অপচয়, বৈষম্য ও সাংবিধানিক লঙ্ঘনের অভিযোগে তীব্র বিতর্কে রাঙামাটির পাজেপ চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার
![]()
নিউজ ডেস্ক
গতবছর জুলাই বিপ্লবে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর নিয়োগপ্রাপ্ত রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কৃষিবিদ কাজল তালুকদার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। গাড়ি বিলাস, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ এবং একপাক্ষিকভাবে শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী থেকে নিয়োগ দেওয়াসহ একাধিক অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থিতিশীলতা, সম্প্রীতি এবং প্রশাসনিক ভারসাম্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
‘গাড়ি বিলাসে’র নতুন নজির
নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই বিতর্কের সূচনা করেন একটি বিলাসবহুল পাজেরো স্পোর্টস গাড়ি কিনে। অর্থবছর শুরুর আগেই রাজস্ব খাত থেকে ১ কোটি ৬৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ব্যয় করে তিনি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য এই গাড়িটি কেনেন। অথচ জেলা পরিষদের সদস্যদের মতে, এই সিদ্ধান্তে পরিষদের অনুমোদন ছিল না এবং পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল একক সিদ্ধান্তনির্ভর। এ নিয়ে পরিষদ সদস্যদের মধ্যেই চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এ বিষয়ে আরও: রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কৃষিবিদ কাজল তালুকদারের গাড়ি বিলাস।
সাবেক মেয়র ও রাঙামাটি জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি সাইফুল ইসলাম ভূট্টো বলেন, “যার কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই, যিনি কখনো বিএনপি আবার কখনো আওয়ামী লীগের ছায়ায় ছিলেন, তার হঠাৎ রাষ্ট্রীয় পদে বসা এবং এমন অপচয়মূলক সিদ্ধান্ত আমাদের স্তম্ভিত করে।”
সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার
এতদসত্বেও বিতর্কের এখানেই শেষ নয়। গত ৯ এপ্রিল রাঙামাটি পৌরসভা প্রাঙ্গণে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করে আয়োজিত বিজু উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশ নেন কাজল তালুকদার। এই প্রোগ্রামের ব্যানারে স্লোগান ছিল—“আদিবাসী জুম্ম জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় চুক্তি বাস্তবায়নে সংগ্রাম জোরদার করো।” অথচ সংবিধান স্পষ্ট করে বলেছে, বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ বলে কোনো জনগোষ্ঠী নেই এবং ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তিতেও এই শব্দ নেই।
এ বিষয়ে আরও: রাষ্ট্রবিরোধী আদিবাসী শব্দ ব্যবহার: অনুষ্ঠানে অংশ নিলেন খোদ রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেন, “একজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তার সংবিধান পরিপন্থী শব্দ ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দেওয়া অনুষ্ঠান উদ্বোধন করা সাংবিধানিক শপথের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।”
চাকরি নিয়োগে একপাক্ষিকতা ও বাঙালি বঞ্চনা
সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে জেলা পরিষদে জনবল নিয়োগে চরম বৈষম্যের। জেলা পরিষদের অধীনে পরিচালিত ProGRESS প্রকল্পে সম্প্রতি ৮টি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে—সবই একটিমাত্র নৃ-গোষ্ঠী ‘চাকমা’ সম্প্রদায় থেকে। এতে মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা কিংবা বাঙালি—কোনো গোষ্ঠীই প্রতিনিধিত্ব পায়নি।
এ বিষয়ে আরও: রাঙামাটি জেলা পরিষদে জনবল নিয়োগ, শতভাগ চাকমা সম্প্রদায়ের!
স্থানীয়রা বলছেন, “এই নিয়োগ প্রক্রিয়া পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরও গভীর করবে। এত বড় বৈষম্যপূর্ণ নিয়োগ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে বিরল।” এমনকি পিসিসিপি ও অন্যান্য সমমনা সংগঠন থেকেও প্রতিবাদ উঠেছে এই নিপীড়নমূলক নিয়োগের বিরুদ্ধে।
সমালোচনার মুখে পাজেপ চেয়ারম্যানের নৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ
চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর একযুগেরও বেশি সময় নিভৃতচারী ছিলেন কৃষিবিদ কাজল তালুকদার। হঠাৎ ২০২৪ সালের পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বসেন তিনি। নিয়োগ পরবর্তী সময়ে জেলা পরিষদ গঠনকে কেন্দ্র করেও আদালতে রিট হয় এবং দুই সদস্যকে দায়িত্ব পালনে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়।
এই নিয়োগ ও পদক্ষেপগুলো থেকে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা, সাংবিধানিক লঙ্ঘন ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতার ঘাটতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ২৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও এ ধরনের পক্ষপাতমূলক প্রশাসন ও অপচয়ের ঘটনা শুধু সংবিধানকেই অমর্যাদা করছে না, পাহাড়ের স্থিতিশীলতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সরকারের উচিত, এসব অনিয়ম ও সাংবিধানিক লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।