পাহাড়ে স্টারলিংক ই-লার্নিং: প্রযুক্তির মুখোশে নিরাপত্তা ঝুঁকি

পাহাড়ে স্টারলিংক ই-লার্নিং: প্রযুক্তির মুখোশে নিরাপত্তা ঝুঁকি

পাহাড়ে স্টারলিংক ই-লার্নিং: প্রযুক্তির মুখোশে নিরাপত্তা ঝুঁকি
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মোঃ সাইফুল ইসলাম

বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এক বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম স্কুলগুলোতে ই-লার্নিং চালুর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।  এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী। চলতি বছরের মধ্যেই অন্তত একশটি স্কুলে অনলাইনে পাঠদান চালুর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে এই মহৎ উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে যখন ‘স্টারলিংক’ ইন্টারনেট ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে, তখন এ প্রযুক্তির সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকি ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব নতুন করে ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে।

পাহাড়ে ই-লার্নিং চালুর অংশ হিসেবে স্টারলিংক ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারের ঘোষণা নিঃসন্দেহে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগ। কিন্তু এই ঘোষণার আড়ালে যে ভৌগোলিক বাস্তবতা, নিরাপত্তা সংবেদনশীলতা এবং কৌশলগত জটিলতা রয়েছে—তা এড়িয়ে যাওয়া বিপজ্জনক হবে।

স্টারলিংক হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি কোম্পানি স্পেসএক্স-এর স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা, যা স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয় এবং এর নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে দেশের বাহিরে। পাহাড়ি এলাকা যেমন বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি—এই অঞ্চলগুলো দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং বিদেশি গোয়েন্দা তৎপরতার জন্য কৌশলগতভাবে স্পর্শকাতর। এমন এলাকায় বিদেশি নিয়ন্ত্রিত, উচ্চগতি ও নজরদারির বাইরের ইন্টারনেট সংযোগ চালু করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হতে পারে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্টারলিংক ব্যবহারকারীর কার্যক্রম সরাসরি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যার ফলে স্থানীয় ইন্টারনেট গেটওয়ে বা সরকারি নিয়ন্ত্রণমূলক সংস্থাগুলোর তেমন প্রবেশাধিকার থাকে না। অর্থাৎ, সরকারের পক্ষে এটি পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এই সুযোগে পাহাড়ে সক্রিয় বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন, যেমন ইউপিডিএফ, কেএনএ, জেএসএস এবং তাদের সমর্থিত অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো এই প্রযুক্তিকে অপব্যবহার করতে পারে।

সরকারি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, দুর্গম এলাকায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট না থাকায় সোলার প্যানেল ও স্টারলিংক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—স্টারলিংকের এই উপস্থিতি বাস্তবে কার হাতে থাকবে? স্থানীয় প্রশাসনের নাকি বিদেশি বেসরকারি কোনো অংশীদারের?

পাহাড়ে স্টারলিংক ই-লার্নিং: প্রযুক্তির মুখোশে নিরাপত্তা ঝুঁকি
বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এক বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রামের একশ স্কুলে এবছরই ই-লার্নিং চালুর নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা।

আরও গভীর চিন্তার বিষয় হলো, স্টারলিংক ইন্টারনেট কার্যত অনির্দেশ্য—এর ব্যবহারকারীরা কোন তথ্য পাঠাচ্ছেন, কোথায় পাঠাচ্ছেন, এবং কারা গ্রহণ করছে—তা সনাক্ত করা প্রচলিত গোয়েন্দা পদ্ধতিতে প্রায় অসম্ভব। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে যদি পার্বত্য অঞ্চলের সক্রিয় সশস্ত্র সংগঠন বা তাদের ছদ্মবেশী সমর্থকরা সুবিধা পেয়ে যায়, তাহলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্ব এক নতুন পরীক্ষার মুখে পড়বে। এর মাধ্যমে অস্ত্রের ছবি, অবস্থান, চলাচল বা কথোপকথন রাষ্ট্রীয় নজরদারির বাইরে চলে যেতে পারে—যা আগাম বিপদের বার্তা।

এছাড়া, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী, অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীরা গোয়েন্দা নজরদারি এড়িয়ে যোগাযোগের নিরাপদ মাধ্যম পেয়ে যেতে পারে।

এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে স্টারলিংক রিসিভার এবং টার্মিনাল স্থাপন করতে হবে। এগুলোর মাধ্যমে বিদ্যমান মোবাইল টাওয়ার ও ফাইবার নেটওয়ার্ক বাইপাস করে সরাসরি বিদেশি ভূ-উপগ্রহে তথ্য প্রেরণ করা সম্ভব হবে। পাহাড়ে এমন প্রযুক্তি চালু হলে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় একটি বিশাল ফাঁক তৈরি হবে। সামরিক তথ্য, জনমত পরিচালনা, এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের গতিবিধি নজরদারির বাইরেও চলে যেতে পারে।

আরেকটি বিষয় হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘিরে ভারতের উত্তর-পূর্ব, চীন-মিয়ানমার সীমান্ত এবং বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা একটি জিওস্ট্র্যাটেজিক করিডোর গড়ে উঠেছে। এই অঞ্চলে মার্কিন প্রযুক্তি হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠলে ভবিষ্যতে বিদেশি হস্তক্ষেপ বা কূটনৈতিক চাপ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

পরিশেষে, প্রযুক্তি নিরপেক্ষ নয়। এটি কাদের হাতে, কোন ভূখণ্ডে এবং কী উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে তা বিবেচনাসাপেক্ষ। পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় স্টারলিংক প্রযুক্তি চালু করার আগে শুধু শিক্ষাগত সুযোগ নয়—রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও ভূরাজনীতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। না হলে অতি-উৎসাহী উন্নয়নচিন্তা ভবিষ্যতের জন্য বড় রকমের বিপদ ডেকে আনতে পারে।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।