পাহাড়ে সন্ত্রাস, বিচারহীনতা ও রাষ্ট্রীয় দ্বিচারিতা: নিরাপত্তা বাহিনীর আত্মত্যাগের কি কোন মূল্য নেই?
![]()
মোঃ সাইফুল ইসলাম
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৯৭ সালে যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার বাস্তব রূপ আজও প্রশ্নবিদ্ধ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর মতো সশস্ত্র সংগঠনগুলো একদিকে যেমন চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, সন্ত্রাসের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে, অন্যদিকে তারা আইন ও রাজনীতির ছত্রছায়ায় ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের মূল কাঠামোর ভেতরেই অনুপ্রবেশ করছে।
এই বাস্তবতায় সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি পাহাড়ে বসবাসকারী পাহাড়ি-বাঙালিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছেন, আহত হচ্ছেন। অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাদক উদ্ধার, অপহরণকারীদের আটক এবং নিরস্ত্র মানুষের জীবন রক্ষায় যে নিরব, কষ্টসাধ্য, আত্মত্যাগমূলক লড়াই তারা চালিয়ে যাচ্ছেন—তা বারবার উপেক্ষিত হয়ে পড়ছে বিচার ব্যবস্থার বেহাল দশায়।
আটক সন্ত্রাসী জামিনে মুক্ত—এ কেমন বিচারব্যবস্থা?
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পাহাড়ে বিভিন্ন অভিযানে আটক অনেক সশস্ত্র সন্ত্রাসী কিছুদিন পরেই জামিনে মুক্ত হয়ে যায়। অথচ তারা হত্যা, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক পাচারসহ একাধিক ফৌজদারি মামলার আসামি। কেন এই বিচ্যুতি ঘটছে?
-
থানা-পুলিশে দায়সারা তদন্ত:
নিরাপত্তা বাহিনী যখন সন্ত্রাসী আটক করে থানায় হস্তান্তর করে, তখন পুলিশ অনেক সময় মামলায় তুলনামূলক ‘সহজ’, জামিনযোগ্য ধারা প্রয়োগ করে। তদন্তেও পেশাদারিত্বের অভাব দেখা যায়। -
আদালতের নিষ্ক্রিয়তা:
সঠিক তথ্য ও উপযুক্ত অভিযোগপত্র না পাওয়ায় আদালতও অনেক সময় সহজেই জামিন দিয়ে দেয়। এতে দেখা যাচ্ছে, যারা পাহাড়ে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে, তারা খুব সহজেই আইনের ফাঁক-ফোকর গলে বেরিয়ে যাচ্ছে। এর পরিণতিতে সন্ত্রাসীরা ফিরে যায় আগের দলে, আগের রুটেই চলে অস্ত্রের দাপট ও চাঁদাবাজি।
নির্বাচনে অস্ত্রধারীদের অংশগ্রহণ – গণতন্ত্রের পরিহাস
আরও ভয়াবহ হলো, এই সন্ত্রাসীরা জামিনে বেরিয়ে স্থানীয় এমনকি জাতীয় নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে। বহু হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, চাঁদাবাজি মামলার আসামিরা পাহাড়ে জনপ্রতিনিধি হয়ে অস্ত্রের জোরেই ক্ষমতায় টিকে থাকে। যেমন লক্ষ্মীছড়ির ইউপিডিএফ নেতা সুপার জ্যাতি চাকমা, পানছড়ির সর্বোত্তম চাকমা বা দীঘিনালার ধর্মজ্যাতি চাকমার মতো সন্ত্রাসীদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে স্থায়ী ক্ষমতা পাওয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার দুর্বলতাকেই নগ্নভাবে তুলে ধরে। এরা সরকারি তহবিল, ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজেদের অস্ত্রধারী সংগঠনকেই শক্তিশালী করছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর সেইফ হাউজে আত্নগোপনে থাকা ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমাও শেখ হাসিনার পতনের পর বেরিয়ে এসে ‘র; এর প্রেসক্রিপশনে নিজেকে আয়না ঘরের নির্যাতিত দাবি করে দেশ-বিদেশে সহানূভুতি আদায় করে এখন আগামী নির্বাচনে রাঙামাটি আসনে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিচারের বদলে পদ—সন্ত্রাসের পুরস্কার!
এখানেই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং নৈতিকভাবে ধ্বংসাত্মক দিকটি স্পষ্ট হয়। হত্যা মামলার পলাতক আসামিরা যখন স্থানীয় সরকার কিংবা জেলা পরিষদের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে নিযুক্ত হন, তখন সেটি শুধু আইন নয়—রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এই পরিস্থিতির চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হলো, পলাতক হত্যা মামলার আসামিকে সরকার নিজেরাই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগ দিচ্ছে। যেমন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য পদে নিয়োগ পেয়েছেন প্রণতি রঞ্জন খীসা, যিনি শান্তি চাকমা হত্যাকাণ্ডের মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। পলাতক থাকার পরও তিনি এখন প্রশাসনিক ক্ষমতায়। এখন তিনি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন, রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করছেন। এই নিয়োগ কেবল আইনের প্রতি অবজ্ঞা নয়, বরং সরাসরি অপরাধীদের পুরস্কৃত করা। এতে রাষ্ট্র নিজেই সন্ত্রাসকে বৈধতা দিয়ে ফেলছে।
এটি কেবল ন্যায়বিচার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া নয়, বরং হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সম্মানিত করা—একটি ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত।
এই চিত্রের পরিণাম কী?
