জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনকে ব্যবহার করে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনকে ব্যবহার করে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনকে ব্যবহার করে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

আলমগীর হোসেন

শান্তিতে সমরে অনন্য বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। অপারেশনাল দক্ষতা, উচ্চ পেশাদারিত্ব এবং মানবিক কর্মকাণ্ডের গুণে বিশ্বব্যাপী এখন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা উচ্চ প্রশংসিত। পৃথিবীর বিভিন্ন গোলযোগপূর্ণ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৬৮ জন শান্তিরক্ষী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ২৬৬ জন।

বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের অনন্য এসব অবদানের জন্য উচ্চ প্রশংসা করে সম্মানজনক মর্যাদা দিয়ে থাকে খোদ জাতিসংঘ। অথচ বাংলাদেশের এই শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাদ দেওয়ার জন্য নতুন করে ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা শুরু করেছে স্বার্থান্বেসী মহল। এ ক্ষেত্রে এবার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়েছে। দেশীয় বা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার সশস্ত্র বাহিনী ও র‌্যাবকে নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ‘ডয়েচে ভেলে’ (ডিডব্লিউ)। বিভ্রান্তি ছড়াতে এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও তারা ইউটিউবেও প্রচার করে।

কতিপয় বিতর্কিত নামধারী সাংবাদিক বা রাজনৈতিক কর্মীর হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ডয়েচে ভেলের মতো স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমকে আস্থাহীনতার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা উচ্চমানের পেশাদারিত্ব এবং মানবিক আচরণের মাধ্যমেই জাতিসংঘসহ বিশ্বব্যাপী আস্থা ও সুনাম অর্জন করেছে। সেখানে এ ধরনের মিথ্যাচার নিঃসন্দেহে ষড়যন্ত্রের গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ বিষয়ে একাধিক সামরিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ডিডব্লিউর প্রতিবেদনটি যারা করেছে তারা হয়তো শান্তিরক্ষী নিয়োগের প্রক্রিয়ায় জানে না। আর জেনেও যদি এমন প্রতিবেদন করে থাকে তা হলে অবশ্যই এটি শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র অথবা শান্তিরক্ষা মিশনকে ব্যবহার করে মূলত বাংলাদেশের সরকারের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

জানা যায়, আগামী ২৯ মে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস। বর্তমানে আফ্রিকাসহ বিভিন্ন ১৩টি দেশে ৬ হাজারের অধিক শান্তিরক্ষী অত্যন্ত সুনাম ও মর্যাদার সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে মিশন সম্পন্ন করেছেন। এ ছাড়া জাতিসংঘের নির্দেশে বিভিন্ন গোলযোগপূর্ণ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৬৮ জন শান্তিরক্ষী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ২৬৬ জন। ঠিক এমন একটি সময়ে এসে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা তুলে ডিডব্লিউর প্রতিবেদন প্রকাশ করায় বিষয়টিকে কোনো ষড়যন্ত্রের নীল নকশা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ বা সোর্স উল্লেখ না করেই সেটিকে আবার ‘ডকুমেন্টারি’ হিসেবেও সংবাদ মাধ্যমটি দাবি করেছে। অন্যদিকে শান্তিরক্ষীদের বিতর্কিত ও অসম্মান করার ঠিক এক দিন আগেই সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ঘটনাও ঘটে। মুশফিক নামে বিদেশে থাকা একজন সাংবাদিকও বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সদর দফতরের নিয়মিত ব্রিফিংকালে অনলাইনে যুক্ত হয়ে সংস্থাটির মুখপাত্র স্টিফেন দোজারিকের কাছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী ও সরকারের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক নানা প্রশ্ন করেন। তার একটি ভিডিও আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রচার করেন বিতর্কিত সাংবাদিক কনক সারোয়ার। এদিকে ওই প্রশ্নকারী সাংবাদিক মুশফিকের প্রকৃত নাম মুশফিকুল ফজল আনসারি। যিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিএনপি নেতা হারিস চৌধুরী ভাগনে এবং বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সাবেক সদস্য সচিব। এ ছাড়াও বিতর্কিত সাংবাদিক কনক সারোয়ার ও তাসনিম খলিলের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলেও জানা যায়। ফলে এই সার্বিক বিষয়গুলো বা তৎপরতাকে একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। শান্তিরক্ষীদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে দূরত্ব বা বিরোধ সৃষ্টির সুক্ষ্ম পাঁয়তারা করা হচ্ছে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

যা বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. দেলোয়ার হোসেন : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা ১৯৮৮ সাল থেকে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন গোলযোগপূর্ণ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে আসছে। সর্বোচ্চ সুনামের অধিকারী হওয়ার কারণেই বাংলাদেশ এখন অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। যা এর আগেও একাধিকবার শীর্ষ অবস্থানে ছিল।’

ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই যে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী শীর্ষ মর্যাদা সম্পন্ন হওয়া বা শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শীর্ষ অবস্থান এটি কিন্তু কেউ করে দেয়নি। এটি কারও করুণা বা দয়া নয়। বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা তাদের উচ্চমানের পেশাদারিত্ব এবং মানবিক আচরণের মাধ্যমেই আস্থা ও মর্যাদা অর্জন করেছে। যা শান্তিরক্ষীদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়।’ তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও আফ্রিকার দেশ কঙ্গোতে (মুনস্কো) শান্তিরক্ষা মিশনের কার্যক্রম পরিদর্শন করেছি।

