পাকুয়াখালী ট্রাজেডি, ২ যুগেও হয়নি বিচার
নিউজ ডেস্ক
আজ ৯ সেপ্টেম্বর, পাকুয়াখালী ট্রাজেডি দিবস। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিহাসে শোকাবহ এক কালোদিন। ১৯৯৬ সালের এই দিনে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের প্রাক্কালে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার লংগদু উপজেলার পাকুয়াখালীর গহীন অরণ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনীর হাতে নির্মম ও বর্বরোচিতভাবে প্রাণ হারায় ৩৪ জন নিরীহ বাঙালী কাঠুরিয়া। সেই থেকে পার্বত্য এলাকায় বাঙ্গালীরা এ দিনটিকে পাকুয়াখালী ট্রাজেডি হিসেবে শোক দিবস পালন করে আসছে।
প্রতিদিন শত শত পাহাড়ি এবং বাঙালি কাঠুরিয়া শান্তিবাহিনীকে চাঁদা দিয়ে বাঁশ এবং গাছ কাটতে যেত পাহাড়ে। লোকজন পাহাড়ে গিয়ে গাছ, বাঁশ কেটে নিয়মিত চাঁদা দিয়ে ফিরে আসত প্রতিদিন। চাঁদা আদায়সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য মাঝে-মধ্যে পাহাড়ে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঠুরিয়াদের বৈঠক হতো। ১৯৯৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপ শান্তিবাহিনী লংগদুর ৩৫ জন কাঠুরিয়াকে প্রতারণা করে ব্যবসায়িক হিসাবের বৈঠকের কথা বলে পাকুয়াখালীর গহীন অরণ্যে যেতে বলে। এই বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য কাঠ ব্যবসায়ীদেরও নেয়ার জন্য শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়। শান্তিবাহিনীর কালেক্টর লংগদু থানার মাইনিমুখ বাজারে এসে ব্যবসায়ীদের চিঠির মাধ্যমে বৈঠকে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু ইতিপূর্বে কোনো বৈঠকে ব্যবসায়ীদের এভাবে গুরুত্ব দিয়ে ডাকা হয়নি। ফলে ৯ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে ব্যবসায়ীদের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ায় ব্যবসায়ীরা বিষয়টি এড়িয়ে যায়। কিন্তু কাঠুরিয়ারা প্রতিদিনের মতো সেই দিন সকাল বেলা স্বাভাবিকভাবেই পাহাড়ে প্রবেশ করতে শুরু করে। তখন শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদেরকে জানানো হয়, বড়বাবু আজ সবার সঙ্গে মিটিং করবেন। তাই আগে মিটিংয়ে যেতে হবে, এরপর যে যার কাজে যাবে। প্রতারণা করে সেদিন কাঠুরিয়াদের জঙ্গলে নিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে অপহরণ করা হয়। সেখানে তিন দিন কাঠুরিয়াদের হাত-পা ও চোখ বেঁধে নির্যাতন চালিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় ৩৪ জন কাঠুরিয়াকে। এর মধ্যে ইউনুছ নামের একজন কাঠুরিয়া পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়, পরে তার ভাষ্যমতে ৯ সেপ্টেম্বর পুলিশ ও সেনাবাহিনী পাকুয়াখালী হতে ২৮ জন কাঠুরিয়ার ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে। বাকি ৬ জন কাঠুরিয়ার লাশ পাওয়া যায়নি। বর্বর এ হত্যাকান্ডের স্মরণে এখনো শিউরে ওঠে লংগদুর মানুষ।
বর্বর এই হত্যাকান্ড থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরত আসা একমাত্র ব্যক্তি ইউনুছ তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘‘বাড়িতে আসার পর আর্মিরা যহন জানলো যে আমাকেও শান্তি বাহিনী ধরে নিয়া গিয়াছিল, তহন তারা লাশের সন্ধান করার জন্য আমাকেও সাথে নেয় পথ দেখানোর জন্য। আমি তাদের পাহাড়ে নিয়া গেলাম। ঘটনার সময় তক্তা নজরুলের যেইখানে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়া ফালাইয়া দিছিল, সেইখান থাইকা আরেকটু সামনে গিয়া, বাম দিকে প্রায় এক দেড়শ গজ সামনে গিয়া দেখলাম, একটা বাঁশের বেড়া। নীচে নাইমা সেই বেড়া পার হইলাম। তারপর আর রাস্তার চিহ্ন নাই। একটু দূরে দেখলাম একটা কাঁচা বাঁশের কঞ্চি আধ ভাঙ্গা অবস্থায় ঝুইলা রইছে। কঞ্চিটা সরানোর পর একটা পথ পাইলাম। পথ দিয়া সামনে গিয়া দেখি সরাফুদ্দি ভাইয়ের টুপিটা একটা কঞ্চির লগে বাইজা রইছে। এর পর স্যান্ডেল, মদের টেংকি, বেশ কয়ডা লাডিও দেখলাম, তারপর দেখলাম আলাল ভাইয়ের লাশ। আরেকটু সামনে গিয়া দেখি বিশাল জায়গা জুইড়া শুধু লাশ আর লাশ কেউরে চেনা যায় না। বন্দুকের সামনের যে চাকুটা (বেয়োনেট) থাকে এইডা দিয়া খোঁচাইয়া খোঁচাইয়া মারছে। কেউরে চেনা যায় না। লাঠি দিয়া পিটাইয়া, দা দিয়া কুবাইয়া, কুইচ্যা মারার শিক দিয়া পারাইয়া, চোখ তুইলা, আরো কতোভাবে যে কষ্ট দিয়া মারছে তা কইয়া শেষ করন যাইবো না। ঐ কথা মনে হইলে আজো শরীরের পশম খারাইয়া যায়।’’
ইউনুছের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, এ হত্যাকান্ড কতটা পৈশাচিক ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত অনেকগুলো বড় ধরনের হত্যাকান্ডের মধ্যে বর্বরতম এ হত্যাকান্ডের প্রায় ২ যুগ অতিবাহিত হলেও এখনো এ ঘটনার বিচার হয়নি।
১৯৯৬ সালে সংঘটিত এ হত্যাকান্ডের পর প্রতিবাদে উত্তাল রাঙামাটিতে এসে তৎকালীন সরকারের চারজন সিনিয়র মন্ত্রী নিহত কাঠুরিয়াদের লাশ সামনে নিয়ে জনতাকে এ হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কথা দিয়েছিলেন যোগ্য ক্ষতিপূরণ দেয়ারও। তাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, শিল্প মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, পানি সম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এবং শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রী এম. এ. মান্নান। তারা লংগদু থেকে ফিরে আসার পর তৎকালীন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সুলতান মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি ৩১ অক্টোবর ’৯৬ ইং বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে তাঁদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। তবে ১ নভেম্বর ১৯৯৬ দৈনিক জনকণ্ঠের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, উক্ত প্রতিবেদনে শান্তিবাহিনীকেই পাকুয়াখালী ট্রাজেডির জন্য দায়ী করা হয়েছে। এরপর অতিক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২যুগ। নিহতদের পরিবার সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ পেলেও তা নিতান্তই কম। সে হত্যাকান্ডের মৃত্যুকূপ থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা ইউনুছ তখনই বাদী হয়ে নিয়মিত মামলা রুজু করেছিলেন, মামলা হয়েছিল সরকারিভাবেও। তক্তা নজরুল থেকে শুরু করে নিহত কাঠুরিয়াদের স্বজনরা হত্যাকান্ডের বিচার না পেয়ে চরম হতাশায় দিনাতিপাত করছেন, অমানবিক জীবন যাপন করছে নিহত কাঠুরিয়াদের পরিবার পরিজন।
এদিকে দিবসটি স্মরণে এবারো বাঙ্গালীরা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। লংগদু উপজেলায় স্থানীয় বাঙ্গালীরা শহীদদের কবর জিয়ারত, শোক সভা ও দোয়া মাহফিল এবং পার্বত্য-বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে শহরে শোক সভা ও মিলাদ মাহফিল কর্মসূচি পালন করবে বলে জানা যায়।