শপথ নিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা

শপথ নিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বঙ্গভবনের দরবার হলে তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পরে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ১৬ জনের মধ্যে ১৩ জনকে শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি। ঢাকার বাইরে থাকায় অন্য তিনজন শপথ নিতে পারেননি। তাঁরা পরবর্তী সময়ে শপথ নেবেন।

মন্ত্রিপরিষদসচিব মো. মাহবুব হোসেন শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।

রাষ্ট্রপতির সহধর্মিণী ড. রেবেকা সুলতানা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, বিচারপতি, বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি), সামরিক ও বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, কূটনীতিকবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র সাংবাদিকসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যে ১৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা হলেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ড. আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান খান, এ এফ হাসান আরিফ, তৌহিদ হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মো. নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, সুপ্রদীপ চাকমা, ফরিদা আখতার, বিধান রঞ্জন রায়, আ ফ ম খালিদ হাসান, নূরজাহান বেগম, শারমিন মুরশিদ ও ফারুক-ই-আজম।

শপথগ্রহণ শেষে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শারমিন মুরশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দেশটা ভেঙে গেছে। মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই সেগুলোকে ঠিক করা প্রয়োজন।

সুযোগ পেয়েছি। দেখা যাক, আমরা কেমন করি। একটা ভালো টিম হিসেবে আমরা নিশ্চয় ভালো করব।’

শপথগ্রহণের আগে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কার, বৈষম্য দূর করা, মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল কাজ হবে।’

চেয়েছিলেন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার, এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা তাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

তাঁরা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গেল জুলাইয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা পরিচালিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে গণমাধ্যমের সামনে কথা বলে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন নাহিদ ইসলাম। এরপর এই আন্দোলন আরো গতিশীল হলে আসিফ মাহমুদসহ অন্যরাও আলোচনায় আসেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে সরকার প্রথম দফায় কারফিউ জারি করার পর নাহিদ, আসিফসহ আরো কয়েকজন সমন্বয়ককে তুলে নেওয়া হয়েছিল। দুই দিন পর যখন নাহিদকে একটি রাস্তার পাশে ফেলে যাওয়া হয়, তখন তাঁর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছিল আঘাতের চিহ্ন। আর আসিফকে ধরে নিয়ে বিশেষ কোনো ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল বলে তাঁর চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন।

এরপর রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অন্য কয়েকজন সমন্বয়কের সঙ্গে তাঁদেরও তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্যরা। পরে তাঁদের দিয়ে একটি ভিডিও বার্তায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য করা হয়।

কিন্তু সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে তাঁরা আবার আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং এর ধারাবাহিকতার এক পর্যায়ে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করেন।

সহিংসতায় রূপ নেওয়া এই আন্দোলনের চাপে ৫ আগস্ট গণভবন ঘেরাও করতে যায় ছাত্র-জনতা। বিক্ষোভের মুখে সেদিনই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।

উপদেষ্টাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নবীনগরে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর হিসেবে ২০০৫ সালের ১ মে দায়িত্ব নিয়ে ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ এমএ করেছেন তিনি। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরে তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রশাসনে (সিএসপি) যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে তিনি অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

ড. আসিফ নজরুল : তাঁর জন্ম ১৯৬৬ সালে। লেখক, ঔপন্যাসিক, রাজনীতি বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের এই অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের আগে ১৯৯১ সালে তিনি ওই সময়ের বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করেছেন। তরুণ ছাত্রদের নেতৃত্বে ঘটা গণ-অভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীদের অভিভাবক হিসেবে সব সময় সামনের সারিতে দেখা গেছে ঢাবির এই শিক্ষককে। আন্দোলনরত কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে অভিভাবক হিসেবে থানা থেকে তাঁদের ছাড়িয়ে আনেন তিনি।

আদিলুর রহমান খান : মানবাধিকারকর্মী হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রতিষ্ঠাতা। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর জোট সরকারের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে আদিলুর রহমান খান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ফেডারেশনের (এফআইডিএইচ) সেক্রেটারি জেনারেলদের একজন। তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন।

