বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সেনাবাহিনী - Southeast Asia Journal

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সেনাবাহিনী

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

শেখ হাসিনা

সেপ্টেম্বর মাস বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার জন্ম মাস। এই সেপ্টেম্বর মাসেই দুনিয়ার নজরকাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্জনের উজ্জল নেতৃত্বদানকারী বিশ্বনেতা জননেত্রী শেখ হাসিনা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ না করলে হয়তো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মুক্তি, আইনের শাসন এবং উন্নত বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের অবস্থান উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভবপর হতো না। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্ম ‘বাংলাদেশের আলোর পথযাত্রা’। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মমাসের দ্বিতীয় দিবসে ‘শেখ হাসিনা রচনা সমগ্র ১’ থেকে পাঠকদের জন্য তাঁর একটি লেখা তুলে ধরা হলো।

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সেনাবাহিনী

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ছিলেন এদেশের প্রতিটি মানুষের অতি আপনজন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রত্যেক বাঙালির জন্যই ছিল তাঁর অকৃত্রিম দরদ। স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জন্য তাঁর স্নেহ ও দায়িত্ব কিছু কম ছিল না। যারা সেনাবাহিনীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছেন তারা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই সত্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ অশুভ শক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে সেনাবাহিনী নিয়ে একটি বিতর্কের সূত্রপাত করা। কিন্তু সেনাবাহিনীর সদস্য বা জনগণ কেউই তা চায় না। এতে শুধু সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে না, জনসাধারণের সাথে বিচ্ছিন্নতাও বেড়ে যাবে। সেনাবাহিনী নিয়ে যে কোনো ধরনের বিতর্কই দেশের জন্যও হবে আত্মঘাতী। জনগণের সাথে একাত্মতাবোধ নষ্ট হলে তাদের উপর অর্পিত দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সংহতি রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পালন বিঘ্নিত হবে। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন সেনাবাহিনী বহিঃশত্রুর আক্রমণের সহজ শিকারে পরিণত হয়। কোনো দেশপ্রেমিক সুস্থ মানুষই এ রকম অবস্থা কামনা করতে পারে না।

পাকিস্তান আমলে সেনাবাহিনী জনসাধারণের প্রতিপক্ষরূপে দাঁড়িয়েছিল। দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সকল প্রস্তুতি ও জনসাধারণের উৎসাহ- উদ্দীপনাকে নস্যাৎ করে আটান্ন সালে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে বসেছিল। গভীর রাতে ক্ষমতার হাতবদল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চরিত্রকে করে তুলেছিল কলঙ্কিত। বেলুচিস্তানে বোমা ফেলে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের মানুষের অধিকার হরণ করে সেনাবাহিনী চূড়ান্তভাবে জনগণের প্রতিপক্ষরূপে দাঁড়িয়েছিল। সংঘাত ছিল যার স্বাভাবিক পরিণতি। আজও পর্যন্ত পাকিস্তানে সে সংঘাতের অবসান ঘটেনি।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশরূপে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু অচিরেই বাংলাদেশ পাকিস্তানি শাসক-শোষকচক্রের বাজারে পরিণত হয়ে একটি নয়া উপনিবেশ হিসেবে গড়ে উঠল। তবে এ অবস্থা প্রথম থেকেই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। আর এর থেকে শুরু হয় এক দীর্ঘস্থায়ী গণসংগ্রামের। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর সাধারণ নির্বাচন, ১৯৬২-এর ছাত্র-গণআন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা-বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯-এর ৬ দফা ও ১১ দফা ভিত্তিক আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০- এর নির্বাচন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিপূর্ণ বিকাশের অভিযাত্রায় এক-একটি পতাকাচিহ্ন। এসব আন্দোলন আর সংগ্রামের স্তরে স্তরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ঘটে উত্তরণ। ১৯৭১-এ এসে তা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আর বাঙালি জনতা একীভূত হয়ে যায়।

আমাদের ইতিহাসের এ পর্যায়ক্রমিক ধাপে অন্যান্য দাবির পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও বেসামরিক চাকরিতে বাঙালিদের অন্তর্ভুক্তি, পদোন্নতি ইত্যাদি প্রশ্নে যে বৈষম্যমূলক নীতি বিরাজ করছিল, তার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুই প্রথম থেকে ছিলেন সোচ্চার। আর এ কারণেই তাঁর ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবিতে পূর্ব বাংলার জন্য স্বতন্ত্র সেনাবাহিনী এবং নৌ সদর পূর্ব বাংলায় স্থাপনের দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। বাঙালির সেদিনের সংগ্রাম ও আন্দোলনে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিল, সমগ্র জাতির মতোই তার সে আবেদন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জোয়ানদের মধ্যেও সাড়া জাগিয়েছিল অভূতপূর্ব। তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি ১৯৭১-এ রক্তে বান ডাকানো দিনগুলোতে। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল শান্তিপ্রিয় ও নিরস্ত্র বাঙালি জনগণের উপর। সে মুহূর্তেই বঙ্গবন্ধু তাঁর ৩২ নং ধানমণ্ডি সড়কের বাড়ি থেকে ঘোষণা করলেন স্বাধীনতা। তিনি ডাক দিলেন সকল বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করে পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে। শুরু হয়ে গেল সশস্ত্র প্রতিরোধ ও যুদ্ধ। চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও যুদ্ধের আহ্বান ওয়ারলেস যোগে পৌঁছে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনতা ও অন্যান্য আধা-সামরিক বাহিনীর বাঙালি ভাইদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জোয়ান ভাইয়েরা। আর এভাবেই সূচনা হলো একটি নতুন দেশ ও একটি নতুন সশস্ত্র বাহিনী সৃষ্টির। বঙ্গবন্ধুর আহ্বান, জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা ও নিজেদের দেশপ্রেমের জন্যই একটি শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করে গড়ে উঠতে পেরেছে আমাদের সেনাবাহিনী। বিজয়ী সৈনিকের উপযোগী স্বাধীন দেশের বাহিনী গড়ে তোলার জন্য তাই বঙ্গবন্ধু ও এদেশের জনগণ স্বাধীনতার পর সর্বাত্মক উদ্যোগ নিয়েছেন।

স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীকে আরও সুসংগঠিত ও সুসজ্জিত করার জন্য জনসাধারণকে বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। সঙ্কুচিত করতে হয়েছে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের অনেক জরুরি কর্মসূচি। তবুও সেনাবাহিনীর চাহিদা মেটাতে কুণ্ঠিত হয়নি বাংলার মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এ সেনাবাহিনীর প্রতি বঙ্গবন্ধু ছিলেন যেমনি স্নেহপ্রবণ তেমনি দায়িত্বসচেতন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তখন হাজার সমস্যা। হানাদার বাহিনী পিছু হটার সময় রাস্তাঘাট, রেলসেতু, ব্রিজ, কালভার্ট সব ভেঙে দিয়ে গেছে। অকেজো করে দিয়েছে বন্দর। জ্বালিয়ে ফেলেছে অনেক শহর, গ্রাম। দেশের কলকারখানা প্রায় সব কটিই ছিল বিধ্বস্ত। কৃষিকাজও তখন প্রায় বন্ধ। তার ওপর এক কোটি শরণার্থীর সমস্যা। যুদ্ধে নিহত, আহত, ক্ষতিগ্রন্ত লক্ষ লক্ষ পরিবার। ঔপনিবেশিক শোষণের নিগড় থেকে মুক্তি পাওয়া সদ্য স্বাধীন একটি দেশের সম্পদ বলতে তখন শুধু মানুষের ঐক্য ও কর্মস্পৃহা। এরকম অবস্থায় বঙ্গবন্ধু হাত দেন দেশ পুনর্গঠনের কাজে। কিন্তু তাতেও সেনাবাহিনীর চাহিদা এতটুকু খাটো করে দেখেননি তিনি। সেনাবাহিনীকে একটি আধুনিক ও শক্তিশালী বাহিনীরূপে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকার । ইনফ্যানট্রি, আর্টিলারি, সিগন্যাল, আর্মড, ইঞ্জিনিয়ার, মেডিকেল প্রভৃতি পূর্ণাঙ্গ রেজিমেন্ট ও ব্যাটালিয়ন এবং আনুষঙ্গিক ইউনিটসহ তিনি সেনাবাহিনী গঠন করেছেন। প্রায় ৩০ হাজার সৈন্যের এ বাহিনী জন্মলগ্নেই সুসজ্জিতভাবে গড়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ আন্তরিকতা ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ফলেই স্বাধীন বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে সম্ভাবনাময় নৌ, বিমান ও পদাতিক বাহিনী।

