তিন পাহাড়ি নদী খননে প্রকৌশল জরিপ ব্যয় ৬ গুণ বেশি
 
                 
নিউজ ডেস্ক
কর্ণফুলী, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী। দেশের তিন পাহাড়ি নদী। নদীগুলো কোথাও কোথাও নাব্য হারিয়েছে, কোথাও আবার দখলের কবলে। তাই খনন ও পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রকল্পে প্রতি ঘনমিটারে প্রকৌশল জরিপ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। বর্তমানে চলমান একই ধরনের সমতলের একটি প্রকল্পে এই ব্যয় ২২ হাজার টাকা। পাহাড়ি নদী হওয়ায় একই খাতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ব্যয় ধরেছে প্রায় ছয় গুণ বেশি।
পাহাড়ি তিন নদী সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও কর্ণফুলীর রাঙ্গামাটি-মারিশ্যা ও রাঙ্গামাটি-থেগামুখ নৌপথ খননের মাধ্যমে নাব্য উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার করা হবে প্রকল্পের আওতায়।
বিআইডব্লিউটিএ-এর প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা কার্যপত্র তৈরি করেছে। সভায় প্রশ্ন এসেছে প্রকৌশল জরিপসহ অন্যান্য খাতের বাড়তি ব্যয় নিয়ে। প্রকল্পের আওতায় এ তিন পাহাড়ি নদীর নাব্য উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধারে মোট প্রকৌশল জরিপ কাজ হবে ৪১ দশমিক ৬৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায়।
অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন মতামত দিয়েছে, অন্যান্য সমজাতীয় প্রকল্পে প্রকৌশল জরিপ ব্যয় অনেক কম। এ তিন নদীর ক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় বাড়ার কারণ ও ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণের বিষয়ে মত দিয়েছে কমিশন। বিষয়টি আগামী পিইসি সভায় উঠতে পারে।
তবে বিআইডব্লিউটিএ বলছে, অন্যান্য নৌপথের সঙ্গে এ তিন নদীর তুলনা করলে হবে না। কারণ, এ তিনটি নদী পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। এখানে প্রকৌশল জরিপ কাজ একদিকে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনই আছে শঙ্কাও। দুর্গম এলাকায় নৌপথ খনন ও প্রকৌশল জরিপ তুলনামূলকভাবে কঠিন। ড্রেজিং করা ও মাটি ফেলাও সহজ নয়। থাকে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ, যা সমতলে থাকে না। এসব কারণে এ তিন নদীর প্রকৌশল জরিপসহ অন্যান্য খাতে বাড়তি ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাহাড়ি এলাকার নদী আর সমতলের নদীকে সমজাতীয় বলা সমীচীন হবে না।
সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো. আবদুল মতিন জাগো নিউজকে বলেন, যে কোনো পাহাড়ি এলাকায় কাজ করা কঠিন। যেমন- সাঙ্গু নদীতে ড্রেজিং ও জরিপ চালানো বেশ চ্যালেঞ্জিং। মাটি খনন ও সেই মাটি ফেলাও দুরূহ। এছাড়া অনেক ড্রেজিং জাহাজ সাঙ্গু নদীতে যেতে পারবে না। এতে বিকল্প পথ দেখতে হবে। যেখানে ব্যয়ও হবে অতিরিক্ত। এসব কারণে সমতলের অন্যান্য নদীর চেয়ে পাহাড়ি এলাকার নদীগুলোর ক্ষেত্রে কিছু কিছু খাতে একটু বাড়তি ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে।
অন্যান্য চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে বেসরকারি ড্রেজার দিয়ে প্রতি ঘনমিটার ড্রেজিংয়ে ১৮০-২৫০ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হলেও প্রস্তাবিত প্রকল্পে ধরা হয়েছে ৩৫০ টাকা। চলমান প্রকল্পে মাটির ডাইক নির্মাণে ৭০-৮০ টাকা ব্যয় হলেও প্রস্তাবিত প্রকল্পে ধরা হয়েছে ১২০ টাকা।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে ১০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ২ হাজার ১৩০ কিলোমিটার হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের প্রস্তাব করা হয়েছে। আবার পরামর্শক খাতের এ হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের দ্বৈততা সম্পর্কে পিইসি সভায় আলোচনা হবে।
প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য অভ্যন্তরীণ নৌপথে গুরুত্বপূর্ণ তিন নদীতে সারাবছর নৌযানসমূহের নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা। পণ্য ও যাত্রীবাহী উভয় নৌযানই চলাচল করবে। এ লক্ষ্যে নদীগুলোর নাব্য উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধারের জন্য খননসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা হবে। প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় ১ হাজার ২৬১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন মেয়াদে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ হয়েছে।
প্রকল্পটি চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, চাপানাইশ, সাতকানিয়া, রাঙামাটির বরকল, জুরাছড়ি, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি সদর, বান্দরবানের আলিকদম, বান্দরবান সদর, লামা, রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি এবং কক্সবাজারের চকরিয়া ও মহেশখালী উপজেলায় বাস্তবায়ন হবে।
বিআইডব্লিউটিএ জানায়, বাংলাদেশের নদীগুলোতে প্রতি বছর বন্যায় ৫ মিলিয়ন কিউসেক (পানিরপ্রবাহ পরিমাপের একক) পানি ও ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন টন পলি পরিবাহিত হয়, যা পুরো বিশ্বের পরিবাহিত মোট পলির সাড়ে ১৮ শতাংশ। বিপুল পরিমাণ পলি পরিবাহিত হওয়ায় নদীগুলো ধীরে ধীরে মৃতপ্রায় ও নৌপথের নাব্যও কমছে। এ অবস্থায় নাব্য ফেরানোর লক্ষ্যে সাঙ্গু, মাতামুহুরী এবং কর্ণফুলী নদীর রাঙ্গামাটি-মারিশ্যা ও রাঙ্গামাটি-থেগামুখ নৌপথে এ প্রকল্পের প্রস্তাব এসেছে।

