প্রত্যাহারকৃত ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে এক ডজন হত্যা মামলা, দুদকে বোনের অভিযোগ
 
নিউজ ডেস্ক
কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত ও প্রত্যাহারকৃত টেকনাফ পুলিশের সাবেক ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে মোট ১৫ জনকে কথিত ক্রসফায়ারের নামে হত্যার অভিযোগ এনে বিভিন্ন থানায় অন্তত ডজনখানেক হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। সবশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে আরো দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, গত ১০ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (টেকনাফ-৩) হেলাল উদ্দীনের আদালতে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়ার আবদুল আমিন ও হোয়াইক্যংয়ের মুফিজ আলম নামের দুজনকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যার অভিযোগ এনে ওসি প্রদীপসহ ৫৬ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মোট ১২টি হত্যা মামলা দায়ের করা হলো।
এর আগে গত ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এরপর ৫ আগস্ট কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করেন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এতে নয়জনকে আসামি করা হয়। এটিই ছিল প্রদীপের বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলা। এরপর তার বিরুদ্ধে গত ১৮ আগস্ট চাহিদামতো ঘুষ দেওয়ার পরও এক ব্যক্তিকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার অভিযোগ এনে প্রদীপ কুমার দাসসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করা হয়। এই মামলাটি করেন টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার এলাকার গুল চেহের। গত ২৬ আগস্ট এক প্রবাসীকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার অভিযোগ এনে তাঁর ভাই কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনের আদালত-৩-এ ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে আরেককটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দীপক চন্দ্রকে প্রধান আসামি করে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাসকে ২ নম্বর আসামি করা হয়েছে। এটি ছিল প্রদীপের বিরুদ্ধে তৃতীয় হত্যা মামলা। ২৭ আগস্ট টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের সানোয়ারা বেগম বাদী হয়ে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হেলাল উদ্দিনের আদালতে ১২ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এই হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। তিনি তাঁর স্বামী আব্দুল জলিলকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার অভিযোগে মামলা করেন। গত ৩১ আগস্ট কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. হেলাল উদ্দীনের আদালতে মামলাটি দায়ের করেন টেকনাফ উপজেলার রঙ্গিখালী এলাকার বাসিন্দা সুলতানা রাবিয়া মুন্নী। টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাইঙ্গ্যা ঘোনা এলাকার বাসিন্দা কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত মুছা আকবরের (৩৫) স্ত্রী শাহেনা আকতার বাদী হয়ে গত ২ সেপ্টেম্বর এই মামলাটি করেন। এটি ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে ষষ্ঠ হত্যা মামলা। গত ২ সেপ্টেম্বর তিনি কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (টেকনাফ-৩) হেলাল উদ্দীনের আদালতে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কাঞ্জরপাড়া এলাকার ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত সাহাব উদ্দিনের (৩০) বড়ভাই হাফেজ আহমদ হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর ২রা সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার মো. ফারুক ও তাঁর ছোটভাই আজাদকে অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি ও হত্যার অভিযোগে চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন নাহার রুমীর আদালতে মামলাটি দায়ের করেন নিহতদের ছোট বোন রিনা সুলতানা শাহীন।গত বছরের ১৯ মার্চ বীজ ও সার আনতে কৃষি অফিসে যান ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মদ। সেখান থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে তাঁর পরিবারের থেকে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি প্রদীপসহ অন্যরা। এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আরো একটি মামলা করা হয়। ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর টেকনাফ থানার একদল পুলিশ মো. আজিজ আহমদ, নূর হাসান ও আবুল খায়ের নামের তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়। পরে আজিজের পরিবার থেকে ২০ লাখ টাকা দাবি করে ওসি প্রদীপসহ অন্যরা। টাকা না দিলে আজিজকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়। নিরুপায় হয়ে ৫০ হাজার টাকা পুলিশকে দেয় আজিজের পরিবার। কিন্তু ১৯ অক্টোবর রাতে টেকনাফের মহেশখালীয়াপাড়া নদীঘাট এলাকায় আজিজকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। এটি ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে দশম হত্যা মামলা। নির্যাতন, চাঁদাবাজি, অপহরণের অভিযোগ এনে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে এই মামলাটি করেন কক্সবাজারের স্থানীয় জনতারবাণী ডটকম ও দৈনিক কক্সবাজার বাণী পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ফরিদুল মোস্তফা খান। তিনি গত মঙ্গলবার কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালত-৪-এ মামলাটি দায়ের করেন। এছাড়া, গত ১২ আগস্ট মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নে ২০১৭ সালে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী হামিদা আক্তার (৪০) বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। এই মামলার আসামিদের মধ্যে প্রদীপ ছাড়াও আরো পাঁচজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। ঘটনার সময় প্রদীপ কুমার দাশ মহেশখালী থানার ওসি ছিলেন। পরের দিন অর্থাৎ ১৩ আগস্ট মহেশখালীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন। তবে ওই ঘটনায় তিন বছর আগে পুলিশের দায়ের করা মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্তের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
অন্যদিকে, ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে কোটি টাকার সম্পত্তি জবর দখলের অভিযোগ করেছেন তার সৎ বোন রত্নাবালা প্রজাপতি। মঙ্গলবার দুদক সমন্বিত অঞ্চল, চট্টগ্রাম-১ এর কার্যালয়ে কোটি টাকার সম্পত্তি জবর দখলের অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। জানা গেছে, অভিযোগটি অনুসন্ধানের অনুমতি চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে। দুদকের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন শুক্রবার (১১ সেপ্টেম্বর) এ তথ্য জানান।
অভিযোগে বলা হয়, প্রদীপ তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে চট্টগ্রাম মহানগরীর মুরাদপুর মোহাম্মদপুর এলাকায় রত্নাবালার ১২ শতক জমি ও একটি চার তলা ভবন দখল করে নেয়। এর মধ্যে ১২ শতক জমিটি প্রদীপ তার স্ত্রী চুমকি কারনের নামে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকায় কিনেছেন বলে রেজিস্ট্রি বায়না করা হয়। কিন্তু বায়না অনুযায়ী একটাকাও পাননি রত্নাবালা। অভিযোগের বিবরণে রত্নাবালা বলেন, আমার বাবা ছিলেন প্রেমলাল প্রজাপতি। মা যুগলরানী প্রজাপতি। আমরা দুই বোন। বোনটি অল্প বয়সে মারা যায়। আমার বাবার মৃত্যুর পর হরেন্দ্র লাল দাশ নামে এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেন মা। ওই সংসারে প্রদীপসহ তিন সন্তান রয়েছে। উত্তরাধীকার হিসেবে বাবার ১২ শতক জমি ও চার তলা ভবনটির একমাত্র মালিক আমি। কিন্তু ২০১৪ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর প্রদীপ দাশ ওই জমি জোরপূর্বক দখল করে নেন। পরবর্তীতে ভয়ভীতি দেখিয়ে তার স্ত্রী চুমকি কারনের নামে রেজিস্ট্রি বায়না করে নেন। এতে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকায় ওই জমি বায়না করেছে বলে উল্লেখ করা হলেও তার একটি টাকাও দেননি প্রদীপ। ওই জমিতে প্রদীপ ৯টি সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, পরবর্তী সময়ে প্রদীপ পৈতৃক সূত্রে পাওয়া মুরাদপুর এলাকার চার তলা ভবনটিও দখল করে নেন। প্রদীপ তার কুকর্মের সহযোগী আলী আকবর নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে ওই বাড়িটি বর্তমানে দখলে রেখেছেন। আলী আকবর ইয়াবা মামলায় ৯ মাস জেলও খেটেছেন।
রত্নাবালা বলেন, সম্পত্তি দখল করতে প্রদীপ আমার ছেলে বিবেক রঞ্জন চৌধুরীকে সাজানো নারী নির্যাতন মামলার আসামি করেছে। নিলুফা নামে টেকনাফের এক নারীকে দিয়ে এ মামলাটি করায়। মামলায় আমার ছেলেকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। আমার মেয়ে বেবী চৌধুরীকেও নানা লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। তাদের হামলায় বেবী চৌধুরী আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তিও ছিল।
প্রসঙ্গত, প্রসঙ্গত, গত ৩১শে জুলাই দিনগত রাতে কক্সবাজারের টেকনাফ থানার শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় প্রদীপ কুমার দাশসহ ১০ পুলিশ সদস্য কক্সবাজার কারাগারে রয়েছেন।
