সন্ত্রাসীদের অপরাধের খড়্গ সাধারণ রোহিঙ্গাদের ঘাড়ে
নিউজ ডেস্ক
কক্সবাজারের উখিয়ার থাইংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস ১৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ নোমানের। গত নভেম্বরে টেকনাফের জাদিমুরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছোট মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল সে। সেখানে কয়েক দিন থাকার সুবাদে স্থানীয় এক কিশোরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। এক বিকেলে বন্ধুর হাত ধরে স্থানীয় কিশোরদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে গেলে প্রথমে তাকে খেলায় নিতে চাইলেও রোহিঙ্গা পরিচয় জেনে আপত্তি ওঠে।
স্থানীয় কিশোরদের অনেকে তাকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বলে কটূক্তি করে। এতে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে মামার বাসায় না ফিরে থাইংখালী ক্যাম্পে নিজ বাড়িতে ফিরে যায় নোমান। মাকে সে বলে, যেভাবে হোক মিয়ানমারের রাখাইনে ফিরে যেতে হবে। যে আরসা তার বাবাকে হত্যা করেছে, তার পরিবারকে নিয়মিত হত্যার হুমকি দিচ্ছে, সেই তাকে ওই গোষ্ঠীর (আরসা) লোক হিসেবে ট্যাগ লাগিয়ে স্থানীয়রাও গালমন্দ করছে।
রোহিঙ্গারা জানায়, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নোমানের মতো অনেকে রয়েছে, যাদের অবস্থান কঠোরভাবে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। তারা কোনো না কোনোভাবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে বা স্বজন হারিয়েছে। অথচ তাদের পরিবারের সদস্যরা আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে বের হলে স্থানীয়দের কাছ থেকে উল্টো কটাক্ষের শিকার হয়।
আশ্রয়কেন্দ্রের রোহিঙ্গারা জানায়, উখিয়া ও টেকনাফে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাস।
সেসব স্থানে সব সশস্ত্র সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা পাঁচ থেকে ১০ হাজার হতে পারে। তারা ক্যাম্পে গোলাগুলি, হত্যা, ডাকাতি, অপহরণ, মাদক ব্যবসা ও মানবপাচার নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যাম্পের বাইরেও একই ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত তারা। স্বল্পসংখ্যক দুষ্কৃতকারীর কাছে ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গারা যেমন অনিরাপদ, তেমনি স্থানীয় বাসিন্দারা ঝুঁকিতে রয়েছে। স্থানীয়রা ওই রোহিঙ্গা দুষ্কৃতকারী সন্ত্রাসীদের কারণে পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ পোষণ করে।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গা আগমনের সময় এই পরিস্থিতি ছিল না।
টেকনাফের সাবেক স্কুল শিক্ষক জাহেদ হোসেন বলেন, ‘একসময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বলতে একটি শান্ত, শৃঙ্খল ও ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনকারী জনগোষ্ঠীকে জানতাম। কিন্তু এখন মানুষ খুন, মাদক ব্যবসা, অপহরণ, ডাকাতিসহ সব অপরাধ তারাই করছে। তাদের কারণে পুরো কক্সবাজারবাসী হুমকিতে রয়েছে।’ জাহেদ হোসেনের মতো কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের অপরাধের জন্য উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দুষছেন নিয়মিত।
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যুবনেতা মোহাম্মদ বলেন, ‘কিছু অসৎ লোক রয়েছে যারা নিয়মিত অস্ত্র দিয়ে মানুষ হত্যা, ডাকাতি, অপহরণ ও মাদক ব্যবসার মতো জঘন্য কাজে জড়িত রয়েছে। তারা বৃহত্তর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন অংশ। তাদের কাছে ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গারাও নিরাপদ নয়। বাংলাদেশের স্থানীয় অনেক মানুষ মাত্র কয়েক শ খারাপ রোহিঙ্গার কর্মকাণ্ডের জন্য পুরো রোহিঙ্গা জাতিকে সন্ত্রাসী বা অপরাধী বলে ধারণা করে। সেটি শুনতে আমাদেরও খারাপ লাগে। কারণ ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গারা শান্তিপ্রিয়, মজলুম এবং বাংলাদেশের সরকার ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এ কারণে হাতে গোনা কয়েক শ রোহিঙ্গার অপরাধের খড়গ মাথায় নিতে আমরা নারাজ।’
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বৃদ্ধ আজগর আলী বলেন, ‘২০১৭ সালে রাখাইন সংকটের সময় এ দেশের মানুষ আমাদের আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে। যখন কোনো আশ্রয় ছিল না তখন নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছিল, নিজেরা না খেয়ে আমাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছিল, আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমাদের কিছু ভাই পথভ্রষ্ট হয়ে ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গাদের হত্যা, ডাকাতি ও অপহরণের পাশাপাশি স্থানীয় বাংলাদেশিদেরও অনেক ক্ষতি করেছে। অপরাধের সঙ্গে জড়িত এসব রোহিঙ্গার ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রমকে সমর্থন করেছি। প্রয়োজনে দুষ্কৃতকারী ও সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সাধারণ রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা একসঙ্গে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে পারি।’
টেকনাফ সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গাদের একটি ক্ষুদ্র দুষ্টচক্র বা সন্ত্রাসীর কারণে ১০-১২ লাখ রোহিঙ্গাকে দায়ী করা ঠিক নয়। এতে স্থানীয় ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভবিষ্যতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। উভয় জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে। তাই পুরো জনগোষ্ঠীকে দোষারোপ না করে সাধারণ রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে লড়তে হবে। এ ছাড়া স্থানীয় ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে বেসরকারি সংস্থাগুলো ভূমিকা রাখতে পারে।