প্রমাণের অভাবে শাস্তি হয় না মানব পাচারকারীদের
![]()
নিউজ ডেস্ক
আবার মানবপাচারের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা মামলা না করায় রাষ্ট্র বাদী হয়ে মামলা করে। তবে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অপরাধীদের বেশির ভাগের শাস্তি হয় না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র মতে, সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে বেশির ভাগ পাচারকারীকে শাস্তির আওতায় আনা যায় না বলে এ ধরনের অপরাধ কমছে না। চলতি বছরের ১০ আগস্ট ভারতে নারী পাচার চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। টিকটক তারকা বানানো এবং বেশি বেতনে চাকরির লোভ দেখিয়ে ভারতে নারী পাচার করছিল চক্রটি। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, স্ত্রী ও শ্যালিকাকে ভারতে পাচারের ঘটনায় ইউসুফ নামের এক ব্যক্তিকে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা থেকে রানা আহমেদ, মো. সুজন মিয়া, মো. সাহাবুদ্দীন, নাইমুর রহমান ওরফে শামীম ওরফে সাগর নামের আরো চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সিআইডি সূত্র জানায়, ভুক্তভোগী ওই দুই নারীকে গত বছরের ৪ মে ঝিনাইদহের মহেশপুর থানার বাঘাডাঙা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে সেখানে অবস্থান করা অন্য অপরাধীদের মাধ্যমে যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। পরে ওই দুই নারী সেখান থেকে পালিয়ে ভারতীয় পুলিশের সহায়তায় চলতি বছরের ২২ মার্চ বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তাঁদের দেওয়া জবানবন্দির ভিত্তিতে মানব পাচার চক্রের ওই সদস্যদের গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
সিআইডির মানবপাচার ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিদেশে গিয়ে উন্নত জীবনযাপন এবং বেশি টাকা রোজগারের প্রলোভনে পাচারকারীদের ফাঁদে পা দেয় এক শ্রেণির মানুষ। অশিক্ষা এর বড় কারণ। তদন্তে দেখা গেছে, শ্রমিক হিসেবে কেউ কেউ দেশের বাইরে যাওয়ার পর এক পর্যায়ে অপরাধের কাজে জড়িয়ে পড়েন। পরে তাঁরা দেশে থাকা দালালদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে মানবপাচার শুরু করেন। ভারতে পাচারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে প্রলোভন। এমনও দেখা গেছে, কোনো মেয়েকে ভারতে পাচারের আগে পাচারকারীরা ওই মেয়ের পরিবারকে অগ্রিম পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে আস্থা অর্জন করে নেয়। তবে পাচারের পর বেরিয়ে আসে এই অপরাধীচক্রের আসল রূপ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মানবপাচারের অভিযোগে ৫০০ মামলা করা হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে আদালতে পাঁচ হাজার ১৭১টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে চার হাজার মামলা। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ২৯ হাজার ৯৪৬। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ১৩ হাজার ৮৭৩ জন। এর মধ্যে ৮০৯টি মামলা তদন্তাধীন। গত ছয় মাসে ৩৬৬টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। তবে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের কোনো আদালতে কোনো মানব পাচারকারীকে সাজা দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।
গত আগস্ট মাসে পাচার হওয়া ৯ জন নারী-শিশুকে ট্রাভেল পারমিটের মাধ্যমে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ফেরত আসা ভুক্তভোগী এসব নারী-শিশুর বাড়ি ঢাকা, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, কিশোরগঞ্জ, যশোর ও বরিশাল জেলায়।
তাদের মধ্যে ছয়জনকে আইনি সহায়তা দিতে জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার, দুজনকে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি ও একজনকে রাইটস যশোর নামের একটি এনজিও সংস্থা গ্রহণ করেছে।
রাইটস যশোরের প্রগ্রাম ম্যানেজার এস এম আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘যাঁদের ফিরিয়ে আনা হয়, তাঁরা শুরুতে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বললেও পরে আর করতে চান না। আর পাচারের শিকার হওয়া বেশির ভাগ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে না পারায় বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ’
একই ধরনের কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জামাল উদ্দিন খন্দকার। তিনি বলেন, ‘মানবপাচারের বেশির ভাগ মামলা করে রাষ্ট্রপক্ষ। তবে পরে সাক্ষী হাজির করতে না পারায় মামলাগুলো বছরের পর বছর পড়ে থাকে। একটা সময় খারিজ হয়ে যায়। মানবপাচারের ৯০ শতাংশ মামলা প্রমাণ করা যায় না। ’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিপুলসংখ্যক এই মামলার বিচারকাজের জন্য ২০১৯ সালে সাতটি মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছে। ময়মনসিংহ ছাড়া অন্য সাত বিভাগের সাত ট্রাইব্যুনালে এসংক্রান্ত মামলার বিচারকাজ চলছে। বর্তমানে ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনালে এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ মামলার বিচারকাজ চলছে বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের পিপি কে এম সাজ্জাদুল হক শিহাব। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘মানবপাচারের পুরনো মামলাগুলোয় সাক্ষীর অভাবে আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। অনেক অপরাধীকে আদালত অর্থদণ্ড দেন। কোনো কোনো মামলা দুই পক্ষ মিলে আপস করে নেয়। আর কিছু মামলায় অপরাধীদের একেবারে যে শাস্তি হচ্ছে না তা ঠিক নয়। বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিও হচ্ছে। ’