সৎ-নির্ভীক এবং দেশপ্রেমিক এবং তাদের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস বেশি। দেশের জনগণ মনে করেন মহা-সংকটের এই দিনে দেশ প্রেমিক সেনাসদস্যগণ আঁধার সরিয়ে আলো নিয়ে আসবেন।
তিন.
বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকেরা জানেন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করে দেশের মানুষকে নিরাপদ ও সুস্থ রাখার জন্য বিগত ২৪ মার্চ হতে সারাদেশে দায়িত্ব পালন শুরু করেছে সশস্ত্র বাহিনী। বর্তমানে দেশের ৬২ জেলায় ৫৪৬টি সেনাদল বেসামরিক প্রশাসনের সাথে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। দলগুলো করোনাভাইরাসে মৃত, আক্রান্ত ও সুস্থ হয়ে উঠা ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত করার পাশাপাশি বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টিনে বা আইসোলেশনে থাকা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনের পদক্ষেপে সহায়তা ও সমন্বয় করছে এবং জেলাপর্যায়ে প্রয়োজনে মেডিকেল সহায়তাও প্রদান করে যাচ্ছে।
এছাড়া সেনাবাহিনীর দলগুলো করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি, সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, গণজমায়েত বন্ধে জোরালো মনিটরিং চালু করা, দরিদ্র-অসহায় ও সংকটাপন্ন লোকজনের মাঝে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী বিতরণ, পৌঁছে দেওয়া ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রগুলোও দেখভাল এবং দায়িত্বে যেসব ব্যক্তি থাকবেন তাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) সংখ্যা ঠিক করা ও নিশ্চিত করার কাজ করছেন।

সুশীল সমাজের নেতারা মনে করেন যেকোন দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনাবাহিনী তাদের অভিজ্ঞতা, পূর্ব প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণের মতো অনুষঙ্গকে মাথায় রেখে সব সময় কাজ করে বিধায় খুব সহজেই সফলতা আসে। তাছাড়া শক্ত চেইন অব কমান্ডের কারণে বেসামরিক প্রশাসনের সাথে কাজ করা কালীন কোন দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও আত্মীয়করণে জড়ায় না সেনাবাহিনীর সদস্যরা। যেহেতু পরিকল্পনা মাফিক সময়ের কাজ সময়ে করতে সক্ষম সেনা সদস্যরা, সেহেতুৃ প্রাণঘাতি করোনা প্রতিরোধে বেসামরিক প্রশাসনের সাথে কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া জনপ্রত্যাশিত ও সময়োপযুগী। সেনাবাহিনীর নেওয়া প্রতিটি উদ্যোগ ফল দিবে এবং জাতিকে চলমান করোনাসংকট হতে উত্তরণে পথ দেখাবে-এই বিশ্বাস আমাদের সবার আছে।
চার.
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। বিগত ৪৯ বছর ধরে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সেনাবাহিনী একটি পরিণত বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিগত ৪৯ বছরে করোনাসংকটসহ ৩৪ বার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মাঠ পর্যায়ে সম্পৃক্ত থেকে বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে জনগণকে সহায়তা দিয়ে গেছে বিভিন্ন সময়ে উদ্ভুত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য। দেশ, দেশের জনগণের পাশাপাশি দেশের বাইরে ২০০৮ সালে সাইক্লোন নারগিসের জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র মায়ানমারে, ২০১০ সালে হাইতিতে, ২০১১ সালে জাপানে এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে নেপালে ভূমিকম্পের সহায়তা প্রদান করার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অনস্বীকার্য ভুমিকা রাখে। মেধা, প্রজ্ঞা, দুরদর্শীতা ও শাররিক শ্রম দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি সেনা সদস্যরা। জনগণের দোরগোড়ে মানবিক সেবা পৌঁছে দিতে, নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সব পদবীর সদস্যদের একদিনের বেতনের পাশাপাশি সেনা কল্যাণ সংস্থা, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড, বাংলাদেশ ডিজেল প্ল্যান্ট লিমিটেড ও ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের পক্ষ থেকে সর্বমোট ২৫ কোটি টাকা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিলে দেওয়া হয়েছে। শুধু দেশের অখন্ডতা রক্ষায় নয়, দেশের মানুষকে সুখ-শান্তি, বিপদ-আপদ মুক্ত রাখতে দুর্যোগকালীন মুহর্তে তথা করোনার মহাসংকটের এই সময়ে কান্ডারীর ভুমিকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। দেশবাসী জানেন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে বিগত ২৪ মার্চ হতে সারাদেশে দায়িত্ব পালন শুরু করেছে সেনাবাহিনী। বর্তমানে দেশের ৬২ জেলায় ৫৪৬টি সেনাদল বেসামরিক প্রশাসনের সাথে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষন করে যতটুকু জানা যায়, সেনা দলগুলো করোনাভাইরাসে মৃত, আক্রান্ত ও সুস্থ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত করার পাশাপাশি বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টিনে থাকা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনের পদক্ষেপে সহায়তা ও সমন্বয় করেছে এবং জেলাপর্যায়ে প্রয়োজনে মেডিকেল সহায়তা ও দিচ্ছে। এছাড়া সেনাবাহিনী দলগুলো করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি, সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, গণজমায়েত বন্ধে জোরালো মনিটরিং চালু করা, সন্দেহজনক ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা পর্যালোচনায় বিভাগীয় এবং জেলা শহরগুলোতে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিচ্ছে। সেনাবাহিনী বিশেষ করে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের কেউ নির্ধারিত কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক সময় পালনে ত্রুটি বা অবহেলা করছে কিনা, তাও পর্যালোচনা করছে। আর দেশের জনগণ মনে করেন দুর্যোগ কালীন সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ”কান্ডারীর” ভুমিকা পালন করবেন এবং মহা-সংকট হতে জাতিকে অক্সিজেন দিয়ে উদ্ধার করবেন, বাঁচিয়ে রাখবেন।
পাঁচ.
গত ১লা এপ্রিল সকালে বৈশ্বিক মহামারী করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয় নির্ধারণে সেনাবাহিনী শীর্ষক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সীর সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন করোনা মোকাবেলায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যা যা করা প্রয়োজন, তাই করা হবে। প্রয়োজনে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী আরো সেনা মোতায়েন করা হবে এবং যতদিন প্রয়োজন ততদিন সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের এই বক্তব্যও জাতিকে অক্সিজেন দিয়েছে। তাছাড়া সেনাবাহিনীর করোনা প্রতিরোধে চলমান কার্যক্রমেও আশার আলো ছড়িয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনালয় স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে খাদ্য সংকটসহ জনগণের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর চাহিদা দুর করতে কাজ করছে। বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধির বিরূদ্ধে খাদ্য-শস্য আত্মসাৎ করা, চুরি করা, ওজনে কম দেওয়া, উৎকোচ গ্রহণ করা, ছবি তুলে ত্রাণের সামগ্রী ফিরিয়ে নেওয়া, সুবিধাভোগীগণ তাদের পন্থী নয়সহ নানা অভিযোগ উঠেছে। একদিকে প্রাণঘাতি করোনায় যখন মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত, অন্যদিকে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের নানা অনিয়মের কারণে আজ করোনার মতো মহা-সংকটে দেশের জনগণ। সরকার ও প্রশাসন যখন জনকল্যানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জনগণের ঘরে পৌঁছার চেষ্ঠা করছেন-তখন জনপ্রতিনিধিদের বিতর্কিত কর্মকান্ডে হতাশ দেশের জনগণ, বিব্রত প্রশাসন। তাই এইমুহর্তে দেশের জনগণের দাবী খাদ্যশস্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী বিতরণের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেওয়া হোক। সেনাবাহিনীর সদস্যগণ এই দায়িত্ব পালন করলে, চলমান সকল প্রকারের অনিয়ম-দুর্নীতি দুর হবে, জনগণ পাবে তাদের প্রত্যাশিত সেবা। সিঁড়ি পাবে মহাসংকট হতে উত্তরণের।