গুলি, মর্টার শেল আর বিস্ফোরণের শব্দ, সরেজমিনে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত - Southeast Asia Journal

গুলি, মর্টার শেল আর বিস্ফোরণের শব্দ, সরেজমিনে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত

গুলি, মর্টার শেল আর বিস্ফোরণের শব্দ, সরেজমিনে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

সীমান্ত পরিস্থিতির খবর সংগ্রহ করতে এসে গাড়ি থেকে নেমেই আঁতকে উঠতে হলো গুলি আর মর্টার শেলের শব্দে। কিছুক্ষণ পরপর মিয়ানমার অংশে যখন একটানা গোলাগুলি আর মর্টার শেলের বিস্ফোরণ হচ্ছিলো, তখন দ্বিগবিদিক ছোটাছুটি করতে দেখা যায় বাংলাদেশ সীমান্তের মানুষজনকে।

তাদের কেউ কাজ করছিলেন ফসলি জমিতে, কেউ গৃহস্থলির কাজ ছেড়ে একটু পরপর আশ্রয় নিচ্ছিলেন নিরাপদ ছাউনির খোঁজে। গোলাগুলি কমলে আতঙ্ক আর ভয় নিয়ে কাজে নামেন।

কথা হয় উখিয়ার সীমান্তবর্তী পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল গ্রামের কৃষক শফিকুর রহমানের সাথে। তার জমি মিয়ানমারের ঢেঁকিবুনিয়া সীমান্তের কাছেই। গত তিন দিনে জমিতে যতবার কাজ করতে নেমেছেন, আতঙ্ক নিয়েই আবাদ করতে হয়েছে। কিন্তু মঙ্গলবার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে সকাল থেকে কাজেই নামতে পারেন নি।

গোলাগুলির শব্দ একটু কমতে থাকায় দুপুরের দিকে কাজে নামেন। মাত্র দশ মিনিট পরই ভয়াবহ গোলাগুলি শুরু হওয়ায় তিনি আর সাহস পাচ্ছিলেন না কাজে নামার।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ধানী জমিতে গুলি এসে পড়ছে। কখন যে কি হয়ে যায়, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। কিন্তু কাজ না করলে তো পেট চলবে না”।

গুলি, মর্টার শেল আতঙ্কে ঘর ছাড়ছেন অনেকে

মঙ্গলবার ভোর রাতে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের মানুষজনের ঘুম ভাঙ্গে তীব্র বিষ্ফোরণ আর গুলির আওয়াজে। সকালে এলাকাটিতে গিয়ে দেখা যায় মানুষজনের চোখে মুখে আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তা।

তারা জানাচ্ছিলেন, প্রত্যেকের পরিবারেই আছে নারী ও শিশু। সবচেয়ে ভয়ে আছেন তারা। কারণ তাদের অনেকেই বলছিলেন কারো কারো বাড়ির টিনের চালে বুলেট এসে পড়েছে ভোরের পর থেকে।

রহমতের বিল গ্রামের বখতিয়ার আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ”আমার পরিবারে দুই বাচ্চা। গুলির শব্দে গত কয়েকদিন অনেক ভয় পাইছে। আজকে ভোরের পর ওদের কান্না বন্ধ হচ্ছে না। ফজরের আজানের পর আর কেউ ঘুমাতে পারি নাই।”

তিনি জানান, এমন অবস্থায় সকালেই তিনি তারা স্ত্রী ও বাচ্চাদের দিয়ে এসেছেন উখিয়া বাজারের কাছাকাছি এক স্বজনের বাসায়। যেহেতু বাড়িতে মালামাল ও গবাদিপশু রয়েছে তাই তিনি ফিরে এসেছেন বাড়িতে।

এমন অবস্থায় বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন অনেকেই।

পালংখালীর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আলতাস আহমেদ বিবিসি কাছে পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলছিলেন, “সব কাজ কর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। গুলি, মর্টার শেলের গোলা এসে পড়তেছে। গুলির খোসা এসে পড়তেছে। মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে মানুষের ঘরে রান্না বান্না পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে”।

