পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘নারী সম্ভ্রম’ কেন রাজনীতির হাতিয়ার?
ছবি- অনলাইন থেকে নেয়া।
![]()
এ এই চএম ফারুক
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই কমবেশি ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজির মতো অপরাধ ঘটে। সামাজিক বাস্তবতায় এসব ঘটনা দুঃখজনক। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ধর্ষণ, খুন, অপহরণ বা চাঁদাবাজির ঘটনাগুলোর সঙ্গে সমতলের অপরাধের সাথে দৃশ্যত মিল থাকলেও মোটাদাড়ে ভিন্নতা রয়েছে। ফলে যারা সমতলের এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে পাহাড়ের ধর্ষণ, খুন, অপহরণ বা চাঁদাবাজির ঘটনাগুলোর তুলনা করতে চান তা জানাশোনা ও গবেষণার সীমাবদ্ধতা মাত্র।
কারণ এই তুলনা অথিকাংশ ক্ষেত্রে ভুল জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়, কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের অপরাধের প্যাটার্নটাই আলাদা। এখানে প্রেক্ষাপট আলাদা, পটভূমি আলাদা, এবং অপরাধের পরবর্তী প্রতিক্রিয়াও একেবারে ভিন্ন।
সমতলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে মামলা হয়, সামাজিক ভাবে শালিশ-দরবার হয়। সাধারণত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করে, মামলা হয়, বিচার হয় বা বা বিচারে গড়ড়িমসি হলে বিচারের দাবিও ওঠে।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদ হবে কি না, তা নির্ভর করে- ভুক্তভোগী কোন জাতির, আর অভিযুক্ত কোন গোত্রের। এই অঞ্চলে নারী নির্যাতনের বিচার হয় জাতি দেখে, ন্যায় দেখে নয়। আর এখানেই প্রশ্ন ওঠে- পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীর সম্ভ্রম কি শুধুই রাজনীতির হাতিয়ার?
খাগড়াছড়িতে মারমা কিশোরী ধর্ষণ : গত ২৪ সেপ্টেম্বও ২০২৫ খাগড়াছড়িতে হিন্দু কিশোর কর্তৃক মারমা কিশোরী ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। ঘটনা জানাজানি হলে সেনাবাহিনী অভিযুক্ত কিশোরকে আটক কওে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিকেল থেকেই খাগড়াছড়ি জেলা সদরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ২৬ সেপ্টেম্বর অর্ধবেলা সড়ক অবরোধ ও হরতালের কর্মসূচী দেয় জুম্ম ছাত্র-জনতার ব্যানারে একটি পাহাড়ি সংগঠন। সকাল থেকে সড়কে আগুন দিয়ে হরতাল পালন করতে দেখা গেছে। এসময় পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর গাড়িও আটকে দেওয়া হয়। ধর্ষণের অভিযোগ ওঠায় সেটার বিচায় চেয়ে এই প্রতিবাদ করা আপাত দৃষ্টিতে সাভাবিক একটা বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন অন্যখানে।
বিচার হয় জাতি দেখে, ন্যায় দেখে নয়
পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণসহ খুন, অপহরণ ইত্যাদি ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদ হবে কি না, তা নির্ভর করে- কে ভুক্তভোগী আর কে অভিযুক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে কেনো এই প্রতিবাদ, এই প্রতিক্রিয়া- শুধু জাতি দেখে হয়? বাঙালি কর্তৃক উপজাতি নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে- প্রতিবাদ হয়, জালাও-পোড়াও হয়, হরতাল-অবরোধ হয়, সড়কে আগুন জ্বলে। অপরদিকে উপজাতি কর্তৃক উপজাতি নারী ধর্ষণের ঘটনায় ভিকটিম বিচারহীনতায় গুমরে কেঁদে মরে। প্রতিবাদও হয় না। কখনো কখনো স্থানীয়ভাবে সালিশ হয়, উজ্জতের বিনিময়ে শুকর জরিমানা করা হয়।
অনেকটা একই নীরবতা দেখা যায় উপজাতি কর্তৃক বাঙালি নারী ধর্ষণ বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে।
এই দ্বৈত আচরণ শুধু রাজনৈতিক কারণে হলেও, এটি নারীর প্রতি চরম অবিচার। নারীর সম্ভ্রমকে, নারীকে এখানে মানুষ হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, ব্যবহার হয়।
কিছু বাস্তব ঘটনা
ইতি চাকমা হত্যা: ২০১৭ সালে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের ছাত্রী ইতি চাকমাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা বাঙালি জনগোষ্ঠির কেউ এটি ঘটিয়েছে এমন দাবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে ও মাঠে আন্দোলন শুরু হয়। উত্তপ্ত হয়ে উঠে রাজপথ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু পরবর্তীতে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে- তুষার চাকমা ও তার সহযোগী ৫ চাকমা যুবক এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, কারণ ইতি তার প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিল।
বালাতি ত্রিপুরা হত্যা: একই বছর মােেন ২০১৭ সালে পানছড়িতে বালাতি ত্রিপুরাকে হত্যা করে সাধন ত্রিপুরা ও তার সহযোগীরা। প্রথমে তিন বাঙালিকে দোষারোপ করে আন্দোলন শুরু হয় উপজাতীয় সংগঠনগুলো। কিন্তু বিধি বাম। এবারও তাদের কূটকৌশল ধরা পড়ে যায়। ঘটনার মাত্র ছয়দিনের মাথায় বালাতি ত্রিপুরার খুনের মূল নায়ক কার্বারী সাধন ত্রিপুরা নামক এক উপজাতিকে গ্রেফতার করে পনছড়ি থানা পুলিশ। তদন্তের পর সাধন ত্রিপুরা গ্রেপ্তার হন, যিনি নিজেই বাঙালিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ পাঠান। (সূত্র: দৈনিক পূর্বকোণ, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৭)।
আয়না চাকমা নির্যাতন: ২০১৬ সালে এক বাঙালি ছেলের দোকানে কলেজে ভর্তির আবেদন করতে যাওয়ার ‘অপরাধে’ উপজাতীয় সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতারা আয়না চাকমাকে ধরে নিয়ে যৌন নির্যাতন করে। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু তাদেরই মুক্তির দাবিতে হরতাল-অবরোধ ও বিক্ষোভ কওে খোদ উপজাতীয় সংগঠন। (সূত্র: পরিবর্তন ডটকম, ২৭ জুন ২০১৬)।
বিশাখা চাকমা ধর্ষণ ও হত্যা: ২০১৪ সালে রাঙামাটিতে বিশাখা চাকমার লাশ কাপ্তাই হ্রদে পাওয়া যায়। ঘটনার পরপরই শুরু হয় বাঙালিদের দোষারোপের রাজনীতি। শুরু হয় সমাবেশ-মানববন্ধন। কিন্তু পুলিশি তদন্তে দেখা যায়- তার স্বামী লক্ষীরাম চাকমার উপস্থিতিতে সঞ্জয়, তত্তারাম ও বিনোদ চাকমা মিলে ধর্ষণ ও হত্যা করে। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। রাঙামাটি কতোয়ালি থানার ওসি মনু ইমতিয়াজ সোহেল তখন এ তথ্য নিশ্চিত করেছিলেন। (সূত্র: সিএইচটি টাইমস, ২২ নভেম্বর ২০১৪।)
উ প্রু মারমা ধর্ষণ ও হত্যা: একই বছর মানে ২০১৪ সালে বান্দরবানে ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষিকা উ প্রু মারমাকে ধর্ষণেরপর ও হত্যা করা হয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তুলে স্থানীয় উপজাতীয় সংগঠনের সদস্যরা বাঙালি কাঠুরিয়া মুসলিম উদ্দিনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে। কিন্তু পরবর্তীতে তদন্তে দেখা যায় ওই ধর্ষণ ও হত্যার মূল খলনায়ক রশদ তঞ্চঙ্গ্যার ছেলে বিজয় তঞ্চঙ্গ্যা, যে একজন উপজাতি যুবক। (সূত্র: পার্বত্য নিউজ, ৮ জুন ২০১৪)।
সবিতা চাকমার মৃত্যু: ২০১৪ সালে খাগড়াছড়ির কমলছড়িতে সবিতা চাকমার লাশ পাওয়া যায়। বাঙালি ট্রাক ড্রাইভার ও হেলপারকে দায়ি করে গণধর্ষণের অভিযোগে আন্দোলন কওে উপজাতীয় সংগঠন। কিন্তু ময়নাতদন্তে ধর্ষণের কোনো আলামতই পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন এড়াতে এখানে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন- খাগড়াছড়ি সদও হাসপালসহ পাহাড়ের হাসপাতালগুলোতে অধিকাংশ চিকিৎসকই উপজাতি।
বান্দরবানে মারমা স্কুলছাত্রী ধর্ষণ: এ বছরের (২০২৫) ১৯ আগস্ট ৫ মারমা উপজাতি যুবক এক মারমা স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করে। কোনো সংগঠন প্রতিবাদ করেনি, বরং ঘটনা চেপে যাওয়া হয়। স্থানীয় সালিশে শুকর জরিমানা দিয়ে বিচার মীমাংসার চেষ্টা হয়।
কক্সবাজারে চাকমা নারী ধর্ষণ ও স্বামীকে হত্যা: ১৩ সেপ্টেম্বর (২০২৫) রাতে কক্সবাজারের কলাতলী এলাকায় ঘটে যায় এক বিভীষিকাময় ঘটনা। চাকমা দম্পতি রঞ্জন চাকমা ও তার স্ত্রী স্থানীয় একটি সুপারি বাগানে কাজ করতেন। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে চাকমা যুবক বীরেল চাকমা একদিন সেখানে হাজির হয়। মদ্যপ অবস্থায় স্ত্রীকে কুপ্রস্তাব দিলে রঞ্জন বাধা দেন। তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে বীরেল চাকমা রঞ্জনকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে, এরপর তার স্ত্রীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। সেনাবাহিনী ঘটনাস্থল থেকে অভিযুক্তকে রক্তমাখা অবস্থায় আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। ঘটনাটি ছিল ভয়াবহ, নির্মম এবং নৃশংস।
তবু আশ্চর্যজনকভাবে কোনো পাহাড়ি সংগঠন প্রতিবাদ করেনি, বিবৃতি দেয়নি, মানববন্ধনও হয়নি। কারণ—ভুক্তভোগী ও অভিযুক্ত, দুজনই একই জাতিগোষ্ঠীর। এখানে রাজনৈতিক পুঁজি নেই, তাই প্রতিবাদও নেই।
এমন অনেক ঘটনাই আছে যা আলোচনায় আসেনি।
একসময় ছিল বিদ্রোহ, এখন চলছে বিভাজন
পার্বত্য চট্টগ্রামে একসময় উপজাতীয় নেতৃত্বে স্বশস্ত্র বিদ্রোহ হয়েছিল। তারপর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (কথিত শান্তিচুক্তি) হলো, কিছুটা স্থিতিশীলতা এল। তবু থেমে নেই খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ। আর এসব অপরাধকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করছে কিছু গোষ্ঠী, যারা আইনের বাইরে থেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে।
রাজনীতির পেছনের ছক
সম্প্রতি “আদিবাসী” স্বীকৃতি, “জাতি বৈচিত্র্য ইনস্টিটিউট অধ্যাদেশ ২০২৫” এবং গণমাধ্যম কমিশনের প্রতিবেদন- সবই দেখায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি গোষ্ঠী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোকেও ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করে। গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালায়, বাঙালিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায়, এবং আদিবাসী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দৈরির দাবি জোরালো করে।
করণীয়; ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিবাদ
ধর্ষণের বিচার ধর্ম, জাতি বা গোত্র দেখে নয়- আইনের ভিত্তিতে হতে হবে। একই ভাবে খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজীরমত ঘটনায় সংগঠনগুলোকে নৈতিক অবস্থান নিতে হবে, পক্ষপাত নয়। প্রথাগত সালিশ নয়, প্রচলিত আইনের আওতায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে। নারীকে রাজনীতির হাতিয়ার নয়, সম্মানিত মানুষ হিসেবে দেখতে হবে।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।
শান্তি ও সম্প্রীতির পথে
পার্বত্য চট্টগ্রামে সব বাঙালি এবং উপজাতি এদেশেরই গর্বিত নাগরিক। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই এই অঞ্চলের উন্নয়ন সম্ভব। কুচক্রি মহলের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের পথে হাঁটতে হলে জাতিগত বিভেদ নয়, ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিবাদ করতে হবে।
নারীর সম্ভ্রম কোনো রাজনৈতিক দাবির পুঁজি নয়- এটি মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন। ধর্ষণ, খুন, অপহরণ- এইসব অপরাধের বিচার ধর্ম, জাতি বা গোত্র দেখে নয়, বরং আইনের আলোয় হতে হবে। যে সমাজে নারীকে প্রতীক নয়, মানুষ হিসেবে দেখা হয়, সেই সমাজই সত্যিকারের শান্তি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
farukkht@yahoo.com