ফরিদা আখতার : বেসরকারি সংস্থা উবিনীগের (উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা) নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে সুপরিচিত। ফরিদা আখতারের জন্ম চট্টগ্রামের চন্দনাইশের হারলা গ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেছেন। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের অবস্থা জানা এবং পরিবর্তনের জন্য নীতিনির্ধারণী গবেষণা ও লেখালেখি তাঁর প্রধান কাজ। নারী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্যসম্পদ, তাঁতশিল্প, গার্মেন্টসশিল্প ও শ্রমিক, জনসংখ্যা এবং উন্নয়নমূলক বিষয়ে নিবিড়ভাবে দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করছেন।

শারমিন মুরশিদ : নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ। তাঁর বাবা খান সারওয়ার মুরশিদ বাংলাদেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ। তাঁর বাবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মা নূরজাহান বেগম স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আওয়ামী সরকারের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

নূরজাহান বেগম : গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে গ্রামীণ ব্যাংককে একটি সফল ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে ড. ইউনূসের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১০ সালে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। গ্রামীণ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন, যে দায়িত্ব তিনি পেয়েছিলেন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতার কাছ থেকে। গ্রামীণ ব্যাংক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময়। গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়াও তিনি গ্রামীণ শিক্ষা ও গ্রামীণ শক্তির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী নূরজাহান বেগম ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকল্পে ড. ইউনূসের প্রথম সারির সহযোগীদের একজন। তিনি গ্রামীণ ফাউন্ডেশন কর্তৃক ২০০৮ সালে সুসান এম ডেভিস লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি সামিট মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস অ্যাওয়ার্ড ২০০৯ এবং ভিশন অ্যাওয়ার্ড ২০০৯-এ ভূষিত হন। ২০০৭ সালে স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় অনুষ্ঠিত ফাউন্ডেশন ফর জাস্টিস পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতি নিযুক্ত হন।

এ এফ হাসান আরিফ : সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ভূমি ও ধর্ম মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) : সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের কমিশনার ছিলেন। তিনি বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি পত্রিকায় কলাম লেখেন। ২০টির অধিক বই লিখেছেন। সাখাওয়াত হোসেন ১৯৪৮ সালে বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

মো. তৌহিদ হোসেন : তাঁর জন্ম ১৯৫৫ সালে। তিনি ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেন। বাংলাদেশের একজন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি ২০০০ পর্যন্ত ফরেন সার্ভিস একাডেমির প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । তিনি ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : আইনজীবী ও পরিবেশকর্মী হিসেবে সুপরিচিত। পরিবেশ আইনবিদদের সংগঠন বেলার নির্বাহী পরিচালক। তাঁর জন্ম ১৯৬৮ সালে। বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ পুরস্কার এবং প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ পান। ২০০৯ সালে টাইম সাময়িকীর হিরোজ অব এনভায়রনমেন্ট খেতাব পান। এ ছাড়া তিনি ২০১২ সালে এশিয়ার নোবেল খ্যাত ফিলিপাইনভিত্তিক র‌্যামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার পান। ২০২২ সালে তিনি আন্তর্জাতিক সাহসী নারী পুরস্কার পান। তাঁর পরিচালিত সংগঠন বেলা ২০০৩ সালে জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্ট প্রগ্রাম ঘোষিত গ্লোবাল ৫০০ রোল অব অনার্স পুরস্কারে ভূষিত হয়।

নাহিদ ইসলাম : নাহিদ ইসলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বর্তমানে তিনি স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন নাহিদ ইসলাম। সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি।

নাহিদ ইসলাম গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সদস্যসচিব। গত বছরের ৪ অক্টোবর সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটে।

আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া : তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। তিনি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। আসিফ মাহমুদের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আকুবপুর গ্রামে। আসিফ মাহমুদ আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং কলেজটির বিএনসিসি ক্লাবের প্লাটুন সার্জেন্ট ছিলেন। তিনি গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির আহ্বায়ক।

আ ফ ম খালিদ হোসেন : তাঁর পুরো নাম আবুল ফয়েজ মুহাম্মদ খালিদ হোসেন। তিনি ১৯৫৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার মাদার্শা ইউনিয়নের মক্কার বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমির ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষা উপদেষ্টা। খালিদ হোসেন চট্টগ্রামের ওমর গণি এমইএস কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। এ ছাড়া এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের খণ্ডকালীন অধ্যাপকের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিনজন উপদেষ্টা রাজধানীর বাইরে থাকার কারণে গতকাল শপথ নিতে পারেননি। তাঁরা আজ শপথ নিতে পারেন।

ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নৌ কমান্ডো বাহিনীর পরিচালিত অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’-এর একজন নৌ কমান্ডো ছিলেন ফারুক-ই-আজম। এটি মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র সমন্বিত অভিযানও বটে। ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে দেশের দুই সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা এবং দুই নদীবন্দর চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে একযোগে এই অপারেশন পরিচালিত হয়। ফারুক-ই-আজমের জন্ম চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ গ্রামে, ১৯৪৯ সালে। ১৯৬৭ সালে তিনি খুলনার ইস্টার্ন ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট নামে একটি কম্পানিতে সুপারভাইজারের চাকরি নেন। এখানেই তিনি ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত চাকরি করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৬ মে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের হরিণা ইয়ুথ ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। সেখানে দুই মাসের প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে অপারেশনের জন্য মনোনীত করা হয়। অপারেশন জ্যাকপটের পর ফারুক-ই-আজম আরো বেশ কয়েকবার অপারেশনে অংশ নেন।

ডা. বিধান রঞ্জন রায় : জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায়ের জন্ম ১৯৬৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। তাঁর পুরো নাম বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। তিনি একজন স্বনামধন্য মনোচিকিৎসক। তিনি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ২ জুলাই পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

সুপ্রদীপ চাকমা : সুপ্রদীপ চাকমার জন্ম ১৯৬১ সালে খাগড়াছড়ির কমলছড়িতে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তিনি সপ্তম বিসিএস (পররাষ্ট্র) ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি মেক্সিকো ও ভিয়েতনামে রাষ্ট্রদূূত ছিলেন। গত বছর তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

প্রতিক্রিয়া

বঙ্গভবনে গতকাল রাতে নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা আনুষ্ঠানিক শপথ নেওয়ার পর তাঁদের কয়েকজন এবং অভিজ্ঞজনরা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এখানে তা তুলে ধরা হলো :

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের মানুষ একটা দীর্ঘ সময় ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনাই হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লক্ষ্য। তিনি বলেন, বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামো ও নির্বাচন কমিশনের আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। এ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

নাহিদ ইসলাম বলেন, জনগণ আমাদের ছাত্র-তরুণদের ওপর ভরসা করে রাজপথে নেমে এসেছিল। আমাদের সঙ্গে অন্য নাগরিকরাও রক্ত দিয়েছে। জনগণ যদি মনে করে, তরুণরাই রাষ্ট্রের হাল ধরবে। জনগণের সে আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের তরুণরা প্রস্তুত আছে। জনগণের ইচ্ছাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তারা যত দিন চাইবে, তত দিন থাকব।

উপদেষ্টা ও ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করা। একই সঙ্গে আমাদের আন্দোলনে শহীদরা যেন সঠিক বিচার পায়, তা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া আমাদের যে মূল অভিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে, তা হলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিলোপ করা।

তিনি বলেন, সংস্কার করতে কেমন সময় লাগবে, এ বিষয়ে এখনই বলা মুশকিল। আমাদের সরকার গঠনেও সময়সীমার বিষয়টি উল্লেখ নেই। আপনারা জানেন, রাষ্ট্রের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান গত ১৭ বছরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। সর্বনিম্ন সময়ে আমরা এসব কিছু সংস্কার করার চেষ্টা করব। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা যেন আর ফিরে আসতে না পারে, বিষয়টি নিশ্চিত করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেব।

অন্যতম উপদেষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমি সব সময় বলি, আবারও বলি, যে পশুশক্তির সঙ্গে আমরা লড়াই করেছি, আমরা যেন সেই শক্তির মতো হয়ে না যাই। তাহলে আমাদের ছাত্র-জনতা যে অভাবনীয় সুযোগ আমাদের জন্য নিয়ে এসেছেন, আমরা বলি যে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন করেছেন, তার অর্থ ও মাহাত্ম্য ম্লান হয়ে যাবে। এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে।

তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। গত ১৫ থেকে ১৭ বছর একটি স্বৈরাচার সরকার ও স্বৈরাচারী শাসন ছিল, তার একটা অন্ধকার যুগ ছিল। মানুষের মধ্যে অনেক ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও ক্রোধ জমে ছিল। অনেক সংখ্যালঘু মানুষের আর্তনাদ শুনেছি। অনেক স্টোরি আমি নিজে দেখেছি। এটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত না। আমাদের ক্রোধ সংবরণ করতে হবে। আইনগতভাবে যারা দোষী, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।

অপর উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করতে চাই বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা এবং গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার।

তিনি বলেন, এখনো আমরা একসঙ্গে বসতে পারিনি। বসে সব বিষয় ঠিক করা হবে। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা কাজ করতে চাই। তিনি বলেন, আগে এই সরকারকে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনে যে দাবি ছিল, তা পূরণ করতে হবে। ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যারা নেমেছিল তারা একেবারেই সাধারণ মানুষ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে আমাদের সাধারণ জনগণ যে কষ্ট পাচ্ছে, সে দিকগুলো নিয়েও গুরুত্ব সহকারে কাজ করতে হবে।

উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, দেশের জনসংখ্যা ৫০ শতাংশই তরুণ; কিন্তু এই তরুণদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে। তবে আমরা রাষ্ট্র পরিচালনায় এই তরুণ প্রজন্মকে সামনে নিয়েই কার্যক্রম পরিচালনা করব।

তিনি বলেন, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্ম যে প্রাসঙ্গিক হতে পারে, আমরা সেটি এত দিন ভাবিনি। এই প্রজন্ম নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করেছে। তারা অবশ্যই দেশের দায়িত্ব নেবে। তরুণরাই একসময়ের দেশের নেতা। দেশের সংকটময় মুহূর্তে কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতে হবে। কাজটা যদি সততার সঙ্গে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে করা যায়, সেই কাজটি তো কঠিন কোনো বিষয় নয়।

উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ বলেন, ‘সদস্য হওয়ায় আমার দায়িত্বের জায়গা একটু বেশি স্পষ্ট করে দিয়েছে। তবে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবেও দেশ গঠন আমার দায়িত্ব। দেশটা ভেঙে গেছে, টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। মানুষে মানুষে বিভাজন, প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। এই জায়গায় থেকে পুনর্নির্মাণ একজন সাধারণ মানুষ হলেও আমাকে করতে হতো। আমি একটা সুযোগ পেয়েছি বড় একটা জায়গা থেকে এটা দেখার। এই কাজটা ততখানি বড় এবং প্রচণ্ড দায়িত্ব হয়ে গেল। আমাদের যে টিম মেম্বার (দলের অন্য সদস্যরা) আছেন, আমি মনে করি এটা একটা খুবই উজ্জ্বল টিম।

জেষ্ঠ্য আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘পরিবর্তন আসবে, এটাকে সবাই খুব ওয়েলকাম (সাধুবাদ) করছে। এ কারণে দেখেন আজকে (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন প্রক্রিয়ায়) উপস্থিতিও অসাধারণ হয়েছে। যেন সবাই মনে করছে যে একটা পরিবর্তন এসেছে। যেটা হওয়ারই ছিল। আশা করব, আশা তো করতেই হয়, পরিবর্তন আসবে। মানুষ আশা করবে যে একটা অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসবে। এটাই হোক।’

এর আগে অনেক আন্দোলন বৃথা গেছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়নি জানিয়ে গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, যে গণতন্ত্রের জন্য, রাষ্ট্র সংস্কার ও রাষ্ট্র মেরামতের জন্য এতগুলো ছাত্র-যুবক-তরুণ প্রাণ দিলেন, তাঁদের রক্ত যেন বৃথা না যায়।’

তিনি বলেন, ‘এর আগে বৃথায় গিয়েছে। একাত্তরে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ড পেলেও প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পাইনি। নব্বইয়ে স্বৈরশাসকের অবসান ঘটিয়েও প্রকৃত গণতন্ত্র পাইনি। কাজেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের রূপান্তরের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেভাবে গড়ে তোলে। তাদের প্রতি সেই আবেদন থাকবে।’

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।