খাগড়াছড়িতে ধর্ষণকাণ্ডে ইউপিডিএফের অপপ্রচার: এক বিষাক্ত পরিকল্পনার ইঙ্গিত
![]()
মোঃ সাইফুল ইসলাম
সম্প্রতি খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়ায় এক ত্রিপুরা কিশোরীর বিষপান এবং তার ধারাবাহিক চিকিৎসাজনিত পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে যে ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তা নিছক একটি গুজব নয়—বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। এই ষড়যন্ত্রের পেছনে রয়েছে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন পাহাড়ের আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফ, যারা দীর্ঘদিন ধরে বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ছড়িয়ে পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
ঘটনার প্রেক্ষাপট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাইবোনছড়া মুনিগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী মেনোকা ত্রিপুরা গত ১২ জুলাই বিষপান করে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়। চিকিৎসা শেষে ১৪ জুলাই বাড়ি ফেরার পর ১৬ জুলাই আবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, মেয়েটির বিষপানের পেছনে তার স্বগোত্রীয় প্রেমিকের বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানানোই মূল কারণ। অথচ এই বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে, ঘটনার ১৬ দিন পর হঠাৎ করে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়, যেখানে বাঙ্গালি তরুণদের বিরুদ্ধে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগ তোলা হয়—যেটা একটি নাটকীয় মোড় নেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
প্রশ্ন একাধিক, উত্তর নেই কোথাও—কেন?
প্রথম প্রশ্ন, যদি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে কেন তা থানায় জানানো হলো না? কেন এতদিন নীরব ছিল পরিবার ও আত্মীয়রা? ১৬ দিন পর ভিডিও প্রচার ও মামলা দায়েরের পেছনে কী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, মেয়েটির পরিবার বা চাচা কেন ঘটনার পরদিন বা তার পরপর দিন থানায় অভিযোগ দিলেন না? কেন তারা স্থানীয় প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের দারস্থ হলেন না?
তৃতীয় প্রশ্ন, মেয়েটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ১২ জুলাই, কিন্তু ১৬ জুলাই কেন হঠাৎ করে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়? যদি সত্যিই ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনা ঘটে থাকে, তবে এত দেরিতে তার প্রতিক্রিয়া কেন?
এই সব প্রশ্নের কোনো স্বাভাবিক ব্যাখ্যা নেই। তবে একটি ব্যাখ্যা অবশ্যই স্পষ্ট—ইউপিডিএফ এই ঘটনাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দিতে চাইছে।
প্রাসঙ্গিকভাবে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, এই একই সময় মানিকছড়িতে এক বাঙ্গালি কিশোর সোহেলকে চাঁদার জন্য অপহরণ করে হত্যা করা হয়, যার দায়ও ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র অংশের দিকে ইঙ্গিত করছে। অথচ এই ঘটনা নিয়ে কোথাও তেমন উচ্চবাচ্য নেই!
অপপ্রচারের লক্ষ্য কী?
ইউপিডিএফ-এর দীর্ঘদিনের কৌশল হলো—একদিকে বাঙ্গালি বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, দখল ও নির্যাতনের অভিযোগ তুলে তাদের পাহাড় থেকে বিতাড়নের প্রচেষ্টা চালানো, অন্যদিকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিজ জনগণের উপর কর্তৃত্ব কায়েম রাখা এবং চাঁদাবাজি চালিয়ে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রাখা। মেনোকা ত্রিপুরার ঘটনাও কি সেই একই কৌশলের অংশ নয়?
নির্বাচনী মাঠে সুবিধা পেতেই কি অপপ্রচারে নেমেছে ইউপিডিএফ?
ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের আগেই ইউপিডিএফ ও তাদের সহানুভূতিশীল একাংশ যেভাবে একতরফা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে, তা শুধু সন্দেহজনকই নয়—বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হচ্ছে। ভাইবোনছড়ার বিষপান করা ত্রিপুরা মেয়েটির ঘটনার পর প্রায় দুই সপ্তাহ নীরব থাকার পর হঠাৎ করেই ধর্ষণের অভিযোগ আনা এবং এরপর সেসবকে কেন্দ্র করে বাঙালি জনগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া—এসবই মনে করিয়ে দেয় ইউপিডিএফ-এর অতীত কৌশল: ‘সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে জনসমর্থন আদায় ও প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করা’।
প্রশ্ন উঠছে, ইউপিডিএফ কি আগাম নির্বাচনের প্রাক্কালে নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে আবারও সেই পুরোনো সহিংস ও বিভ্রান্তিকর পথেই হাঁটছে? নাকি এই অপপ্রচার আসলে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে প্রতিহত করার নতুন রূপ?
বিক্ষোভ-প্রতিবাদের নামে মাঠ গরম করতে চায় ইউপিডিএফ
এখন পর্যন্ত ভিকটিমের কোনো মেডিক্যাল টেস্ট হয়নি। আদালত থেকেও কাউকে ধর্ষক হিসেবে রায় দেওয়া হয়নি। থানায় অভিযোগ দায়েরের পরপরই সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে মামলার ৬ আসামির মধ্যে ৪ জনকে গ্রেফতার করে। এরপরই নামে-বেনামে কিছু তথাকথিত মানবাধিকার বা ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে বিক্ষোভের নামে ইউপিডিএফ-এর সন্ত্রাসীরা মাঠে নামে, যাদের ব্যানারে পরিচিত মুখ না থাকলেও শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বে ঠিকই ইউপিডিএফ জড়িত। এর ফলে সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙ্গালি উভয় জনগোষ্ঠীর মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। শান্তিপূর্ণ পার্বত্য জনপদে আবারো নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে, যার পেছনে ইউপিডিএফ-এর সুস্পষ্ট ছায়া রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, মেয়েটির বিষপানের পেছনে প্রেমঘটিত সম্পর্ক ও পারিবারিক বিরোধই প্রধান কারণ হিসেবে স্থানীয়ভাবে জানা যাচ্ছে। ফলে, ধর্ষণের অভিযোগ বাস্তব নাকি সাজানো, তা নির্ধারণ করবে আদালত, মেডিকেল রিপোর্ট ও তদন্তের ভিত্তিতে। এ নিয়ে জনমত গঠন বা পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারণা চালানো শুধু অন্যায় নয়, অপরাধের শামিল।
তবে এসব যুক্তির বিপরীতে ইউপিডিএফ-এর প্রচারযন্ত্র একতরফাভাবে বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীকে অভিযুক্ত করে পাহাড়ে উত্তেজনা ছড়াতে তৎপর। একই সময়ে মানিকছড়িতে সোহেল নামের এক বাঙ্গালি কিশোরকে অপহরণ করে হত্যা করে পার্বত্য চাঁদাবাজ গোষ্ঠী। সে ঘটনা নিয়ে কেউ মুখ খুলছে না। এই নীরবতা এবং পক্ষপাতদুষ্ট আচরণই স্পষ্ট করছে—কে পাহাড়ে সম্প্রীতি চায়, আর কে অশান্তি ছড়াতে চায়।
পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ধরনের মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্র। প্রশাসনের উচিত, দ্রুত সময়ের মধ্যে এই মামলার পেছনের মূল উদ্দেশ্য ও প্ররোচনাকারীদের খুঁজে বের করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পাশাপাশি পাহাড়ি-বাঙ্গালি জনগণের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখতে উস্কানিমূলক অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।