দেশ তখন দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। বঙ্গবন্ধু হাঁপিয়ে উঠেছেন দশ কোটি মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে। বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও তখন তুঙ্গে। সে সঙ্কটের সময়ও বঙ্গবন্ধু ভুলে যাননি তাঁর প্রিয় সেনাবাহিনীর কথা। খাদ্য ক্রয়ের পাশাপাশি বিদেশ থেকে সেনাবাহিনীর জন্য সংগ্রহ করেছেন প্রয়োজনীয় অস্ত্রসম্ভার। যুগোশ্লাভিয়ায় সামরিক প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে পদাতিক বাহিনীর জন্য আনা হয় ক্ষুদ্র অস্ত্রশস্ত্র এবং সাঁজোয়া বাহিনীর জন্য ভারী অস্ত্র। ভারতের অনুদান ৩০ কোটি টাকায় সেনাবাহিনীর জন্য কেনা হয় কাপড় ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে মিগ বিমান, হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমান। সে সময় মিগ-২১ই ছিল এ উপমহাদেশের সবচেয়ে আধুনিক বিমান। আজ পর্যন্ত তার সমকক্ষ কোনো জঙ্গী বিমান আওয়ামী লীগ-পরবর্তী সরকারসমূহের পক্ষে সামরিক বাহিনীর জন্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফলেই মিসর থেকে আনা সম্ভব হয়েছে সাঁজোয়া গাড়ি বা ট্যাংক। উন্নত প্রযুক্তি ও উন্নত জ্ঞান লাভ করে দেশ যাতে আধুনিক সেনাবাহিনী গড়তে পারে সে উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু অফিসারদের প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে প্রেরণ করেন। ব্রিটেন, সোভিয়েত রাশিয়া, ভারত প্রভৃতি দেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন সেনাবাহিনীর অফিসাররা। জেনারেল এরশাদ নিজেও সে সময় দিল্লিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার সেনাবাহিনীর জন্য নগদ অর্থে আধুনিক বেতারযন্ত্র ক্রয় করেন এবং সিগন্যাল শাখাকে আরও আধুনিক করে গড়ে তোলেন। এভাবে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে অত্যন্ত সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর প্রতি কোনো প্রকার অনীহা প্রকাশ করেননি। তিনি সামরিক একাডেমী স্থাপন করে আরও নতুন নতুন তেজোদীপ্ত তরুণের সমন্বয়ে সেনাবাহিনীকে উন্নত করার চেষ্টা করেছেন।

পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনকারী আরও ত্রিশ হাজারের অধিক সামরিক কর্মকর্তা ও জওয়ানদের তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পুনর্বাসিত করেন। এ কাজ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকেও সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তৎকালীন সেনাবাহিনীর অনেক কর্তাব্যক্তি এ পুনর্বাসনের বিরোধিতা করেছেন। অনেক জেনারেল বিভিন্ন সেনাছাউনিতে গিয়ে এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বক্তৃতাও করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত উদার ও যুক্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। এ প্রত্যাবর্তনকারী হাজার হাজার সৈনিক ছিল দেশেরই সন্তান। তারা দেশের শত্রু ছিল না। জাতির জনক হিসেবে তাদের প্রতি অনুদার ছিলেন না বঙ্গবন্ধু। তাছাড়া সে মুহুর্তে সেনাবাহিনীকে গড়ে তোলার জন্য অভিজ্ঞতার প্রয়োজনও ছিল। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এ সৈনিকদের সেনাবাহিনীতে গ্রহণ করাই বঙ্গবন্ধু যুক্তিসংগত মনে করেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তখন ত্রিশ-চল্লিশ জন মাত্র কর্মকর্তা। আর প্রত্যাবর্তনকারী কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল প্রায় তেরো শত। বঙ্গবন্ধু সেদিন অত্যন্ত সততার সঙ্গে সকল অফিসার ও জওয়ানদের নিয়ে অর্ধ লক্ষের অধিক সদস্যের সেনাবাহিনী গড়ে তুললেন ।

বঙ্গবন্ধু সকলকে শুধু চাকরিতে পুনর্বাসনই করেননি, কর্মকর্তা ও সদস্যদের জন্য নির্ধারণ করেছেন পদোন্নতির প্রণালী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ও পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা দ্রুত পদোন্নতি লাভ করেছেন। আজকের কর্মকর্তা ও সেনানায়কদের পদমর্যাদা লক্ষ্য করলেই এর সত্যতা মিলবে। বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছিল তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। তিনি প্রত্যাবর্তনকারী কর্মকর্তা ও জওয়ানদের পাকিস্তানে বন্দি থাকাকালীন সময়ের জন্যও বেতন প্রদান করেন। সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র, খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ সংগ্রহের জন্যই শুধু বঙ্গবন্ধু ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি, সেনা ছাউনির (ক্যান্টনমেন্ট) উন্নতি ও নতুন ছাউনি নির্মাণের পরিকল্পনাও গৃহীত হয় তখনই। পুরনো ছাউনিগুলোতে নতুন নতুন ভবন নির্মাণের পরিকল্পনার সাথে নতুন ছাউনিও গড়ে ওঠে সারাদেশে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ‘দিঘনালা’, ‘রুমা, ‘আলিকদম’-এর মতো সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ৩টি ছাউনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই গড়ে ওঠে।

বঙ্গবন্ধুর সরকারই প্রথম সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপর যারা নির্ভরশীল তাদের রেশন নিকটস্থ সেনা ছাউনি থেকে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পূর্বে যারা সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে ছাউনিতে অবস্থান করতেন তারাই শুধু এ সুযোগ লাভ করতেন।

জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন ছিল বঙ্গবন্ধুর একটি সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফল। অথচ এ নিয়েও এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল অপপ্রচারের ঘোলাজলে মাছ শিকারে নেমেছিল। জাতীয় রক্ষীবাহিনী কোনোদিনই সামরিক বাহিনীর বিকল্প ছিল না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেরও প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠনের প্রয়োজন ছিল দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের স্বার্থে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবির মধ্যেই বাঙালির সামরিক স্বার্থের কথা উল্লেখ করেছেন। স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখে জনগণের কল্যাণের জন্যই বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের সহায়ক শক্তিরূপে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করেন—যার সদস্যসংখ্যা ছিল সেনাবাহিনীর মাত্র ৬ ভাগের ১ ভাগ। মুক্তিযোদ্ধাদের ফেরত দেওয়া অস্ত্রেই শুধু তারা সজ্জিত ছিল। কোনো ব্যাটালিয়নেই ৬ থেকে ৮টির বেশি হালকা মেশিনগান ছাড়া ভারী অস্ত্র ছিল না। প্রশাসনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ও সর্বোপরি সদ্য স্বাধীন দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ ধরনের বাহিনী গঠনের যৌক্তিকতা সারা বিশ্বে বিদ্যমান। সেভাবেই বঙ্গবন্ধুও গঠন করেছিলেন জাতীয় রক্ষীবাহিনী।

বঙ্গবন্ধু সামগ্রিকভাবে সেনাবাহিনী গঠন ও উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ের মধ্যে, যখন দেশ স্বাধীনতার ধকল সামলে উঠতেই হিমসিম খাচ্ছিল। অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের কাজই ছিল তখন জরুরি। তার মধ্যেও সেনাবাহিনীর কল্যাণ কার্যক্রম ব্যাহত হতে দেননি বঙ্গবন্ধু, অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়েছেন।

এদেশের সেনাবাহিনী তাই গড়ে উঠেছে জনসাধারণের স্বার্থত্যাগের বিনিময়ে, বঙ্গবন্ধুর গর্ব ও গৌরবের প্রতীক হিসেবে। সে সেনাবাহিনী নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠবে এ কথা কল্পনা করাও ছিল কঠিন। অথচ বাস্তব কি নির্মম, সত্য কি কঠিন, যা কোনোদিন কেউ কল্পনা করে নাই তা-ই সত্য হয়েছে বাংলাদেশে।