বিজিবির রামু জোনের সেক্টর কমান্ডার মেহেদী হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এলাকার বাসিন্দারা যেনো নিরাপদে থাকার চেষ্টা করেন। এই মুহূর্তে যদি প্রয়োজন না হয়, সীমান্তের কাছাকাছি না যাওয়াই ভালো”।

মঙ্গলবার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এলাকাগুলো গিয়েছিলেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারও।

পালিয়ে আসা মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা আশ্রয় নিয়েছেন রহমতের বিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্কুল কেন্দ্রে
পালিয়ে আসা মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা আশ্রয় নিয়েছেন রহমতের বিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্কুল কেন্দ্রে

গুলি, মর্টার শেলের ভয়ে পালিয়ে আসছে যারা

বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি বরাবর মিয়ানমার বর্ডারে তিনটি ক্যাম্প আছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর।

ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি থেকে বাংলাদেশের লোকালয় প্রায় ৮০০ মিটার দূরে। ঢেঁকিবনিয়া ও ঘুমধুমের মাঝখানে নাফ নদীর সরু একটি শাখা ও প্যারাবন রয়েছে। এ কারণে তুমব্রু রাইট ক্যাম্পে গোলাগুলির সময় বাংলাদেশের বসতঘরে গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে।

এসব স্থানের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশিদের সাথে বিবিসি বাংলার কথা হয় মঙ্গলার।

তারা জানাচ্ছিলেন, জান্তা বাহিনীর সাথে যুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর এই যুদ্ধ চলছে গত তিন মাস ধরে। গত সোমবার ৩৪ নম্বর পিলার রাইট ক্যাম্পটি দখলে নেয় বিদ্রোহী আরাকান আর্মি গ্রুপ। এরপর তারা সামনের দিকে আগাতে থাকে।

মঙ্গলবার ভোরে ঢেকিবুনিয়া ক্যাম্প দখলের চেষ্টা করে আরাকান আর্মি। এরপরই সকাল থেকে ওপার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ অংশে ঢুকে পড়ে অন্তত ১১৪ জন।

বিজিবি সদস্যরা জানান, যারা পালিয়ে আসছিলো তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মিয়ারমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদস্য। অন্তত চারজন ছিলো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর। এছাড়াও মিয়ানমার কাস্টমস কর্মকর্তাসহ ছিলেন নারী ও পুরুষ।

মঙ্গলবার সকালে তারা সবাই রহমতের বিল সীমান্ত এলাকা থেকে পাড়ি দেয় বাংলাদেশে। তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর তাদেরকে নিয়ে আসা হয় স্থানীয় রহমতের বিল প্রাথমিক বিদ্যালয় স্কুলে।

সেখানে দেখা যাচ্ছিলো, তাদের কাছ থেকে শুরুতেই অস্ত্রগুলো জব্দ করে বিবিজির সদস্যরা। তাদের কাছে থাকা মোবাইল মানিব্যাগসহ সব কিছুই রাখা হয় বিজিবি হেফাজতে। পরে একে একে সবার পরিচয় নিশ্চিত করে রাখা হয় ঐ স্কুলেই।

বিজিবির রামু সেক্টরের কমান্ডার মেহেদি হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার আইন রয়েছে সেই অনুযায়ী তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। ভাষাগত সমস্যার কারণে তাদের সব পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না”।

বিজিবির সদস্যরা তাদেরকে বিস্কুট ও পানি সরবারহ করছিলেন মাঝে মাঝে। যারা এখানে এসেছিলেন তাদের মধ্যে দুই থেকে তিনজন শিশু ও কয়েকজন নারীকেও দেখা যায়।

স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার আলতাস আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ”কারো কারো গায়ে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পোশাক। আবার কারো কারো পোশাক আশাক দেখে মনে হচ্ছিলো তারা সাধারণ সীমান্ত পারের বাসিন্দা। তারা ভয়ে পালিয়ে এসেছে”।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের হামলায় আহত বাংলাদেশিরা!

পালংখালীর রহমতের বিলের পাশেই নলবুনিয়া গ্রাম। মঙ্গলবার সকালে সীমান্ত লাগোয়া এই গ্রামের ভেতর থেকে কয়েকজনকে অস্ত্রসহ বাংলাদেশে ঢুকতে দেখেন নলবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দারা।

নলবুনিয়ার বাসিন্দারা তাদের বাধা দিলে হামলা করে সশস্ত্র ঐ গ্রুপটি। যেখানে ১২ থেকে ১৪ জন। এসময় তারা হামলা চালায় গ্রামবাসীদের ওপর। এতে সাতজন আহত হওয়ার কথা বলছেন গ্রামবাসী।

ঐ গ্রামের পয়ত্রিশোর্ধ শফিকুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আহত সাতজনকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমরা যতটুকু জানি তারা সবাই মুসলমান এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য”।

  • কক্সবাজারের অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।

মি. ইসলাম বলছিলেন, যারা গোলা বারুদ নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন, এই গোলাবারুদগুলো প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে নেয়া উচিত। তা না হলে এই এলাকায় আতঙ্ক আরো বাড়বে।

গুলি, মর্টার শেলের বিপরীতে কতটা সুরক্ষিত সীমান্ত এলাকা?

সীমান্তের দক্ষিণ ঢেকিবুনিয়ার বাংলাদেশ অংশের আঞ্জুমানপাড়া এলাকার দিকে আমরা যাই বিকেল তিনটার দিকে। তখন এই সীমানা দিয়ে বাংলাদেশ অংশে ঢুকে পড়ে আরেকটি গ্রুপ। যাদের সবাই ছিলো মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদস্য।

তারা এই অঞ্চল দিয়ে যখন প্রবেশ করে তখন এলাকায় বিজিবি সদস্যদের উপস্থিতি ছিলো তুলনামুলক কম। পরে পালংখালীর সীমান্ত ক্যাম্প থেকে বিজিবি সদস্যরা এসে মোট ৩৫ জনের মতো মিয়ানমার সীমান্ত বাহিনীর সদস্যকে আটক করে পাঠিয়ে দেয় ঘুমধুম ক্যাম্পে।

তখন সীমান্ত এলাকায় গিয়ে আমরা দেখতে পাই সীমান্তের ওপারে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলো। আঞ্জুমানপাড়ার বাসিন্দারা জানাচ্ছিলেন এই গোষ্ঠীই মুলত আরাকান আর্মি। যাদের সবাইকে ভারি অস্ত্র বহন করতে দেখা যায় সীমান্তের বাংলাদেশ অংশ থেকেই।

সীমান্তের বর্ডার লাইনে বিজিবির স্বাভাবিক যে পাহারা থাকে সেটি আরও জোরদার করার কথা বলা হলেও, মঙ্গলবার সীমান্তে গিয়ে তেমন কড়াকড়ি চোখে পড়েনি। বরং বিজিবির সদস্যরা সীমান্ত থেকে একটু ভেতরের দিকে অবস্থান নিয়ে ছিলেন।

সোমবার ঘুমধুমে বাংলাদেশের ভেতরে দুইজনের মৃত্যুর পর আতঙ্কে বাড়িঘড় ছেড়েছেন অনেকে। মঙ্গলবার ঘুমধুম সীমান্তে গোলাগুলি শব্দ কম পাওয়া গেলেও, যুদ্ধ পরিস্থিতি বেশি খারাপ ছিলো ঢেকিবুনিয়া সীমান্তে।

কিছুক্ষণ পরপর ছোট ছোট টিলা ধরে মাথা লুকিয়ে খালি গায়ে যাচ্ছিলেন অনেকেই। স্থানীয় আঞ্জুমানপাড়ার বাসিন্দারা বিবিসিকে বলেন, যারা পালিয়ে যাচ্ছেন তারা তাদের গায়ের জামা খুলে পালাচ্ছিলেন কারণ যাতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো তাদের সহজে শনাক্ত করতে না পারে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা।