অকল্পনীয় বর্বরতার নজির পাকুয়াখালী গণহত্যা
ফিচার ডেস্ক
সবুজের চাদঁরে ঢাকা সুপ্র মেঘের পরশ ছোঁয়ানো এক স্বপ্নীল ও রুপময় ভূ-খন্ড নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। অপার সম্ভাবনার এই অঞ্চলটি পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের আগে ছিল অশান্ত এক দূর্গম জনপদ। তার মাঝে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি রাঙ্গামাটি, পার্বত্য জেলা। যেখানে ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সালে সংগঠিত হয়েছিল ভয়াবহ হৃদয় বিদায়ক অমানবিক হত্যাকাণ্ড পাকুয়াখালী গণহত্যা। যে গণহত্যার করুন কাহিনী আমাদেরকে আজও শিহরিত করে তোলে। স্বাধীনতার পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)- এর সশস্ত্র সংগঠন শান্তি বাহিনীর হাতে অসংখ্যবার পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা গণহত্যার শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ভয়াবহ হৃদয় বিদায়ক অমানবিক হত্যাকাণ্ড এটি।
শান্তিবাহিনীর হত্যাকাণ্ড গুলোর মধ্যে রাজনগর গণহত্যা, পাকুয়াখালী ট্রাজেডি, মাটিরাঙ্গা গণহত্যা, দীঘিনালা গণহত্যা, কাউখালী গণহত্যা, রাজস্থলী গণহত্যা, ভাইবোনছড়া গণহত্যা, পানছড়ি গণহত্যা, ভূষণছড়া গণহত্যা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক শত বছরের ইতিহাস ঘাটলেও পাকুয়াখালী গণহত্যার মতো এমন ধ্বংসযজ্ঞের আর কোন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানী হায়েনারাও বাংলাদেশে এমন জঘন্যতম ঘটনার জন্ম দেয়নি।
তবে এই দিনে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার পাকুয়াখালীতে নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালি কাঠুরিয়াদের উপর নির্মম হত্যাকান্ড চালিয়ে তাদের বিভৎস মানসিকতার এক জঘন্যতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।
স্বাধীনতার পর পরই পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি বিনষ্টকারী সন্ত্রাসী সংগঠন জেএসএস তথা শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পার্বত্যাঞ্চলের সহজ-সরল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোকে স্বাধীন জুম্মল্যাণ্ড প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়ে শুরু করে সশস্ত্র তৎপরতা। প্রথম থেকেই তারা নিরাপত্তা বাহিনী এবং নিরীহ বাঙালিদের বিরুদ্ধে চালাতে থাকে একের পর এক আক্রমণ। নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালিদের উপর হাজার হাজার সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করেছে এই সন্ত্রাসীরা। শান্তিবাহিনী এ পর্যন্ত হত্যা করেছে ৩৮ হাজারেরও বেশি বাঙালিকে। এর মধ্যে কিছু কিছু গণহত্যার ঘটনা আছে যেগুলোকে কোনভাবেই কোনো মানুষের কর্ম বলে বিশ্বাস করা যায় না। যার মধ্যে অন্যতম ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ রাঙ্গামাটির পাকুয়াখালী গণহত্যা। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল আছেন তারা পাকুয়াখালী গণহত্যাকে শান্তিবাহিনীর নৃশংসতম গণহত্যা বলে স্বীকার করেন। কেননা সেদিন শান্তিবাহিনী মিটিং করার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ডেকে নিয়ে ৩৫ জন নিরীহ বাঙালি কাঠুরিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। অবাক করার বিষয় হচ্ছে যে, শান্তিবাহিনী সেদিন এতগুলো মানুষকে হত্যা অমানুষিক কষ্ট দিয়ে যাতে একটি বুলেটও ব্যবহার করেনি। হাত-পা বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, দা-দিয়ে কুপিয়ে এবং বন্দুকের বেয়নেট ও অন্যান্য দেশি অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নানাভাবে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করেছিল এই অসহায় মানুষগুলোকে। প্রতিটি লাশকেই বিকৃত করে সেদিন চরম অমানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তারা। বর্বর এ হত্যাকান্ডের স্মরণে এখনো শিউরে ওঠে লংগদুর মানুষ।
এসময় পুরো পার্বত্যাঞ্চলই ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত। শান্তিবাহিনী এসময় স্ব-ঘোষিত অস্ত্র বিরতি দিয়ে, চাঁদা আদায় এবং অস্ত্র সংগ্রহের প্রতিই বেশি মনোযোগী ছিল। সেই সাথে সরকারের সাথে নিজেদের দাবী-দাওয়া নিয়ে দেন-দরবার করার জন্যও সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। অন্যদিকে নিজেদের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছিল সর্বাত্মকভাবে। তাই, তখন পার্বত্যাঞ্চলের নিরীহ অসহায় পাহাড়ি-বাঙালিরা শান্তিবাহিনীকে নিয়মিত চাঁদা দিয়ে পাহাড় থেকে বাঁশ-কাঠসহ অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করছিল। রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার সীমান্তবর্তী বাঘাইছড়ির পাকুয়াখালীতেও একই অবস্থা চলছিল। এখানে প্রতিদিন শত শত পাহাড়ি এবং বাঙালি কাঠুরিয়া শান্তিবাহিনীকে চাঁদা দিয়ে বাঁশ এবং গাছ কাটতে যেত। লোকজন পাহাড়ে গিয়ে গাছ, বাঁশ কেটে নিয়মিত চাঁদা দিয়ে ফিরে আসত।
