খোদ রাজধানীতেই সুরক্ষিত নয় মিয়ানমারের জান্তা সরকার - Southeast Asia Journal

খোদ রাজধানীতেই সুরক্ষিত নয় মিয়ানমারের জান্তা সরকার

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

অ্যাডাম সিম্পসন

২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে বেশ কয়েকটি দেশ রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় তাদের আগেকার অঙ্গীকার অনুযায়ী পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করেছে। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলাটিতে তারা পক্ষভুক্ত হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এদিকে মিয়ানমারের যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন আইসিজে ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চলমান অপরাধের বিচারে প্রভাব ফেলতে পারে।

২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর এ মামলায় দুটি পক্ষ পৃথকভাবে পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন জানায়। প্রথমটি মালদ্বীপ। আর দ্বিতীয়টি যৌথভাবে কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্য। আইসিজের ৬৩ ধারা অনুযায়ী তারা এ আবেদন করে। আবেদনটি গ্রহণ করা হলে এ মামলায় দেশগুলো পক্ষভুক্ত হবে।

রোহিঙ্গা গণহত্যার ছয় বছর পর এবং আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার অভিযোগ দায়েরের চার বছর পর সত্যিকার অর্থে অভ্যুত্থানের নেতা ও জ্যোষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের বিপদের বাড়ল।

পক্ষভুক্ত হওয়ার জন্য যারা আবেদন করেছে তাদের মধ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দুটি স্থায়ী সদস্য দেশ যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স রয়েছে। এ ছাড়া ইউরোপের প্রভাবশালী দেশ জার্মানিও রয়েছে।

যদিও এখন পর্যন্ত জার্মানির ফেডারেল পাবলিক প্রসিকিউটর জেনারেল আন্তর্জাতিক এনজিও ফোরটিফাই রাইটসের উদ্যোগে চালু হওয়া একটি বৈশ্বিক বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে রাজি হননি। এই মামলাটিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জনগোষ্টীর বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক পরিসরে মিয়ানমারের সেনা কর্তাদের বিরুদ্ধে বিচারিক পদক্ষেপ যখন এগিয়ে চলছে, তখন মিয়ানমারের জান্তা সরকার যুদ্ধক্ষেত্রে বিশাল বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। একের পর এক পরাজয় জান্তা সরকারকে অস্তিত্বের সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে। ২৭ অক্টোবর সফল অভিযান পরিচালনার পর জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো দেশের বিভিন্ন অংশে চালকের আসনে রয়েছে।

তিনটি সশস্ত্র সংগঠনের জোট ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স উত্তরাঞ্চলীয় শান স্টেটের দুটি প্রধান শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর থেকে ১২০টি সেনাছাউনি ও ঘাঁটি দখলে নিয়েছে।

এর পরপরই পূর্ব মিয়ানমারের কারেননি ও কারেন প্রতিরোধ যোদ্ধারা জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর ওপর হামলা শুরু করে। সবচেয়ে বড় হামলাটি করা হয় মধ্যাঞ্চলের সায়াগনে। এ হামলায় নির্বাসিত বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) সশস্ত্র সংগঠন জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী কাউলিন শহর দখলে নিয়েছে।

জাতীয় ঐক্য সরকার ডিসেম্বরের শুরুতে ঘোষণা দেয় কাউলিন হলো জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর দখলে নেওয়া জেলা পর্যায়ের প্রথম শহর, যেখানে পুরোপুরি বেসামরিক প্রশাসন চালু করা হয়েছে।

এদিকে নভেম্বরের মাঝামাঝি মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ১২ মাস ধরে চলা অস্ত্রবিরতি ভেঙে দিয়েছে। মিয়ানমারে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে আরাকান আর্মি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ব্রাদারহুড় অ্যালায়েন্সের সদস্য। যুদ্ধবিরতির পর হামলা চালিয়ে তারা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সীমান্ত চৌকি এবং চারটি প্রধান শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে।

এর ফলে, গ্রামগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আরাকানের প্রতিবেশী চিন রাজ্যে, সেখানকার জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী কমপক্ষে দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এখানকার সংঘাতের কারণে সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার মানুষ।

সাম্প্রতিক এসব হামলা মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের গতিমুখে বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ও গাজা যুদ্ধের কারণে যে সংঘাত এত দিন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একেবারেই গুরুত্ব পেত না, সেই সংঘাত এখন সংবাদমাধ্যমের খবরের শিরোনাম হচ্ছে।

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠছে, তার নজির দেখা গেল ৪ ডিসেম্বর ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার প্রথম পাতায় কারেন জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নকে নিয়ে করা প্রতিবেদন থেকে ।
গৃহযুদ্ধ–পরবর্তী মিয়ানমার সরকারের ধরন কেমন হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এ থেকেও প্রমাণ হয় যে মিয়ানমার নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির মনোযোগ তৈরি হয়েছে।

নির্বাসিত জাতীয় ঐক্য সরকার মিয়ানমারে ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতি জোর দিচ্ছে। ক্ষমতায় গেলে তারা কেন্দ্রীয় গণতান্ত্রিক সনদ বাস্তবায়ন করতে চায়। কিন্তু জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো মিয়ানমারের বামার জাতিগোষ্ঠীর আধিপত্য নিয়ে হতাশা জানিয়ে আসছে। মিয়ানমারের সরকার ও সামরিক বাহিনীতে বামাররা আধিপত্য করছে। নির্বাসিত বিরোধীদের জাতীয় ঐক্য সরকারের অনেকেই বামার।

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের এই ধারা যদি চলতে থাকে তাহলে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো জাতীয় ঐক্য সরকারের নেওয়া মিয়ানমারকে গণতান্ত্রিক ও ফেডারেল রাষ্ট্র গড়ার আকাঙ্ক্ষায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আরাকান আর্মির দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। জাতীয় ঐক্য সরকারে সামরিক দিক থেকে সবচেয়ে বড় অবদান আরাকান আর্মির। যুদ্ধের পর তারা মিয়ানমারকে স্বাধীন রাজ্যগুলোর যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী, যেখানে রাখাইন জনগোষ্ঠী নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সক্ষম। কিন্তু কেন্দ্রীয় গণতান্ত্রিক কিংবা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার গড়ে তোলা এখনো অনেক দূরের পথ।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা এখন তাঁদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে যে মামলা হচ্ছে, তা নিয়ে সতর্ক রয়েছে। এ মামলার রায় তাদের বিরুদ্ধে গেলে তার প্রভাব কী হবে তা নিয়ে সজাগ তারা। ক্ষমতায় থাকার জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের হাতে এখনো অনেক কৌশল রয়েছে। এর মধ্যে নাজুক ও সংঘাতময় সীমান্ত এলাকা থেকে সরে এসে কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ক্ষমতা সংহত করার মতো কৌশলও নিতে পারে তারা।

কিন্তু গত দুই মাসের ঘটনাপ্রবাহ বলছে যে, মিন অং হ্লাইং মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতেই সুরক্ষিত নন।

অ্যাডাম সিম্পসন, জ্যোষ্ঠ প্রভাষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ইউনিভার্সিটি অব অস্ট্রেলিয়া
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত