দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে সেনাবাহিনী - Southeast Asia Journal

দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে সেনাবাহিনী

দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে সেনাবাহিনী

পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা, নির্মাণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পৃক্ত ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ছবি: সংগৃহীত

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

লে. কর্নেল এ এস এম নাছের

জাতির পরম আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠার সঙ্গে দেশ গঠনেও রেখে যাচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা। দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতায় ভাস্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। দেশপ্রেমের সুর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের অন্তরে ধ্বনিত হচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মে; সেই জন্মলগ্ন থেকে। ‘সমরে আমরা শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে’– এ মূলমন্ত্র হৃদয়ে ধারণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন সেবামূলক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

চিকিৎসাসেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের নির্দেশনায় সিএমএইচ ঢাকা সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের ফলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তির আধুনিক চিকিৎসাসেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে। চিকিৎসাক্ষেত্র প্রসারিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ (এএফএমসি) এবং ২০১৪ সালে ৫টি মেডিকেল কলেজ বগুড়া, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর ও রংপুর সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী তথা সার্বিকভাবে বাংলাদেশে সেবিকাদের ঘাটতির বিষয় বিবেচনায় এনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাঁচটি আর্মি নার্সিং কলেজ (বগুড়া, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, যশোর ও রংপুর) প্রতিষ্ঠা করার প্রশাসনিক অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে দুটি আর্মি নার্সিং কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সরকারের নির্দেশনায় ১৯৯৮ সালে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে সংগতি রক্ষা, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা এবং আধুনিক জ্ঞানচর্চার জন্য ২০১৩ সালে মিরপুর সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)। এ ছাড়া কারিগরি বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র ও ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে শিক্ষা প্রসারিত করার লক্ষ্যে কুমিল্লা, সৈয়দপুর ও কাদিরাবাদ সেনানিবাসে ৩টি আর্মি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএইউএসটি) এবং সাভার ও সিলেট সেনানিবাসে আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এআইবিএ) নামে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত ১২টি ক্যাডেট কলেজ, ৪৪টি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ এবং ১৯টি ইংলিশ মিডিয়াম/ভার্সনসহ সেনাবাহিনী-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্কুল-কলেজ শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উন্নত পরিবেশে মানসম্পন্ন শিক্ষা পেতে সক্ষম হচ্ছে।

সেনা পরিবার কল্যাণ সমিতির পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে প্রয়াস স্কুল প্রতিষ্ঠা একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। এ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে।

দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে সেনাবাহিনী
মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোডে এশটি পাইলিংয়ের নির্মাণকাজে সেনা সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সেনাবাহিনীর ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা বহুমুখী সেতু। পদ্মা সেতু নির্মাণ চলাকালীন নদী শাসন, নিরাপত্তার পাশাপাশি সেনাবাহিনী জাজিরা ও মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ এবং ব্রিজ অ্যান্ড ফ্যাসিলিটিজ সার্ভিস এরিয়ার কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক বাস্তবায়িত হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প জাতি গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের আরও একটি উদাহরণ। ঢাকা ও তার আশপাশে সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও যানজট নিরসনে হাতিরঝিল ইউলুপ, ঢাকা শহরের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের শিফটিংয়ের কাজ, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, মিরপুর এয়ারপোর্ট রোডে ফ্লাইওভার, বনানী লেভেল ক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ, ধানমন্ডি লেক উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প এবং রায়েরবাজার কবরস্থানের উন্নয়ন প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন করেছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে মহিপাল ফ্লাইওভারটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর নির্মাণের মাধ্যমে সহজে ও স্বল্প সময়ে যাতায়াত নিশ্চিত হয়েছে।

বাংলাদেশের সর্বাধিক উচ্চতাবিশিষ্ট সড়ক থানচি-আলীকদম সড়ক, চিম্বুক-থানচি সড়ক, বাঙ্গালহালিয়া-রাজস্থলী সড়ক, বান্দরবান-বাঙ্গালহালিয়া-চন্দ্রঘোনা-ঘাগড়া সড়ক, খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা-বাঘাইহাট সড়ক, দীঘিনালা-ছোটমেরুৎ-চঙ্গরাছড়ি-লংগদু সড়ক, বাঘাইছড়ি-মাসালং-সাজেক সড়ক এবং দীঘিনালা-মারিশ্যা সড়ক সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মাণ করার কারণে পাহাড়ি জনপদে এসেছে উন্নয়ন ও প্রাণের স্পন্দন। শিক্ষার হার বেড়েছে, রাস্তাঘাট উন্নত হয়েছে, বাজার অর্থনীতি ও বিপণন সফলতার মুখ দেখেছে, স্বাস্থ্যসেবায় সূচক উন্নত হয়েছে, চাষাবাদ বেড়েছে, জীবনধারায় পরিবর্তন এসেছে এবং কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে দারিদ্র্যের হার কমেছে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অতি গুরুত্বপূর্ণ ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ প্রকল্পটি ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্পসহ হাজারো প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন সম্পন্ন করে অর্জন করেছে জনগণের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও আস্থা। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়। সেনাসদস্যরা দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে।

দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে এক আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে আর্তমানবতার সেবায় জানমাল রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী যে আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তা দেশবাসীর কাছে প্রশংসিত। বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম অনেক দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে জাপানে ভয়াবহ সুনামি ও ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা সে দেশে জরুরি সহায়তা প্রদানসহ শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিয়ানমার, চীন, মিসর, মালদ্বীপ ও হাইতিতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দক্ষতার সঙ্গে দুর্যোগ মোকাবিলা করে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে।

সেনাবাহিনী মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের দায়িত্ব গ্রহণের পাশাপাশি তাদের কক্সবাজারে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে সহায়তা, চিকিৎসাসেবাসহ বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতায় দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে সবার হৃদয়ে স্থান করে নিয়ে দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করেছে। দেশের ক্রান্তিলগ্নে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ ও ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’-এর অধীনে জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে যে কোনো জাতীয় সমস্যা মোকাবিলায় সেনাবাহিনী আপামর জনসাধারণের আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে সুপরিচিত।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • সংবাদ সংশ্লিষ্ট ভিডিও পেতে আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হোন।

জাতীয় পরিচয়পত্র, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ও মেশিন রিডেবল ভিসা (এমআরভি) তৈরির ব্যাপারে সরকারের গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সেনাবাহিনী অত্যন্ত সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পালন করছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্প হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম দারিদ্র্য বিমোচন ও পুনর্বাসন প্রকল্প। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদাতিক ডিভিশনকে ভূমিহীন ও আশ্রয়হীন জনগোষ্ঠীর আবাসনের লক্ষ্যে সাম্প্রতিক অর্থবছরগুলোতে ব্যারাক নির্মাণের প্রকল্প দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ব্যারাক হাউস নির্মাণ সম্পন্ন করে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করায় জাতীয় পরিমণ্ডলে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে জাতীয় পর্যায়ের লোকসানি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) ২০০০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর পর এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্ট (বিডিপি) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

বিশ্বশান্তির দূত হিসেবে আজ পৃথিবীর অনেক দেশে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। আন্তর্জাতিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের আত্মত্যাগ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছেন সম্মান ও গৌরব। শান্তিরক্ষা মিশনে অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে তারা বিশ্বসমাজে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন এবং বিশ্ববাসীর কাছে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর করেছেন।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম। দেশমাতৃকার বিরুদ্ধে যে কোনো অপচেষ্টা নস্যাৎ করে উত্তরোত্তর উন্নতিকল্পে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় শপথে অঙ্গীকারবদ্ধ সেনাবাহিনী সদা প্রস্তুত। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশ সরকারের স্বপ্ন বাস্তবায়নে দেশের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় সততা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে ইতোমধ্যে সরকার এবং আপামর জনসাধারণের আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীকরূপে গণ্য। দেশের সার্বিক উন্নয়নের অংশীদার হতে পেরে সেনাসদস্যরা গর্বিত ও আনন্দিত ।

লে. কর্নেল এ এস এম নাছের, পিএসসি, জি+: সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা