মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের চলমান অসন্তোষ প্রসীত বিকাশ খীসার ইউপিডিএফকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
![]()
পারভেজ হায়দারঃ
বাংলাদেশের ইতিহাসে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) স্বায়ত্বশাসনের দাবি নিয়ে জন্ম নেওয়া একমাত্র দল, যা ক্রমাগত মাঠ পর্যায়ে দিনের পর দিন কর্মী অসন্তোষের কারণে বর্তমানে একরকম নড়বড়ে অবস্থানে রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর রীতি, নীতি ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট বজায় রাখার মত আদর্শভিত্তিক কথা বলে শান্তিচুক্তির পরপরই যে দলটি পাহাড়ী যুবকদের মধ্যে কিছুটা আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পেরেছিলো তা কালের পরিক্রমায় নেতদের স্বার্থান্বেষী কার্যক্রম, পার্টিকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা, সাধারণ কর্মীদের নূন্যতম স্বার্থ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়া এবং সর্বোপরি আদর্শবিচ্যুত অসংখ্য উদাহরণ সৃষ্টি করা এই পার্টির দূর্বল অবস্থানে যাওয়ার মূল কারণ বলে অনুমেয়।

প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ তাদের জন্মের শুরুতেই বাম ঘরণার রাজনীতির আদলে অনেক আদর্শ বক্তব্যের বুলি আওড়ালেও শুরু থেকেই সন্ত্রাসকে সঙ্গী করে পার্টির কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পথ খোঁজার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু আদর্শগত সংগ্রাম করতে নেতৃত্ব পর্যায়ে যে ব্যক্তিগত উদাহরণ সৃষ্টি করতে হয়, এই পার্টির নেতৃত্ব তা করতে পারেনি। তাই সময়ের সাথে সাধারণ কর্মীদের মধ্যে এই পার্টির প্রকৃত রুপটি সামনে চলে আসায় তারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
২০১৫ সালে তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা, যিনি ইউপিডিএফ’র সশস্ত্র দলের প্রথমসারির একজন কমান্ডার ছিলেন, তিনি যখন ইউপিডিএফ’র এই অপরাজনীতির বিষয়টি বুঝতে পারলেন তিনি দল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। বর্মার ইউপিডিএফ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তটি অনেক নেতা-কর্মীর চোখ খুলে দিয়েছিলো। তাদের অনেকেই মনে করেছিলো দীর্ঘদিন ধরে যে চাপা কষ্ট তারা বুকে পুষে রেখেছিলেন, বর্মা সেই কাজটি করেই তাদের পথ দেখিয়েছেন।

জনপ্রিয় এই ফিল্ড কমান্ডারের হাত ধরেই ২০১৫ সালে অন্তত ৬০-৭০ জন মাঠ পর্যায়ের সশস্ত্র কর্মীগণ ইউপিডিএফ ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলো। পরবর্তীতে এই ৬০-৭০ জন ঐক্যবদ্ধভাবে একত্রিত হয়ে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে নতুন একটি দলের আত্নপ্রকাশ ঘটিয়েছিলো। অর্থাৎ গণতন্ত্রের স্বাধ পাওয়ার ঐকান্তিক ইচ্ছা তারা ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের মাঝে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলো। সময়ের সাথে সাথে পাহাড়ের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্বার্থবিরোধী কাজের বিষয়ে ইউপিডিএফ’র মুখোশ উন্মোচিত হতে থাকে। সাধারণ কর্মী ও জনগন ক্রমান্বয়ে বুঝতে পারে ইউপিডিএফ’র আদর্শভিত্তিক বক্তব্য শুধুমাত্র তাদের ফাঁকা বুলির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এমনিভাবে বর্তমান সময়ে অনেক নেতা-কর্মী ইউপিডিএফ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায় অথবা অন্যান্য যে সমস্ত আঞ্চলিক দল রয়েছে সেগুলোতে যোগদান করতে চায়, বিশেষ করে এমএন লারমার আদর্শে বেড়ে উঠা জেএসএস সংস্কার ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকই তাদের প্রথম পছন্দ। তবে অধিকাংশ সাধারণ কর্মীগণ সবধরণের দল বাদ দিয়ে নিজের পরিবার নিয়ে শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপন করতে চায়। কিন্তু প্রসীত বিকাশ খীসার ইউপিডিএফের মতো দল থেকে বেরিয়ে আসা কি এতই সহজ?
সাম্প্রতিক সময়ে যারা কোনক্রমে পালিয়ে আসতে পেরেছে তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে সাধারণ কর্মীদের প্রতি নেতাদের বিরূপ আচরণের চিত্র খুঁজে পাওয়া গেল। এই পার্টির শাখা ও উপশাথাগুলোর যে নামই থাকুক না কেন মূলত তিনটি বিভাগ যথাক্রমে, রাজনৈতিক শাখা, অবৈধ চাঁদা উত্তোলন শাখা ও সশস্ত্র শাখা কাজ করে। অবৈধ চাঁদা উত্তোলনই এই পার্টির আয়ের মূল উৎস। সাধারণ কর্মীগণ যে শাখাতেই কাজ করুক না কেন, অবিবাহিত হলে মাস শেষে মাত্র ৩০০টাকা ভাতা পায় আর বিবাহিত হলে মাত্র ২৬০০ টাকা ভাতা হিসেবে পেয়ে থাকে। টাকার এই অংকই বলে দিচ্ছে সাধারণ কর্মীদের কি মানবেতর জীবন-যাপন করার করতে হয়।

গত শতকের ৮০ বা ৯০ এর দশকের সময় শান্তিবাহিনীর চলমান সশস্ত্র সংগ্রামের দিনগুলোতে আদর্শভিত্তিক বিষয়টি কাজ করতো বিধায় সাধারণ কর্মীগণ যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলো। এমনকি তারা কখনো নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যতের কথাও ভাবেনি। তারা শুধু তাদের নিজ জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে মনোনিবেশ করেছিলো। কিন্তু বর্তমান প্রসীত বিকাশ খীসার ইউপিডিএফ’র ক্রমাগত আদর্শবিচ্যুতি সাধারণ কর্মীদের ব্যক্তিগতভাবে ত্যাগ স্বীকারে নিরুৎসাহিত করেছে। নেতাদের আদর্শবিচ্যুতি, অবৈধ চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে জনগণের উপর চাপ প্রয়োগ, পাড়া পর্যায়ে বিচার-আচার নিয়ন্ত্রন, এসবের সাথে যোগ হয়েছে নিজ জাতির মেয়েদের উপর পাশবিক নির্যাতন; মিতালী চাকমা, জোসনা চাকমা, ইতি চাকমা, নওমুসলিম ফাতেমা ও চিক্কো চাকমাসহ রয়েছে এই ধরণের অসংখ্য উদাহরণ। দিনের পর দিন প্রাণভয়ে সাধারণ মানুষ এসকল অত্যাচার সহ্য করে গেলেও আস্তে আস্তে সময় বদলাচ্ছে।
মনস্তাত্বিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়া ইউপিডিএফ কর্মীদের একটি বড় অংশ জীবনের ভয়ে পার্টির অভ্যন্তরে থেকে কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তবে এরই মাঝে অনেক কর্মী পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ধরা পড়লে তাদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে। এমনই একজনের সাথে কথা হচ্ছিলো, যিনি সাম্প্রতিক সময়ে ইউপিডিএফ’র কাছ থেকে কোনক্রমে জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। নাম তার উষাতণ চাকমা, পার্টির নাম রিজাং।

৩৮ বছর বয়সের এই বিবাহিত ব্যক্তির স্ত্রী ও ২টি কণ্যাসন্তান রয়েছে। গত ২০১৪ সালের শুরুতে প্রসীত পন্থি ইউপিডিএফ নেতাদের আদর্শভিত্তিক মিষ্টি কথায় ভুলে গিয়ে, নিজ জাতিগোষ্ঠীর জন্য কাজ করবে এই অভিপ্রায়ে উজ্জীবিত হয়ে, স্ত্রী-কণ্যাদের ভবিষ্যতের কথা তেমন ভাবে না ভেবেই সে ইউপিডিএফ এ যোগ দেয়। কিন্তু যোগদানের পর থেকেই নেতাদের আদর্শবিচ্যুতি তাকে ব্যাথিত করেছিলো। তারপরেও প্রাণভয়ে গত ৫ বছর কোনক্রমে সময় অতিবাহিত করছিলো সে। কিন্তু একটা সময় নিজের পরিবারের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এবং ইউপিডিএফ নেতাদের বিভিন্ন অপকর্ম নিজ চোখে দেখে বিতঃশ্রদ্ধ হয়ে যখন সে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো তখন সে ধরা পড়ে যায়। তাকে বন্দি করে অমানুষিক নির্যাতন করা হয় এবং ৬টি তালা দিয়ে শিকল বন্দি করে গোপন একটি বাড়িতে রেখে দেয় ইউপিডিএফ। সৌভাগ্যক্রমে সে সুযোগবুঝে বন্দিশালা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এখন জীবন হারানোর ভীতি থাকলেও সে শুধুমাত্র তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে একটি সুন্দর, স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বাঁচতে চায়। উষাতন চাকমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো বলে বন্দি অবস্থা থেকে সে পালিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু অসংখ্য নেতা-কর্মী হয়তো আদর্শবিচ্যুত প্রসীত বিকাশ খীসার ইউপিডিএফ দল থেকে পালিয়ে আসার সাহস পাচ্ছেন না, তারা অনুচ্চারিত চাপা কষ্ট নিয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সব অন্যায় মেনে নিচ্ছে। এভাবে হয়তো বেশীদিন চলবে না। অন্যায় আর মিথ্যার উপর কোন দল টিকে থাকতে পারে না। উষাতনের মতো আরো অনেক কর্মীই দলত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাইবে। তাদের পরিবার নিশ্চই সেই সুদিনের অপেক্ষায় থাকবে, আর ঐ দিন বেশী দূরে নয়!
ভিডিওঃ