সাঙ্গু নদী
সাঙ্গু নদীর উৎপত্তি মিয়ানমারের আরাকান পর্বতশৃঙ্গ। পাহাড়ি এ নদী বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জেলার থানচি, রোয়াংছড়ি ও বান্দরবান শহর পর্যন্ত নদীটি প্রথমে উত্তর দিকে এবং পরে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও বাঁশখালী উপজেলা হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে।

মাতামুহুরী নদী
মাতামুহুরী বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে পাহাড়ি এলাকায় লুসাই পাহাড় থেকে এ নদীর উৎপত্তি। উৎপত্তি স্থান থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে আলীকদম ও লামা উপজেলা নিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিম দিকে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার দিকে প্রবাহিত হয়েছে এ নদী।

কর্ণফুলী নদী
কর্ণফুলী বাংলাদেশ ও ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান এ নদী ভারতের মিজোরাম এলাকার লুসাই পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার বুশান ছড়া ইউনিয়নের থেগামুখ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে রাঙ্গামাটি সদরের কাছে বালুখালী ইউনিয়নে কাপ্তাই লেকে পড়েছে। পরবর্তীসময়ে আবার কাপ্তাই হয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার কাছে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এ নদীর মোহনায় দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর অবস্থিত। নদীটির দৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার। কর্ণফুলী নদীর রাঙ্গামাটি-মারিশ্যা ও রাঙ্গামাটি-থেগামুখ পর্যন্ত নাব্য ফেরানো হবে।
প্রকল্পের প্রস্তাবিত প্রধান কার্যক্রম
প্রকল্পের আওতায় থাকছে কনসালটেন্সি সেবা। ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হবে ১৮১ লাখ ঘনমিটার। এছাড়া ৮৫ লাখ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং বা মৌলিক খনন করা হবে। হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ হবে ২ হাজার ১৩০ কিলোমিটার। ২৩ লাখ ঘনমিটার মাটির ডাইক নির্মাণ হবে। ৩৬ দশমিক ২৬ লাখ ঘনমিটার সংরক্ষণ ড্রেজিং ও ৫ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার ব্যাংক প্রতিরক্ষামূলক কাজ করা হবে।
এদিকে প্রকল্পের বেশকিছু খাতের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। পরামর্শক খাতের অফিস ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, প্রিন্টার/কম্পিউটার সামগ্রী ও প্লটের ভাড়া, চেয়ার-টেবিল ও এসি কেনা, মাঠ পরিদর্শনে অন্তর্ভুক্ত, হোটেল ভাড়া ও ট্রান্সপোর্ট খাতে ব্যয় বরাদ্দ প্রস্তাবের যৌক্তিকতা, পরামর্শকদের বেতন-ভাতা ও জনমাস বাবদ বরাদ্দ যৌক্তিকভাবে নির্ধারণের বিষয়ে মত দিয়েছে কমিশন। প্রকল্পের আওতায় ১২ জন কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিপরীতে ২০টি কম্পিউটার (১০টি কম্পিউটার ও ১০টি ল্যাপটপ), ১৪টি প্রিন্টার (প্রিন্টার ১০টি ও ই-প্রিন্টার চারটি), চারটি ফটোকপিয়ার, চারটি স্ক্যানার, ছয়টি ফ্যাক্স কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে নদীখনন সংস্থার একটি প্রকল্পে এত বেশি সংখ্যক কম্পিউটার সামগ্রী কেনার যৌক্তিকতা নিয়ে আগামীতে পিইসি সভায় আলোচনা হবে বলে জানা যায়।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে একটি জিপ, দুটি পিকআপ ও পাঁচটি মোটরসাইকেল কেনারও প্রস্তাব রয়েছে। তবে কমিশন শুধু একটি জিপ কেনায় সায় দিয়েছে।
