রামগড় স্থলবন্দরঃ সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের আগেই ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ - Southeast Asia Journal

রামগড় স্থলবন্দরঃ সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের আগেই ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মোঃ সাইফুল ইসলাম, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে

১৯২০ সালের সাবেক মহকুমা ও বর্তমান উপজেলা শহর রামগড়ে ভারত-বাংলাদেশ পণ্য আমদানি-রপ্তানির লক্ষ্যে নির্মিত স্থলবন্দরকে ঘিরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাণ সঞ্চার হতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই গত বছরের ৯ মার্চ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মহামনি এলাকায় ফেনী নদীর ওপর বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ উদ্বোধন করেন। এছাড়া এপারে ইমিগ্রেশন সেন্টারও চালু হচ্ছে সহসাই।

স্থলবন্দরকে ঘিরে ১০ একর জায়গায় বন্দর টার্মিনাল, সড়কপথ, গুদামঘর, চেকপোস্ট, কাস্টমস ও বিজিবির জন্য জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এদিকে রামগড়-হেঁয়াকো-বারৈয়ারহাট সড়কে ১৬টি সেতুর নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের পথে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)-এ অনুমোদিত প্রধান সড়ক প্রশস্তকরণসহ ৭ প্রকল্পের কাজও চলমান।

এর মধ্যেই সম্প্রতি বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পে খাগড়াছড়ির রামগড় অংশে ভূমি অধিগ্রহণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। রামগড় বাজার থেকে সোনাইপুল পর্যন্ত তিন কিলোমিটার সড়কের পাশে অর্ধ শতাধিক ব্যক্তির মালিকানাধীন ভূমির নথি জাল-জালিয়াতি করে অধিগ্রহণের অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা চলছে বলে জানা যায়। এসব অনিয়মে স্থানীয় ভূমি অফিসের কিছু অসাধু কর্মচারী ও ভূমি দুস্য ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যের তথ্য মিলেছে অনুসন্ধানে। স্থানীয় প্রশাসন বলছেন বিধি মোতাবেক ভূমির প্রকৃত মালিককে দেয়া হবে অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের ন্যায্য টাকা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি রামগড়-হেঁয়াকো-বারৈয়ারহাট সড়কে প্রশস্তকরণ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই স্থানীয় প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট ভূমি অফিসের কিছু অসাধু কর্মচারী ও ভূমি দুস্যদের যোগসাজেশে উপজেলার বাহিরের এমনকি জেলার বাহিরের কয়েকজনের নামে মূল মালিকের সাক্ষর জাল করে ভূমি বিক্রির নকল বায়না দলিল কিংবা দাগ নম্বর পরিবর্তন করে মালিকানা পরিবর্তন করেছেন। এছাড়া অনেকে দাবী করেছেন, সরকারী খাস ভূমিও অনেক দস্যু নিজেদের নামে দলিল করেছেন, আর এতে সহায়তা করেছে ভূমি অফিসের কতিপয় সার্ভেয়ারসহ কয়েকজন।

উপজেলার দারোগাপাড়ার সত্তরোর্ধ্ব মনির আহমেদের দিন কাটছে নিজের নামে রেকর্ডীয় ভূমি হারানোর শঙ্কায়। রামগড়ে প্রস্তাবিত স্থলবন্দরের সড়ক প্রশস্তকরণের লক্ষে রামগড় বাজার থেকে সোনাইপুল পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। এতে মনির আহমেদের নিজের নামে থাকা ভূমির মালিক কাগজে পত্রে হয়ে গেলেন অন্যজন।

শুধু মনির আহমেদ নয়। রামগড়ের অর্ধশতাধিক ভূমি মালিক জানেন না, কার নামে অধিগ্রহণের নথিতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ভূমির মালিকানা। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় ভূমি দুস্যরা ভূমির খতিয়ান ও দাগ জালিয়াতি করে ভুয়া দলিল, বায়নার ভিত্তিতে মালিকানা ও খাস ভূমি নিজেদের নামে করিয়ে নিয়েছেন। অন্য এলাকার ভূমির দলিল অধিগ্রহণ ভুক্ত ভূমি এলাকায় দেখিয়ে মালিকানা দাবিরও অভিযোগ মিলছে। সরকারি কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অসহায় ভুক্তভোগীরা।

এছাড়া, অনুসন্ধানে উঠে এসেছে নথি জালিয়াতিতে স্থানীয়দের পাশাপাশি উঠে এসেছে খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা, মাটিরাঙ্গা উপজেলা সহ চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার বাসিন্দাদের নাম। ভূমি অফিসের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে যাচাই বাছাই করে ভূমি ক্রয় ও বায়নার কথা স্বীকার করেছেন তাদের কেউ কেউ। অনেকে আবার অস্বীকার করে নিজেদের নামে এসব ষড়যন্ত্র বলেও দাবি করছেন।

ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে উপজেলা প্রশাসনের হল রুমে অংশীজনদের নিয়ে একটি অবহিতকরণ সভাও অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কে.এম. ইয়াসির আরাফাত ভূক্তভোগী ও ক্ষতিগ্রস্থদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেন এবং মৌখিক অভিযোগ শুনেন। এদিন উন্মুক্ত ও গণশুনানীর মাধ্যমে ভূমির প্রকৃত মালিক নির্ধারণ করে অধিগ্রহণের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পরিশোধের আশ্বাসও দেয়া হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে।

এদিকে, বিষয়টি নিয়ে কোন সঠিক সুরাহা হবে না আশঙ্কা করে ইতিমধ্যেই রামগড়ের ক্ষতিগ্রস্ত কিছু লোকজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এছাড়া ফেসবুকে প্রকাশ্যে পোষ্ট করে এ ধরনের কর্মকান্ডের জন্য ক্ষমতাসীন দলের একটি প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় মোস্তফা রাইটার, নুর নবী চৌধুরী, রামগড় পৌরসভার রোলার চালক নুর ইসলামসহ বেশ কয়েজনকে দায়ী করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ বেশ কয়েকজন ও স্থানীয়রা জেলা প্রশাসন সহ বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক অভিযোগও প্রেরণ করেছেন। এসব অভিযোগের কয়েকটি কপি হাতে পেলেও এসব অভিযোগের বিষয় নিয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জেলা প্রশাসনের কোন নির্দেশনার বিষয়ে জানা যায় নি।

জানতে চাইলে রামগড় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কুমার কার্বারী জানান, ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে কোন ধরণের অনিয়ম যাতে না হয় সেজন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে সকল অংশীদারদের নিয়ে সভা করা হয়েছে। এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অবহিত করেছি, তিনি এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিবেন এবং আসল মালিকদের কাগজপত্র বাছাই সাপেক্ষে পরবর্তী কাজ সম্পাদন করবেন।

খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কে.এম. ইয়াসির আরাফাত মুঠোফোনে জানান, বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পে কোন ধরনের অনিয়মের সুযোগ নেই। ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রকৃত মালিকদের মাঝেই অধিগ্রহণের অর্থ বন্টন করা হবে।

জানা যায়, বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ কাজে রামগড় অংশে ১৭ একর ভূমির অধিগ্রহণের আওতায় আসবে। বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পটি ৩ হাজার ৪৬১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ধরা হয়। তার মধ্যে ২ হাজার ৬১৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা সরকার দেবে, বাকি ৫৮১ কোটি ২০ লাখ টাকা বিদেশি ঋণ এবং ২৬০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বিশ্ব ব্যাংকের অনুদান।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ৬ জুন ঢাকা সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রামগড় স্থলবন্দর ফেনী নদীর উপর বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু ১-এর ভিত্তিপ্রস্তর প্রতিস্থাপন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।