চাঁদা আদায় সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনার জন্য মাঝে-মধ্যে পাহাড়ে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঠুরিয়াদের বৈঠক হতো। একইভাবে ৯ সেপ্টেম্বর ’৯৬ একটি বৈঠক ডাকা হয়। এই বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য কাঠ ব্যবসায়ীদেরও নেয়ার জন্য শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়। শান্তিবাহিনীর কালেক্টর লংগদু থানার মাইনিমুখ বাজারে এসে ব্যবসায়ীদের চিঠির মাধ্যমে বৈঠকে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু ইতিপূর্বে কোনো বৈঠকে ব্যবসায়ীদের এভাবে গুরুত্ব দিয়ে ডাকা হয়নি। ফলে ৯ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে ব্যবসায়ীদের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ায় ব্যবসায়ীরা বিষয়টি এড়িয়ে যায়। কিন্তু কাঠুরিয়ারা প্রতিদিনের মতো সেই দিন সকাল বেলা স্বাভাবিকভাবেই পাহাড়ে প্রবেশ করতে শুরু করে। কে জানতো এটাই
হবে পাকুয়াখালীর কাঠুরিয়াদের শেষ বৈঠক। তখন শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদেরকে জানানো হয়, বড়বাবু আজ সবার সঙ্গে মিটিং করবেন। তাই আগে মিটিং-এ যেতে হবে। এর পর যে যার কাজে যাবে। একথা বলেই এক সাথে চার-পাঁচজন বাঙালি কাঠুরিয়াকে কিছুদূর নিয়ে হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেদিনকার বাঁধা অবস্থা থেকে পালিয়ে আসা একমাত্র ব্যক্তি মোহাম্মদ ইউনুছ মিয়া। এই ইউনুছ মিয়ার দেখানো পথ ধরেই ১১ সেপ্টম্বর খুঁজে বের করা হয় ২৮ জনের ক্ষত-বিক্ষত, বিকৃত লাশ। কারো হাত নেই, কারো চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, কারো কেটে নেয়া হয়েছে কান কিংবা পুরুষাঙ্গ। কাউকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে থেতলে দেয়া হয়েছে মাথা। আবার কাউকে জবাই করা হয়েছে অমানবিকভাবে। অপর ৭ হতভাগ্যেরতো লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমন নির্মম দৃশ্য দেখে সেদিন পার্বত্যাঞ্চলের আকাশ-বাতাস স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। শোকে ভারি হয়ে ওঠেছিল পাকুয়াখালীর মানুষ। পরে উদ্ধার করা লাশগুলি এনে লংগদু উপজেলা মাঠ সংলগ্ন খোলা যায়গায় দাফন করা হয়।
তবে ১ নভেম্বর ১৯৯৬ দৈনিক জনকণ্ঠের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, উক্ত প্রতিবেদনে শান্তিবাহিনীকেই পাকুয়াখালী ট্রাজেডির জন্য দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার দুই যুগ পরেও শান্তিবাহিনীর সন্ত্রসীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কোন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়নি। পুনর্বাসন করা হয়নি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে। ক্ষতিগ্রস্থদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারেও কোন দায়িত্ব নেয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। তাই আজ তারা শিাক্ষা-দীক্ষাহীনভাবে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে।
১৯৯৭ সালে শান্তিবাহিনী সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে অস্ত্র জমা দিলেও তারা তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে আসেনি, পাহাড়ে অস্ত্রবাজী এবং চাঁদাবাজি রয়ে গেছে আগের মতোই। পাহাড়ে সংগঠিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দেখে বুঝা যায় ধীরে ধীরে তারা অস্ত্রের মজুদ রাড়িয়ে আরো শক্তিশালী হচ্ছে। মাঝে-মধেই জেএসএস নেতাদের আবারো জঙ্গলে গিয়ে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার হুমকি থেকেও এটা প্রমাণিত। তাছাড়া কোন অপকর্ম করে বিচারের সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা যদি না থাকে তাহলে অপরাধীরা তো তাদের অপকর্মে উৎসাহ পাবেই। তাই মানবাধিকার এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই পাকুয়াখালী গণহত্যাসহ সকল হত্যাকান্ডের তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন। অন্যথায় পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা কোনদিনই সফল হবে না।