জনগণের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছে সেনাবাহিনী। সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রে কিছু বিপথগামী উচ্চাভিলাষী অফিসারের হাতে প্রাণ দিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং এ কুচক্রীরা জাতির জনককে হত্যার মাধ্যমে তাঁর অনুসৃত কর্মসূচিকে বানচাল করে বাংলাদেশে প্রগতির ধারা পাল্টে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছে। একের পর এক নিজেদের ক্ষমতারোহণ, রাজনীতি, প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, দুর্নীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে অভ্যুত্থানকারীরা তাদের স্থায়ী বাহনে পরিণত করে চলেছে। এমনকি ক্ষমতালোভীরা সেনাবাহিনীর নামে হুমকি দিচ্ছে দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষকে। সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ করে তাদের বার বার যুক্ত করা হচ্ছে সুবিধাবাদী সমাজবিরোধী ও অসৎ চরিত্রের ক্ষমতাশ্রয়ী সংগঠনের সাথে।

ক্ষমতাসীনরা উসকে দিচ্ছে রাজনৈতিক সংগঠনে কলহ বিভেদ। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে ঠেলে দিয়ে নেতাকর্মীদের চরিত্রহননের অশুভ প্রক্রিয়ার সূচনাও করেছে দেশে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতার লোভে অভ্যুত্থানকারী ও তাদের দোসররা সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করছে জনগণের প্রতিপক্ষরূপে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এদেশে সূচনা করা হয়েছে হত্যার রাজনীতি। অন্যায়ভাবে অস্ত্র শক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে রাজনীতিতে আগত দুশ্চরিত্র কতিপয় ব্যক্তিকে নিয়ে ক্ষমতা ভাগাভাগির এক অশুভ প্রক্রিয়া চলছে। পর্যায়ক্রমে সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের ধারাও এক্ষেত্রে অব্যাহত রয়েছে। ক্ষমতার লড়াইয়ে এক একটি সামরিক অভ্যুত্থানে যেমনি প্রাণ দিতে হয়েছে বীর সৈনিকদের তেমনি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রামে গত এক দশকে শহীদ হয়েছে বহু ছাত্র-জননেতৃবৃন্দ।

গত দশ বছরে দেশের অবস্থাও হয়েছে আরও সঙ্কটাপন্ন। সামরিক শাসন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে যেমনি অস্থির করে তুলেছে তেমনি নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, নারী ও শিশু-কিশোর হত্যা, খুন, ডাকাতি, ব্যাংকের টাকা লুট, ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, সরকারি অর্থ অপব্যয় বেড়ে চলছে। বঙ্গবন্ধুর জাতীয়করণ, ভূমি সংস্কার, বৈদেশিক নীতি, সর্বজনীন শিক্ষার কর্মসূচি বিসর্জন দিয়ে আরও বৃদ্ধি করা হচ্ছে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য। ক্ষমতাসীনরা সামরিক বাহিনীর নাম ভাঙিয়ে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে নির্যাতনের মুখে।

অথচ বঙ্গবন্ধুর কত গর্বই না ছিল সেনাবাহিনী নিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ছিল তাঁর স্বপ্নের বাস্তব রূপ। কুমিল্লার সামরিক একাডেমীতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে ক্যাডেটদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি পূর্ণ সুযোগ পেলে আমাদের ছেলেরা যে কোনো দেশের যে কোনো সৈনিকদের সাথে মোকাবিলা করতে পারবে, তাদের সে শক্তি আছে।” তিনি সেদিন তাদের প্রতি শৃঙ্খলা ও জনসাধারণের প্রতি দায়িত্ব ও মমত্ববোধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তব কি নির্মম! জাতির জনকের হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত তাঁরই প্রিয় সেনাবাহিনী। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সমগ্র সেনাবাহিনী এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত নয়। অথচ ১৫ আগস্টের হত্যার দায়িত্বের বোঝা তাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ক্ষমতাসীনচক্র খুনীদের বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়ে তাদের পুরষ্কৃত করেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার আজও হয়নি বলেই হত্যার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর কাঁধে চেপে আছে। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার কারণেও এ হত্যাকাণ্ডের বিচার বাঞ্ছনীয় ছিল। আসলে ক্ষমতাসীনরা সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কারণেই খুনীদের বিচার করতে চায় না।