সেখানে দেখেছি কীভাবে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা সেখানকার স্থানীয় মানুষদের কাছে প্রিয়জনে পরিণত হয়েছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে শান্তিরক্ষীরা সেখানে নিয়োজিত ছিলেন তাদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের দারুণ একটা সম্পর্ক দেখেছি। এ চিত্র প্রায় সবখানেই। এমনকি বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা পৃথিবীর বিভিন্ন গোলযোগপূর্ণ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। সারা জীবনের জন্য অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। আর সেখানে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে নানাভাবে হেয় করাটা নিশ্চিতভাবেই সংকীর্ণ উদ্দেশ্য থেকে করা হচ্ছে।’

অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর যে সুনাম এবং কার্যক্রমের বিশ্বব্যাপী যে গ্রহণযোগ্যতা বা বিশ্বব্যাপী যে অবদান সেটিকে প্রতিফলন করে না। কেন বা কি উদ্দেশ্যে এ রকম একটি বিষয় অবতরণ করা হলো তা নিঃসন্দেহে রহস্যময়।’

সামরিক বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আলী শিকদারের অভিমত : এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ‘বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের নিয়ে ডয়েচে ভেলের যে প্রতিবেদন বা ডকুমেন্টারি বলা হচ্ছে সেটি সম্পূর্ণ অনুমানভিত্তিক। বাংলাদেশের পাঁচ হাজারের অধিক শান্তিরক্ষী বর্তমানে বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত আছে। তা হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে দুয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বা ইঙ্গিত দিয়ে এ ধরনের প্রতিবেদন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের ওই প্রতিবেদনে কোনো সোর্স নেই।’

সাবেক এই জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বলেন, ‘জাতিসংঘ মিশনে কীভাবে শান্তিরক্ষী নিয়োগ বা নিয়োজিত হয়, কি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয় সে সম্পর্কে যারা প্রতিবেদনটি করেছে তাদের সামান্য কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। যখন কোনো দেশের শান্তিরক্ষী নিয়োগ হয় তখন জাতিসংঘ থেকে বেশকিছু ‘রিক্যুয়ারমেন্ট’ দেওয়া হয়। যে ধরনের ‘রিক্যুয়ারমেন্ট’ জাতিসংঘ দেয় তার সবই শতভাগ নিশ্চিত করার পরেই শান্তিরক্ষী নিয়োজিত হয়ে থাকে। তারা প্রক্রিয়াটায় জানে না। জানলে এ ধরনের প্রতিবেদন করার কথা নয়। আর ধারণা থেকে থাকে তা হলে এ ধরনের প্রতিবেদন উদ্দেশ্যমূলক বা কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ।’

শান্তিরক্ষী নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ‘জাতিসংঘের যে সদর দফতর আছে নিউইয়র্কে সেখানে ‘শান্তিরক্ষী ডিভিশন’ আছে। যখন কোনো দেশের শান্তিরক্ষী মোতায়েন প্রয়োজন হয়, তখন তারা সবাই একসঙ্গে বসে কোন দেশ থেকে কতজন শান্তিরক্ষী নেবে তা ঠিক করা হয়। সেখানে তারা সব শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশের পূর্বের ‘পারফরমেন্স’ (কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা) গুরুত্বের সঙ্গে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর যে দেশকে শান্তিরক্ষী প্রেরণের দায়িত্ব দেয় সেটিও নিরাপত্তা পরিষদে পাস করতে হয়। অনুমোদন হলে অনেক ‘রিক্যুয়ারমেন্ট’ (প্রয়োজনীয় শর্তগুলো) পূরণ হলেই কেবল শান্তিরক্ষী নেওয়া হয়।’

বাস্তবতা যা বলছে : ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধে ‘মিলিটারি অবজারভারস’ গ্রুপে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশ সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে জাতিসংঘ মিশনে কাজ করে চলেছে। জাতিসংঘে ব্লু হেলমেটের প্রশংসা এখন বিশ্বব্যাপী। মিশনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের বীরত্ব ও ত্যাগের ইতিহাসও লম্বা। ২০০৫ সালে আফ্রিকার কঙ্গোতে ৯ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ পর্যন্ত মোট ১৬৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষা মিশনে নিহত হয়েছেন। উচ্চ পেশাদারিত্ব, সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ফলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছে বাংলাদেশ। গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার জন্য বিভিন্ন সময়ে স্বীকৃতিও মিলেছে জাতিসংঘের।

অথচ এতসব ইতিবাচক অবদানের পরেও ‘ডয়েচে ভেলে ও নেত্র নিউজ’ কোন উদ্দেশ্যে, কাদের লাভের জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার চালাচ্ছে সেটিই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একাধিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্বের একটি দেশ বিতর্কিত টিভি সঞ্চালক জিল্লুর রহমানের সেন্টার ফর গভরন্যান্স স্টাডিজকে (সিজিএস) অর্থায়ন করছে গণতন্ত্র বিকাশের কথা বলে। আর তাসনিম খলিলের নেত্র নিউজকে ফান্ডিং করছে আইনি সহায়তা ও মানবাধিকারের কথা বলে। আর বিতর্কিত এ দুটো সংস্থাই জেনে বুঝে টাকার কাছে জলাঞ্জলি দিচ্ছে দেশের সুনাম ও স্বার্থ। খুবই দুর্বল তথ্যের ভিত্তিতে তৈরিকৃত ডিডব্লিউর প্রতিবেদনটিকে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।