উখিয়া-টেকনাফে এনজিওর দখলে বনভূমি, দেড়শ কোটি টাকা সিন্ডিকেটের পকেটে

উখিয়া-টেকনাফে এনজিওর দখলে বনভূমি, দেড়শ কোটি টাকা সিন্ডিকেটের পকেটে

উখিয়া-টেকনাফে এনজিওর দখলে বনভূমি, দেড়শ কোটি টাকা সিন্ডিকেটের পকেটে
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

রোহিঙ্গা শিবির ঘিরে মানবিক সহায়তার কাজের আড়ালে উখিয়া-টেকনাফের সংরক্ষিত বন ঘিরে গড়ে উঠেছে ভাড়া বাণিজ্য। দেশি-বিদেশি এনজিও অফিস, ওয়্যারহাউস ও বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছে বনভূমির ভেতরে। সরকারি নোটিসে বৈধ কাগজপত্র দিতে বলা হলেও নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেছে; কিন্তু কোনো সংস্থার জবাব নেই। এনজিও সংস্থার প্রতিনিধিদের দাবি,স্থানীয়দের কাছ ভাড়া নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, স্থানীয় প্রভাবশালী ও দখল সিন্ডিকেটের হাতে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার ভাড়া। কিন্তু সরকারের কোষাগারে যাচ্ছে না এক টাকাও!তবুও স্থাপনাগুলো টিকে আছে আগের মতোই।

হাজার একর বনভূমি এনজিওর দখলে

রোহিঙ্গা শিবিরের আড়ালে বন যেন হয়ে উঠেছে অফিস ও ওয়্যারহাউসের এলাকা। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ি বনভূমি খোলা হয়। কয়েক বছরের মধ্যে হাজার হাজার একর বন কেটে গড়ে ওঠে আশ্রয়স্থল, বাজার ও দোকানপাট। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বনভূমিতে অফিস স্থাপন শুরু করে।

জাতীয় একটি গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওয়ালাপালংয়ের মুহুরীপাড়া এলাকায় বনের বিশাল অংশ দখল করে স্থাপনা করেছে মাইশা এন্টারপ্রাইজ। সেখানে স্থানীয়দের প্রবেশ সীমিত করা হয়েছে; অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে সাংবাদিকদের আনা গোনায়। একই দৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে মধুরছড়া, কুতুপালং, ফলিয়াপাড়া ও অন্যান্য এলাকায়। এছাড়া কোথাও গড়ে উঠেছে বিশাল ওয়্যারহাউস, কোথাও অফিস, আবার কোথাও পশুখামারের আড়ালে প্রকল্প।

‘পাত্তা’ পাচ্ছে না বনবিভাগও!

দেশি-বিদেশি এনওজিও সংস্থাগুলোর কাছে যেন একেবারে অসহায় বনবিভাগ। ২০২৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বন বিভাগের উখিয়া রেঞ্জ অফিস থেকে ব্র্যাক, ডব্লিউএফপি, আইওএম, ইউএনএইচসিআরসহ ছয়টি এনজিও-আইএনজিওকে নোটিস দেওয়া হয়। নোটিসে ছয় কর্মদিবসের মধ্যে বৈধ কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কোনো সংস্থাই জবাব দেয়নি। বরং তারা আগের মতোই দখল করা স্থাপনায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

বন আইন ১৯২৭ (সংশোধিত ২০০০) অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনে স্থাপনা নির্মাণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে শুরু করে স্থানীয় সংগঠন পর্যন্ত কেউই আইনের তোয়াক্কা করছে না। অভিযোগ রয়েছে, বন বিভাগের অবস্থান ও প্রশাসনিক উদাসীনতায় বনভূমি এখন বন্যপ্রাণীর জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।

উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, এনজিও-আইএনজিওগুলোকে নোটিস দেওয়া হলেও তারা কোনো জবাব দেয়নি। এখন আদালতের মাধ্যমে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।

কার পকেটে যাচ্ছে টাকা?

এসব বনভূমি সরাসরি এনজিওরা দখল করেনি। তারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে। স্ট্যাম্প চুক্তির নামে মাসে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। সাবেক উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী মধুরছড়ার একটি দখলকৃত জায়গা মাসে সাত লাখ ৫০ হাজার টাকায় ভাড়া দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সংস্থা ডব্লিউএফপির কাছে। মুহুরীপাড়ার ইব্রাহিম নামে এক দখলদার প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন তিনি বনভূমি দখল করে এনজিও ফোরামকে ভাড়া দিয়েছেন এবং মাসে লাখ টাকা আয় করছেন।

বছরে দেড়শ কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য

স্থানীয়দের ভাষ্যে, প্রতিটি বড় প্লট মাসে ৫–৭ লাখ টাকায় ভাড়া যাচ্ছে। উখিয়া-টেকনাফে এমন প্লট সংখ্যা ২০০–২৫০টির বেশি। এতে মাসে প্রায় ১০ থেকে সাড়ে ১২ কোটি টাকা হাতবদল হয়। বছরে দাঁড়ায় প্রায় ১২০–১৫০ কোটি টাকা। সচেতন মহল বলছে, এই অর্থ সরাসরি সরকারের কোষাগারে গেলে রাজস্ব আয় হতো শতকোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে এই টাকা চলে যাচ্ছে দখল সিন্ডিকেটের পকেটে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যদি আইনি প্রক্রিয়ায় বনভূমি ইজারা দিত, তবে বছরে কয়েকশ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতো। কিন্তু এখন অবৈধ দখলদাররা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, সরকার পাচ্ছে না কিছুই। তাদের মতে, দখলকৃত এলাকা জরিপ করে চিহ্নিত করতে হবে। এনজিও-আইএনজিওর সব কার্যক্রম আইনের আওতায় আনতে হবে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বিকল্প জমিতে স্থানান্তরের উদ্যোগ নিতে হবে। দখলবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

দায় এড়াচ্ছেন এনজিও কর্তারা

হাজার হাজার একর বনভূমি দখল করে স্থাপনা গড়ে তোলার পক্ষে বৈধ কোন কাগজপত্র না থাকলেও এনজিও প্রতিনিধিরা দোহাই দিচ্ছেন স্থানীয়দের। তারা বলছেন, স্থানীয়দের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছেন। মাইশা এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার রাশিক খান দাবি করেন, তারা হাজি শামশুল আলম নামে এক স্থানীয়ের কাছ থেকে জায়গা ভাড়া নিয়েছেন। তবে কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

ব্র্যাকের কক্সবাজার ডিপিএম শাহরিয়ার শাহ জানিয়েছেন, তাদের একটি টিম আছে, যারা প্রকল্পের জন্য জমি নির্ধারণ করে এবং ভাড়া নেয়।

ডব্লিউএফপির কর্মকর্তা লিটন ভূঁইয়া সাংবাদিককে অফিসে প্রবেশে বাধা দেন। পরে জানান বিষয়টি হেড অফিস দেখবে। আইওএমের সিনিয়র কর্মকর্তা মো. নাহিদ নোটিস পাওয়ার পরও কোনো উত্তর দেননি এবং সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি হননি।

সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ।

You may have missed