টেকনাফজুড়ে অপহরণ ও মুক্তিপণ আতঙ্ক, নেই প্রতিকার - Southeast Asia Journal

টেকনাফজুড়ে অপহরণ ও মুক্তিপণ আতঙ্ক, নেই প্রতিকার

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

টেকনাফ সীমান্ত উপজেলার পাহাড়ের বাঁকে-বাঁকে এখন বড় আতঙ্কের নাম অপহরণ ও মুক্তিপণ। এমন আতঙ্কে টেকনাফের লাখো মানুষের জীবন হুমকিতে। এমনকি অপহরণের পর খোঁজ না পাওয়ার মানুষের লাশ মিলছে পাহাড়ে। দিন দিন এ ধরনের ঘটনা বেড়ে চললেও নেই প্রতিকার। কারা এসব করছে, কেন করছে- প্রশ্নের জবাব মিলছে না কারও কাছে, সুরাহাও হচ্ছে না। গত চার দিনে এক স্কুলছাত্রসহ আট জন অপহরণের খবর এসেছে পুলিশের কাছে। এর মধ্য চারটি ঘটনা রহস্যজনক বলে দাবি পুলিশের।

তবে অপহরণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা টেকনাফে বেশ আগে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যেসব অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছিল, সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে না নেওয়ায় এখন ধারাবাহিকভাবে ঘটছে এসব ঘটনা।

একের পর এক অপহরণের ঘটনায় উদ্বিগ্ন উল্লেখ করে কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘বিশেষ করে অপহরণ ও মুক্তিপণের আদায়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়দের জীবনযাত্রা ও নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে। ফলে অনেকে ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠানো নিরাপদ মনে করছেন না। এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করতে দ্রুত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। অন্যথায় অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্য আরও বাড়তে পারে।’

এদিকে, অপহরণ ও মুক্তিপণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কে দিন কাটছে স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের। অপহরণের পর অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরলেও আবারও একই ঘটনার শিকার হওয়ার আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সম্প্রতি অপরাধ বেড়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যা ও সংঘাতের ঘটনায় ২৪১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩১টি হত্যা, ১২টি হত্যাচেষ্টা, ২৪টি অস্ত্র, ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ও ১৩৭টি মাদক মামলা। এ ছাড়া মানবপাচারসহ আরও কয়েকটি অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়েছে।

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তথ্যমতে, গত দেড় বছরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আড়াই শতাধিক অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ক্যাম্পের বাইরে টেকনাফ উপজেলায় দেড়শ অপহরণের ঘটনায় ২০০ জন অপহরণের শিকার হন। এর মধ্যে বেশিরভাগই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন।

বিশেষ করে পাহাড়ি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় উপজেলার হ্নীলা ও বাহারছাড়া ইউনিয়নে অপহরণের ঘটনা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার জনপ্রতিনিধিরা। তাদের ভাষ্যমতে, গত বছরের তুলনায় এ বছর অপহরণের ঘটনা বেশি। যদিও পুলিশের খাতায় কম।

হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাসেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘গত বছরের তুলনা এখন অপহরণের সংখ্যা বাড়ছে। এই ঘটনা এখন নিত্যদিনের। এতে পাহাড়ি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা জড়িত। গত পাঁচ মাসে আমার এলাকায় ২০টির বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। মুক্তিপণ না পাওয়ায় হত্যাও করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথ অভিযান না চালালে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাহারছড়া ইউনিয়নের এক সদস্য বলেন, ‘অপহরণের ভয়ে আমার এলাকার লোকজন সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হন না। গত পাঁচ মাসে আমার এলাকায় অর্ধশতাধিক এমন ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন বেশিরভাগ।’

হত্যার ভয়ে অপহরণের শিকার লোকজন থানায় যেতে চান না উল্লেখ করে এই ইউপি সদস্য বলেন, ‘অপহরণের পর তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে উদ্ধার করা হয়েছে, এমন নজির নেই। পুলিশকে জানালে নির্যাতন করে হত্যার হুমকি দেয় অপহরণকারীরা। অনেক সময় পুলিশ পাহাড়ে অভিযানে যেতে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরতে হয়।’

সর্বশেষ গত রবিবার দুপুরে টেকনাফের লেদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ হোসেন (৮) অপহরণের শিকার হয়। এর সাত ঘণ্টা পর মোবাইল ফোনে তার বাবার কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে হত্যার হুমকি দেয় অপহরণকারীরা। পরে পুলিশ অপহৃত শিশুটিকে উদ্ধারে পাহাড়ে অভিযান চালালে অপহরণকারী তাকে ছেড়ে দেয়।

এই স্কুলছাত্রের বাবা সুলতান আহমদকে হুমকি দিয়ে মোবাইল ফোনে অপহরণকারীরা বলেছে, ‘তুই ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলি। কিন্তু কোনও চালাকি করলে ছেলেকে গুলি করে দেবো। খোঁজাখুঁজি করতে হবে না। ছেলে ভালো আছে। জীবিত ফেরত চাইলে ৫০ লাখ টাকা দিবি। না হয় ছেলের লাশ পাবি পাহাড়ে।’

এ বিষয়ে হ্নীলা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল হুদা বলেন, ‘অপহৃত স্কুলছাত্র একদিন পর ফিরেছে। অপহরণকারীরা ৫০ লাখ টাকা দাবি করেছিল।

আমার ওয়ার্ডজুড়ে সবাই একই আতঙ্কে আছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সবার মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কে কখন অপহরণের শিকার হয়, তা নিয়ে ভয় সবার। অনেকে বিদ্যালয়ে সন্তানদের পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। এসব ঘটনার পেছনে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তাদের দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ মডেল থানার ওসি আব্দুল হালিম বলেন, ‘প্রযুক্তির সহায়তায় অপহৃত শিশুর অবস্থান জেনে উদ্ধারের চেষ্টা চালালে অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দেয়। এ ছাড়া গত চার দিনে আটটি অপহরণের অভিযোগ পেয়েছি। সেগুলো নিয়েও আমরা কাজ করছি।’

ওসি বলেন, ‘আগের তুলনায় এখন অপহৃত পরিবারের সদস্যরা বেশি থানায় আসছেন। আমরাও অপহরণকারীদের ধরতে তৎপরতা বাড়িয়েছি। তবে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে চলাচলের সুযোগ বন্ধ না হলে, অপহরণের ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না। সেটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নকে নিশ্চিত করতে হবে।’

জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা বলছেন, সম্প্রতি মুক্তিপণ না পেয়ে তিন জনকে হত্যা করা হয়েছিল। পরে পাহাড় থেকে তাদের লাশ উদ্ধারের পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা চোখে পড়েনি। ফলে একের পর এক অপহরণের ঘটনা ঘটছে। দিনদুপুরে অস্ত্রসহ দলবল নিয়ে পাহাড়ের ভেতর থেকে এসে ধরে নিয়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চোখে পড়েছে না তাদের।