সেনাবাহিনীর ওপর এ দায়িত্ব চাপিয়ে রাখতে চায়। এসব ক্ষমতালোভী সেনানায়করা কথার চমক দিয়ে সেনাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর অংশীদারিত্বের প্রশ্ন তুলেছে এ বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়ে তোলার জন্য। সংবিধানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। দেশরক্ষা, দেশের উন্নয়ন, দুর্যোগকালে সহায়তা –এ সকল ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনীর দায়িত্ব রয়েছে। সঙ্গীন নয়, সহৃদয়তাই স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর সাথে জনগণের সম্পর্কের মাপকাঠি। অথচ উচ্চাভিলাষীরা সমঝোতা ও ভ্রাতৃত্বের সাংবিধানিক সেতু ভেঙে জনগণ ও সৈনিকদের মধ্যে প্রতিপক্ষ চেতনার স্থায়ী সংঘর্ষ বাধিয়ে ক্ষমতা ভোগ করতে চায়। ১৫ আগস্টের পর যেমনি জনগণ হারিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার, দেশে বৃদ্ধি পেয়েছে সঙ্কট — ঠিক তেমনি সেনাবাহিনীর সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে, তাদের করে তোলা হয়েছে বিতর্কিত। এ অবস্থা দেশের জন্য কিছুতেই কল্যাণকর হবে না। ধুরন্ধর ক্ষমতালোভীরা সৈনিক ও জনতার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে সেনাবাহিনী ও জনগণের ওপর কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব চালিয়ে যাচ্ছে গত দশ বছর ধরে।

সেনাবাহিনী জনগণের পবিত্র আমানত। তারা দেশ রক্ষা করবে, দেশ শাসন করা তাদের দায়িত্ব নয়। আমি স্পষ্টই মনে করি রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ সৈনিকের নৈতিক উন্নতি ব্যাহত করে ও দেশবাসীর সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে আজ দেশে সামরিক শাসন স্থায়ী করার যে কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে তাতে সর্বনাশের পথই সুগম হবে। ক্ষমতার স্বার্থে সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। একাজ কারও জন্যই শুভ নয়। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকার অত্যন্ত কষ্টকর সময়ে দেশবাসীর অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে এ সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছেন এবং তার শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সংগ্রাম সামরিক শাসনের পরিবর্তে গণতন্ত্র অর্জনের সপক্ষে। সামরিক ও বেসামরিক যে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী আজ ব্যক্তিস্বার্থে জাতীয় সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করছে তাদের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সংগঠন আওয়ামী লীগ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ সহযোদ্ধা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকই ক্ষুণ্ণ হতে দিতে চায় না; বঙ্গবন্ধুর এ প্রিয় সেনাবাহিনী তাঁর আদর্শের পথ থেকে বিচ্যুত হবে, বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে আমারও তা কাম্য নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে এদেশে সেনাবাহিনী তার যোগ্য মর্যাদা পাবে এ প্রত্যাশা দেশবাসীর সাথে আমারও রয়েছে। সেনাবাহিনী জাতির প্রতিবন্ধক নয়; ক্ষমতালোভীদের উচ্চাভিলাষই হচ্ছে সকল প্রতিবন্ধকতার উৎস। বঙ্গবন্ধু তাঁর সৈনিকদের বলেছিলেন, “তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানি মনোভাব না আসে। …. তোমরা হবে আমাদের জনগণের বাহিনী। … তোমরা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবে। যেখানে অন্যায়-অবিচার দেখবে, সেখানে চরম আঘাত হানবে।” বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে অসৎ উদ্দেশ্যে যারা ক্ষমতার উচ্চাশায় উন্মাদ হয়ে সামরিক শাসনের চক্রান্তে জনগণের গণতান্ত্রিক ক্ষমতাকে বন্দি করেছে, তাদের হাত থেকে ক্ষমতা উদ্ধার বঙ্গবন্ধুর তিল তিল শ্রমে গড়া সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন সমুন্নত থাকবে এ প্রত্যাশা আমারও রয়েছে ।

রচনাকাল : আগস্ট ১৯৮৩, প্রকাশিত : আমি তোমাদেরই লোক (সংকলন)

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার