হ্রদ-পাহাড়ের বুকে চিরশায়িত বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ
 
                 
ইয়াছিন রানা সোহেল
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৩ সালের ১লা মে ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানার আওতাধীন সালামতপুর (বর্তমানে রউফ নগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সী মেহেদী হাসান এবং মাতার নাম মুকিদুন্নেছা। মুন্সী আব্দুর রউফ ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার একমাত্র পুত্র সন্তান। তাঁর দুই বোন হলেন হাজেরা বেগম ও জোহরা বেগম । মুন্সী আব্দুর রউফের পিতা মুন্সী মেহেদী হাসান স্থানীয় মসজিদে ইমামতি করতেন ও মক্তবে পড়াতেন। তিনি পুত্রকে আড়পাড়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু অল্প বয়সে পিতার মৃত্যু হওয়ায় অভাবের কারণে মেধাবী আব্দুর রউফকে সংসারের হাল ধরতে হয়। এর ফলে তাঁর পড়াশোনা আর বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। তাঁর চাচা মুন্সী মুসতাক হোসেন ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)-এ চাকরি করতেন। তাঁরই সহযোগিতা ও উৎসাহে মুন্সী আব্দুর রউফ ১৯৬৩ সালের ৮ই মে ইপিআর বাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর সৈনিক নম্বর ছিল ১৩১৮৭।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মুন্সী আব্দুর রউফ চট্টগ্রামে ইপিআর-এর ১১নং উইং-এ কর্মরত ছিলেন। ততদিনে তিনি সৈনিক থেকে ল্যান্স নায়েক পদে উন্নীত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর উইং-এ কর্মরত সকল সৈনিক ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ২০শে এপ্রিল রাঙামাটি মহকুমা (বর্তমান জেলা)-র নানিয়ারচর উপজেলাধীন বুড়িঘাট ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কমতলী গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। সংক্ষেপে ঐ যুদ্ধের পটভূমি ছিল নি¤œরূপ- ১০ই এপ্রিল চট্টগ্রামের কালুরঘাট ব্রিজ পাকিস্তানিদের দখলে চলে গেলে মেজর মীর শওকত আলী তার সৈন্যদের নিয়ে পটিয়া ও কাপ্তাই হয়ে এপ্রিলের মধ্যবর্তী সময়ে রাঙামাটি এসে পৌঁছান। সার্বিক বিবেচনায় সেখানের চেয়ে উত্তরে চেঙ্গীখাল তীরবর্তী তিনদিক পাহাড়-জঙ্গল পরিবেষ্টিত মহালছড়ি অধিকতর নিরাপদ মনে হওয়ায় তিনি তাঁর অস্থায়ী সদর দপ্তর রাঙামাটির পরিবর্তে এখানে স্থাপন করেন। মহালছড়ি থেকে সীমান্তবর্তী রামগড়ের দূরত্ব বেশি নয়।
রামগড় ক্যাম্প থেকে আর্টিলারি অফিসার ক্যাপ্টেন আকতাবুল কাদের মহালছড়িতে মেজর মীর শওকতের ব্যহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। পাকিস্তানি বাহিনী যাতে তাঁর হেডকোয়ার্টারে দিকে অগ্রসর হতে না পারে, সেজন্য মেজর শওকত এর আশপাশে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করেন। সে অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের নেতৃত্বে ১০০ জনের একটি সেনাদল বুড়িঘাটের নিকটবর্তী ঘাগড়ায়, সুবেদার মোতালেবের নেতৃত্বে একটি গ্রুপকে কুতুবছড়ি এলাকায় এবং লে. খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে ১০০ সদস্যের অপর একটি দলকে বুড়িঘাটে মোতায়েন করা হয়। ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ এ দলে ছিলেন। বাকি ৭০ জনের মতো সেনাসদস্যকে লে. মাহফুজের অধীনস্থ করে মহালছড়ির হেডকোয়ার্টার্সের নিকটস্থ চেঙ্গীখালের উভয় পাড়ে অতিরিক্ত ফোর্স হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়। ১৯শে এপ্রিল লে. খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে সেনা, ইপিআর, পুলিশ ও অন্যান্যসহ মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল নানিয়ারচর বাজারে আসে। বিকেলে তাঁরা বুড়িঘাটের চেঙ্গীখালে যান এবং শত্রুবাহিনীকে ঠেকাতে সেখানে বাংকার তৈরি করেন। মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে, কোথায় পজিশন নেবেন, সে সম্পর্কেও লে. খালেকুজ্জামান তাদের বিস্তারিত ব্রিফিং দেন। এখানে স্থানীয় চেয়ারম্যান তিলক চন্দ্র চাকমা তাঁদের জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা করেন। রাতের খাবার খেয়ে তাদের কেউ দোকানে, কেউ লঞ্চে, কেউ বোটে, কেউ-বা স্থানীয়দের বাড়িঘরে থাকেন। সকালে রণসাজে মুক্তিযোদ্ধারা বোটে আর লঞ্চে করে বুড়িঘাটের দিকে রওনা হন। সেখানে হ্রদের ভেতর তিনটি টিলা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তাতে পজিশন নেন। রাঙামাটির দিক থেকে আসতে প্রথম টিলায় ৯-১০ জন যোদ্ধাসহ গানার মুন্সী আব্দুর রউফ, দ্বিতীয় টিলায় সুবেদার মীর আমির হোসেন ও অপর কয়েকজন এবং তৃতীয় টিলায় লে. খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে আরেকটি গ্রæপ অবস্থান নেয়। সর্ব পেছনে ফায়ারিং দেয়ার জন্য একটি গ্রুপকে প্রস্তুত রাখা হয়। ২০শে এপ্রিল শত্রুপক্ষের ২য় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানি ৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার নিয়ে ৩টি লঞ্চ ও ২টি স্পিডবোটে করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়ে। মুক্তিবাহিনীকে দেখামাত্র মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে তারা গোলাবর্ষণ শুরু করে। সংঘটিত হয় উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। মুন্সী আব্দুর রউফ নিজের মেশিনগান দিয়ে শত্রুর ওপর গোলাবর্ষণ করতে থাকেন। হানাদারদের ভারী অস্ত্র, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সীমিত অস্ত্র ও অস্ত্রের গুলি ফুরিয়ে আসায় এক পর্যায়ে লে. খালেকুজ্জামান মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ প্রত্যাহার করে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন। নির্দেশ অনুযায়ী অন্য সবাই দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে গেলেও মুন্সী আব্দুর রউফ হালকা মেশিনগান হাতে অসীম সাহসের সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ সহজ ও নিরাপদ হয়। তারা কেউ সাঁতরে পাশের ঝোপে, কেউবা গাছ বা পাহাড়ের আঁড়ালে আশ্রয় নেন। সহযোদ্ধারা বারবার মুন্সী আব্দুর রউফকে সরে আসতে বলেন। তিনি উত্তর দেন-আপনার নিরাপদে সরে যান। আমি একাই ওদের সামলে রাখছি। তাঁর সাথে থাকা দুই সহযোদ্ধাকেও সরে যেতে বলেন মুন্সী আব্দুর রউফ। নিজেই চালাতে থাকেন মেশিন গান। তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে হঠাৎ শত্রুদের মর্টারের গোলা এসে মুন্সী আব্দুর রউফের শরীরে আঘাত হানে। মুহূর্তে তার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। শহীদ হন দেশমাতৃকার অকুতোভয় সন্তান মুন্সী আব্দুর রউফ। এরপর সবকিছু নিস্তব্ধ হলে পাকিস্তানি হানাদাররা তাদের বাকি যানবাহনযোগে রাঙামাটি হেডকোয়ার্টার্সে ফিরে যায়। এ-যুদ্ধে ২টি নৌযান ও ১টি স্পিডবোট ধ্বংস এবং তাদের বেশকিছু সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে মুন্সী আব্দুর রউফ ছাড়া আরো ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

একটি আমগাছের উঁচু ডালে বসে দয়াল কৃষ্ণ চাকমা নামে স্থানীয় এক লোক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের পুরো যুদ্ধ দেখছিলেন। পরের দিন সকালে তিনি যে টিলায় মুন্সী আব্দুর রউফ যুদ্ধ করেছিলেন, সেখানে যান। গিয়ে দেখেন একজন সৈনিকের দেহ ছিন্ন-ভিন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। পাশে একটি এলএমজি ও গুলির খোসা। তিনি দেহাংশগুলো কুড়িয়ে গর্ত করে করবস্থ করেন আর একটি খুঁটি দিয়ে স্থানটি চিহ্নিত করে রাখেন। ঐ পথ দিয়ে যাওয়া-আসার সময় প্রায়ই তিনি সেখানে গিয়ে কবরটি দেখে আসতেন।
এভাবে কেটে যায় ২৬টি বছর। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে। সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ১নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম, মুন্সী আব্দুর রউফসহ বাংলাদেশের ভেতরে ও ভারতের মাটিতে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবর অচিহ্নিত অবস্থায় রয়েছে, সরেজমিনে সেসব কবর সন্ধানের উদ্যোগ নেন। এজন্য তিনি বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদস্যদের নিযুক্ত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সে-সময় বুড়িঘাট যুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা, পরবর্তীতে রাঙামাটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের কমান্ডার ও রাঙামাটি স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচিত সদস্য, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা রবার্ট রোনাল্ড পিন্টুর মাধ্যমে প্রথমে খোঁজ মিলে দয়াল কৃষ্ণ চাকমার। তাঁর সহায়তায় চিহ্নিত হয় মুন্সী আব্দুর রউফের কবর।
অতঃপর রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে কবরটি পাকা করা হয়। বর্তমানে সরকারের উদ্যোগ ও অর্থানুকুল্যে সেখানে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফের অসীম বীরত্ব, অদম্য সাহস, কর্তব্যপরায়ণতা, দৃঢ় সংকল্প, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতিকে ধরে রাখতে তাঁর জন্মস্থান ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিসৌধ, ভাস্কর্য, জাদুঘর ও পাঠাগার স্থাপন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে তার নিজ জন্মভূমি ফরিদপুরে প্রতিষ্ঠিত বীরশ্রেষ্ঠ উচ্চ বিদ্যালয় ও বীরশ্রেষ্ঠ সরকারি কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ জাদুঘর ও গ্রন্থাগার, ঢাকার পিলখানায় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, রাঙ্গামাটি শহরের বিজিবি সদরে স্থাপিত বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মহালছড়িতে অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ উচ্চ বিদ্যালয়, রাঙ্গামাটি শহরের প্রবেশমুখে বীরশ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য এবং ফরিদপুর ও রাঙ্গামাটিতে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ সড়ক উল্লেখযােগ্য।
এছাড়াও বীরশ্রেষ্ঠের জন্মবার্ষিকী ও শাহাদাৎবার্ষিকী আড়ম্বরপূণভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে এবং শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পার্বত্য জেলায় কাজ করছে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ফাউন্ডেশন। “প্রেরণায় দেশ-চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ’’ এই শ্লোগানে পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে চলেছে সংগঠনটি।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক।
