জাতীয় নির্বাচনে রাঙামাটি আসনেও আঞ্চলিক শক্তির ঐক্যপ্রচেষ্টা: নির্বাচনের আগে বাড়ছে উত্তেজনা
![]()
নিউজ ডেস্ক
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে শুধু খাগড়াছড়ি নয়, উত্তেজনা তীব্র হয়ে উঠছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আরেক গুরুত্বপূর্ণ জেলা রাঙামাটিতেও। যদিও ভোটার সংখ্যা মাত্র তিন লাখের কিছু বেশি এবং আসন একটি, তবে পাহাড়ের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই নির্বাচন নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে।
মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও মাঠে চলছে আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য বিস্তারের নতুন খেলা। অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিভাজন, জোট গঠন ও একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা—সব মিলিয়ে ২০২৬-এর নির্বাচন রাঙামাটিতে আরেকটি সমীকরণে রূপ নিতে চলেছে।
এর পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ— আঞ্চলিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর নির্বাচনমুখী সক্রিয়তা এবং সম্ভাব্য জোট গঠনের কৌশল।
আঞ্চলিক জোটের নেপথ্যে যে গেমপ্ল্যান
সূত্র জানায়, খাগড়াছড়ির মতো রাঙামাটিতেও আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি আসনভিত্তিক অলিখিত সমঝোতা তৈরি হয়েছে।
রাঙামাটি আসনে দায়িত্বে থাকছে সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন জেএসএস, খাগড়াছড়ি নিয়ে নেবে ইউপিডিএফ (প্রসীত), বান্দরবানে থাকতে পারে জেএসএস, আর স্থানীয় উপজেলা নির্বাচনগুলো ভাগ করে নেওয়া হবে প্রয়োজনে।
এই ভাগাভাগিকে পাহাড়ের ভেতরে “চুক্তিভিত্তিক দখলনীতি” বলে উল্লেখ করছেন কেউ কেউ। যদিও বাইরে থেকে একে রাজনৈতিক কৌশল মনে হলেও, নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা একে সশস্ত্র প্রভাব খাটানোর পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন। অতীতে যে দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংঘর্ষে জড়িয়েছিল, তারা এখন একাট্টা হচ্ছে— সেটাই শঙ্কার মূল।
প্রার্থী ‘নির্বাচন’ নয়, ‘নিযুক্ত’ হতে পারেন
জেএসএসের প্রার্থী হিসেবে সাবেক সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদারের নাম প্রায় চূড়ান্ত— যা তৃণমূল না, বরং দলীয় সিদ্ধান্ত থেকেই নির্ধারিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের দাবি করলেও, জেএসএস এখনো একটি সশস্ত্র কাঠামোর উপর নির্ভরশীল এবং এটাই প্রশাসনের দুশ্চিন্তার জায়গা।
বিশেষ করে নির্বাচনের আগে প্রতিপক্ষ দলগুলোর উপর হুমকি, পাহাড়ি ভোটব্যাংকে চাপ এবং নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অতীতে এসব সংগঠনের অনুগত গেরিলাদের ছায়া থেকেই এই অঞ্চলের নির্বাচনগুলো বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

একটি সূত্র বলছে, রাঙামাটি আসনে কয়েক দফা বৈঠকের পরও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি প্রধান আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন—পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)— এখনো একক প্রার্থী দিতে একমত হতে পারেনি। তবে আড়ালে গড়ে উঠেছে এক অদৃশ্য ‘স্ট্যাটাস কো-অ্যালায়েন্স’, যেখানে ভোট নয় বরং নির্বাচন ঘিরে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তিন গোষ্ঠীর মধ্যে বর্তমানে একটি অলিখিত সমঝোতা চলছে— কে কোন উপজেলার ‘জোন’ নিয়ন্ত্রণ করবে, কে কোথায় ‘প্রভাবশালী’ থাকবে, আর কে প্রশাসনের সঙ্গে কীভাবে দেন-দরবার করবে। এতে করে প্রার্থী কে হবেন, সেটি আপাতত গৌণ বিষয় হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন মূল জেএসএস নেতৃত্ব এবার কিছুটা কৌশলী ভূমিকা নিচ্ছে। দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সরকারঘনিষ্ঠ একাধিক নেতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। মূল লক্ষ্য—নিজেদের পুরনো আধিপত্য ও ‘একক প্রতিনিধি’র ধারণাটিকে আবার সামনে আনা, অন্তত ‘সরকারি মহলের’ চোখে।
এছাড়া, বর্তমানে ইউপিডিএফের দাবার গুটি মাইকেল চাকমা রাঙামাটি আসনে সরাসরি ফ্যাক্টর হয়ে ওঠেননি, কারণ তার রাজনৈতিক ও সশস্ত্র কার্যক্রম মূলত খাগড়াছড়ি অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত। তবে আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠী ও জোটের মাধ্যমে তিনি নেপথ্যে প্রভাব বিস্তার করছেন এবং দীর্ঘমেয়াদী কৌশলে রাঙামাটিতেও রাজনৈতিক উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তাই নির্বাচনী মঞ্চে তার সরাসরি পদচারণা না থাকলেও তার বা তার অনুসারীদের নিকট থেকে আঞ্চলিক জোটের মাধ্যমে রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যাবর্তন
দীর্ঘদিন পর রাঙামাটিতে বিএনপি ও জামায়াত আবার মাঠে সক্রিয়, একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীকে সামনে এনে প্রচার শুরু করেছে। জামায়াত ইতিমধ্যে অ্যাডভোকেট মোখতার আহমদকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে, যিনি সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমেও এলাকাজুড়ে প্রভাব বিস্তার করছেন।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন, কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান, সাবেক সংসদ সদস্য মনি স্বপন দেওয়ান, জেলা বিএনপির সভাপতি দীপেন তালুকদার দিপু, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ মামুন, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও রাঙামাটি পৌরসভার সাবেক মেয়র সাইফুল ইসলাম ভুট্টো এবং জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম পনির। তারা সবাই অনুসারীদের নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছেন, চেষ্টা করছেন মাঠ গরম রাখার।
তবে পাহাড়ি ভোটব্যাংকের ধরণ ভিন্ন। এখানে প্রার্থীর জনপ্রিয়তার পাশাপাশি গোষ্ঠীগত আনুগত্য ও নিরাপত্তা বাস্তবতা বড় ভূমিকা রাখে। ফলে বাঙালি প্রার্থীরা মাঠে থাকলেও পাহাড়ি ভোটে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার তরুণদের একাংশ চায়— এমন প্রার্থী, যিনি পাহাড়ি-বাঙালি ভেদাভেদ না করে সামাজিক উন্নয়ন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করবেন। তবে আঞ্চলিক দলগুলোর ঐক্য যদি কেবল রাজনৈতিক না থেকে সশস্ত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় যায়, তাহলে তা এই অঞ্চলের জন্য বড় সংকটের বার্তা হতে পারে।
যদিও এখনো পর্যন্ত রাঙামাটি নিয়ে নির্বাচন কমিশন কোনো বিশেষ ঘোষণা দেয়নি, তবে আঞ্চলিক জোট ও তাদের ভূমিকা নজরদারিতে আনা প্রয়োজন— এমনটাই মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। অতীতে শান্তিচুক্তির নামে অস্ত্র গচ্ছিত রেখে ভোট নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ নতুন নয়।
রাঙামাটি আসনে এবার নির্বাচন শুধু দলীয় লড়াই নয়, বরং এক অদৃশ্য ‘সামরিক রাজনীতির’ পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোর জোট এবং নির্বাচনী মাঠে তাদের পরিকল্পনা যদি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বাইরে চলে যায়— তবে তা শুধু নির্বাচন নয়, পাহাড়ি অঞ্চলের সামগ্রিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। এখন দেখার বিষয়, রাষ্ট্রযন্ত্র কতটা কার্যকরভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে।
তথ্যসূত্র: আমার দেশ।