- মৃত্যু উপেক্ষা করে অভিযান, অথচ সন্ত্রাসীরা ফিরে আসে
- বান্দরবানে গত কয়েক বছরে সন্ত্রাসী হামলায় একাধিক সেনা সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। গহীন অরণ্যে, মৃত্যু আর গুলির মুখে জীবন দিয়ে যারা দেশ রক্ষা করছেন, তাদের আত্মত্যাগ অর্থহীন হয়ে যায় যদি ধৃত সন্ত্রাসীরা কদিন পর জামিনে বেরিয়ে আবার পাহাড়ে রক্তপাত ঘটায়। এটি কেবল আইন-আদালতের ব্যর্থতা নয়, এটি নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি প্রহসন।
-
নিরাপত্তা বাহিনীর মনোবলে আঘাত:
যারা জীবন বাজি রেখে সন্ত্রাসী ধরে, তাদের চোখের সামনে সেই সন্ত্রাসীরা জামিনে বেরিয়ে এসে রাজনীতি করে—এটি সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়। তাদের আত্মত্যাগের মূল্য খাটো হয়ে যায়। -
তরুণ সমাজ সন্ত্রাসে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে:
পাহাড়ি যুব সমাজের একটা অংশ দেখছে, অস্ত্র হাতে নিলে একসময় জনপ্রতিনিধি হওয়া যায়, গ্রেপ্তার হলেও সহজেই বের হয়ে আসা যায় এমনকি পুরস্কৃত করা হয় সংগঠনের পক্ষ হতে। এটি সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করছে। -
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে:
আইনের শাসন ও রাষ্ট্রীয় পদাধিকার—এই দুটি বিষয় পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়ছে। এটি পুরো শাসন কাঠামোকেই দুর্বল করে তোলে।
করণীয় ও সুপারিশ
-
বিচারিক প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর প্রতিবেদন বাধ্যতামূলক করা:
আটক সন্ত্রাসীদের মামলা পরিচালনায় শুধুমাত্র পুলিশের নয়, অভিযানে অংশ নেওয়া বাহিনীরও বক্তব্য ও প্রমাণ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। -
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিত্বে ব্যাকগ্রাউন্ড চেক বাধ্যতামূলক করা:
নির্বাচন কিংবা নিয়োগের আগে প্রার্থীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা আছে কি না, তা যাচাই করতে হবে স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। -
বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা:
পাহাড়ে সংঘটিত সন্ত্রাস, খুন ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমের বিচার নিশ্চিত করতে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠনের চিন্তা করা যেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস দমন কেবল অস্ত্রের লড়াই নয়—এটি নৈতিকতা, বিচার ও রাষ্ট্রীয় অবস্থান পরিষ্কার করার লড়াই। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর, জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা , পুলিশ পেশাদার তদন্ত ও চার্জশিট দাখিলে নিষ্ঠাবান হতে হবে, আদালত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নিলে, আইন ও নীতি সংশোধন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণে আসামি পরিচয় বিবেচনায় আনা হলে এবং রাষ্ট্র নিজেই যেন সন্ত্রাসীদের দায়িত্বে না বসায়—এই আত্মঘাতী প্রবণতা বন্ধ করা গেলে সেনাবাহিনীর ত্যাগ তখনই পূর্ণতা পাবে।
একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বপ্ন তখনই সম্ভব, যখন রাষ্ট্র একমুখী ও নিষ্ঠার সঙ্গে সন্ত্রাস দমনে অঙ্গীকারবদ্ধ হবে। নয়তো পাহাড়ে রক্ত ঝরবে, আর নীতির ফাঁকে সন্ত্রাসের রাজনীতি জিতে যাবে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাহাড়ে শুধু নিরাপত্তা রক্ষা করছে না, বরং জাতির পক্ষে এক বিপুল আত্মত্যাগে নিয়োজিত। অথচ বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা ও প্রশাসনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এসব আত্মত্যাগকে অকার্যকর করে তুলছে। রাষ্ট্র যদি এই ধারা অব্যাহত রাখে, তবে পাহাড়ে সন্ত্রাস চক্র কেবল আরও শিকড় গজাবে—এবং এক সময় তা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, বরং সমগ্র রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
এখনও সময় আছে। রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—সে কি খুনিকে পুরস্কৃত করবে, না রক্ষককে সম্মান জানাবে?
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।